You dont have javascript enabled! Please enable it!

রীতিমত নাটকের নায়ক নিক্সন

অবাক হয়েছে গােটা দুনিয়া। প্রেসিডেন্ট নিকসন যাচ্ছেন পিকিং সফরে। প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই জানিয়েছেন তাকে আমন্ত্রণ। সানন্দে তিনি তা করেছেন গ্রহণ। ১৯৭২ সালের মে মাসের আগেই ঘটবে এই ঐতিহাসিক শান্তি অভিযান। প্রেসিডেন্ট নিকসনের ধারণা— চীন এবং আমেরিকার মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে না উঠলে দুনিয়ায় হতে পারে না কোন স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা। কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের অর্থ এই নয় যে, অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা। বিভিন্নমতাবলম্বী সব দেশের সঙ্গেই মিত্রতা সম্ভব। কথাগুলাে শুনে মনে হয়, গ্রামােফোন রেকর্ডে রাজছে যেন নেহরুর কণ্ঠ। প্রেসিডেন্ট নিকসন উদার। চীনের সঙ্গে নূতন সম্পর্ক পাতাতে গিয়ে তিতি পথে বসাবেন না পুরানাে বন্ধুদের। পিকিং বিরােধিতার মধ্যে গত বাইশ বছরে আমেরিকা জোগাড় করেছিল অনেক সুহৃদ। গড়ে তুলেছিল সামরিক জোট সিয়াটো। তা জোরেই তরপাত ফরমােজা, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্র। পূর্ব এশিয়ায় চীন যদি শান্তিকামীদের জাতে ওঠে তবে এসব রাষ্ট্র সংঘবন্ধ থাকবে কিসের জোরে? সামরিক জোটেরই হবে কি দশা? আর্তনাদ করে উঠেছে ফরমােজা। আরও অনেকে যােগ দেবে তার সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট নিকসনের অভয়ে পুরাপুরি স্বস্তি পাবে না কেউ। অসাধ্য সাধন করেছেন ডা: কিসিঙ্গার। রাওয়ালপিন্ডিতে তাঁর কূটনৈতিক অসুখের মধ্যে যে এতবড় একটা রাজনৈতিক চাল ছিল তা বুঝতে পারেন নি ঝানু সাংবাদিকরাও। পেটের অসুখে বিছানায় পড়ে যখন তাঁর ছটফট করার কথা তখন তিনি পিকিং-এ আলাপ-আলােচনা করছিলেন চীনা নেতাদের সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট নিকসনের সম্ভাব্য পিকিং সফরের চূড়ান্ত রূপ দিয়েছেন তিনিই। ভিত্তিটা অবশ্য তৈরী করে রেখেছিল রুমানিয়া এবং পাকিস্তান।
আগামী বছর নভেম্বর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সাধারণ মানুষ নিকসনের ভিয়েতনাম-নীতির উপর হাড়ে হাড়ে চটা। তারা চান এ িরক্তক্ষয়ী লড়াই-এর অবসান। এশিয়ার এক সুদূর প্রান্তে এত মার্কিন রক্ত এবং অর্থ ঢালতে সমাজের এক প্রভাবশালী অংশ নারাজ। চীন একটু নরম না হলে ভিয়েতনামে যুদ্ধাবসানের সম্ভাবনা কম। নিকসন হয়ত দেখাতে চাচ্ছেন তিনি শান্তিকামী। চীন সফরের আয়ােজন তারই অকাট্য প্রমাণ। এই পাঁয়তারা আন্তরিক, না নিছক নির্বাচনী প্রচার স্টান্ট—তা বােঝা যাবে পবে। আপাতত এইটুকু লাভ রাষ্ট্রসংঘে চীনের সদস্যপত প্রাপ্তির বাধা কমবে। ফরমােজার আতঙ্ক বাড়বে। আর পাকমার্কিন দোস্তীর বনিয়াদ হবে আরও পাকাপােক্ত। মার্কিন ব্যসায়ীরা পাবেন চীনা বাজারে প্রবেশের ছাড়পত্র। জাপান দুলবে সন্দেহ দোলায়। ইউরােপের ব্যবসায়ীরা মােকাবিলা করবেন মার্কিন প্রতিযােগিতার। কোন উদ্বেগের কারণ নেই ভারতের। চীনের সঙ্গে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সেও উৎসুক। মস্ত বড় বাধা সীমানা বিরােধ। ওটা হয়ত দীর্ঘ দিন থাকবে ধামাচাপা। যারা মনে করেন, আমেরিকার ভয়ে চীন করত না। ভারত সীমান্তে বাড়াবাড়ি। সে ভয় যখন যাবে কেটে তখন নখদন্ত বার করবে পিকিং। এ আশঙ্কা হয়ত অমূলক। চীন-মার্কিন সম্পর্কের স্বাভাবিকতার অর্থ এই নয় যে, তাদের মধ্যে রয়েছে আসমান-জমিন ফারাক। ওটা সহজে বুজে যাবার নয়। আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়ার মধ্যে স্বাভাবিক সম্বকের অভাব নেই। তা সত্ত্বেও মস্কো-পিকিং এর ব্যবধান বিরাট। কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। দিল্লী-ইসলামাবাদ এবং দিল্লী-পিকিং—এর মধ্যে রয়েছে কূটনৈতিক সম্পর্ক। তবু এ দুটি রাষ্ট্র ভারত-বিরােধী। পিকিং-মার্কিন সম্পর্কও কূটনৈতিক গন্ডীর বাইরে না যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
সােভিয়েট রাশিয়ার কথা আলাদা। সীমান্ত এলাকার দাবী নিয়ে উভয়ের মধ্যে মন কষাকষি দীর্ঘ দিনের। মস্কোকে কোণঠাসা করার জন্য চীনের দরকার আমেরিকার। আবার একই কারণে আমেরিকার প্রয়ােজন। চীনের দরকার আমেরিকার। আবার একই কারণে আমেরিকার প্রয়ােজন চীনের। প্রেসিডেন্ট নিকসনের সম্ভাব্য পিকিং সফর অবশ্যই সুনজরে দেখবে না সােভিয়েট রাশিয়া। ভারতের উপর বেশী নজর পড়বে মস্কোর নেতাদের। তাদের মধ্যে হয়ত দেখা দেবে দিল্লীকে খুশী রাখার তাগিদ। আন্তর্জাতিক রাজনীতির সম্ভাব্য পট পরিবর্তন হয়ত হবে ভারতের পক্ষে সুবিধাজনক। গতানুগতিক ভারত-মার্কন বন্ধুত্বের উপর নূতন করে দানা বেঁধে উঠবে ভারত-সােভিয়েট নিবিড় মিতালী। বাংলাদেশ সমস্যায় আমেরিকার আগ্রহ কমবে। কারণ এতে পাকিস্তান আসামী এবং চীন তার সাফাই সাক্ষী। পাক-মার্কিন সম্পর্কের স্বাভাবিকতা আনবার বােধনের সময় বিসর্জনের বাজনা বাজাবেন না ওয়াশিংটন। ভিয়েতনাম হাতছাড়া হয়ে গেলে কমিউনিজম বিরােধী মার্কিন প্রতিরক্ষা লাইন কোথা দিয়ে টানা হবে তা দেখবার বিষয়। আমেরিকা যদি তার এত দিনের সামরিক ষ্ট্যাটেজী পাল্টিয়ে ফেলে তবে সে নিজেই বেকুব সাজবে। তাতে প্রমাণ হবে—চীন সম্প্রসারণবাদী নয়। মার্কিন কর্তারা এতদিন ভুল বুঝিয়েছিলেন দুনিয়াকে। প্রেসিডেন্ট নিকসন যাবেন পিকিং-এ এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই সৌজন্যমূলক ফিরতি সফরে আসবেন ওয়াশিংটনে। পিকিং-এর প্রচার হয়ত শােনা যাবে মস্কো বেতারে। এতদিন পিকিং বলতেন—সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এবং শােধনবাদী সােভিয়েট রাশিয়া একজোট হয়ে ঘায়েল করতে চাচ্ছে বিল্পবী চীনকে। এখন মস্কোর পালা। তারা বলবেন—সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এবং সুবিধাবাদী চীনের দোস্তীর উদ্দেশ্য, সােভিয়েট রাশিয়াকে কোণঠাসা করা। প্রেসিডেন্ট নিকসনের সম্ভাব্য পিকিং সফরের ঘােষণা যেমন নাটকীয় এবং এই সংবাদের পরবর্তী ঘটনাগুলােও হবে তেমনি চাঞ্চল্যকর। দুনিয়ার কূটনৈতিক নাটকে সবই সম্ভব।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৭ জুলাই ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!