বাঙলার মুক্তিযুদ্ধ ও সাম্প্রদায়ীকতা
বিবেকানন্দ মুখােপাধ্যায়
বাঙলার মুক্তিযুদ্ধের একমাসের বেশি পার হইয়া গেল। গত ২৫ মার্চ রাত্রিবেলা ইয়াহিয়া খাঁর ফ্যাসিস্ত বাহিনী জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা পূর্বক আধুনিক মারণাস্ত্র সহ যে বর্বর আক্রমণ চালাইয়াছিল, তার সুখে বাঙলাদেশের জনগণের একদিনও টিকিয়া থাকার কথা নয়। কিন্তু পাকিস্তানি মিলিটারি সরদারদের অবাক করিয়া দিয়া বাঙলার মুক্তিফৌজ কেবল সাফল্যের সঙ্গে আত্মরক্ষা করেন নাই, বহুস্থানে প্রতিরােধ যুদ্ধের বিস্ময়কর নজীরও দেখাইয়াছেন। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে বাঙলাদেশের মানুষ নিরস্ত্র, পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী শাসকের ভণ্ডামীকে বিশ্বাস করেনাই, আর্মিতে তারা প্রবেশআধিকার পায় নাই মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি ছাড়া। সুতরাং পূর্ব বাঙলায় পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রায় খােলা মাঠ পাইয়াছিল ভয়াবহ আক্রমণ ও অত্যাচার চালাইয়া যাওয়ার এবং এই আক্রমণ নিতান্তই একতরফা, নিজের দেশের (পাকিস্তানের দাবি অনুসারে বাঙলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান) জনগণের বিরুদ্ধে এই ধরণের যুদ্ধ ঘােষণা আধুনিক কালের পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূব। এমনকি হিটলারও এমন কাজ করেন নাই। যেখানে দুই পক্ষই সমান অস্ত্র সজ্জিত, সেখানে। নিয়মিত যুদ্ধ গড়িয়া ওঠে। কিন্তু বাঙলাদেশে তার সম্ভাবনা নাই। পশ্চিম পাকিস্তানের দস্যু বাহিনী একতরফা ধ্বংস কার্য চালাইয়া যাইতেছে এবং সেই সমস্ত বিবরণী পৃথিবীর পঞ্চ মহাদেশের বড় বড় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইতেছে, এই সমস্ত সংবাদপত্র নিশ্চয়ই ভারতবর্ষের তাবেদার নয়। ইঙ্গ মার্কিন জার্মান জাপানি সংবাদপত্রগুলােই বলিয়াছে যে পূর্ববঙ্গে ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র সৈন্যরা যে গণহত্যা ও রক্তের প্লাবন ঘটাইয়াছে ইদানিং কালের ইতিহাসে তার তুলনা নাই। একটি সাম্প্রতিক হিসাবে দেখা যাইতেছে যে, হানাদার পাক সৈন্যরা গত চার সপ্তাহে আক্রমণে বাঙলাদেশের দুইহাজার কোটি টাকা মূল্যের সরকারি ও বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করিয়াছে। নিহত হইয়াছে পাঁচ লক্ষ বাঙালি এবং সেই সঙ্গে ৩০ লক্ষ মানুষ গৃহহারা হইয়াছে। আর জ্ঞানী বিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের পাইকারীভাবে হত্যা করা হইয়াছে-যেন ভবিষ্যতে বাঙলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে কোন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর নেতৃত্ব না থাকে। এই হিসাব, যদিও আনুমানিক তথাপি ভিত্তিহীন নয় এবং এই হিসাব দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সােভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে হিটলারি নাৎসী বাহিনীর আক্রমণের নৃশংসতা ও ধ্বংসকার্য স্মরণ করাইয়া দিবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এবং আশ্চর্যের বিষয়ও বটে, পূর্ববঙ্গে মানবতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বরদের এই সাংঘাতিক অপরাধকে যে অপরাধের জন্য ইয়াহিয়া খান ও তার সেনাপতিদের যুদ্ধপরাধী হিসাবে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হওয়া উচিত) এক শ্রেণীর সাম্প্রদায়ীকতাবাদী মুসলমান এপারে এবং ওপারে কেবল তুচ্ছ করিতে চাহিতেছে না, এই পাইকারি নরহত্যা ও অত্যাচারে উস্কানি দিতেছেন। তারা এই মর্মে প্রচার করিতেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দুরা এবং হিন্দুদের চক্রান্তের ফলে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্নতার দাবি তুলিয়াছে, ভারতবর্ষ পাকিস্তানকে ধ্বংস করিতে চায়। সুতরাং রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দেশদ্রোহীদের দমন করিবার জন্য যে ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন, তা যুক্তিসঙ্গত ও আইনসঙ্গত। অবশ্য পাকিস্তানি রেডিও থেকেও অনবরত এই ধরণের প্রচারকার্য চলিতেছে। এই প্রচারের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতবর্ষের মুসলমানদের একাংশেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হইতেছে। তাদের ধারণা মুসলমানদের একটি হােমল্যান্ড প্রতিষ্ঠার জন্যই পাকিস্তানের সৃষ্টি হইয়াছে, সুতরাং পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন। হইয়া গেলে মুসলমানদের হােমল্যান্ড ধ্বংস হইয়া যাইবেএবং যদি ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে, তবে উৎপীড়িত মুসলমানেরা কোথায় গিয়া আশ্রয় পাইবে?
বিশেষত বাঙলাদেশের এই তথাকথিত স্বাধীনতার যুদ্ধ ভারতবর্ষেরই কারসাজি মাত্র। সুতরাং মুসলমানেরা যুদ্ধের তাে সহায়তা করিবেই না, বরং পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য এর বিরােধীতা করিবে।
উপরে যে মুসলিম মানসিকতা সংক্ষেপে বর্ণনা করা হইল, বলা বাহুল্য যে সেই মানসিকতা বহণ করিতেছে ভারতবর্ষ ও পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম লীগের একাংশ ও তার সমর্থকগণ। এমনকি শুনা যাইতেছে যে পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভায় যে তিনজন মুসলিম লীগ পন্থী সদস্য আছেন, তারা ইতিমধ্যেই সামপ্রদায়কি প্ররােচনার শিকার হইয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখুজ্যের নেতৃত্বে যে বাঙলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক কমিটি গঠিত হইয়াছে, এই তিন জন মুসলিম মন্ত্রি তার সঙ্গে কোন সহযােঘিতা করিতেছেন না, বরং প্রচ্ছন্নভাবে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধীতা করিতেছেন। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে, বিশেষভাবে সীমান্ত অঞ্চলে এবং ভারতবর্ষের নানা কেন্দ্রে পাকিস্তানি গুপ্তচর ও বিভীষণেরা সক্রিয় হইয়াছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের যে। তিনজন মুসলিম লীগ মন্ত্রির কথা উল্লেখ করা হইল, মনে রাখা দরকার তারা পাকিস্তানি নন (অন্তত বাহ্যত:) তারা ভারতবর্ষের স্থায়ী বাসিন্দা ও প্রজা এবং ভারত রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়া তারা পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রিসভার আসনে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন। অথচ তাদের আচরণ ও মানুষিকতা হইতেছে পাকিস্তানপন্থী এবং কার্যত ভারত রাষ্ট্রের বিরােধী। কারণ পাকিস্তান মূলত ভারত রাষ্ট্রের বৈরি এবং পাকিস্তানের বর্বর শাসকেরা এত অত্যাচারী যে, তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান তাদের সরকারি নামটা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিয়া বাঙলাদেশ নাম রাখিতে বাধ্য হইয়াছে এবং পশ্চিমের শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘােষণা করিয়াছে। গত ২৩ বছর ধরিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের শােষক এবং শাসক ও মিলিটারি গােষ্ঠী পূর্ব বাঙলাকে কলােনির মতাে ব্যবহার করিয়াছে- এটা তাে ঐতিহাসিক সত্য এবং এই সত্যের পিছনে ‘হিন্দু ভারতের তাে কোনাে কারসাজি নাই। শেখ মুজিবুর এবং আওয়ামী লিগ তাে হিন্দু নেতৃত্বের অধীন নয়। কেন পূর্ব বাঙলার ৬ কোটি (১ কোটি মাইনরিটি বাদ দেওয়া গেল) মুসলমান এক বাক্যে এবং একযােগে ইসলামাবাদের ফ্যাসিস্ট দৌরাত্মের বিরুদ্ধে গত ১৯৫২ সাল থেকে (ভাষা আন্দোলন) ক্রমাগত মুক্তি আন্দোলনে অবর্ণনীয় ত্যাগ স্বীকার ও লাঞ্ছনাবরণ করিতে বাদ্য হইয়াছেন? জাতিতত্ত্ব ও নেতৃত্বের বিচারে বাঙালিরা নিশ্চয়ই একটা পৃথক জাতিগােষ্ঠী যেমন বালুচ, পাঠান সিন্ধিরা পৃথক। সেই জাতিগােষ্ঠীর স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতার দাবি আন্তর্জাতিক বিধি নীতি ও আইনসম্মত ভারতীয় হিন্দুদের আধিপত্য থেকে মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐশ্লামিক জীবনধারা রক্ষার নামে যদি ভারতবর্ষের মুসলমানেরা পৃথক জাতিত্বের দাবিতে পাকিস্তান সৃষ্টিকে ন্যায় সঙ্গত মনে করেন, তবে পশ্চিম পাকিস্ত নিদের একচেটিয়া শােষণ ও নিরবচ্ছিন্ন দৌরাত্ম থেকে বাঙালির শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা এবং জীবনধারা ও সমাজ রক্ষার জন্য কেন তারা (বাঙালিরা) আলাদা হইয়া যাইতে পারিবেন না এবং স্বাধীন বাঙলা রাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবেন না? বিশেষত ১৯৪০ সালে লাহােরে গৃহীত মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক প্রস্তাব অনুসারে পূর্বদিকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র মুসলিম রাষ্ট্র স্থাপনের কথাই বলা হইয়াছিল। মৌলানা ভাসানী, সুরাবদি প্রভৃতি নেতারা পশ্চিমী একচেটিয়া শাসণের বিরুদ্ধে বারবার সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। অর্থাৎ বর্তমান স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিতান্ত ঐতিহাসিক কারণেই বাঙলাদেশে দেখা দিয়েছে। এটা একদিকে যেমন বাঙালির জাতীয় স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই, তেমনি অন্যদিকে শােষিত ও বঞ্চিত বাঙলার গরীব কৃষক, মজুর, কারিগর এবং সাধারণ মধ্যবিত্তের লড়াই-যে লড়াইয়ের প্রথম সূচনা হয়েছিল ১৯১৭ সালের সােভিয়েত বিপ্লবে। ইতিহাসের মহান নায়ক লেনিন পৃথিবীর দূর্গত ও বঞ্চিত মানুষকে মুক্তির ও গণতান্ত্রিক অধিকারের যে নতুন পথ দেখাইয়া দিয়াছেন, বাঙলাদেশের জনগণের সংগ্রাম তারই ফলশ্রুতি। সুতরাং মুসলিম লীগের অন্ধ ও বিদ্বেষপরায়ণ সদস্যরা বাঙলার এই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সামপ্রদায়িকতার বিষ সঞ্চারে যে চেষ্টা করিতেছেন, সেটা হইতেছে রক্ষণশীলতা ও ধনতন্ত্রের নির্লজ্জ দালালি এবং বাঙলাদেশের সাতকোটি গরীব মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। এই সাম্প্রদায়ীক দালালেরা পূর্ববাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের পিছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা করিতেছে। বিশেষভাবে হিন্দুদের ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ধরাইয়া, দিতেছে এমনকি নারী ধর্ষণে পর্যন্ত সহায়তা করিতেছে। পশ্চিমবঙ্গে যে সমস্ত অ-বাঙালি মুসলমান পলাইয়া আসিতেছে তারাও আবার বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এখানকার মুসলমানদের মধ্যে নানা কুৎসা প্রচার করিতেছে এবং প্রদেশিকতার বিষ ছড়াইয়া দিতেছে। অথচ স্বাধীন বাঙলার এই মুক্তিযুদ্ধ প্রদেশিকতাও নয়, সামপ্রদায়কিতা তাে নয়ই। বরং সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পূর্ণতর গণতান্ত্রিক আদর্শের এই অভিযান।
কিন্তু যারা ইসলামের রক্ষক, তারা কিভাবে তাঁদের স্বজাতীয় মুসলমানদের ক্ষক হইয়া উঠিয়াছে, পশ্চিমের সেই নর-রাক্ষসদের চেহারা, চরিত্র ও কার্যাবলীতে আর গােপন নাই। তামাম দুনিয়ায় সেই বীভৎস কাহিনি প্রচারিত হইয়াছে। পূর্ব বাঙলার মুসলিম নেতারা, প্রক্তন পাক কূটনীতিকরা (কলিকাতায়, দিল্লিতে, লন্ডনে, নিউ ইয়র্কে) জ্বলন্ত ভাষায় সেই বর্বরতার বর্ণনা দিয়াছেন, এগুলাে তাে হিন্দুদের বানানাে নয়। সভায় মৌলানা ভাসানী যিনি সেদিন পর্যন্ত ভারতবিরােধী এবং চীনের প্রেমিক ছিলেন, তিনি এখন কি বলিতেছেন? তাঁর নিজের মুখের জবানিতেই শুনুন:
যান ইয়াহিয়া ও তার বর্বর সৈনিকরা ধর্মের দোহাই তুলিয়া আজ মুসলমান নারী সহ, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর ধর্ম বিনষ্ট করিতেছে, মুসলমান হইয়া অসংখ্য মসজিদ বিনষ্ট করিতেছে, নামাজ পাঠরত মুসলমানকেও হত্যা করতে কুণ্ঠাবােধ করিতেছে না, মানবতা বিরােধী এই সব কাজের জন্য মুসলিম বিশ্ব কি ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে? তাহারা কি ইয়াহিয়ার অ-ঐশ্লামিক মানবতা কিরােধী জঘন্য কার্যক্রম সমর্থন করিবেন? নাকি জালেমেরে বিরুদ্ধে মজলুমের পক্ষে দাঁড়াইয়া মহান ইসলাম ধর্মের সত্য, ন্যায়, প্রীতির প্রতি সমর্থন জানাইবেন? গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে বাঙালির প্রশ্ন গণতন্ত্র হত্যার এই মারণযজ্ঞে তাঁহারা কি ইয়াহিয়াকে সমর্থন জানাইবেন, না পাকিস্তানের আভ্যন্তরিক ব্যাপারের বাজে অজুহাতে নিরপেক্ষ থাকিয়া বর্বর অত্যচারকেই পক্ষান্তরে সমর্থন করিবেন?
মৌলানা ভাসানি আরও বলেন পাকিস্তানের মূল ভিত্তিকে নস্যাৎ করিয়া দিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসন ও শােষণ রাখার মূল ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কতিপয় মুখচেনা বাঙালি দালালদিগকে নানা প্রলােভনে হাত করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানি সামন্তপ্রভু, পুঁজিপতি পূর্ব বাঙলার ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের সংগ্রামকে বারবার নস্যাৎ করিবার মুখে পাকিস্তানি বর্বরতা সম্পর্কে এই ভাষ্য। পৃথিবীর চিন্তাশীল লােকেরা এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ই জাতিতত্ত্ব, আর পাকিস্তানকে অবাস্তব এবং বিজ্ঞান বিরােধী বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। একমাত্র ধর্মই জাতিত্বের ভিত্তি হইতে পারে না, তাহলে সারা ইউরােপ এবং আমেরিকা এক দেশ এবং এক রাষ্ট্র হইত। এদিকে এশিয়া খণ্ডে মালয়েশিয়া এবং আফগানিস্তান ও মুসলিম হিসাবে পাকিস্তানরূপী আজব রাষ্ট্রের -যে রাষ্ট্রের দুই অংশের মধ্যে সহস্রাধিক মাইলের ব্যবধান— তার অন্তর্গত হইত। কিংবা আফ্রিকার ও আরব দেশের মুসলিম রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে ক্রমাগত বিরােধ ও মারামারি লাগিয়া থাকিত না। অতএব, পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতের এবং এপারে ওপারে তার দালালেরা হালে পানি না পাইয়া যে সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্র ধরিতেছেন, সেই অস্ত্র একদিন তাদের ঘাড়েই পড়িবে।
আমরা বামপন্থী মতবাদে এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। মধ্যযুগীয় বিশ্বাস ও আচরণ, সাম্রাজ্যবাদ সামপ্রদায়কিতার আমরা ঘােরতর বিরােধী। আমরা বিশ্বাস করি বাঙলাদেশে যে সংগ্রাম শুরু হইয়াছে, তা সাধারণ মানুষের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙলার নিজস্ব স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ। এমন কি সামপ্রদায়িকতার মূল্যচ্ছেদের এতবড় যুদ্ধ আর কখনও অনুষ্ঠিত হয় নাই। আমরা নিশ্চয়ই দুই বাঙলা এক করিতে চাই না। পূর্বদিকের এক ইঞ্চি জমিও আমরা ভারত সীমানার অন্তর্গত করিতে চাই না। আমরা চাই পূর্ব বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ ধর্ম বর্ণ ও সমপ্রদায় নির্বিশেষে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করুক এবং দুই বাঙলার মধ্যে দুই ভাই এর স্বভাবিক সম্পর্ক ও আদান প্রদান প্রতিষ্ঠিত হােক। এটা গণতন্ত্রের দাবি ও মানবতার দাবি। যারা এর বিরােধীতা করিতেছে এবং গণমুক্তি সংগ্রামের প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা করিতেছে, তাদের সঙ্গে একদিন মােকবিলা করিতেই হইবে। সুতরাং তারা সাবধান।
সূত্র: সপ্তাহ, ৩০ এপ্রিল ১৯৭১