You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.04 | কান্দে শিশু, কান্দে বধূ, কান্দে মা-জননী রে হাফিজ আবদুল্লাহ | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

কান্দে শিশু, কান্দে বধূ, কান্দে মা-জননী রে
হাফিজ আবদুল্লাহ

সেদিনের কথা ভুলবাে না। পুলিশ লাইনে পুলিশের সঙ্গে পাকসেনাদের যুদ্ধ হচ্ছে। আঠারােটি ঘণ্টার যুদ্ধ। পুলিশের হাতে রাইফেল পাকসেনারা ব্যবহার করছে গােলা ও মর্টার। একটা অসম যুদ্ধে যা হতে পারে, এ যুদ্ধেও হয়েছিল ঠিক তাই। তারিখটা মনে আছে ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সাল। স্থান রাজশাহী শহর। পুলিশবাহিনী প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মতাে লড়াই করে মৃত্যুকে বরণ করেছে। বাকি আহত ও অন্যান্যেরা হটে গেলেন। রণক্ষেত্র থেকে। পুলিশের সম্বন্ধে আমার ধারণা সেদিন পালটে গিয়েছিল। পুলিশের নিন্দা না করে জলগ্রহণ করা বাঙালির স্বভাব ছিল না, দুনিয়ার তাবৎ অপরাধ পুলিশের ঘাড়ে চাপাতে পারলে তবেই আমাদের অপরাধ-বােধগুলাে শান্তি পেত। সেই পুলিশ ভাইরা পাকসেনাদের বিরুদ্ধে বাঙলা ও বাঙালির প্রথম মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, শহিদ হয়েছে, পুলিশের সমস্ত দোষ-ত্রুটি-অপরাধকে মহা-পূণ্যরক্তে ধুয়ে পবিত্র করে দিয়ে গেছে। বারংবার সেই পুলিশ ভাইদের প্রতি আমার মাথা নত হয়েছে। সেলাম আমার শহিদ ভাইরা, সেলাম জানাই তােমাদের। সেলাম আমার পুলিশ ভাইরা, তােমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করছাে, সেলাম তােমদের। বাঙলাদেশের পুলিশবাহিনী অমর হও।
আজ মনে পড়ছে, বড়ডাে বেশি করে মনে পড়ছে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কথা। পরনে লুঙ্গি, গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়ে চপ্পল, মুখে শুভ্র দাড়ি এবং মাথায় টুপি। সভায় এসে দাঁড়াতেন, চারিদিকটা দেখে নিতেন এবং তারপর বলা শুরু করতেন। বলতেন, এই যে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার নামে শত শত পুলিশ আমার মিটিংয়ে পাঠানাে হয়, সেইসব অল্প মাইনের সেপাই ভাইদের কথা কি আপনারা জানেন? তারপর কিছুক্ষণ থামতেন। পরে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলতেন, তােমরা যখন। স্ত্রী-পুত্র কন্যা নিয়ে সুখে মত্ত থাকো, এমনকি একদিনের ট্যুরে গেলেও বিবিকে সঙ্গে নিয়ে যাও, তােমরা কি একবার ভাবাে এসব সেপাইদের কথা, স্ত্রীর সােহাগ, পুত্র-কন্যার মুখের বুলি, মা-বাবার স্নেহ থেকে তারা বঞ্চিত, জীবন কাটে তাদের ব্যারাকে। শীত-গ্রীষ্মে-বর্ষায় এই সেপাইরা দেশের শান্তি রক্ষা করছে, তােমাদের বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছে, কিন্তু তার বিবি কোথায়, বাচ্চারা কোথায়, বৃদ্ধ মা-বাবা কোথায়? সেপাই ঘুষ খেলে তা হয় আলােচনার বিষয়, তােমরা যে দিন-দুপুরে ডাকাতি করছে তার হিসেব তােমরা দিয়েছাে?
না ঐ সামান্য মাইনের সেপাইদের খোঁজ কেউ করে না। তাদের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে ‘ভদ্রলােক বাঙালিরা বিবেকের ময়লা পরিষ্কার করেন, নিজেদের পাহাড়প্রমাণ পাপ গােপন করার কী নির্মম প্রয়াস আমাদের। কিন্তু যে দিন মুহূর্ত এলাে প্রকৃত সংগ্রামের, আমার চিরবঞ্চিত চির-অবহেলিত সেপাই ভাইরা পরিচয় দিলেন বীর্যের, সাহসের এবং মহান দেশপ্রেমের । আমায় মাফ করাে, আমার শহিদ সেপাই ভাইরা, তােমাদের লড়াইতে আমি ছিলাম না, কিন্তু ছিলাম তােমাদের পাশ পাশে। আমি ভীরু, কাপুরুষ তাই সামনে
বাঙলাদেশের মান-ইজ্জতকে তােমরাই তুলে ধরেছাে, মা-বােনের লজ্জাকে তােমরাই রক্ষা করেছে। জিন্দাবাদ বীর সেপাই শহিদ ভাই, জিন্দাবাদ।
দু মাস থেকে লড়াই চলছে এবং চলবে। সামান্য মাইনের সেপাইরা শহিদ হয়েছেন। সমস্ত পুলিশ লাইন-গুলিতে যুদ্ধ হয়েছে, বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সবকিছু। ব্যারাকের সেপাই ব্যারাকে ফেরেননি। আমার সেপাই ভাইদের সন্তানেরা কোথায়, তাদের স্ত্রী কোথায়, তাদের মা-বাপ কোথায়? না, কেউ তাদের খোঁজ জানেন না। কেউ সন্ধান করেননি তাদের। তারাও কি জানেন, তাদের প্রিয় সন্তান জীবন দিচ্ছেন প্রতি দিনে, প্রতি মুহূর্তে। তাদের প্রিয় স্বামীরা কোথায় আছেন, জানেন না তারা। আর সেই সব শিশুরা, যারা বাবার ফেরার জন্য বসে ভাবছে। হয়তাে ভাবছে, বাবা এলে ভারি মজা হবে। বাবা কত সুন্দর সুন্দর খেলনা আনবে। বাবা কত গল্প বলবে। সেইসব শিশুরা দিন গুনবে, তবু বাবা ফিরবেন না। লজ্জানত বধূ শ্বশুর-শ্বাশুড়ির সামনে কথা বলে না। শুধু কাখে কলসী করে জল আনতে গিয়ে দিগন্তরে নিরুদ্দেশ পথের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, কত লােক তাে আসে, কিন্তু তার সে তাে আসে না। এমন কতদিন তাকাবে। একদিন আর তাকাবে না, শুধু কাঁদবে। সমস্ত অন্তর জুড়ে হাহাকার পরিণত হবে এক-সমুদ্র কান্নায়। মা খেতে বসবেন, ভাত মুখে দিতে গিয়ে মনে পড়বে ছেলের কথা। ভাত আর নামবে না গলা দিয়ে। গড়িয়ে গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়বে মায়ের চোখের জল। ভাত খাওয়া আর হয়ে উঠবে না। কে কবে আপন রক্তের ফুলকে মৃত জেনে খেতে পারে। শিশুর কান্না, বধুর কান্না আর মায়ের কান্না—সব মিলিয়ে হবে এক কান্নাময় মহাসমুদ্র।
‘মা মাগাে, মা ছেলেটি বারবার চেঁচিয়ে ডাকবে। পাশে দাঁড়িয়ে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক। জ্ঞান ফেরেনি তখনও। ঘাড়ে আর গলায় গুলির আঘাত। কেউ বলছে বাঁচবে, কেউ বলছে বাঁচবে না। পরের দিন আবার গেলাম। দেখি তাকাচ্ছে মুখটা বিশীর্ণ, ফ্যাকাশে। মাথার চুলগুলাে কামিয়ে দিয়েছে। বললাম, একটু ভালাে বােধ করছ কি? চোখের ইশারায় কী যেন বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই চোখে ওর অশ্রুর আভাস দেখা দিয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হাত দিয়ে আমার একটা চেপে ধরলে। না-বলা সমস্ত কথা আমার জানা হয়ে গেল। বিধাব মায়ের একমাত্র ছেলে ফরিদ। পুলিশে নাম লিখেয়েছিল, মাকে দুটো অন্ন যোেগাতে পারবে বলে। গোঁফের স্বল্প-রেখা, টোপা-টোপা গাল, ছেলেমানুষি দুটি ভীরু চোখ। বলছিলাম, তুমি কিছু খাবে ভাই? ফলমূল বা অন্যকিছু? বলেছিল, না। বলেছিল এমাসে তাে কোনও মাইনে পেলাম না। জানেন, মায়ের কাছে একটি পয়সাও হয়তাে নেই। মার্চের সাতাশ তারিখে রাজশহীর পুলিশ লাইনে ফরিদ লড়াই করেছিল। ফরিদ আমাকে বলেছিল, শেখ সাহেব আটাশ তারিখে মাইনে দেবেন বলেছিলেন। মাইনে কি আমরা পাবাে? ফরিদ মাইনে পায়নি, মাকে টাকা পাঠাতে পারেনি। হাসপাতালে ওর একটু একটু করে উন্নতি হচ্ছে।
কিন্তু তেসরা এপ্রিল শুরু হলাে পাকি-সেনার বিমান আক্রমণ। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড-বয়, মেথর—সবাই পালাতে শুরু করলাে। পরে শুনেছিলাম, আহত সেপাই ও অন্যান্য রুগীদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এমন নির্মম কাহিনি ইতিহাসে নেই। মানুষ হয়ে মানুষকে কি এমন করে কেউ মারতে পারে? হ্যা পারে, ইয়াহিয়া এবং তার জল্লাদ সেনারা সব পারে । পারিনি শুধু আমরা, পারেনি বাঙলাদেশের শান্ত নিরীহ মানুষেরা। তাদের টাকায় এবং সম্পদে গড়ে ওঠা পাকি-সেনাবাহিনী নির্মমভাবে তাদেরই হত্যা করেছে। ভ্রাতৃত্ববােধ এবং ইসলাম ধর্মের নামে বাঙলাকে শ্মশান করে, বাঙালিকে ভিখিরী করে, বাঙলার সংস্কৃতির টুটি চেপে ধরে, বাঙালি জাতকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল তারা।
রাজশাহী শহর থেকে আশ্রয় নিয়েছি গাঁয়ে। এক বাড়িতে গিয়ে দেখি একজন আহত সেপাই সেখানে শুয়ে আছেন বিছানায়। কথায় কথায় সেই সেপাই ভাইটি বলছিলেন, “কি জানেন স্যার’ যদি আমাদের হাতে গােলা থাকত, তাহলে ওরা কিছুতেই আমাদের সঙ্গে পেরে উঠতাে না। আমাদের হাতে শুধু রাইফেল, তাও পুরনাে ব্রিটিশ আমলের। ওদের হাতে সব আধুনিক গােলাগুলি।” বলতে বলতে তার মুখটা উজ্জল হয়ে উঠলাে। ভুলে গেলেন তার ব্যথা-বেদনা। বললেন, লড়াইতে আমরা জিতব স্যার, দেখবেন, আমরা জিতব। আমি জানতাম ওরা জিতেছে। নৈতিক দিক থেকেই শুধু নয়, ওরা জিতেছে প্রকৃত যুদ্ধেও। একদিকে ভাড়াটে পাক-সেনা, অন্যদিকে দেশপ্রেমিক সেপাই ভাইরা। কে ইতিহাসের রায় সেপাই ভাইদের দিকে। ঐ বাড়িতেই দেখেছি, একজন মা অসংকোচে সেপাই ভাইটির সেবা করছেন। না, আমার মাবােনেরা শুধু কাঁদে না, তারা সেবা করে, স্নেহ দেয়, ভালােবাসে।
এপার বাঙলায় এসে বন্ধু-বান্ধবের কাছে এসব সেপাই ভাইদের বীরত্বের কথা বলেছি। কিন্তু যাদের কথা বলতে পারিনি, তারা হলাে সেপাই ভাইদের মা-বােন, স্ত্রী-পুত্র কন্যা। এপারে এসে সবার আগে এসব নাম-না-জানা -বােন ও শিশুদের কথা ভেবেছি। হয়তাে এ আমার একটুখানি ভাবনাবিলাস। কিন্তু পরক্ষণেই ভেবেছি, তা নয়। হয়তাে আমি একটুখানি কাব্যিক। কেননা শিশুদের আর্তক্রন্দনে, বধূর বুকফাটা বিরহ-হাহাকারে এবং মায়েদের হৃদয়-মথিত বেদনায় আমি আছি, আমি আছি তাদের দীঘনিঃশ্বাসে, তাদের দুঃখে-দহনে, আছি তাদের সমস্ত শােকের মধ্যে।
এপারে আসবার পর এক সেপাই ভাইয়ের মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বহরমপুরে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “হাসপাতালটি কোথায় জানাে, বাবা? হাসপাতালে আমার ছেলেটা নাকি আছে শুনেছি।” তাকে নিয়ে আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। না, সেখানে তার ছেলে নেই। ফিরে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন তার বৌমার কাছে। আশ্চর্য একটি মুখ, দুঃখিনী বাঙলাদেশের প্রতীক। কোলে দু-বছরের একটি ছেলে। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় মা কাঁদলেন, বধূ কাঁদলেন এবং কাঁদলাে দু-বছরের সেই শিশুও। বধুটির মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কেননা বাঙলাদেশের শােক আরও দীর্ঘতর হবে, হয়তাে এ-শতাব্দীর একটা বিরাট অংশ জুড়ে বিধাব বাঙালি বধূদের ক্রন্দনময় হাহাকার পরিণত হবে পৃথিবীর দীর্ঘতম শােকের বছরে।

সূত্র: সপ্তাহ, ৪ জুন ১৯৭১