You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.09 | আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন ও বাংলাদেশ | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন ও বাংলাদেশ

যুগান্তরের পাঠকবর্গের হয়তাে একথা অজানা নয় যে, বর্তমান প্রবন্ধ লেখক গত ১৫, ১৬ বছর ধরিয়া বিশ্বশান্তি সংসদ বা ওয়ার্লড পীস কাউন্সিলের সদস্যরূপে আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলনের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আমাদের দেশে শান্তির নাম শুনিলে কেউ কেউ নাসা কুঞ্চিত করিয়া থাকেন। কিন্তু এই শান্তির অর্থ যুদ্ধ, পররাজ্য আক্রমণ ঔপনিবেশিকতা ও শােষণ ইত্যাদিকে ধামাচাপা দিয়ে কোন প্রকারে শান্তি প্রতিষ্ঠা নয়। অর্থাৎ শান্তি আন্দোলন কোন বৈধব্য নীতি বা নেতিবাচক মনােভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। প্রায় দুই যুগ ধরিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলন যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা এবং পারমাণবিক অস্ত্রাদির বিরুদ্ধে এবং পরাধীন জাতিসমূহের মুক্তি ও জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃডুশ অধিকার রক্ষার স্বপক্ষে পরিচালিত হইয়া আসিতেছে। যদিও রাষ্ট্রসঙ্ঘ বা ইউনাইটেড নেশন্স আন্তর্জাতিক সরকারি সংগঠন হিসাবে অদ্বিতীয়, তথাপি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনগণের প্রতিনিধিস্থানীয় সংগঠন হিসাবে ওয়ার্লড পীস কাউন্সিল এবং তার সহযােগী জাতীয় সংগঠনগুলির গুরুত্ব আদৌ কম নয়। বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনগণের প্রতিনিধিস্থানীয় সংস্থারূপে এই সমস্ত সংগঠন যথেষ্ট প্রভাবশালী। ১৯৫৫ সালে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে ভারতীয় ডেলিগেশনের সদস্যরূপে বর্তমান লেখকের প্রথম সুযােগ ঘটিয়াছিল আন্তর্জাতিক শান্তি মহাসম্মেলনে যােগদানের জন্য। তারপর থেকে এই পর্যল্প পৃথিবীর বহুদেশের রাজধানীতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও বৈঠকগুলিতে যােগদানের সুযােগ ঘটিয়াছিল। কিন্তু গত ১৬ বছরের মধ্যে বােধ হয় এই প্রথম ভারতীয় প্রতিনিধিমন্ডলী এমন একটা গুরুতর সমস্যার দায়িত্ব নিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি মহাসম্মেলনে যােগ দিয়াছিলেন, যার সঙ্গে আগেকার অধিবেশনগুলির তুলনা দেওয়া কঠিন। কারণ, এই সমস্যা ছিল একান্তরূপেই আমাদের বুকের কাছের সমস্যা, অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের সমস্যা। এই উপলক্ষে বর্তমান লেখক ৭ই মে তারিখের পর থেকে কলিকাতা ও ভারতবর্ষের বাইরে ছিলেন সারা মে মাস এবং ইউরােপের হাঙ্গেরীতে ও সােভিয়েট ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশে কাটাইয়া যখন কলিকাতায় ফিরিয়া আসা গেল গত ৩রা জুন তারিখ, (অর্থাৎ প্রায় এক মাস বাদে) তখন দেখা গেল আমাদের ভারত সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের সমস্যা নিয়া হাবুডুবু খাইতেছেন এবং ৪০ লক্ষ শরণার্থীর ভয়ঙ্কর চাপে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারত সরকার অভাবনীয় বিপর্যয়ের মুখে পড়িয়াছেন। তাঁরা বাংলাদেশের সরকারকে আজও স্বীকৃতি দিলেন না, অথচ আশা করিতেছেন যে, বৃহৎ শক্তিবর্গ আগাইয়া আসিয়া বাংলাদেশের বােঝা আমাদের ঘাড় থেকে, নামাইয়া নিবেন। পরনির্ভরতার এই মােহ যতদিন না দূর হইবে, ততদিন আমরা নিজেদের এবং বাংলাদেশের গুরুতর সঙ্কট নিবারণে সহায়তা করিতে পারিব না—এই কঠিন সত্য জানা উচিত। কারণ, বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানি বর্বরতার সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বরূপ কি এবং পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগলিক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের চেহারা ও চরিত্র কি, এই সমস্ত গুরুতর প্রশ্নে বাইরের জগতে তেমন কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদাপেষ্টের সুরম্য নগরীতে গত ১৩ই মে থেকে ১৬ই মে পর্যন্ত যে আন্তর্জাতিক শান্তি মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হইয়া গেল, তাতে প্রথম অনুভব করা গেল যে, বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ বা war of liberation ইন্দোচীন বা পশ্চিম এশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের মত খ্যাতি ও প্রচার লাভ করে নাই। কিন্তু একথা সবিনয়ে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, বুদাপেষ্টের আন্তর্জাতিক শান্তি মহাসম্মেলনে ভারতীয় ডেলিগেশনের চেষ্টায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বাইরের মত ছিল, সেটা ভাঙ্গিতে শুরু করিতেছে। পাঠকবর্গের স্মরণে রাখা দরকার যে, বিশ্বশান্তি সংসদের এই বুদাপেষ্ট সম্মেলনে পৃথিবীর ১২৪টি দেশের (রাষ্ট্রসঙ্ঘের মােট সদস্য সংখ্যার প্রায় সমান) এবং ৩০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিমন্ডলী ও পর্যবেক্ষক যােগদান করিয়াছিলেন। ইউরােপ, এশিয়া, আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়া, অর্থাৎ পৃথিবীর পঞ্চ মহাদেশের সমাজজীবনের নানা স্তরের বহু বিশিষ্ট ও বিখ্যাত নরনারী এই মহাসম্মেলনে সমবেত হইয়াছিলেন। দূর-দূরান্তের ও দেশ-দেশান্তরের এত বিভিন্ন বর্ণ ও বিচিত্র বেশের নরনারীর একত্র সমাবেশ ও ভাব বিনিময় সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববােধের এক আশ্চর্য প্রেরণা সঞ্চার করে সন্দেহ নাই।
ভারতীয় ডেলিগেশনের পক্ষ থেকে সকলেই এক বাক্যে এই সঙ্কল্প গ্রহণ করিয়াছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্ত ানের সামরিক বর্বরতা এবং বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমস্যাটিকে এবার সর্বতােভাবে আন্ত র্জাতিক মহাসম্মেলনে তুলিয়া ধরিতে হইবে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতিতে নিশ্চিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হইবে। বলা বাহুল্য যে, বিশ্বশান্তি সংসদের সেক্রেটারিয়েট বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক বর্বরতা ও গণহত্যার অভিযান শুরু হওয়ার পর মুহূর্তেই সক্রিয় হইয়া উঠিয়াছিলেন এবং গত ৩১শে মার্চ তারিখ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নিকট এক মর্মস্পর্শী তারবার্তায় বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানি সামরিক চক্রের জঘন্য ফ্যাসিষ্ট অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিশ্বের জনমত জাগ্রত করার জন্য এক আন্তরিক আবেদন জানাইয়াছিলেন এবং এই আবেদনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি নিবেশিক কমিশন, ভিয়েৎনাম বা ইন্দোচীন কমিশন, পশ্চিম এশিয়া এবং নিরস্ত্রীকরণ কমিশন ইত্যাদিতে বাংলাদেশের কথা জোরালােভাবে উত্থাপন করিয়াছেন। এমন কি, নেপাল থেকে আগত কোন কোন প্রতিনিধিও বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানি অত্যাচারের বিরুদ্ধতা করিয়াছেন এবং তাদের স্বাধীনতার দাবী সমর্থন করিয়াছেন। এই সমস্ত বক্তৃতা ও আলােচনার সুফল এই হইয়াছে যে, বাংলাদেশের সমস্যার প্রতি মহাসম্মেলনের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছিল।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য এই যে, বিশ্বশান্তি সংসদের এই বুদাপেষ্ট সম্মেলনে বাংলাদেশের তিনজন প্রতিনিধি উপস্থিত হইয়াছিলেন এবং বিভিন্ন বৈঠকে ও আলােচনায় সক্রিয়ভাবে যােগ দিয়াছিলেন। এবং তিনজন প্রতিনিধি ছিলেন মি: সামদ, ডা: সারােয়ার সীমা এবং দেওয়ান মেহবুব সীমা সকলেরই বয়স ৪০-এর কোঠায় বা নিচে। (দুভার্গ্যক্রমে শেষােক্ত ব্যক্তি দেওয়ান মেহবুব সীমা নয়াদিল্লীতে প্রত্যাগমনের পর হঠাৎ হৃদরােগে আক্রান্ত হইয়া গত ৪ঠা জুন মারা গিয়াছেন, যে ঘটনা ডেলিগেশনের নিকট নিরতিশয় দুঃখজনক) তারা বিভিন্ন কমিশনে ও বৈঠকে বক্তৃতা দিয়াছেন। মি: সামাদ উপনিবেশ সংক্রান্ত কমিশনের সভাপতিমন্ডলীতে বা প্রেসিডিয়ামে নির্বাচিত হইয়া কমিশনের কার্য পরিচালনা করিয়াছিলেন। বিশ্বশান্তি সংসদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্ব ও আত্মােৎসর্গের প্রতি সম্মান দেখাইবার জন্য মি: সামাদের হাতে যখন মেডেল বা পদক উপহার দেওয়া হয়, তখন উপস্থিত দর্শকমন্ডলী করতালি ধ্বনির দ্বারা সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা বুদাপেষ্ট সম্মেলনের পর বিভিন্ন দেশের সরকারি মহলের সঙ্গে যােগাযােগ ও সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন হাঙ্গেরী, পূর্ব জার্মানি, পােল্যান্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, সােভিয়েট ইউনিয়ন প্রভৃতির কর্তৃপক্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসিয়াছিলেন। ভারতীয় ডেলিগেশন এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে পৃথিবীর শান্তি রক্ষা ও যুদ্ধ নিবারণের উদ্দেশ্যে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দূরবর্তী দেশগুলির উপর সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসানির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাইয়াছেন, কিন্তু এবার আমাদের লাঞ্ছনা, বেদনা ও মুক্তি সংগ্রাম লইয়া বিশ্বের দরবারে আন্দোলনের যে সুযােগ পাইয়াছিলাম তার জন্য আমাদের সানন্দ চেষ্টা তাে ছিলই, গর্ব বােধও কম ছিল না। কারণ, পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শােষণ থেকে বাংলাদেশের মুক্তি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা ও সামাজিক মুক্তিরই অপরিহার্য অংশরূপে প্রতিভাত হইয়াছিল। সৌভাগ্যক্রমে এর প্রতিফলন আমরা দেখিয়াছি ভােলা অধিবেশনের প্রকাশ্য ঘােষণায় এবং উপনিবেশ সংক্রান্ত কমিশন, ইন্দোচীন, পশ্চিম এশিয়া, নিরস্ত্রীকরণ ইত্যাদি কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবে ও রিপাের্টে, অকৃণ্ঠ ভাষায় ও তীব্রভাবে পাকিস্তানি জল্লাদ-বৃত্তির যেমন নিন্দা করা হইয়াছে, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রতিও পূর্ণ সহানুভূতি ও সমর্থনও জানানাে হইয়াছে। বিশ্বশান্তি সংসদের আন্তর্জাতিক সভামঞ্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবী স্বীকৃতি পাইয়াছে এবং সমস্ত পৃথিবীর জনগণের নিকট সাড়ে সাত কোটি মানুষের জাতীয় স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন জানাইবার জন্য আবেদন প্রচার করা হইয়াছে। যদিও স্বাধীন বাংলাদেশের গভর্নমেন্টের প্রতি কূটনৈতিক স্বীকৃতি দানের প্রশ্নটি এখনও দূরে রহিয়াছে (কারণ, ভারত সরকার এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি দিতেছেন না), তবু একথা বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রশ্নটিকে পৃথিবীর প্রগতিশীল জনমতের নিকট তুলিয়া ধরিয়াছেন এবং একদিন বাংলাদেশের এই সংগ্রাম সার্থক হইবেই। কিন্তু উপসংহারে একটি কথা উল্লেখ না করিলে এই প্রবন্ধ সম্পূর্ণ হইবে না এবং তা এই যে, ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি বা সি পি আইয়ের উদ্যোগে ও নেতৃত্ব ছাড়া সম্ভবতঃ বাংলাদেশের প্রশ্নটি বুদাপেষ্টের মহাসম্মেলনে এতটা প্রাধান্য লাভ করিতে পারি না। কারণ, ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে একমাত্র সি পি আইয়ের আন্তর্জাতিক যােগসূত্র সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ফলপ্রসূ। বিশেষভাবে এই যােগসূত্র রহিয়াছে সােভিয়েট ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরােপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে এবং আফ্রো-এশিয় ও লাতিন আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী সংগঠনগুলির সঙ্গে। ফলে, ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি ও বিশ্বশান্তি সংসদের সম্মিলিত উদ্যোগে ও চেষ্টায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম একদা অনতিদূর ভবিষ্যতে সারা দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক নূতন জোয়ার আনিতে পারিবে, এমন আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় হইবে না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৯ জুন ১৯৭১