You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজধানীর চিঠি

পাক-ভারত যুদ্ধ কি আসন্ন? প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খানের সাম্প্রতিক হুমকির পর এ প্রশ্ন অনেকেরই মনে জেগেছে বিশেষ করে তাঁদের, দেশরক্ষার দায়িত্ব রয়েছে যাদের উপর। প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খানের হুমকিকে তারা ফাঁকা হুমকি বলে মনে করছেন না বরং মনে করছেন ইয়াহা খান আজ নয় কাল হঠাৎই ভারতের উপর ঝাপিয়ে পড়বেন। একটা ছুতা খুঁজছেন, না পেলে সেটা আবিষ্কার করতে দ্বিধা করবেন না।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খান যেভাবে এখন বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান চান, একমাত্র ভারত আক্রমণের দ্বারাই তা সম্ভব। প্রথম দিকে তার হিসাবে ছিল, প্রচণ্ড দমননীতির সাহয্যে তিনি বাঙ্গালীদের মনােবলকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে পারবেন। সেটা ব্যর্থ হবার পর তিনি বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী দাঙ্গা এবং হিন্দু-মুসলমান বিরােধ সৃষ্টিতে হাত দিয়েছিলেন। তাঁর এ চেষ্টা বিশেষ সফল হয়নি। অতঃপর সুপরিকল্পিতভাব হিন্দুখেদার ব্যবস্থা করেন। এতে তিনি অবশ্য কিছুটা সফল হয়েছে। পূর্ববঙ্গ থেকে এখনও পর্যন্ত যে সত্তর লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তার মধ্যে হিন্দু সংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষের মতাে হবে। কিন্তু হিন্দুখেদার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কিছুটা সফল হলেও যে দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি এর আয়ােজন করেছিলেন তা কিন্তু অপূর্ণ রয়ে গেছে। পূর্বরঙ্গের হিন্দু-মুক্ত অঞ্চলের বাঙ্গালী মুসলমানরা ইসলামাবাদের প্রতি এবং ইসলামাবাদের ইঙ্গিতে পরিচালিত মুসলিম লীগ, জামতে ইসলাম প্রভৃতি দলগুলির প্রতি, আনুগত্য প্রকাশে বিরত থেকেছে। আর, হিন্দু শরণার্থীরা ভারতে প্রবেশ করে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গ-হাঙ্গামার সৃষ্টি করতে কোন উৎসাহ দেখায় নি। যে বাঙ্গালীরা পূর্ববঙ্গে রয়ে গেল তারা এবং ভারতের সীমান্ত বরাবর এসে ঘাঁটি গেড়ে বসলাে যারা, তারা মুক্তিফৌজ গড়ে খান-সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে দেবে এটা প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খানের হিসাবের মধ্যে ছিল না। যার শিরদাঁড়া তিনি ভেঙ্গে দিয়েছেন সে উঠে দাঁড়ায় কি করে।
একটা ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খান কিন্তু গােড়া বেঁধে কাজ করেছিলেন। সেটা পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার ঢালাও হুকুম দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভিতরের খবর বাইরে যাতে না যায় তার এবং সরকারি প্রচারযন্ত্রগুলির মাধ্যমে বিকৃত ও মিথ্যা খবর পরিবেশনের দ্বারা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার পাকা ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। এর একটা ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী হিসাবে চিহ্নিত করা এবং দুষ্কৃতিকারীরা যে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী অবিরত সে কথা প্রচার। পঁচিশে মার্চ ঘটেছে তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষভাবে হিন্দুস্থানীদের জড়ানাে হয়েছে। বলা হয়েছে এদের দ্বারা প্ররােচিত হয়েই আওয়ামী লীগের বাঙ্গালী সমর্থকরা ঢাকায় বিহারীদের হত্যা করে তাদের ধন-সম্পত্তি লুট করে এবং বাড়ী-ঘর পুড়িয়ে দেয়। ফলে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খানের সৈন্য বাহিনী শান্তি রক্ষার্থে ছাউনি ছেড়ে পথে বার হয় এবং কোথাও কোথাও গুলি চালাতে বাধ্য হয়। অতঃপর প্রচার চলতে থাকে, হিন্দুস্থানীদের প্ররােচনাতেই শরণার্থীরা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছে এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খান পরে তাদের অভ্যর্থনা করার জন্য যেসব কেন্দ্র খুলেছেন শরণার্থীদের সেখানে ফিরে আসতে এই হিন্দুস্থানীরাই বাধার সৃষ্টি করছে। হালে মুক্তিফৌজের ক্রমবর্ধমান গেরিলা কার্যকলাপের খবরকে একেবারে চেপে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাই বলা হচ্ছে হিন্দুস্থানী অনুপ্রবেশকারীরাই এই সব ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য দায়ী। এই ধরনের গােয়েবেলীর প্রচার পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের মনে কি ধারণার সৃষ্টি করেছে তা সহজেই অনুমেয়। বিস্ময়ের বিষয় এই যে, পাকিস্তানের এই মিথ্যা প্রচার ভারতীয় মুসলিমদের একাংশকেও বিভ্রন্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
এই পটভূমিকায় এখন মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খানের পক্ষে হঠাৎই একদিন ভারতের উপর ঝাপিয়ে পড়া এবং তা হিন্দুস্থানী আক্রমণ প্রতিহত করতে করা হয়েছে বলে প্রচার করা সহজ এবং সম্ভব।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খান ভারত আক্রমণের জন্য যে তৈরী তা অবশ্য বিশেষ চাপা নেই। আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীতে নূতন ভর্তি, আধা-সামরিক বাহিনীগুলিকে শক্তিশালীকরণ ইত্যাদি বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। পাকিস্তান আমেরিকানদের কাছ থেকে শুধু অস্ত্রশস্ত্রই সংগ্রহ করছে না, ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে গােপন তথ্যাদিও সে আমেরিকান বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সংগ্রহ করছে বলেও প্রকাশ পেয়েছে। ভারতীয় সীমান্তে ছােট-খাটো সংঘর্ষ সৃষ্টি দ্বারা ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভের চেষ্টাও করছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এদিকে দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে গত ২০ ও ২১ জুলাই। এই দু’দিন পাকিস্তানের ২টি মীরাজ বােমারু বিমানের একটি কাশ্মীরে প্রবেশ করে শ্রীনগর বিমানঘাঁটির ওপর কয়েকটি পাক খেয়ে এবং অন্যটি জম্মুর ওপর দিয়ে চলে যায়। ভারতীয় আকাশে সাত-আট মিনিট ধরে উড়েছিল এরা। কাশ্মীর সীমান্তে ভারতের যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে তাতে এ বিমান দুটিকে ভূপাতিত করার কোন অসুবিধা ছিল না। করা হয়নি সম্ভবতঃ রাজনৈতিক কারণে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খান যে অজুহাত খুঁজছেন এখনই সেটা তার হাতে তুলে দেওয়ার ইচ্ছা ভারত সরকারের নেই। (এই ঘটনা নিয়ে সংসদে হৈ-চৈ হলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন পাকিস্তানিদের। এরূপ ধৃষ্টতা ভবিষ্যতে আর সহ্য করা হবে না।)
বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীকে দমন করতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং গত চার মাসের আপ্রাণ চেষ্টাতেও সেখানে কোন তাবেদার অসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার মতাে লােকবল সংগ্রহে অপারগ হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহা খান সম্ভবতঃ বুঝে নিয়েছেন যে পশু বলে হয়তাে আরও কয়েক লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা করা যাবে কিন্তু তার সঙ্গে বাংলাদেশকে হারাতে হবে চিরতরে। আর, এভাবে বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানের বাইরে চলে যায় তা হলে নিছক পশুবলের সাহায্যে সিন্ধী, বেলুচ ও পাখতুনদের বেশীদিন বশে রাখা সম্ভব হবে না।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৭ জুলাই ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!