You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.18 | ঢাকা থেকে দীর্ঘ পথ... যূথিকা চট্টোপাধ্যায় | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকা থেকে দীর্ঘ পথ…
যূথিকা চট্টোপাধ্যায়

ঢাকা জেলার কালীগঞ্জ থানায় কালীগঞ্জ শ্রমিক কলেজ’ -এ তর্কশাস্ত্র (লজিক) বিভাগের অধ্যাপিকা ছিলেন শ্ৰীমতী যূথিকা চট্টোপাধ্যায়। হাজার হাজার শরণার্থীর সঙ্গে উনি ওঁর পরিবারসহ পদব্রজে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এসে পৌঁছেছেন। ঐ পদযাত্রার বিবরণ এই লেখায় লেখায় পাওয়া যাবে। আর পাওয়া যাবে ইয়াহিয়া বাহিনীর নৃশংস তাণ্ডবের মুখে মুক্তিসংগ্রামীদের দৃঢ় প্রত্যয়ের সম্যক পরিচয়। সম্পাদক, সপ্তাহ।
শস্যশ্যামলা বাঙলা মায়ের কোল ছিটকে ভারতের শরণার্থী খাতায় নাম লিখে আজ ভাবছি বাঙলার ঘরে ঘরে শান্তিপ্রিয় সাড়ে সাত কোটি বাঙালি কী চেয়েছিল আর কী পেয়েছে? ১৯৬৯ সালের দুর্বার গণআন্দোলনের মুখে যেন কুচক্রী আয়ুব সরকার পিছু হটে গিয়েছিল সেদিনই বাঙালিঘাতক ইয়াহিয়া সরকার এসেছিল শান্তির দূত সেজে। আজকের বেইমান সেদিন ঘােষণা করেছিল যে “দেশে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই আমার আগমন আর দেশে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলেই জনপ্রতিনিধিদের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দিয়ে আমি সরে পড়ব।”
বাঙলার সরলপ্রাণ মানুষগুলাে সেদিন সত্যি সত্যি ভুলে গিয়েছিল শয়তান ইয়াহিয়ার মিষ্টি বুলিতে আর সেই থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে সে দিনটির জন্য।
সুচতুর ইয়াহিয়াও সুপরিকল্পিতভাবে এগুতে লাগলেন। দেশে সাধারণ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হলাে ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগ শতকরা ৯৮ ভাগ ভােট পেয়ে সমগ্র দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে পেল স্বীকৃতি। ধাপ্পাবাজ ইয়াহিয়া জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রনেতা হিসাবে ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান জনালেন। আজকে সবাই জানেন যে, সে অধিবেশন আর বসেনি। তিনি সময় বাড়িয়ে দিলেন, অর্থাৎ শান্তিপ্রিয় সাড়ে সাত কোটি বাঙালির উপর মরণকামড় হানার জন্য রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া-সৈন্যের প্রস্তুতির কিছুটা বাকি হয়তাে তাই- ২৪ মার্চ পর্যন্ত চলল ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে জঘন্য ষড়যন্ত্র।
২৫ মার্চ আমার এক প্রােগ্রাম ছিল ঢাকা যাওয়ার। আমাদের বাড়িটা ঢাকা থেকে ২৫ মাইল দূরবর্তী নরসিংন্দী এলাকায়। ভাবলাম বিকেলের ট্রেন ধরে যাব কিন্তু সৌভাগ্যবশত ট্রেনখানা ধরতে পারিনি। যাক, রাত ৪টার ট্রেন এ যাব বলেই স্থির করলাম, আর ভােররাতে উঠতে হবে ভেবে একটু ভালাে করেই নিদ্রাদেবীর কোলে বিশ্রাম নিয়েছেলাম কিন্তু কোন ট্রেনও আর আসল না, ঢাকাও আর যাওয়া হলাে না।
২৫ মার্চ রাতের আঁধারের বুক চিড়ে সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালির উপর ট্যাঙ্ক, কামান আর মেশিনগান নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বর সেনাদল। আর সেই সাথে শয়তান ইয়াহিয়া আর তার মন্ত্রণাদাতা ভুট্টো টিক্কা খানের হাতে বাঙালি নিধনযজ্ঞের ভার দিয়ে শেষ রাতের প্লেনে ঢাকা ছেড়ে পালাল চোরের মতাে।
একটা দুঃস্বপ্নে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। রাতের নির্জনতা ভেদ করে কানে আসতে লাগল কামান আর মেশিনগানের অনবরত গর্জন। ঘড়ির দিকে তাকালাম, রাত তখন দুটো। দরজা খুলেই আন্দাজ করতে পারলাম যে ঢাকা শহরের বুকেই চলছে ধ্বংসের এক তাণ্ডবনৃত্য। | ঢাকা যাওয়ার চিন্তার তাে সেখানেই সমাপ্তি ঘটলাে। অস্বস্তিতে বাকি রাতটুকু কাটল। স্টেশনের ধারেই ছিল আমাদের বাড়ি, জানলাম রাতে কোন-ট্রেনই নাকি আর চলাচল করেনি। ভাের হতে না হতেই স্টেশনে গিয়ে বসলাম। দলে দলে লােক জমা হতে লাগল, সবাই যেন কিছু একটা শােনার প্রতীক্ষায়। সমস্ত পরিবেশটাই যেন থমথমে, কারাে মুখে তেমন কথা নেই, কেবল দূর থেকে ভেসে আসছে থেকে থেকে কামানের গর্জন।
প্রতিটি বাঙালি সেদিন আশা করেছিল যে ইয়াহিয়ার কাছ থেকে শুনবে এক শান্তির বাণী, সমঝােতার বাণী। কিন্তু তার বদলে পেল সর্বপ্রকার আধুনিক সমরসাজে সজ্জিত ইয়াহিয়া বাহিনীর বর্বরােচিত আক্রমণ। আর তাই ঘুমের মধ্যে থেকেই প্রাণ দিতে হলাে ঢাকা শহরের শত শত বাঙালিকে। ( ২৬ মার্চ সকালে ঘঘাষিত হলাে ইয়াহিয়া প্রদত্ত সামরিক নির্দেশাবলী। আর তারি সাথে গর্জে উঠল গ্রামবাঙলার ঘরে ঘরে প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাঙালি। নিজেকেও সেই মুহূর্তে সামলাতে পারিনি, তাই বেরিয়ে পড়লাম জনতার এক মিছিল নিয়ে। ভাবলাম দূর গ্রামবাঙালার ঘরে ঘরে ইয়াহিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার সংবাদ পৌঁছে দিয়ে আসি। না, জনতা যে দেখছি আমার চেয়েও সজাগ। চারিদিক থেকে কৃষক, ছাত্র, জনতা সবাই আজ বের হয়েছে মিছিলে, সে যেন এক বিরাট প্রাণের তাগিদ। চোখে মুখে তাদের আগুন। সবাই এক হয়ে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলল। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ভেসে গেল মুক্তিপণ দূর হতে বহু দূরে। তারা আওয়াজ তুলল—মানি না মানি না ইয়াহিয়ার ঘােষণা। বাঙালির, রক্ত বৃথা যেতে দেব না। কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধর, বাঙলাদেশ স্বাধীন কর। স্বাধীনতার সংগ্রাম চলবেই চলবে।
কিন্তু পশ্চিমা বর্বরদের কাছে সে ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়েই সেদিন ফিরে এল । চারিদিকের শহরগুলােতে চলল নরখাদক ইয়াহিয়া সৈন্যের সে কী পৈশাচিকতা। যারা বাঁচতে পারছে তারা শুধু প্রাণ নিয়ে পালাতে শুরু করেছে গ্রামের দিকে। ভেবেছিল বুঝিবা হানাদার দস্যুরা গ্রামে আর ঢুকবে না। দিন যতই কাটতে লাগল হানাদাররা যে আরাে জঘন্যতম হয়ে উঠলাে। নিস্পাপ শিশুরাও রেহাই পায়নি। অবলা নারীদের উপর চালিয়েছে একদিকে হত্যাকান্ড আর একদিকে অকথ্য নির্যাতন।
১ এপ্রিল। কাছাকাছি স্টেশনগুলােতে রেল লাইন তুলে ফেলার এক হিড়িক পড়েছে। আমাদের স্টেশনেও জনতা কোথাও লাইন তুলে নিচ্ছে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে আনমনে সে দৃশ্যই দেখছিলাম। হঠাৎ পিছন থেকে এক চেনা কণ্ঠের ডাক ভেসে এল । পিছনে তাকিয়েই আঁতকে উঠলাম: নিষ্পলক দৃষ্টি নিয়ে দাড়িয়ে আছে রঞ্জন। চোখ দুটি লাল, চুলগুলাে বহন করছে এক রুক্ষতার সাক্ষী, জামা আর প্যান্টে লেগে আছে ছােপ ছােপ কাদা।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আমাদের অনেক আপনজনের ছিল বাস। তার মধ্যে শুধু এক রঞ্জনই পথ পেল খুঁজে, আর তাে কেউ ফেরার পথ দেখেছে সেদিকেই ছিটকে পড়েছে, বর্বরতার মুখে কেউ আর কারাে খোজ রাখতে পারেনি। রঞ্জনকে সকলের কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করলে বলল সে, ২৬ মার্চ বিকাল ৩.৩০টায় শাঁখারিবাজারে প্রথমে কয়েকটি বাসায় ঢুকে গুলি করে। সেই সাথে তাদের বাসায় ঢুকেও গুলি করে তার দাদাকে হত্যা করে যায় পাক-সৈন্য। রঞ্জন বাসার বাইরে ছিল, তাই কারফিউতে আটকে পড়ে যায়। সারা রাতের জন্যও আর বাসায় ফিরতে পারেনি। পরদিন কারফিউ ভাঙলে পর বাসায় ফিরে প্রাণপ্রিয় দাদার মৃতদেহ মেঝেতে লুটিয়ে থাকতে দেখে। অনেক আঘাতেও নিজেকে শক্ত করল। কারণ তখন যে বাঙালির কাঁদবারও সময় নেই। লাস ঘরে রেখেই পরিবারের অন্যান্যদেরকে নিয়ে শাঁখারিবাজারের বাসা ছাড়ল এবং সবাইকে নিয়ে অন্যত্র রাখল। কিছুক্ষণ পরই অবশ্য তাদের গােটা এলাকাটা কামান দেগে খানখান করে দেওয়া হয়। জনপূর্ণ পুরাে এলাকাটা পরিণত হলাে এক প্রেতপুরীতে আর ঘরে ঘরে কত ছােট ভাই হারাল তার দাদাকে, মা বাবা হারাল তাদের সন্তানকে, স্ত্রী হারাল স্বামীকে—কে তার হিসাব রাখে? যাক রঞ্জন এখানে সেখানে রাত কাটাত আর লুকিয়ে একবার করে মা-বাবা-বৌদির সাথে দেখা করত। কিন্তু তাদেরকে সেই প্রেতপূরী ঢাকার শহর থেকে বের করে আনার পথ সে খুঁজে পায়নি। তার আগে নিজেই ধরা পড়ে গেল সেই পাকসেনাদের হাতে। সাথে ছিল তার আরেক বন্ধু কালিদাস। দুজনকেই নিয়ে এল বহুপরিচিত জগন্নথ কলেজের এক রুমে। সারাদিন আরাে অনেককেই এনে জমা করল। সেদিন ছিল ৩১ মার্চ। কুচক্রী ইয়াহিয়া আবার তখন চালাচ্ছিল এক নতুন পথে বাঙালি হত্যা। সারাদিন কারফিউ বাতিল করে দিত ঠিকই কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় এভাবে অনেককে জমা করে রাতের আঁধারে লাইন করে তাদের উপর চালাত মেশিনগান। সেদিন জগন্নাথ কলেজের ২৩ নম্বর রুমে এমনিভাবে ৩৫ জন হতভাগ্যকে ধরে আনল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন ছাড়া পেয়ে গেল, কারণ তাদের সাথে খাজা খয়রুদ্দীনের সই-করা পরিচয়পত্র ছিল। অর্থাৎ তারা নিজেদের ইয়াহিয়ার পাচাটা দালাররূপে জাহির করতে পেরেছিল। বাকি রইল আর ৩৩ জন। সারাদিন তাদেরকে একই রুমে আটকে রাখা হলাে। আর এদিকে কিছুক্ষণ পর পর তাদের গার্ড পরিবর্তিত হলাে। রঞ্জনের হাতে ছিল ২টা আংটি, ঘড়ি এবং ২২ হাজারের মতাে টাকা। লােভী দস্যুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সব কিছুই সে নিঃশেষ করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলাে না ভেবে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাগ্যের হাতে ছেড়েই বসে রইল। এদিকে গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে ৬টা বেজে গেল। আবার শুরু হবে সান্ধ্য আইন আরােপ করে রাতের আঁধারে হত্যাকাণ্ডে ।
ঠিক এমনি সময়ে সে রুমে উপস্থিত হলাে সামরিক বাহিনীরই কোন উচ্চপদস্থ অফিসার; লম্বা-চওড়া সুন্দর চেহারা। হঠাৎ রঞ্জনের চোখে চোখ পড়তেই মনে হলাে একটু থমকে গেল। জানি না হয়তাে বা তার নির্দোষ মুখখানা অফিসারের মনে দাগ কেটে গেল। রঞ্জনের কাছে এসে দাড়াল। বিভিন্ন প্রশ্ন করল। যেমন কী করতে? কোথায় যাচ্ছিলে? ইত্যাদি। হয়তাে বা তার সাথে কথা বলে মনে কোন আলােড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। কথা অবশ্য সব উর্দুতেই হয়। রঞ্জনও ভালাে উর্দু বলতে পারত। জানি না কী ভেবে অফিসারটি তাকে নির্ভয় হতে বলল। যথাসময়ে তাদেরকে রুমের বাইরে আনা হলাে। চারিদিকে অন্ধকার। জগন্নাথ কলেজ আর ঢাকা কোর্টের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তা তারই মােড়ে সবাইকে আনা হলাে। এদিকে কায়দা করে অফিসারটি রঞ্জনকে সবাইর পিছনেই রেখেছিল। তখনই অন্য দুজনকে কী একটা বলল এবং তিন জনে মিলে সামরিক কায়দায় তাকে অন্যান্যদের লইন থেকে আলাদা করে ফেলল এবং পাশেই একটা বাগান ছিল তাতে ঢুকিয়ে দিল। আর মুহুর্তেই দুদিক থেকে মেশিনগান গর্জে উঠল, লুটিয়ে পড়ল ৩২ জনের দেহ।
নিজে বাঁচল ঠিকই কিন্তু বন্ধুকে চিরদিনের জন্য হারাল। ওর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তের দুটি শব্দ রঞ্জনের কানে ভেসে আসল “জয় বাঙলা” “জয় পাখতুনিস্তান”। শেষ হয়ে গেল সব। রঞ্জন আর ভাবতে পারে না। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলিয়ে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকল সেই বাগানে। উপরে টিপটিপ বৃষ্টি, তার নীচে কাদা। সারা রাত তেমনি থেকে ভাের হলে পর পালিয়ে সােজা শহর ছেড়ে চলে আসল আমাদের বাড়ি। পরিবারের আর কারাে খোঁজ নেওয়া আর তার হলাে না— আজ পর্যন্ত বেঁচে আছে কিনা তাও সে জানে না। সব হারিয়েও আজ আমাদের দুঃখ নেই ; কারণ ২৩ বৎসরের শােষিত মাকে নরখাদক পিশাচদের হাত থেকে মুক্ত করার নেশায় আজ আমরা মেতেছি আর এর জন্য যে চাই প্রচুর ত্যাগ।
(ক্রমশ)

সূত্র: সপ্তাহ, ১৮ জুন ১৯৭১