শরণার্থীদের মধ্যে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি
বাঙলাদেশ থেকে আগত অর্ধ কোটি শরণার্থীদের কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অপপ্রচার শুরু হয়েছে। শরণার্থীদের রাজনৈতিক দাবা খেলার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করার পার্টির অভাব নেই। ইতিমধ্যেই জনসংঘ বাঙলাদেশের স্বাধীন সরকারের স্বীকৃতির দাবি প্রত্যাহার করে এক নতুন কৌশল অবলম্বন করেছেন। শরণার্থীদের পুণর্বাসনের নামে জনসংঘীরা পাকিস্তানের একটা অংশ দখল করার দাবি উত্থাপন করেছেন। বস্তুতপক্ষে এ দাবির অর্থ হল পাক-ভারত যুদ্ধ। অন্যথায় ভারত থেকে সমসংখ্যক মুসলমান বিতাড়ন করে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। জনসংঘীরা আবার নতুন উদ্যোগে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধাবার জন্য শরণার্থীদের ব্যবহার করার সুযােগ খুঁজছে। বারবার বিভিন্ন রাজ্যে তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে হাত পাকিয়েছে। বিগত লােকসভা নির্বাচনে জনসংঘ যে দক্ষিনপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল জোটের একটা শক্তিশালী স্তম্ভ এবং নয়া উপনিবেশবাদের অন্যতম মুখপাত্র-এই সত্যটি উদঘাটিত হয়েছে। তারা নির্বাচনে পরাজিত হলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন থেকে উৎপাটিত হয়নি। শরণার্থীদের কেন্দ্র করে তারা আবার সাম্প্রদায়িক কৌশলকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সচেষ্ট। বাঙলাদেশে যেমন মুসলিমলীগ ও জমিয়ত উলেমা মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার জন্য ইয়াহিয়ার সমর্থনে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলেছে, তেমনই জনসংঘও শরণার্থীদের কেন্দ্র করে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভ্রান্ত করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। তারা বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় ডুবিয়ে দিতে চায়। বাঙলাদেশের মুসলিম লীগ এবং এখানে জনসংঘের ভূমিকা এক ও অভিন্ন। উভয়েই মুক্তি-সংগ্রাম ও গণতন্ত্রকে আক্রমণ করে সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রকে সফল করতে চায়। ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা যেমন গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শত্ৰু, তেমনই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাও মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম শত্রু। আবার কোন কোন বামপন্থী পার্টিও শরণার্থীদের পুনর্বাসনের অজু হাতে অন্য রাজ্যে তাদের স্থানান্তরিত করার বিরুদ্ধে প্রচারকার্যে নেমেছেন। বিচিত্র তাদের যুক্তি। তথাকথিত মানসিকতার অজুহাত তুলে তারা শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গে রাখতে চান। তাদের কাছে পশ্চিমবঙ্গের সামর্থের প্রশ্নটি গৌণ, মানসিকতার প্রশ্নটি মুখ্য। তারা শরণার্থীদের বাস্তব সমস্যাকে উপেক্ষা করে তাদের সরকার বিরােধী বিক্ষোভ সংগঠিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তথাকথিত মানসিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। উভয় দলের মধ্যে একটা সাদৃশ্য আছে। এরা কেউ পাকিস্তানের দাঙ্গার শরণার্থী এবং বাংলাদেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যারা শরণার্থী হয়েছে-তাদের মধ্যে কোন তারতম্য করে না। অতীতে পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার ফলে যারা শরণার্থী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছে তাদের পুনর্বাসন সমস্যা ছিল প্রধান। কিন্তু বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ময়দান থেকে যারা সাময়িকভাবে শরণার্থী হয়েছে তাদের পুনর্বাসনের সমস্যা সাময়িক। আবার মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিতভাবে প্রত্যাবর্তন করাই শরণার্থীদের কাম্য। এই শরণার্থীদের মনােভাবও পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস করা নয়। যারা শরণার্থীদের নিছক বস্তুহারা ও দেশচ্যুত মনে করেন তারা মুক্তিযােদ্ধাদের কেবল মর্যাদা দেন না নয়, তাদের দেশ প্রেমকেও মর্যাদা দেন না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদের সমীক্ষা থেকে যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে তার থেকে প্রমাণিত হয় যে, শরণার্থীদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ বাঙলাদেশে ফিরে যেতে চায়। এদের মধ্যে অনেকেই মুত্তি অংশ নিয়েছে। এরা যে ভবিষ্যতে আবার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। জনসংঘ ও তথাকথিত বামপন্থী পার্টি শরণার্থীদের সম্পর্কে যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা কেবল শরণার্থীদের জন্যই বিপজ্জনক নয়, বাঙলাদেশের মুক্তি-সংগ্রাম ও ভারতের গণতন্ত্রের পক্ষেও বিপজ্জনক। এদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সকলকেই হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
সূত্র: কালান্তর, ২৭.৬.১৯৭১