You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজনীতি আর ক্রিকেট
একাত্তরে পাকিস্তানী ক্রিকেট টিমের সাথে আইয়ুব খান লন্ডনে
শেষ রক্ষা হয়নি। ক্রিকেট টিম সম্পর্কে অনেকগুলো ঘটনা জানা যায়। তাদের বিরুদ্ধে বাঙালীরা বিক্ষোভ করতে থাকে। একটি ঘটনা নীচে বর্ণিত হল –

পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে লন্ডনে প্রবাসীদের বিক্ষোভ।
::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
টেন্টম্যাচ খেলতে পাকিস্তান ক্রিকেট দল গেছে ইংল্যান্ডে। লন্ডনের অভিজাত মে ফেয়ার এলাকায় ডার্টমাউথ হাউসে ইংলিশ স্পিকিং ইউনিয়নের সদর দফতর। সেখানে পাকিস্তানী ক্রিকেটারদের সম্মানার্থে এক নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু, ভেতরে কেউ ঢুকতে পারছেন না। প্রায় এক হাজার বাঙালি ভেতরে ঢােকার পথ বন্ধ করে রেখেছে। তারা শ্লোগান দিচ্ছে ‘খুনিরা আমাদের মা-বোনদের হত্যা করছে।’ পরে ৫০ জন পুলিশ এসে মনিবঢাল তৈরি করে ক্রিকেটারদের ভেতরে নিয়ে যায়। খবরের কাগজের প্রতিবেদন অনুযায়ী ধর্মঘটিদের একজন নেতা শামসুল আলম বলছিলেন, “যেখানে যেখানে খেলা হবে সেখানে সেখানেই আমরা প্রতিবাদ জানাব। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশের অবস্থা আরো খারাপ।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের অধিকাংশ চেয়েছি শান্তিপূর্ণ অবস্থান করতে। কিন্তু আবেগ চেপে রাখা যাচ্ছে না। এই ক্রিকেটারদের প্রত্যেকে পশ্চিম পাকিস্তানী । সব সময় তাই ছিল। কখনও তারা বাঙালিদের টেস্ট টিমে নেয়নি। তবে, ক্রিকেটাররা যদি তাদের প্রেসিডেন্টের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান তাহলে তারা আর কিছু করবেন না। না করলে দক্ষিণ আফ্রিকা গতবার খেলতে এসে যেমন প্রতি পলে পলে বাধা পেয়েছে, এখন অবস্থা তার চেয়ে খারাপ হবে।”পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১৫ জনকে গ্রেফতার করে। বিভিন্ন অপরাধের জন্য ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। কিন্তু, ধর্মঘটিদের সেখান থেকে সরাতে পারেনি। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ সালে।পাকিস্তানী ক্রিকেটাররা যেখানেই খেলতে যাচ্ছিলো বৃটেনে সেখানেই বাঙালিরা প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন বা বিক্ষোভ সমাবেশ করছিলেন। ওরচেষ্টারে পাকিস্তানী দল খেলতে গিয়েছিল। সকাল থেকেই মাঠের বাহিরে অপেক্ষা করছিল বাঙালিরা। মধ্যাহ্নভোজের সময় তারা মাঠের বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। তারা চিৎকার করে বলছিল ‘আউট আউট আউট।’ দি অবজার্ভারের প্রতিবেদক জানিয়েছেন, এই বিক্ষোভ মিছিল ছিল শান্ত। প্রায় ৬০০ বাঙালি ছিলেন সেখানে। পরে লন্ডন থেকে একবাস ভর্তি বাঙালি এসে যোগ দেন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে। বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির বার্মিংহাম শাখার সভাপতি জগলুল পাশা প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করব বলে জানিয়েছি এবং তাই করছি। আমরা ব্রিটিশ জনগণের সমর্থন চাই। বিক্ষোভকারীরা গণহত্যার ছবি সম্বলিত লিফলেট বিলি করছিলেন। লিফলেটের শিরোনাম ছিল- ‘Can you play cricket on their graves? ৫ মে এজবাস্টনেও বার্মিংহাম অ্যাকশন কমিটি বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভকারীদের ব্যানারে লেখা ছিল ‘বয়কট দ্য প্রচারস’। জগলুল পাশা জানিয়েছিলেন, বৃটেনের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিবাদ জানাতে বাঙালিরা এসেছিলেন এবং সে সংখ্যা প্রায় ২০০০ মতো হবে। প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ইকোনোমিস্ট এইসব বিক্ষোভ মিছিলের বিরোধিতা করেছিল। ইকোনোমিস্টের মতে, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে এর আগে বিক্ষোভ হয়েছে, সে খেলা হয়নি কারণ এর পিছে জনসমর্থন ছিল। বিরোধী লেবার পার্টি এর বিরোধিতা করেছিল। সবধরনের মানুষ এর বিরোধিতা করেছিল যারা মেধার ভিত্তিতে নয় বর্ণের ভিত্তিতে ক্রিকেট টিম গড়েছিল। এখন ক্রিকেটের বিরুদ্ধে তেমন অসন্তোষ নেই। পত্রিকা বলছে, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তাতে বাঙালিদের ক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু বৃটেন কেন তাতে যোগ দেবে? আর পাকিস্তানী ক্রিকেট দলকে বর্ণের ভিত্তিতে হয়নি মেধার ভিত্তিতে হয়েছে। সরকারও এইসব বিক্ষোভকে পাত্তা দেবে না।তবে ইকোনোমিক্টের অনুমান ভুল হয়েছিল। ক্রমেই বৃটেনের জনসমর্থন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। আর পাকিস্তানী দল যে মেধার ভিত্তিতে গড়া হতো তাও নয়। এখানেও বৈষম্য ছিল।জুন মাস। পাকিস্তান ক্রিকেট টিম ইংল্যান্ডে। তারা যেখানেই খেলতে যাচ্ছেন সেখানেই বাঙালি প্রতিবাদকারীদের মুখোমুখি হচ্ছেন। এ সময় তারা আবার জড়িয়ে পড়লেন আরেক বিতর্কে। এজবাসটনে খেলা হবে। বার্মিংহামের লর্ড মেয়র এক অভিনব পরিকল্পনা নিলেন। দুই দলের সদস্যরা দুটি ব্যাটে সই করবেন এবং তা নিলামে বিক্রি করা হবে। যে অর্থ পাওয়া যাবে তা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য দান করা হবে। ইংল্যান্ড দল বিনাবাক্যব্যয়ে সই করে দিলেন। পাকিস্তানের খেলোয়াররাও রাজি। কিন্তু বাদ সাধলেন দলের ম্যানেজার। তিনি জানালেন হাই কমিশনারের মতামত নেবেন তারা আগে। হাই কমিশনার সালমান আলী জানালেন, এইসব রাজনীতির ব্যাপারে খেলোয়ারদের না জড়ানোই উত্তম। খেলোয়াররা সই করলেননা। মেয়র দুঃখ করে বললেন, যে অমানবিক কর্মকাণ্ড চলছে তার বিরুদ্ধে একটি নিরপেক্ষ স্ট্যান্ড নেয়ার সুযোগ ছিল খেলোয়ারদের যা তারা গ্রহণ করলেন না। অন্যদিকে ইয়ং লিবারেলর্সের পলিটিকাল ভাইস চেয়ারম্যান সাইমন হেডিচ এক বিবৃতিতে জানালেন ”This narrow minded inhuman attitude of the Pakistan High Commission only reinforce the view of these East Bengalis who see this cricket tour as a monstrous facade to the atrocities being committed by West Pakistan.”

সূত্র :
দি অবজারভার, ২.৫.১৯৭১।
দি মর্নিং স্টার ৬.৫, ১৯৭১।
দি ইকোনমিস্ট, লন্ডন, ৮.০৫.১৯৭১।
সংগ্রামের নোটবুক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!