ঐক্যবদ্ধ মুক্তি সংগ্রাম
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নূতন মােড় নিয়েছে। পাঁচটি দলের আটজন সদস্য নিয়ে গড়ে উঠেছে যুদ্ধকালীন উপদেষ্টা কমিটি। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ আজ সংগ্রামের সামিল। তাদের সামনে প্রধান শত্রু দখলদার পাক-বাহিনী। ওদের উচ্ছেদের উপরই নির্ভর করছে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ। জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসকে সার্থক পরিণতির দিকে টেনে নেওয়া প্রত্যেকটি প্রগতিবাদী রাজনৈতিক দলের আশু কর্তব্য। এই কর্তব্যেরই প্রাথমিক প্রকাশ উপেদেষ্টা কমিটি গঠনের উদ্যোগে। তাতে যােগ দিয়েছেন এমন ক’টি দল যারা শান্তির সময় বিশ্বাসী ছিলেন না। মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। জাতির চরম সঙ্কটে ভুলে গেছেন তারা দলাদলি। ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকগােষ্ঠী মুক্তিকামী বাঙালীর প্রধান শত্রু। ওদের খতম করার জন্য হাত মিলিয়েছেন সবাই। সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ আচ্ছন্ন করে নি তাদের লক্ষ্যবস্তু! নেতাদের এই বাস্তব বুদ্ধি নিঃসন্দেহে প্রশংসার যােগ্য। একথা সত্য, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার মূলত আওয়ামী লীগ সরকার। উপদেষ্টা কমিটিতেও রয়েছে এ দলের প্রাধান্য। বর্তমান অবস্থায় তা অপরিহার্য। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের গণতান্ত্রিক ভিত্তি বিগত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল। তার উপর নির্ভর করেই গঠিত হয়েছে। স্বাধীন সরকার এবং সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব। ভারতে এবং বহিবিশ্বে এই সরকারই পরিচিত। মুজিবুর রহমান সংগ্রামী জনতার প্রেরণার উৎস এবং সংহতির প্রতীক। সর্বস্তরে তাঁদের প্রাধান্য খুবই স্বাভাবিক। এই সত্য স্বীকার করে নিয়েছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দল। না নিলে ফাটল ধরত বাঙালী ঐক্যে। সুযােগ পেতেন ইয়াহিয়া খান।
অনেক আগেই স্বার্থহীন ভাষায় বলেছিলেন মৌলানা ভাসানী—প্রধান শত্রু পাকবাহিনীকে উচ্ছেদের আগে কোয়ালিশন সরকার গঠন না করাই যুক্তিযুক্ত। তাতে বাড়বে দলাদলি। দুর্বল হয়ে পড়বে মুক্তি সংগ্রামের গতি। বর্তমান সরকারকে সামনে রেখেই চালাতে হবে আপােষহীন লড়াই। হয়ত পশ্চিম বাংলার যুক্তফ্রন্টের মরণদশা দেখে হুশিয়ারী দিয়েছিলেন এই বর্ষীয়ান নেতা। সঙ্কটকালে দলীয় কোন্দলের লড়াই নূতন নয়। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময়ও বিপাবলিকান সরকারের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থপরতা। ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিস্ত বাহিনী যখন চরম আঘাত হানতে উদ্যত তখন রিপাবলিকান সরকারের অন্ত ভূক্ত দলগুলাে ছিলেন নিজেদের দলভিত্তিক প্রাধান্য বিস্তারের খেয়াব রচনায় ব্যস্ত। পরস্পরের কুৎসা রটনায় তারা ছিলেন পঞ্চমুখ। বাংলাদেশে এসব ঐতিহাসিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি অবাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশ সরকার এখনও পান নি কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি। এসময় দরকার তাদের ঐক্যবদ্ধ ভাবমূর্তি। তার অভাব ঘটলে এই স্বীকৃতির পথ হয়ে পড়বে কন্টকাকীর্ণ। বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী হারিয়ে ফেলেন নি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলাে। সর্বসম্মতিক্রমে বিভিন্ন দল থেকে উপদেষ্টা কমিটির সদস্য মনােনয়ন তার প্রমাণ। আসল ক্ষমতা অবশ্যই থাকবে আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে। যতদিন সংগ্রাম চলবে ততদিন তা নড়চড় বিপজ্জনক। দেশটা স্বাধীন হবার পর গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে নূতন করে পরীক্ষা হবে দলগত শক্তি। এটা সুস্থ রাজনৈতিক চেতনার লক্ষণ। ঐক্যের প্রতিশ্রুতির উপর জন্ম নিয়েছে উপদেষ্টা কমিটি। তার সার্থক পরিণতি ঘটাতে হবে সংগ্রামের বাস্তব রুপায়ণে। এখানেই প্রমাণ মিলবে নেতাদের দুরদিৰ্শতা এবং আন্তরিকতা।
এদিকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন। অসম্ভব বেড়েছে ভারত সরকারের কর্মতৎপরতা। রাষ্ট্রসঙ্ঘে উঠবে নাকি বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। নেপথ্য প্রয়াস নাকি চলছে পুরাদমে। ভারতসহ গােটা কয় রাষ্ট্র নাকি স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানে তৈরী। আগামী ক’সপ্তাহের মধ্যেই নাকি ঘটবে যুগন্ত কারী ঘটনা। আকাশে বাতাসে প্রচণ্ড গুজব। এসব গুজবের সত্যাসত্য যাচাই সম্ভব নয়। রাজনীতিতে ভাবালুতার স্থান নেই। কঠিন বাস্তববােধ অবশ্য কাম্য। কূটনৈতিক স্বীকৃতি এলেও বন্ধ হবে না সংগ্রাম। বর্ষার শেষে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করবে পাকবাহিনী। তার মােকাবিলার মূখ্য দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের এবং মুক্তিবাহিনীর! স্বীকৃতি না পেলে বাড়বে তাদের মানসিক দৃঢ়তা। স্বীকৃতি না পেলেও প্রতিরােধ এবং প্রত্যাঘাতের জন্য করতে হবে মরণপণ। মুক্তিবাহিনীর বিজয় ভারতের স্বার্থের পক্ষে অপরিহার্য। কারন তারা জয়লাভ করলেই প্রশস্ত হবে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ। কোটি কোটি টাকা খরচের দায় থেকে রেহাই পাবেন নয়হাদিল্লী। গণতন্ত্রের পথে কধাপ এগিয়ে যাবে এশিয়া।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১