You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব বাংলার বিপন্ন বৌদ্ধেরা

পূর্ব বাংলার নানাস্থানে, বিশেষ করে চট্টগ্রামে যে সংখ্যালঘু বৌদ্ধরা ছিলেন, পাকিস্তানি ফৌজের গুন্ডামি ও বর্বরতায় তারাও অন্যদের মতই নিরাশ্রয় হয়েছেন। তাদের মঠ মন্দির ভেঙ্গে, বর বাড়ী জ্বালিয়ে, কুলনারীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে পাকিস্তানি দুষমনরা যে নরকের আরহাওয়া সৃষ্টি করেছে, তার মধ্যে বেঁচে থাকা অসম্ভব। নিছক প্রাণের দায়েই তাই ২০ হাজার বৌদ্ধ ব্রহ্মদেশের আরাকান অঞ্চলে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। ব্রহ্মদেশবাসী এক বাঙালী বৌদ্ধই এ সংবাদ জানিয়েছেন আসামের বৌদ্ধপ্রধান শ্রীজিনরতন মহাস্থবিরকে। আসামের মিজো পাহাড় অঞ্চলেও নাকি এসেছেন প্রায় ১৫ হাজার বৌদ্ধ এবং তারাও এসেছেন একইভাবে বর্বরতার শিকার হয়ে।
আর্ত ও বিপন্ন মানুষরা যে ধর্ম বা মতাবলম্বীই হন, তাদের দিকে আমাদের তাকাতে হবে একই উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে। সে হিসাবে পূর্ব বাংলার মৃত্তিকা থেকে উনুলিত লক্ষ লক্ষ হিন্দু মুসলমান নর-নারীর সমস্যা থেকে বৌদ্ধদের সমস্যাকে হয়ত তফাৎ করে দেখা চলে না। তবু বঙ্গ ভাষাভাষী বৌদ্ধদের সমস্যার একটা নিজস্ব দিক আছে। তারা শুধু বাংলায় নয় গােটা ভারতেই সংখ্যায় নিতান্ত কম। তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রীতিপদ্ধতির বৈশিষ্ট্য অব্যাহত রেখে তারা এতদিন যেভাবে জীবন কাটিয়েছেন, তার ভিত্তি হঠাৎ গুড়িয়ে যাওয়ায় তারা অনিবার্যভাবে আজ অকূলে পড়েছেন। এই সংকটে তাদের জন্যে সহায়তার হাত এগিয়ে দেবার জন্যে তাদের স্বগােষ্ঠীর মানুষ আরাে অধিক সংখ্যায় থাকলে ভাল হত।
ধর্মের আনুষ্ঠানিক অংশ আমরা মানি বা না মানি, তার অন্তর্লগ্ন ঐক্যের বন্ধনটি যে অদৃশ্যভাবেই কাজ করে তা বােঝা যায়, তখন চরম বিপদের মুহূর্তে ত্রাণের আশায় মানুষ স্বশ্রেণী ও স্বভাষাভাষীর আশ্রয়েই ছুটে যায়। পূর্ব বাংলার হিন্দু মুসলমান ভারতে রিক্ত হাতে এলেও এসেছেন এখানকার হিন্দু মুসলমানদের পােষকতার ভরসায়। এই ভরসা নিশ্চয় অন্তরে আছে বৌদ্ধদেরও, কারণ বৌদ্ধধর্ম যেহেতু হিন্দুধর্মেরই সম্প্রসারিত একটি শাখা এবং ভারতবর্ষ যেহেতু সেকুলার বা ধর্মের গোঁড়ামি বিমুক্ত রাষ্ট্র, সেই হেতু তারাও এখানে আশ্রয় ও সহায়তা পাবেন। তবু কতকটা নিরুপায়তা বােধ হবেই তাদের এবং তার কারণ আমরা গােড়াতেই বলেছি। এদিক থেকে ব্রহ্মদেশের পরিবেশ তাদের হয়ত খানিকটা অনুকূল হবে।
অবশ্য রাজনীতিক শরণার্থীদের সম্বন্ধে সরকারি নীতি সেখানে কি হবে, তার ওপরই নির্ভর করছে সব কিছু। আসামে ও পশ্চিম বাংলায় যে বৌদ্ধ শরণার্থীরা এসেছেন, তাঁদের ত্রাণ এবং সেবার কাজে যে আমাদের সতর্ক মনােযােগ আকৃষ্ট হবে, এতে অবশ্য কোনই সন্দেহ নেই। এক দিন আমরা হিটলারের জার্মানী থেকে ইহুদীদের দলে দলে উৎখাত ও বিতাড়িত হয়ে পৃথিবীর দিকে দিকে পিছিয়ে পড়তে দেখেছি। অদম্য প্রানহানি ও বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আত্মপ্রত্যয়ের জোরে তারা চরম দুর্যোগের মধ্যেও টিকে থেকেছেন এবং তা থেকেছেন বলেই শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়িয়েছেন। স্বৈরাচারী হিটলারই পরাজয়ের ভস্ম মুখে নিয়ে বিদায় নিয়েছেন ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চ থেকে। বাঙালী বৌদ্ধরাও এইভাবেই জয়ের অধিকারী হবেন একদিন, স্বধর্মদ্রোহী, মানবদ্রোহী আজ জঙ্গী সর্দারদের ক্ষণিকের খেলা শেষ হলে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৬ জুলাই ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!