You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.19 | বিপর্যয়ের মুখে ভারত | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বিপর্যয়ের মুখে ভারত

গত ২৫ শে এপ্রিল “শরণার্থীর দায়িত্ব ও পাকিস্তানি আক্রমণ” শীর্ষক প্রবন্ধে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম তা সত্যে পরিণত হইতে চলিয়াছে। অর্থাৎ শরণার্থী বা উদ্বাস্তু সৃষ্টির অধিকার রহিয়াছে জঙ্গীবাদী পাকিস্তানের, আর সেই লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দায়িত্ব বহনের ‘নৈতিক কর্তব্য’ রহিয়াছে ভারতবর্ষের এবং পাকিস্তান এই ভারবাহী ভারতকে গর্ধভের মত তাড়াইড়া ফিরিতেছে! পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দৃশ্য কখনও দেখা যায় নাই। এমন কি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবর্ণনীয় বর্বরতা, হত্যাকান্ড ও সর্বাত্মক ধ্বংসকান্ডের সময়েও কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশ থেকে ৫০/৬০ লক্ষ লােক মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে অন্য দেশে শরণার্থীরূপে প্রবেশ করে নাই। ১৯৪০ সালে হিটলারী বিদ্যুৎগতি আক্রমণের ফলে ফ্রান্সের মত বৃহৎ রাজ্যশক্তির পতনের সন্ধিক্ষণেরও এমন ভয়ঙ্কর ট্রাজেডির উদ্ভব হয় নাই যদিও সেদিনের পৃথিবী সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখিয়া মর্মাহ হইয়াছিল। কিন্তু আজ বাংলাদেশে মানুষের ইতিহাসের যখন সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা হইয়াছে, যখন অগণিত উদ্বাস্তুর চাপে ভারতবর্ষের ঘাড় ভাঙ্গিয় চুড়মার হইবার জে হইয়াছে তখনও কিন্তু পৃথিবীর বিবেক। তেমন কিছু বিচলিত হয় নাই। কারণ, কাপুরুষকে ভীরুকে কেউ খাতির করে না, সম্মান করে না, বড়জোর করুণা করিতে পারে। ভারত সরকার সেই করুণার পাত্র, বিদেশের কাছে দুই হাত পাতিয়া ভিক্ষা চাহিতেছে বাঁচাও, বাঁচাও, ঔষধ দাও, পথ্য দাও, ত্রাণ সামগ্রী দাও। স্বরণ সিং গিয়াছেন ইউরােপে আমেরিকা বড়লােকের দুয়ারে করুণা নেওয়ার জন্য, জয়প্রকাশ গিয়াছেন বাংলাদেশের হতভাগ্যের বেদনা প্রকাশের জন্য আর সিদ্বার্থশঙ্কর আশা করিতেছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বর প্রার্থণা সিদ্ধিলাভের জন্য! এমন দৃশ্য ভারতবর্ষের পৌরুষধর্মের পক্ষে, রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে অসম্মানজনক এবং লজ্জাকর। কিন্তু সেই লজ্জাবােধ কি ভারত রাষ্ট্রের কর্ণধারগণের আছে?
কেবল আমরা নই, প্রকৃতপক্ষে সারা ভারতবর্ষ দাবী করিয়াছিল—(১) স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হােক এবং (২) পাকিস্তানি বর্বর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের সরকারের হাতে উপযুক্ত অস্ত্র সম্ভার দেওয়া হােক। ভারতবর্ষের দক্ষিণ বাম মধ্য বা প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দল একবাক্যে এই দাবী জানাইয়াছিল। ভারতীয়, পার্লামেন্ট বাংলাদেশের অনুকূলে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের আইনসভাগুলিতে সেই দাবী প্রতিধ্বনিত হইয়াছিল। সমস্ত রাজনৈতিক দলের এমন মতৈক্য এবং ভারতীয় জনমতের এম সংহত —- প্রকাশ ইতিপূর্বে আর কোন প্রশ্নে দেখা যায় নাই। আমরা সর্বদা গণতন্ত্রের এবং জনমতের দোহাই দেই ইন্দিরা গান্ধীর দল গলা ফাটাইয়া গণতন্ত্রের জয়গান করেন। কিন্তু সেই জনমত, সেই গণতন্ত্র আজ কোথায় গেল? যখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতন্ত্রকে ট্যাঙ্কের চাকায় গুড়াইয় দেওয়া হইল, তখন ভারতীয় গণতন্ত্র, মার্কিন গণতন্ত্র, ফরাসী গণতন্ত্র এবং বৃটিশ গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীর এমন নির্লজ্জ বৃহসলার ভূমিকায় নিষ্ক্রিয় রহিলেন কেন? আর যখন ভারতবর্ষের সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং পার্লামেন্টের সদস্যগণ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও অস্ত্রদানের জন্য দাবী জানাইল, তখন গণতন্ত্রের সেই স্বতঃস্ফূর্ত দাবীর মূলে ভারত সরকার নির্বাক ও হতােদ্যম রহিলেন কেন?। অথচ ইন্দিরা গান্ধী বীরাঙ্গগণর মত কত লড়াই করিয়াছেন কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে, কত আশ্চর্য কূটবুদ্ধি ও কৌশল খাটাইয়াছেন একে একে ওল্ড গার্ডদের ও পুরাতন ঘুঘুদের কুপােকাৎ করার জন্য। সেই কূটকৌশল ও সেই বীরত্ব আমরা আশা করেছিলাম ইন্দিরাজীর কাছে, যখন গােড়ার দিকে তিনি স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াইবার সাহস দেখাইয়াছিলেন। আমরা ভাবিয়াছিলাম দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসে এবার মােড় ঘুরিবে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের এক নুতন স্বাধীন রাষ্ট্র পূর্ব দিকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নূতন সিংহদ্বার খুলিয়া দেবে এবং ভারতবর্ষের ৫৫ কোটি দুর্গত মানুষ এক নতুন যুগের মুখ দেখিতে পাবে? কিন্তু ও হরি, ইন্দিরা গান্ধীর সদিচ্ছার উচ্ছাসও সােডার বােতলের ফাকা আওয়াজের মত ফাটিয়া গেল, আর কিছু বুদবুদ ও ফেনা খবরের কাগজে ছাড়াইয়া পড়িল। তবু আমরা ভাবিলাম জেনারেল মানেক শা এবং তার সহকর্মীরা যখন বীরদর্পে বর্ডার এলাকায় দাপাদাপি করিয়া ফিরিতেছেন, তখন ইয়াহিয়া খানের দুষমন।
বাহিনী নিশ্চয়স্থ তাড়া খাইয়া একেবারে বঙ্গোপসাগরে গিয়া ঝাঁপ দিবে। কিন্তু যেমন আমাদের প্রধানমন্ত্রী তেমন আমাদের প্রধান সেনাপতি একেবারে সােনায় সােহাগা। সুতরাং প্রশ্ন উঠিয়াছে আমরা যখন অহিংসবাদী তখন প্রতি মাসে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করিয়া এবং বিরাট বাহিনীকে আর পুষিয়া লাভ কি, এদের রামকৃষ্ণ মিশনে পাঠাইয়া দেওয়া হােক এবং সেখানে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা গ্রহণপূর্বক শরণার্থী সেবায় লাগিয়া যাক, সৈন্যবাহিনী অন্ততঃ একটা কাজে লাগুক।
কিন্তু এই বিদ্রুপ এবং এই করুণার কোন প্রশ্ন উঠিত না— যদি প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের প্রতি দায়িত্ব এবং ভারত রাষ্ট্রের প্রতি তার কর্তব্য পালন করিতেন— যদি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার দাবীকে তিনি এভাবে পদ্মার জলে ভাসাইয়া না দিতেন। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের নূতন স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষিত হইয়াছিল এবং তারপর থেকে সেই সরকারের স্বীকৃতি দান ও সমরিক সাহায্য দানের জন্য অজস্রবার আন্তরিক আবেদন জানাইয়া আসিতেছেন। যদি সেই আবেদনে সাড়া দেওয়া হইত, তবে বাংলাদেশের আর্ত লাঞ্ছিত ও ভীত মানুষের দল সান্তনা পাইত, সাহস পাইত, মুক্তিযােদ্ধারা নূতন, শক্তির প্রেরণা পাইত এবং তা হলে প্রবল জনস্রোতের মত শরণার্থীর স্রোত পূর্বদিক থেকে এভাবে ছুটিয়া আসিত না। ৫০ লক্ষ ইতিমধ্যেই ভীড় করিয়াছে আরও ৫০ লক্ষ আসিবে। সেই সঙ্গে কলেরা মহামারী এবং মৃত মানুষের বিভীষিকা ভারতবর্ষের পূর্বাংশকে গ্রাস করিবে। পশ্চিমবঙ্গের সাধ্য নাই এর এক কণা ভার বহন করিতে পারে—তার পুলিশী ব্যবস্থা, তার প্রশাসনিক ব্যবস্থা, তার পরিবহন ব্যবস্থা সমস্ত কিছু ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে, আর খুনােখুনি মারামারি ও উশৃঙ্খলতায় সারা দেশ উচ্ছাস খাইতেছে। পশ্চিমবঙ্গের দুঃখের ভাগ কেউ নিতে রাজী নয়, উড়িষ্যাতাে সাফ জবাব দিয়াছে— একজন শরণার্থীকেও সে জায়গা দিতে পারিবে না। অন্যান্য রাজ্যও গােমরা মুখ করিয়া বসিয়া থাকে। সান্তনা দ্বারা প্রচার করা হইতেছে পাকিস্তান বাংলাদেশে মিলিটারি অভিযানের জন্য দেউলিয়া হইয়া যাইবে। আর আমাদের কি হইবে? —ভারতবর্ষের ঘাড়ে পঞ্চাশ লক্ষ শরণার্থী আসিয়া জুটিয়াছে, আরও লক্ষ লক্ষ আসিতেছে। এদের মাথাপিছু যদি দুই টাকা করিয়া দৈনিক খরচ হয়, তবে প্রত্যহ অন্ততঃ এক কোটি টাকা করিয়া খরচ হইবে। অর্থাৎ একমাত্র শরণার্থী পােষিতেই ভারত সরকার দেউলিয়া হইয়া যাইবেন। আর এই দৃশ্য দেখিয়া রাওয়ালপিন্ডিত ভুট্টো-ইয়াহিয়ার দল হি হি করিয়া হাসিতেছে। বিনা যুদ্ধে ভারতবর্ষ স্তব্ধ হইতেছে। বিনা রক্তপাতে ভারতবর্ষের রক্ত জল হইয়া যাইতেছে এবং পাকিস্তানের পাপের বােঝা ভারতবাসীকে নত শিরে বহন করিতে হইতেছে—আর শক্তিমানের দ্বারে আর্তনাদ করিয়া প্রর্থনা করিতে হইতেছে বাঁচাও, বাঁচাও আমরাও রুশ মার্কিন-বৃটেনের করুণা ভিখারী শরণার্থী। এত বড় ভারতবর্ষ, তার ৫৫ কোটি মানুষ আজ বৃহৎ পৃথিবীর কাছে অসহায় ভিক্ষুক মাত্র। এ জন্যই কি আমরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার ঢক্কানিনাদ করিয়াছিলাম।
কিন্তু বাংলাদেশকে স্বীকার করিয়া না লওয়ার এই লজ্জা ও কাপুরুষতা ভারতকে ক্রাইসিস থেকে ডিস্যাসটার অর্থাৎ সঙ্কট থেকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলিয়া দিতেছে। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করিতে যাইতেছি। তিনি ইতিমধ্যেই বলিতে আরম্ব করিয়াছেন—পাকিস্তান ভাসিয়া যাউক, এটা তিনি চান না এবং শরণার্থী ইত্যাদির প্রশ্নটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রীর এত বড় ডিগবাজি আমরা আগে। ভাবতে পারি নাই। বুঝিতেছি বৃহৎ শক্তিবর্গ ইয়াহিয়ার উপর তেমনি ইন্দিরা গান্ধীর উপরও চাপ দিতেছেন। সুতরাং আপােষ করাে—আপােষে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হইয়াছিল এবং আপােষে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেও ডুবাইয়া দাও বদলে মালিশের ঔষধ ও কলেরার টিকা নাও। সুতরাং জনগণ প্রস্তুত থাকুন ভারতবর্ষের সর্বনাশের জন্য। ইতিহাসের বৃহত্তম বিপর্যয় আসিতেছে। আমাদের জীবন, আনাদর সম্পদ আমাদের গৃহ, আমাদের স্বাস্থ্য সমস্তই আজ বিপন্ন হইতে বসিয়াছে। কয়েকবার সংক্রমক ব্যাধির সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক এবং সামরিক সর্বনাশের মহামারী ভারতবর্ষকে গ্রাস করিবে, তার স্পষ্ট অমঙ্গলের ছায়া দেখিতেছি। ভীরুরা ভন্ডামী এবং জোড়াতালি দেওয়ার রাজনীতি ভারতবর্ষের গণতন্ত্রকে বিপর্যয়ের অন্ধকার — লইয়া যাইতেছে—এ জন্য দায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এবং তাদের পেটোয় মূর্খ আমলাতন্ত্র।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ জুন ১৯৭১