সাড়ে তিন মাসের যন্ত্রণার শেষে
ঢাকাস্থিত প্রাক্তন ভারতীয় ডেপুটি হাই-কমিশার শ্রীকৈলাসচন্দ্র সেনগুপ্ত সহ সমস্ত ভারতীয় কর্মী ও তাদের পরিবারবর্গ যে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে পেরেছেন তাতে দেশের মানুষ গভীর স্বস্তি বােধ করবেন। সাড়ে তিন মাসের অধিককাল এই মানুষগুলি যে কষ্ট পেয়েছেন তার নজীর খুব কমই রয়েছে। নিছক ইসলামাবাদের দুবুদ্ধি ও শয়তানির জন্যই তাদের এই কষ্টভােগ করতে হয়েছে, এর অন্য কোন হেতু ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমরা যে মানুষগুলিকে অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্ত করে আনতে পেরেছি তার প্রথমত, কলকাতা থেকে মেহেদি মাসুদ ও তার দলবলকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাকিস্তানের তাগাদা ছিল এবং দ্বিতীয়ত, নয়াদিল্লির সুইস দূতাবাস অপরিসীম ধৈৰ্য্যর সঙ্গে এই ব্যাপারে মধ্যস্থতা করে একটা আপােষ মীমাংসা সম্ভব করেছেন। এজন্য ভারতবর্ষের মানুষ সুইস প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানাবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন যে, পাকিস্তানের সুবুদ্ধি ফিরিয়ে আনতে হলে তার সঙ্গে শঠে শাঠ্যং নীতি প্রয়ােগ করা ছাড়া অন্য পথ নেই।
ঢাকায় এই সাড়ে তিন মাস সময় ভারতীয় কর্মীরা ও তাদের পরিবারের লােকরা যে কি দুঃসহ অবস্থায় কাটিয়েছেন তার কিছু বিবরণ আমরা বিদেশী সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের সংবাদ থেকে জেনেছি। এরা সকলেই এই দীর্ঘ সময় প্রকৃতপক্ষে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যােগাযােগহীন অবস্থায় বাড়ীর মধ্যে বন্দী হয়ে কাটিয়েছেন। শ্রীকৈলাস সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, এমনকি চুল কাটার জন্যও তাকে বাড়ীর বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। এদের যে কি অপরাধ তা কিন্তু পাকিস্তান সরকার কোন দিন জানান নি। ভারত সরকার কূটনৈতিক শিষ্টাচারের দোহাই তুলেছেন; কিন্তু ইসলামাবাদের কানেই ঢেকে নি সেসর কথা। কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাই-কমিশনারের দপ্তর তুলে দেওয়া, মেহেদি মাসুদ ও তাঁর দলবলকে নজরবন্দী করে রাখা, এসবই ভারত সরকার করেছেন পাকিস্তানের পাল্লা জবাব হিসাবে। ভারত সরকার নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এসব কিছুই করেন নি। কিন্তু ইসলামাবাদের কি লাভ হল এইভাবে জল ঘােলা করে? ঘরের মানুষদের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে কাজটা অনেক আগে অনেক সহজ, স্বাভাবিকভাবেই চুকে যেতে পারত, সেই কাজটাই অবশেষে করা হল অনেক অনাবশ্যক জটিলতা সৃষ্টি করার পর।
অথচ, যে আশায় পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা এভাবে জল ঘােলা করেছেন তাদের সে আশা অপূর্ণই রয়ে গেল। কলকাতায় পাকিস্তানের প্রাক্তন ডেপুটি হাই-কমিশনার জনাব হােসেন আলি ও অন্যান্য যারা ইসলামাবাদের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে নিজেদের বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বলে ঘােষণা করেছেন, তাঁদের কয়েকজনকে আবার ইয়াহিয়া খার খােয়াড়ে ঢােকান যাবে—এই আশা ছিল মেহেদি মাসুদ ও তার প্রভুদের। সুইস প্রতিনিধি তাদের আবদার রক্ষার জন্যই জনাব আলি ও তাঁর সহকর্মীদের মত শােনার সুযােগ করে দিয়েছিলেন মেহেদি মাসুদ সাহেবকে। কিন্তু একজনকেও তিনি ভাঙ্গাতে পারেন নি। তাঁর আশায় গড়ে বালি পড়েছে। এই পরাভব তিনি ও তার প্রভুরা নিজেরাই বেচে নিয়েছেন। অথচ তারই জন্য কতকগুলি নির্দোষ মানুষকে ও তাদের ঘরের স্ত্রী-পুত্র-পরিজনকে অশেষ ক্লেশ ভােগ করতে হয়েছে এবং গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে; যারা ফিরে এলেন দেশের মানুষ তাঁদের স্বাগত জানাবেন এবং তাঁদের প্রতি গভীর সহানুভূতি বােধ করবেন। এই কষ্ট স্বীকার করে তারা দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য করেছেন। বিশেষ করে শ্রীকৈলাসচন্দ্র সেনগুপ্ত বিপদ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে যে ধৈৰ্য্য দেখিয়েছেন, সেটা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ রাখার মতাে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৩ আগস্ট ১৯৭১