You dont have javascript enabled! Please enable it!

কিসিঙ্গার আসছেন, কে এই কিসিঙ্গার?

ভারত-মার্কিন সম্পর্কে এখন আবার দারুণ সংকট। উপলক্ষ অন্যান্য অনেক বারেরই মতাে পাকিস্তান। প্রথমে শােনা গিয়েছিল, ভারতকে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করতে দিল্লীতে আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রােজার্স। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসছেন ড: হেনরি কিসিঙ্গার (৪৮)। মঙ্গলবার তাঁর দিল্লী পৌছানাের কথা।
ড: কিসিঙ্গার আবার কে? তিনি তাে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মন্ত্রিসভার সদস্য নন, মার্কিন সেনেটরও না। সরকারি নথিপত্রে তিনি শুধু জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে প্রেসিডেন্টের সহকারী। তবে তিনি এসে কী করবেন? নিক্সন সাহেব কি তবে ছােটখাটো একজন দূত পাঠাচ্ছেন দিল্লীকে প্রবােধ দিতে?
মার্কিন সরকারি যন্ত্র, বিশেষতঃ পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্যকলাপ কীভাবে চলে যারা জানেন তারা অবশ্য স্বীকার করবেন না যে কিসিঙ্গার সামান্য মানুষ। মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি কে বা কারা তৈরী করেন বলা মুস্কিল। কিন্তু প্রতিরক্ষা দপ্তর তাে রয়েছেই। কিন্তু প্রতিরক্ষা বা পেন্টাগনের প্রভাব এ ব্যাপারে বড় কম নয়। এমন কি, অনেকে বলেন, পররাষ্ট্র নীতি রচনায় সি আই এ’রও নাকি একটা হাত থাকে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নিক্সন যখন কিসিঙ্গারকে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী নিযুক্ত করলেন তার কিছু পর থেকেই শুরু হয়ে গেল দারুণ জল্পনা। পররাষ্ট্র নীতি রচনার ব্যাপারে নিক্সন নাকি শুধু কিসিঙ্গারের পরামর্শ মতােই চলছেন। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে এই আলােচনার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক মহলে ঈর্ষাও দেখা দিল। পেন্টগনের প্রভাব কি তা হলে কমছে? উইলিয়াম রােজার্স কি তা হলে পররাষ্ট্র দপ্তরের নৈবেদ্যের ওপর শুধুই শােভা হয়ে আছেন? এই সব প্রশ্ন উঠতে দেরি হল না।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন ঠিক কিসিঙ্গারের কথায় ওঠেন-বসেন কিনা জানি না, মানসিকতার দিক থেকেও কিসিঙ্গার প্রেসিডেন্টের কতােটা কাছের লােক বলা মুস্কিল, তবে শারীরিক অর্থে তিনিই নিক্সনের উপদেষ্টাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকটবর্তী। কারণ তার ছােট অফিসটি একেবারে হােয়াইট হাউসেই। সেখানে অনবরত নানা রিপাের্ট, তারবার্তা তিনি পুঙ্খনুপুঙ্খরূপে পড়েন, তারপর তার সারমর্ম জানান প্রেসিডেন্টকে। বিভিন্ন দপ্তরের কর্তাদের নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে যে বৈঠক হয় সেখানে সভাপতিত্ব করেন তিনি। ঐ বৈঠকে যে-সব প্রস্তাব ওঠে তার বিচার-বিবেচনা করার পর তিনি তা জানান প্রেসিডেন্টকে। কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট নিক্সন একের পর এক প্রশ্ন করে যান, আর তার উত্তর দিতেও কিসিঙ্গারের নাকি একটুও দেরি হয় না।
জাতে জার্মান ইহুদি। হিটলারের অত্যাচারের হাত থেকে বাচার জন্যে ১৯৩৮ সালে আমেরিকায় পালিয়ে আসেন। সেখানেই লেখাপড়া সারেন। তারপর যুদ্ধে যােগ দেন। যে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন ছাত্র ছিলেন, পরে সেখানেই অধ্যাপক হন কিসিঙ্গার। আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে ক্রমে ক্রমে একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন।
কিন্তু অধ্যাপনা, গ্রন্থ রচনা ও পঠন-পাঠনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সরকারের উপদেষ্টার কাজও করতে থাকেন। ডেমােক্র্যাট প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপদেষ্টার কাজ করছেন। কেউ কেউ বলেন, সব প্রভুকেই খুশি করতে পারেন কিসিঙ্গার। এই বক্রোক্তির জবাবে আবার অনেকে আবার বলেন, তা নয়, কিসিঙ্গারের দাম তার গভীর জ্ঞানের জন্যে।
কিন্তু কি উপদেশ তিনি দেন প্রেসিডেন্টকে? নিক্সনের কার্যভার গ্রহণের পর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে যে রদবদল হচ্ছে তা নাকি কিসিঙ্গারেরই পরামর্শে। চীন-মার্কিন কূটনৈতিক পিং-পং খেলায় তার হাত আছে। ‘৬৯ সালে নিক্সন যে ইউরােপ সফরে এবং বিশেষতঃ রুমানিয়ায় যান, তাও নাকি কিসিঙ্গারেরই পরিকল্পনা অনুযায়ী। ঐ বছরই নিক্সন যখন নানা দেশ সফরে বেরােন তখন কিসিঙ্গার তার সঙ্গে ছিলেন। ঐ সময়েই নিক্সনের সঙ্গে তিনি প্রথম ভারতে আসেন।
আলােচনার মারফৎ ভিয়েৎনাম সমস্যার মীমাংসার জন্য আমেরিকা যে চেষ্টা সুরু করেছে তারও মূল উদ্যোগ কিসিঙ্গারের। তা হলে ভিয়েনামের যুদ্ধের মীমাংসার জন্যে প্রথমে কাম্বােডিয়া ও পরে লাওসে ব্যর্থ মার্কিন অভিযানও কি ঘটেছে কিসিঙ্গারেরই পরামর্শে? সেটা কিন্তু আশ্চর্য নয়, কারণ কিসিঙ্গার নরম গরম নীতিতে বিশ্বাসী। একবার তিনি স্পষ্ট করে সেই কথাই বলেছিলেন– “আমাদের সামরিক শক্তিও বাড়াতে হবে আবার অস্ত্র নিয়ন্ত্রণও করতে হবে। নিরাপত্তার দিকে নজর দিতে হবে, আবার নতুন রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আলােচনাও করে যেতে হবে।” এই ধরণের প্যারাডসের মীমাংসা করলে তবেই নাকি বাঁচা সম্ভব।
পাকিস্তান সম্বন্ধেও আমেরিকা যে দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেছে তার মূলে কিসিঙ্গারই নেই তাে? এক হাতে শরণার্থীদের সাহায্য দাও অন্য হাতে ইয়াহিয়া খানকে অস্ত্র দাও—কিসিঙ্গারের ভাষায় এটাও তাে একটা চমৎকার “প্যারাডক্স”? কিসিঙ্গারের আস্তিনের মধ্যে কি এই প্যারাডসের কোনাে মীমাংসা থাকবে?

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৬ জুলাই ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!