You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.18 | দেশে দেশে মন্ত্রীমিশন | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

দেশে দেশে মন্ত্রীমিশন

বাংলাদেশ থেকে বন্যার স্রোতের মতাে চলে আসা শরণার্থীদের নিয়ে আমরা যতই ব্ৰিত ও বিড়ম্বিত হচ্ছি, নয়াদিল্লী ততই নিত্যনূতন কর্মসূচী গ্রহণে তৎপর হয়ে উঠছে। সমস্যাটা বৃহৎ, ব্যাপক এবং আচমকা আমাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে, এবিষয়ে কোনাে দ্বিমত নেই। কিন্তু সমস্যার ধাক্কায় বেসামাল হয়ে এমন কোনাে কর্মসূচী নেওয়া উচিত নয়, যার দ্বারা আমাদের হাতেনাতে লাভের কোনাে আশা নেই। কারণ, আমাদের যা এখন দরকার তা হল এই শরণার্থীদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দান, তাদের খাওয়া পরার ব্যবস্থা করা ও রােগে চিকিৎসা। এরা পাকিস্তানে জল্লাদের হাতে ফিরে যাবে না। অন্তত অদূর ভবিষ্যতে তেমন কোনাে সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী তাে দৃপ্তকণ্ঠে একথাই আমাদের শুনিয়েছেন যে, যদি জাহান্নামেও যেতে হয় তবু এই আশ্রয়প্রার্থীদের আমরা বঞ্চিত করব না। আমাদের যা আছে তাই সকলে মিলে ভাগ করে নেব। এ হল একটি জাতির নেত্রীর পবিত্র সঙ্কল্পের কথা। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা চাইব যে, এই শরণার্থীদের সমস্যা তথা বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা সম্পকে বিশ্বজনমত অবহিত থােক এবং তারা এই প্রশ্নে ভারতের পাশে এসে দাঁড়াক। এই উদ্দেশ্য নিয়ে ভারত সরকারের দুই মন্ত্রী সর্দার স্বরণ সিং এবং সিদ্বার্থ শঙ্কর রায় পৃথিবীর কয়েকটি দেশ পরিভ্রমণে গেছেন। দুনিয়ার পয়লা সারির রাজধানীগুলােতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং সফর করেছেন। অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলােতে ভারতের বক্তব্য পেশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী সিদ্বার্থশঙ্কর রায়। এরা পন্ডশ্রম করছেন একথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। নিশ্চিতই একটি দেশের মন্ত্রী অন্য কোনাে দেশে গেলে তাঁর বক্তব্য কিছুটা মনোেযােগের সঙ্গে শােনা হয়। অন্তত কূটনৈতিক সৌজন্য তাে তাই বলে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, ভারত সরকার মন্ত্রীদের এই বিদেশ সফরের ওপর অত্যাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। নতুবা অন্য সব কাজ ফেলে রেখে দফায় দফায় আরও মন্ত্রী বিদেশ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন কেন? কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চয়ই এতদিনে জেনে গেছেন, বাংলাদেশের দাবির পক্ষে সহানুভূতি থাকলেও কোনাে বৃহৎ শক্তি সােজাসুজি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে কোনাে বিরােধে আসতে চাইছেন না। বিশ্বের জনমত অর্থাৎ পৃথিবীর নামকরা সংবাদপত্রগুলাে ইয়াহিয়া খানের গণহত্যার তীব্র নিন্দা করেছে। তারা স্পষ্টভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানি ঘাতকদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ভারত যে এত বড় একটা সঙ্কটেও পাকিস্তানিদের দ্বারা প্ররােচিত না হয়ে পঞ্চাশ লক্ষাধিক শরণার্থীকে স্থান দিয়েছে, বিশ্বের জনমত সে সম্পর্কে সপ্রশংসভাবেই অবহিত। কিন্তু সংবাদপত্রের বা বেসরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্যও সব সময় সরকারকে বেসরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্যও সব সময় সরকারকে প্রভাবিত করতে পারে না। যদি তা হত তাহলে এতদিনে বৃটেন বা আমেরিকা দ্বিধাহীনভাবেই পাকিস্তানকে তার এই জল্লাদবৃত্তি ও সংখ্যালঘু উৎসাদন নীতি বন্ধ করার জন্য চাপ দিত। ভারত সরকার বােধ হয় মনে করছেন যে, বাংলাদেশের ঘটনার প্রকৃত স্বরূপ কী তা অনেক দেশ এখনাে জানে না। তাই দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের পাঠিয়ে এই কাজটি সুসম্পন্ন করা যাক। এবারের সফর তালিকায় দেখছি, কৃষিমন্ত্রী ফকরুদ্দিন আলি আমেদ যাচ্ছেন সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র, সিরিয়া, ইরাক ও লেবাননে। রাজস্থানের এক মন্ত্রী বরকতুল্লা যাচ্ছেন অন্যান্য মুসলিম দেশে– লিবিয়া, সুদান, মরক্কো, টিউনিসিয়া ও আলজেরিয়া। স্বরণ থাকতে পারে যে, সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণও এই অঞ্চলে সফরে গিয়েছিলেন। তাতে বিশেষ কোনাে কাজ হয়েছে বলে আমরা শুনিনি। এরা পাত্তা পাবেন, এ ধারণা দিল্লীর হল কেন? রাবাতে ইসলামিক সম্মেলনে ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ সাহেব তাে গিয়েছিলেন। তার কী শােচনীয় পরিণতি হয়েছিল তা কি আমাদের মনে নেই? পূর্ব ইয়ােরােপের দেশগুলাে সাধারণভাবে ভারতের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন। সেখানে যাচ্ছেন পর্যটন মন্ত্রী করণ সিং এবং ইস্পাত মন্ত্রী মােহন কুমারমঙ্গলম। এরা আলাদাভাবে নতুন করে আর কী চমকপ্রদ হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করতে পারবেন তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। অপর এক মন্ত্রী শ্রীবিদ্যাচরণ শুক্লকে পাঠানাে হচ্ছে সুইজারল্যান্ডে, সুইডেন, ডেনমার্ক ও নরওয়েতে। এই সমস্ত দেশ আন্তর্জাতিক ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামায় না। তা সত্ত্বেও নয়াদিল্লীর মনে হয়েছে এই দেশগুলােতেও আমাদের একজন মন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে যাওয়া দরকার। এখানেই তালিকা শেষ নয়। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী শাহনওয়াজ খানকে পাঠানাে হচ্ছে আফগানিস্থান, কুয়াইত, দক্ষিণ ইয়েমেন, উত্তর ইয়েমেন ও সৌদী আরব। এরা ভারতের বক্তব্য ভালভাবেই বলবেন, এ সম্পর্কে আমরা কোনাে সন্দেহ প্রকাশ করছি না। কিন্তু আমাদের বক্তব্য হল এই যে, যে-কাজ আমাদের রাষ্ট্রদূতেরাই করতে পারতেন, অন্তত করা উচিত, সে কাজের জন্য একই সময়ে এতজন মন্ত্রীদের প্রভূত অর্থ ব্যায়ে বিদেশে পাঠাবার প্রয়ােজন কি খুবই জরুরী ছিল? সমালােচকরা অনেক সময় ঈর্ষাপরবশ হয়ে বলে থাকেন যে, এই গরমের সময়টাতে দিল্লীতে থাকা কষ্টকর বলে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিদেশ সফরের সুযোেগ খোঁজেন। আমরা অবশ্য মাননীয় মন্ত্রীদের সম্পর্কে তা বলব না। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে যদি বিশ্বজনমতকে একটু জাগিয়ে তুলতে পারেন তাহলেও ধরে নেব এই সফর যত ব্যয়বহুলই হােক, একেবারে ব্যর্থ হয় নি। আর এই ভ্রাম্যমাণ মন্ত্রীদের অবর্তমানেই রুশ বিমানে শরণার্থীরা দফায় দফায় দমদম থেকে মানা শিবিরে গিয়ে অপেক্ষ করতে থাকবে, মন্ত্রীরা তাদের ভবিষ্যতের জন্য কী সুসংবাদ নিয়ে আসেন? ততদিনে অবশ্য পূর্ব বাংলা এই সীমান্তে ছুটে আসতে থাকবে প্রাণ রক্ষার তাগিদে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৮ জুন ১৯৭১