You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকা থেকে লিখছি
সুধাময় কর

নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ঢাকা শহর স্বাধীনতার আলােকে এক নতুন রূপ নিতে শুরু করেছে। সর্বত্র এক প্রাণচাঞ্চল্য ও উদ্দীপনার ছাপ ফুটে উঠেছে। দিকে দিকে আনন্দের প্রাণবন্যা। বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাবেন এ সংবাদে শহর যেন হঠাৎ এক নতুন রূপ নিল। চারিদিকে জয় বাঙলা ধ্বনির সাথে বুলেটের অবিরাম আওয়াজ। রাতের শীতকে উপেক্ষা করে মিছিল নেমে গেল পথে পথে। কেউ বা বাদ্য নিয়ে শুরু করেছিল আনন্দনৃত্য। অনেকেই ছুটে গিয়েছিল ধানমণ্ডিতে শেখ সাহেবের বাসভবনে। সেখানে যেন এক মহ হুলুস্থুল কাণ্ড । দেশি-বিদেশি সাংবাদিক আর টিভি ক্যামেরায় ভিড়ে যে ব্যাপারটা স্টষ্ট হয়ে উঠেছিল তা হলাে মুক্তিপাগল মানুষের মনের আবেগ। সে আবেগের প্রথম ধাক্কা সামলে উঠে অনেকেই নতুন করে ভাবলেন—পাকিস্তানি জঙ্গীচক্রের ধাপ্পাকে বিশ্বাস করতে চাইলেন না। শেখ সাহেবকে নিজেদের মাঝে না পেয়ে কেউ যেন নিশ্চিত হতে পারছে না।
ঢাকায় সাইনবাের্ডগুলাে ইদানীং বেশ নতুন চেহারা পেয়েছে। যেখানে পাকিস্তান’ শব্দ ছিল সেখানটায় কাগজ এঁটে দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও অন্য রং দিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে। কাগজে বাঙলাদেশ লিখে পাকিস্তান শব্দের উপর বসিয়ে দেবার নমুনাই বেশি। স্থানীয় দৈনিকগুলােতে প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নতুন নামকরণ অর্থাৎ পাকিস্তান শব্দকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ রাখার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হচ্ছে। সাইন বোের্ড লেখার দোকানগুলােতেও নতুন করে লেখাবার ভিড় লেগেছে। গাড়ির নাম্বারও আবার বাঙলার লেখা শুরু হয়েছে। সামরিক জান্তা ইংরেজিতে নাম্বার লেখাতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও জিন্নাহ্ অভিনিউতে (যার নাম এখন রবীন্দ্ৰ বীথি রাখার কথা অনেকেই ভাবছেন) পাক-সােভিয়েত মৈত্রী সমিতির পাঠাগারের সাইনবাের্ডটা সদম্ভে এখনও অবস্থান করছে। আর শত্রু সম্পত্তি’ শব্দের উপর কাগজে লেখা মিত্র শােভা পাচ্ছে।
ঢাকার অবাঙালিদের প্রতি অবহেলা করা হচ্ছে বলে বিশ্বের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বেশ শােরগােল শুরু করেছিল। কিন্তু বাঙলাদেশে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের প্রধান সেসব খবরের অসত্যতা সম্পর্কে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বাঙলাদেশ সরকার অবাঙালিদের এলাকায় পর্যাপ্ত রেশন ও নগদ টাকা দেবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রথম থেকেই গ্রহণ করেছেন। মহম্মদপুর এলাকায় যেখানে অন্যান্য এলাকা থেকে অবাঙালিরা এসে জড়াে হয়েছে সেখানে সপ্তাহে প্রায় ৮০০ মণ আটা ও ১৭০০০ টাকা দেয়া হচ্ছে। সে এলাকাটিকে তিনটি ক্যাম্পে ভাগ করে সুষ্ঠু বিলির জন্য সরকার অফিসার নিয়ােগ করেছে। মীরপুর প্রভৃতি এলাকাতেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিদেশের অনেক সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তি সে এলাকা নিজ চক্ষে দেখে প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রচারের অসারতা অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। এঁদের মধ্যে ভারতের লােকসভার তিনজন সদস্য গতকাল মহম্মদপুর এলাকা পরিদর্শন করেছেন। তাঁরা নিজেরাই সে এলাকা ঘুরেছেন। সেখানে অবস্থানরত অবাঙালিদের সাথে তাদের আলাপ আলােচনাও হয়েছে। আলােচনায় অনেকেই ভারতে ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে, কারণ তারা এখন বাঙলাদেশ বা পাকিস্তান উভয় স্থানেই উদ্বাস্তু। তাই তাদের আদি নিবাস বিহার, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে ফিরে যেতে আগ্রহী। কেউ কেউ আবার পাকিস্তানে চলে যাবার মতাে পােষণ করে। কিংবা অন্য কোন রাষ্ট্রে। ভারত কিংবা বাঙলাদেশে কিছুতেই থাকবে না।

সূত্র: সপ্তাহ, ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!