ঢিলেমির স্থান নেই শরণার্থী সেবায়
বর্ষা নেমেছে। শরণার্থীদের অবস্থা ভয়াবহ। যারা শিবিরে স্থান পান নি তাদের দুর্দশার কথা কল্পনাও করা যায় না। রাস্তায় পড়ে মরছেন কলেরার রােগী। এ্যম্বুলেন্স খবর দিয়েও মিলে না কোন সাড়া। মৃতদেহ নিয়ে টানাটানি করছে শিয়াল, কুকুর এবং শকুনি। লাইন পড়ে গেছে ইনজেকশনের জন্য। অনেকেই হাতে পাচ্ছেন ছুঁচের স্পর্শ। নিরাশ হয়ে ফিরে আসছেন শরণার্থীরা। এমনিতর ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। সরকারি ভান্ডারে সব জিনিসই বাড়ন্ত। কাজ চলছে সত্য, কিন্তু ঢিমে তেতালায়। প্রশাসন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। আরও হাজার হাজার দুর্গত নরনারী ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন সীমান্তের দিকে। যে কোন দিন ওরা পৌঁছবেন ভারতে। তখনকার অবস্থা হবে আরও শােচনীয়। শম্বুক গতিতে চলছেন নয়াদিল্লী। অপর রাজ্যগুলােতে শরণার্থী পাঠাতে সময় লাগবে। কর্তৃপক্ষ শিবির নির্মাণের স্থান নির্বাচনে ব্যস্ত। শরণার্থীর বােঝা একদিনে এসে পড়েনি ভারতের মাথায়। গত দু’মাস ধরেই তারা আসছেন। বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও টনক নড়ে নি কেন্দ্রীয় সরকারের। অবস্থা যখন আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে তখন শুরু হয়েছে অন্য রাজ্যে শরণার্থী পাঠাবার আয়ােজন। এই উদ্যমটি যদি ক’সপ্তাহ আগে করা হত তবে বাড়ত না এত জটিলতা।
পশ্চিম বাংলার হৃদপিন্ড কলকাতা। এই কলকাতার গায়েই লাগছে প্রচণ্ড ধাক্কা। শহরের উপকণ্ঠে ভীড় করেছেন শরণার্থীরা। বিমানবন্দরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জনাকীর্ণ। দেখলে মনে হয়, কতগুলাে প্রেতাত্মা গিজগিজ করছে সর্বত্র। কর্তৃপক্ষের পণ, শরণার্থীমুক্ত রাখবেন তারা কলকাতাকে। স্বার্থপরের মতে শুনাবে। কথাগুলাে। সীমান্তের গ্রামাঞ্চলের অধিবাসীরা অবশ্যই প্রশ্ন করবেন, তারা যদি সইতে পারেন সব ধকল তবে কলকাতাই বা পারবে না কেন, কি করে থামাবেন তারা শরণার্থীদের কলকাতামুখী অভিযান? যতদিন যাবে হতভাগ্য মানুষগুলাে তত মরিয়া হয়ে উঠবেন। মানবেন না তারা কোন বাধা। রাস্তা-ঘাটে এবং উন্মুক্তস্থানে বেঘােরে মরার চেয়ে অবশ্যই করবেন বাঁচার শেষ চেষ্টা। ইয়াহিয়ার দাপট খােয়া গেছে ওদের বাড়িঘর। সামান্য সম্বলটুকুও পাক সৈন্য এবং গুন্ডারা কেড়ে নিয়েছে রাস্তায়। প্রাণের মায়ায় দুর্গতরা বেরিয়ে পড়েছিলেন অনিশ্চিতের পথে। ভারতে এসেও পাচ্ছেন না তারা নিশ্চিতের সন্ধান। ইউরােপের কোন রাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কলরব উঠত চারদিকে। দুঃশাসনের গর্দান নেবার জন্য দিকে দিকে শােনা যেত অস্ত্রের ঝনৎকার। সদাশিব ভারত সরকার। আঘাতে আঘাতে কালাে শিরা পড়ে যাচ্ছে পিঠে। তবু জেগে উঠছে না প্রত্যাঘাতের পৌরুষ। মন্ত্রীরা ছুটছেন দুনিয়ার বিবেকের গােড়ায় সুড়সুড়ি দিতে। যারা জেগে জেগে ঘুমায় তাদের জাগান অসম্ভব। প্যালেস্টাইনের শরণার্থীদের পুণর্বাসনের জন্য বারবার লড়াই-এ নেমেছিল আরব দুনিয়। প্রতিবার তারা ইস্রাইলের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছে। তবু তাদের সংখ্যা প্যালেস্টাইনী শরণার্থী সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ। তবু আরব দুনিয়া থেকে উঠছে না কোন প্রতিবাদ। কারণ ইসলামাবাদ ঐশ্লামিক সংস্কৃতির ধ্বজাধারী। পাক-নায়কদের ধর্মবোেধ যতখানি তার নমুনা দেখে যেতে পারেন ঐশ্লামিক ধর্মগুরুরা। ইয়াহিয়া এবং তার ঘাতকবাহিনী ইসলামের আবর্জনা। সত্যিকারের ধর্মবিশ্বাসীদের চোখে ওরা নরকের কীট। বাংলাদেশ ধর্ষিতা এবং ধর্ষিতা তার কণ্যারা। মানুষের এই চরম অপমান সহ্য করছে অন্ধ দুনিয়া এবং তার দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভারতের মন্ত্রীরা।
শরণার্থীদের বাঁচিয়ে রাখা জরুরী কর্তব্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান কতদূর তাও অজানা। বাইরের দুনিয় প্রায় নির্বাক। শরণার্থীদের নিয়ে চলেছে কিছুটা হৈ-চৈ। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ চিন্তার পাশ কাটাচ্ছেন সবাই। সাহায্যের ছিটেফোটা দিয়ে ওরা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন নিজেদের মানবীয সত্তার অস্তিত্ব। কিছু সাহায্য অবশ্যই আসবে। তৈরী হয়ে আছে বিমান। ওষুধপত্র এবং অন্যান্য দ্রব্যসম্ভার নিয়ে ওরা হাজির হবেন বিমানবন্দরে। লাটবহরের খানিকটা অংশ পৌঁছে গেছে। বর্তমান সঙ্কলজনক অবস্থায় যা পাওয়া যায় তাই লাভ। জোরদার করতে হবে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। মাল খালাসে বিলম্ব ঘটলে ক্ষমা করবেন জনসাধারণ। এই বিলম্বের অর্ত, শতশত নরনারী এবং শিশুর জীবনহানি। ভুলে গেলে চলবে না শহর কলকাতা এবং গ্রামঞ্চল আসন্ন মহামারীর মুখে। প্রতিষেধক ব্যবস্থা আশু দরকার। মাল খালাসে যারা গাফিলতি করবেন উপযুক্ত দণ্ড তাদের প্রাপ্য। হাতের কাছে জিনিসপত্র থাকা সত্ত্বেও যদি সেগুলাের ব্যবহার বিলম্ব ঘটে তবে দানা বেঁধে উঠবে বিশ্বজোড়া সমালােচনা। নৈতিক বল হারিয়ে ফেলবে ভারত। তার কর্মতৎপরতায় আস্থা থাকবে না কারও। অপর পক্ষে ইয়াহিয়া পাবেন নষ্টামীর অধিকতর সুযােগ। তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণও সহজ হবে না। যুদ্ধের ভিত্তিতে গড়ে তােলা দরকার শরণার্থী প্রশাসন। বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে অনায়াসেই ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে এ দায়িত্ব। তাদেরও লাগান যেতে পারে শরণার্থী সেবায়। সামনের দিনগুলাে বিপজ্জনক। প্রত্যক্ষ সংঘর্ষও পটুতার মধ্যেই নিহিত সঙ্কটের মােকাবিলার পাথেয়। শরণার্থীর সেবা চরম পরীক্ষা। এখানে ঢিলেমির কোন স্থান নেই।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ জুন ১৯৭১