রাজনৈতিক মীমাংসা কি তবে সম্ভব?
এক্ষণে পরিষ্কার বুঝা যাইতেছে যে, ভারত সরকার বাঙলাদেশের স্বাধীন সরকারকে কাগজপত্র কোন স্বীকৃতি দিবেন না এবং যে মুক্তিফৌজ গত তিন মাস ধরিয়া পর্বত প্রমাণ বিঘ্ন। সত্ত্বেও স্বাধীনতার লড়াই চালাইয়া যাইতেছে, তাদের হাতেও সামরিক অস্ত্র তুলিয়া দিবেন না। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এখন তার মনের ভাব আর গােপন করিতেছেন না। তিনি পার্লামেন্টের বিরােধী দলের ভাব আর গােপন করিতেছেন না। তিনি পার্লামেন্টের বিরােধী দলের নেতৃবৃন্দের সহিত আলােচনা সভায় উপদেশ দিতে সুরু করিয়াছেন—“বাঙলাদেশের প্রশ্নে সংযম অবলম্বন করুন, ধৈর্য করুন!’ এই সেই কণ্ঠস্বর, পশ্চিমের বড়বাবুদের কণ্ঠস্বর!—যে বড়বাবুরা পাকিস্তানকে ভারতবর্ষের চিরশত্রু রূপে দাঁড় করাইয়া রাখিতে চায় এবং যারা কিছুতেই পাকিস্তানি সামরিক চক্রকে ভাঙ্গিয়া পড়িতে এবং পূর্ব বাংলাকে স্বাধীনতা অর্জন করিতে দেবে। এই সাম্রাজ্যবাদী পুরাতন কূটকৌশলেরই নূতন খেলা সুরু হইয়াছে কূটনৈতিক ভাষায় পােষাকী নাম Balance of Power বা শক্তির ভারসাম্য, সেই ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঙলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ রূপে জীয়াইয়া রাখিতে হইবে এবং এই সঙ্গে পাকিস্তানি ফ্যাসিষ্ট শক্তির হাতে সমস্ত প্রকার আধুনিক মারণাস্ত্র তুলিয়া দিতে হইবে! বাঙলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করিলে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচণ্ড মার খাইবে এবং জনগণের সত্যকার গণতান্ত্রিক শক্তি মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইবে। সমাজতন্ত্রের যারা বিরােধী তারা জনগণের এই গণতান্ত্রিক শক্তিকে ভয় করে। সুতরাং বৃটিশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে, জুয়াচুরি, ভন্ডামী ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ ধরিবে এবং বাঙলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি ইয়াহিয়া খানের হাত দিয়া পিছন হইতে ছুরি মারিবে, সেটা কিছু আশ্চর্য কথা নয়। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীও কি সেই চক্রান্তর ফাদে পা দিতেছেন? আমাদের পশ্চিমী প্রভুরা (যারা আমাদের কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ ও বৈষয়িক সাহায্য দিয়াছেন, তাঁরা আমাদের প্রভু ছাড়া আর কি?) আমাদের উত্তেজনা ঠাণ্ডা করিবার জন্য সংযমের উপদেশ দিতেছেন—অর্থাৎ বাঙলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিও না, সামরিক সাহায্যও দিও না। —আর ভারতের প্রধানমন্ত্রীও সেই প্রভুদের কণ্ঠস্বরেরই প্রতিধ্বনি করিতেছেন। শুধু তাই নয়। সদস্যদের তীব্র সমালােচনার মুখে পড়িয়া তিনি মাঝে মাঝে চটিয়া উঠিতেছেন—না, কোন হটকারী পন্থা নেওয়া হইবে না। আর যুদ্ধ? ওসব গরম বুলি মুখেও আনিবেন না। এতে ইয়াহিয়া খানেরই সুবিধা হইবে এবং পশ্চিমী শক্তিরা তাকে আরও সামরিক সাহায্য দিবে! অর্থাৎ পাকিস্তান যত খুশী অত্যাচার করুক, ভারতবর্ষের ঘাড়ে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু চাপাইয়া দিক এবং পশ্চিম (কাশ্মীর) সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করুক—এক কথায় ভারতবর্ষের বারােটা রাজাইয়া দিক, কিন্তু খবর্দার, আমরা যে শয়তানদের গায়ে হাত না দেই, যেন মুখ বুজিয়া সব সহ্য করি!
কিন্তু কিভাবে এই ভয়ঙ্কর সমস্যার মীমাংসা করিলেই তাে এই সমস্যার সমাধান হইতে পারে? বৃহৎ শক্তিবর্গের দুয়ারে ভারত সরকারের প্রতিনিধিরা যখন ধর্ণা দিয়াছিলেন। কিন্তু এখন আর রাজনৈতিক মীমাংসার কথাও শুনা যাইতেছে না। কারণ, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বজ্রকণ্ঠে ঘােষণা করিয়াছেন যে, আওয়ামী লীগের দুষ্মনদের সঙ্গে কোন আপােষ মীমাংসা নয়। মিলিটারী শাসন চলিবে, ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র তারাই রচনা করিবেন এবং দরকার মত দালালদের দিয়া বাঙলাদেশে একটা সরকার গঠন করা হইবে। অর্থাৎ ওয়াশিংটন-লন্ডন-মস্কো-নয়াদিল্লী যে রাজনৈতিক মীমাংসার নামে সকলকে সান্ত
টদিতে চাহিয়াছিলেন, ইয়াহিয়া খান তারও জবাব দিয়াছেন। কারণ, রাজনৈতিক মীমাংসা বলিতে পূর্ব বাঙ্গলায় সামরিক তান্ডব এবং গণহত্যা ও গণ-অত্যাচারের বদলে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বাঙলাদেশের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার কথঠন বলা হইতেছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া খান পরিষ্কার ঘােষণা করিয়াছেন ও সব চলিবে না, পূর্বে পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে গােলাম হিসাবেই থাকিতে হইবে। অথচ এই ঘােষণার পরেও আমাদের মন্ত্রীদের এবং বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রী সর্দার স্বরণ সিংয়ের কী বীরত্ব! না, আমরা বাঙলাদেশে কোন কুইজলিং সরকারকে স্বীকার করিয়া লইব না। মন্ত্রী স্বরণ সিংয়ের এই আস্ফালন দেখিয়া মনে হইতেছে বাঙলাদেশে কী ধরনের গবর্ণমেন্ট হইবে তার নিয়ামক যেন ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং এই দপ্তর রাজী না হইলে পাকিস্তানি মিলিটারী গবর্ণমেন্ট ঢাকায় কোন সিভিল সরকার প্রতিষ্ঠা দিতে পারিবেন না। ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিশ্চয়ই একজন সম্মানিত ব্যক্তি, সুতরাং তাঁকে আহাম্মক বলা যায় না। কিন্তু সবিনয়ে নিশ্চয়ই তাকে জিজ্ঞাসা করা যায় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কি আপনার একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী? —আপনার হাতে এমন কী ক্ষমতা আছে যে, আপনা ইচ্ছামত সরকার পূর্ববঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হইবে? কালই যদি ঢাকাতে সত্যসত্যই একটি কুইজলিং সরকার ইয়াহিয়া খান বসাইয়া দেন, তবে, স্বরণ সিং তথা ভারত গবর্ণমেন্ট কিভাবে ঠেকাইবেন? –পাঁচ ডিভিসন সৈন্য পাঠাইবেন, না ওয়াশিংটনে গিয়া ধর্ণা দিবেন, অথবা রাওয়ালপিন্ডিতে জয়প্রকাশ নারায়ণকে পাঠাইবেন বাপুজীর নামে উপুষ করার জন্য? আমাদের মনে হয় শেষের প্রস্তাবটিই সর্বোত্তম, সুতরাং আসুন আমরা সকলে মিলিয়া যমুনার জলে স্নান করি এবং রাজঘাটে সূত্রযজ্ঞ ও সমবেত প্রার্থনায় ধ্যানমগ্ন হই যাতে পাষান্ড ইয়াহিয়া খার হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটে।
কিন্তু যদি আমাদের অহিংস প্রার্থনার পরে পাকিস্তানের পাষন্ডদের হৃদয়ের কোন পরিবর্তন না ঘটে, বরং আরও লুণ্ঠন, হত্যা ও বালাকার চালাইতে থাকে এবং যদি ইঙ্গ-মার্কিন-চীন সেই পাক বর্বরদিগকেই সমর্থন ও সামরিক সাহায্য দিতে থাকে, তা হলে আমরা কি করিব? এমন কি, যে বােঝা ইতিমধ্যেই আমাদের ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে এবং যার ফলে আমাদের ঘাড় ভাঙ্গিবার জো হইয়াছে, সেই বােঝাই বা নামাইব কিরূপে? শ্রম ও পুণর্বাসন মন্ত্রী শ্রী খালিদকরতাে লােকসভায় প্রায় আর্তনাদের সুরে বলিয়াছেন যে, ৩০শে জুন তারিখ পর্যল্প ভারতে আগত রেজিষ্টার্ড শরণার্থীর সংখ্যা ৬৩ লক্ষ, ৭৩ হাজার, ৮ শত ১১ জন এবং অদূর ভবিষ্যতে এই সংখ্যা ৮০ লক্ষে দাঁড়াইতে পারে। স্বয়ং গবর্ণমেন্টই স্বীকার করিতেছেন যে, এই শরণার্থীদের পােষণ করিতে আমাদের ৬ মাসে ৩০০ কোটি টাকা খরচ লাগিবে এবং এর মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ পাকিস্তান অবিলম্বেই আমাদের হাতে মারিয়া ভাতে মারিবার জন্য অগ্রসর হইয়াছে এবং খাদিলকর সাহেব সখেদে স্বীকার করিয়াছেন যে, পাকিস্তান মরীয়া হইয়া আমাদের অর্থনীতি আক্রমণ করিয়াছে এবং আমাদের আর্থিক শক্তিকে তছনছ করিয়া দিতেছে। কিন্তু আমরা সুশীল শান্ত সুবােধ বালক (কিম্বা বালিকা?)! কারণ, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদিগকে সংযম ও ধৈর্য ধারণের জন্য উপদেশ দিয়াছেন। অথচ আমরা জানি না ৬ মাস পরে কিম্বা কিম্বা ৩০০ কোটি টাকা খরচ হইয়া যাওয়ার পরে আমরা এই শরণার্থীদের নিয়া কি করিব? তাদের মধ্যে কতজন পূর্ব বঙ্গের বর্তমান নারকীয় অবস্থায় দেশে ফিরিয়া যাইবে? সুতরাং ইন্দিরাজীকে সসম্মানে জানাইতে চাই আমরা অনেক ধৈর্য ধরিয়া আসিতেছি। অনেক মার খাইয়াছি, অনেক অসম্মান সহ্য করিয়াছি, কাশ্মীর যুদ্ধ, চীনের যুদ্ধ, পাক-ভারত যুদ্ধ এবং ৮০ লক্ষ উদ্বাস্তু (দেশ বিভাগের পর)—গত ২৩/২৪ বছরের কত লজ্জার কাহিনী উল্লেখ করিব? একটা বৃহৎ প্রশ্নেও কি ভরতবর্ষ এই পর্যন্ত সত্যকার সাহসের সহিত মাথা উঁচু করিয়া দাঁড়াইতে পারিয়াছে? ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধ নিয়া ইতিমধে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় গর্ব বােধ করিতে চাহিয়াছেন। এ কথা ঠিক যে, আমাদের জোয়ানদের হাতে প্রচুর প্যাটন ট্যাঙ্ক ও —- জেট বিমান ধ্বংস হইয়াছিল, পাকিস্তানি আক্রমনের জবাবে আমাদের পাল্টা আঘাত পশ্চিম পাঞ্জাবে পাক-সৈন্যদের কাবু করিয়াছিল, কিন্তু ওই পর্যন্ত, তার চেয়ে বেশী নয়। কারণ চূড়ান্ত জয়লাভ আমাদের হয় নায় এবং লাহাের দখল করিতে আমরা পারি নাই। জেনারেল চৌধুরি কৈফিয়ৎ দিয়াছিলেন লাহাের দখল করিলে নাকি ১০ লক্ষ অভিবাসীকে খাওইবার দায়িত্ব আমাদের নিতে হইত। সামরিক ইতিহাসের কোথাও আমরা এমন অদ্ভুত কৈফিয়ৎ শুনি নাই। কিন্তু সেবার আমরা ১০ লক্ষ লােককে রেশন জোগাইবার ভয়ে লাহাের দখলে বিমুঢ় ছিলাম বটে, কিন্তু এবার কিন্তু আমরা অতিরিক্ত ৬০ লক্ষ লােককে (শরণার্থী) খাওইবার দায়িত্ব নিয়াছি এবং এই সংখ্যা নাকি ৮০ লক্ষে গিয়া পৌছিতে পারে। সুতরাং ভাবিয়া দেখুন ইন্দিরাজী, আমরা কত বুদ্ধিমান, কত উদার এবং কত দানশীল! তবে, হ্যা আমরা চতুর্দিক দিয়া আক্রান্ত, আমাদের সীমান্তে পাক ও চীনা সৈন্য দণ্ডায়মান। আমাদের অর্থনীতী তছনছ হইয় যাইতেছে, আমাদের দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি ও সি আই এ চর গিজগিজ করিতেছে, আমাদের শহরে, গ্রামের রাস্তায় ঘাটে দলে দলে শরণার্থী ভীড় করিতেছে এবং সংক্রামক ব্যাধি ছড়াইয়া দিতেছে, আমাদের স্কুক-কলেজ, কল-কারখানা বন্ধ হইয়া যাইতেছে, আমাদের ছেলেরা লেখাপড়া শিখিয়া ফ্যা ফ্যা করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এবং রাজনৈতিক ও সমাজ-বিরােধী মস্তান ও গুন্ডারা আমাদের ছােরা মারিতেছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা ক্রমশঃ ভিক্ষা-জীবিতে পরিণত হইতেছেন, ঘরে বাইরে আমাদের মা ও স্ত্রীদের চোখে ঘুম নাই! সুতরাং ইন্দিরাজী, আমরা খাস আছি, আমাদের সংযম, আমাদের ধৈৰ্য্য এবং আমাদের কান্ডজ্ঞান অসাধারণ।
অতএব শেষ পর্যন্ত আবার সেই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করিতেছি বাঙলাদেশের এই সমস্যার রাজনৈতিক মীমাংসা কিভাবে হইবে? পশ্চিমের এবং বড়বাবুদের মধ্যে কার আমাদের বন্ধু এবং কারা আমাদের উদ্ধার করিবে? বিনা যুদ্ধে কোন দেশ কি কোন দিন সত্যকার স্বাধীনতা পাইয়াছে?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৪ জুলাই ১৯৭১