টিটোর স্বাধীনতা
নাসির উদ্দীন ইউসুফ
প্ৰচণ্ড বেগে বইছে ঝড়।
মাঝে মাঝে ঝাপটা মেরে তাঁবুটা উড়িয়ে নিতে চায়।
তাঁবুর ভেতর আমরা পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধা। সবাই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি জেগে বসে আছি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাত মুখের সামনে মেলে ধরলেও দেখা যায় না।
তাঁবুর এক কোনায় রাখা হারিকেনটা ঝড়ের দাপটে অনেক আগেই নিভে গেছে।
তাঁবুর সামনের পর্দার ফাক দিয়ে বাইরে তাকালাম।
কিছুই দেখা যায় না। অঝোর ধারায় বৃষ্টি আর প্রচণ্ড বাতাস বাইরের অন্ধকারকে করেছে আরো গাঢ়। একেই বুঝি বলে পাহাড়ি ঝড়।
আমরা যেখানে তাঁবু গেড়েছি সে জায়গাটার নাম মনিঅন্দ।
জায়গাটা বেশ উচু। ঠিক পাহাড় নয়।
অনেকটা মালভূমির মতো । দিনের বেলায় দেখেছি কী সুন্দর সবুজ। এখান থেকে দাঁড়িয়ে নিচের ঘর-বাড়ি আর গাছ-গাছালির মাথার ওপর দিয়ে দেখা যায় তিতাস নদীর রুপালি শরীর।
আমাদের লক্ষ্য ওই তিতাস নদী। পাকিস্তানি মিলিটারির চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের আখাউড়া-ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া সড়ক পেরিয়ে পড়তে হবে তিতাস নদীর বুকে। তিতাসে পৌছলে আর কোনো চিন্তা নেই। কেননা কোনোভাবে দিন সাতেক নৌকা চালিয়ে পৌঁছে যাবো ঢাকা।
আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকা উত্তর অর্থাৎ সাভার-ঢাকা অঞ্চলের পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনীকে খতম করার।
আগস্টের শেষ প্রায়। আমরা বাহান্নজন মুক্তিযোদ্ধা এই উত্তেজনার্পূন কাজে ঢাকা যাবো। ঢাকা যেতে হলে এই মনিঅন্দে আসতে হয়। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় ক্যাম্প রয়েছে। এরা সব খবরাখবর রাখে। এরাই পার করে দেয় মুক্তিযোদ্ধা দলগুলোকে।
আমাদের জন্য সব ঠিকঠাক ছিল।
গত পরশু সন্ধ্যা নাগাদ আমরা ঢাকা কোম্পানির বাহান্নজন এবং ফরিদপুর কোম্পানির একশ’ পঞ্চাশ জন রওনা দিয়েছিলাম। রওনা দেয়ার আগে ক্যাম্প কমান্ডার ক্যাপ্টেন আইনুদ্দীন সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। সঙ্গে দিয়েছেন তিরিশ জন সৈনিক। ওরা নিরাপদে আমাদের পার করে দেবে আখাউড়া-ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া মহাসড়ক।
পার হওয়ার নকশাটি ছিল-দশটি বড় নৌকায় আমরা অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে প্রথমে পার হবো ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া-আখাউড়া রেলসেতু। ওই সেতু পার হলে পানিতে সয়লাব একটি বড় বিলে গিয়ে পড়বে আমাদের নৌকাবহর। ওই বিল আড়াআড়ি পাড়ি দিলে দেখা মিলবে আখাউড়া-ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া মহাসড়ক। ওই সড়কের একটি নির্দিষ্ট সেতুর নিচ দিয়ে আমাদের নৌকা পার হয়ে যাবে তিতাসের বুকে। নকশা অনুসারে আমরা সন্ধ্যার পর নেমে আসা নিস্তব্ধ রাত্রির ঘুটঘুটে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে নিরাপদে পার হয়ে যাই রেলসেতু। নৌকা দশটি আস্তে আস্তে পানি কেটে বিল পাড়ি দিয়ে প্রায় আখাউড়া-ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া মহাসড়কের নির্দিষ্ট সেতুর কাছে পৌঁছে যায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বুকের হৃৎপিণ্ডের টিপটপ শব্দ। আমরা তখনো জানি না কী ভয়াবহ সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সামনে ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাতটি নৌকা। পেছনে আমাদের তিনটি। সেতুর একেবারে কাছে ওরা। হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে গর্জে উঠল শত শত রাইফেল আর মেশিনগান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনের সাতটি নৌকার চারটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কী করবো বুঝতে পারছি না।
তড়িৎ গতিতে বাকি নৌকার মাঝিরা নৌকা ঘুরিয়ে ছুটি দিল। বুঝতে পারলাম আমরা ফাঁদে পড়েছি। যেভাবেই হোক পাকিস্তানিরা আমাদের প্ল্যান আগেই টের পেয়ে মহাসড়ক ও সেতুর ওপর স্থান নিয়েছে। মেশিনগান, রাইফেলের বিরতিহীন গুলি আর মটারের গোলায় আমরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন। সামনের নৌকার মুক্তিযোদ্ধাদের আর্তচিৎকার আর কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। আমরা দ্রুত নৌকা ঘুরিয়ে অথৈ পানির মাঝে জেগে থাকা ছোট্ট একটি মাটির ঢিবির আড়ালে চলে আসি। নৌকা থেকে নেমে সাতার কেটে কেটে নৌকা তিনটিকে আমরা নিয়ে আসি আরো নিরাপদ স্থানে। সারারাত ধরে চলে গোলাগুলি। আমাদের কিছুই করার নেই । পানির ওপর মাথা জাগিয়ে অপেক্ষা করি কখন ভোর হবে। ক্রমেই পাকিস্তানিদের গুলি থেমে আসে। ভোরের আলোতে দেখতে পাই মহাসড়কের সেতু হতে মাত্র ৫০ গজ দূরে আমরা। সেতুর ওপর পাকিস্তানি ঘাতক সৈনিক। চারপাশে সহযোদ্ধাদের লাশ। ক্ষোভ, দুঃখ আর ক্ৰোধে পানির ভেতর সারারাত থাকা শরীরের রক্ত চনচন করে ওঠে। প্রতিশোধ, প্ৰতিশোধ নিতে হবে। তবে এখনই কিছু করতে যাওয়া মানে আত্মহত্যা। প্রথমে ফিরে যেতে হবে ক্যাম্পে। কতজন বেঁচে আছি আমরা। এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। প্রথম কাজ যারা বেঁচে আছে সবাইকে একত্রিত করে ঘাঁটিতে ফেরা। পানিতে নুইয়ে থাকা ঝোপ আর বাঁশঝাড়ের আড়ালে সাঁতার কেটে ক’জন যোদ্ধা ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে জীবিত সবাইকে একত্রিত করে ফেললো। হিসাব করে দেখা গেল চুয়াল্লিশ জন নেই। আমরা বুঝে নিলাম চুয়াল্লিশ জন সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছে। এবার ফিরে চলা। সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পে পৌঁছলাম। উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছিল মনিঅন্দ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা। হতভম্ব, ক্লান্ত, শ্ৰান্ত মুক্তিযোদ্ধারা সবাই দাঁড়ালো সারি বেঁধে ক্যাম্প কমান্ডারের সামনে নতমুখে। সবার চোখে দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। বিষাদ করুণ কণ্ঠে কমান্ডার সান্তুনা দিলেন। তারপর সবাইকে বিশ্রাম নিতে বললেন। আমরা যার যার তাঁবুতে চলে গেলাম। সন্ধ্যার পরপরই মুষলধারে বৃষ্টি নামল, সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। যেন প্রকৃতি রাগে আর ক্ষোভে কাঁদছে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। সাখী হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত দীর্ঘ যাত্রায় পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা বৃষ্টি ও ঝড়ের ঠাণ্ডায় আস্তে আস্তে সবাই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লো।
প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা পর সবাই বিশ্রামের সুযোগ পেয়েছে। আমি জেগে। ঘুম আসছে না। বাইরে প্রচণ্ড ঝড়। অন্ধকারে চোখ মেলে বসে আছি। গত রাতের ভয়াবহ নারকীয় দৃশ্য বারবার চোখর সামনে ভেসে ওঠে। গুলি খাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দেহগুলো নৌকা থেকে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে বিলের কালো পানিতে। ক্ষোভ, দুঃখ আর বেদনায় দম বন্ধ হয়ে আসে। হঠাৎ তাঁবুর সামনের পর্দার ফাঁক দিয়ে আলোর রেখা দেখতে পেলাম। তারপর গাড়ির শব্দ। তাকিয়ে দেখি একটি জিপ এসে দাঁড়ালো আমাদের তাবুর সামনে। কে হতে পারে? রাত কত এখন? গাড়ির দরজা খুলে নামলেন একজন দীর্ঘদেহী মানুষ। দরাজ ও গভীর কণ্ঠে ডাকলেন মানিক, বাচ্চু কোথায় কোথায় তোমরা? কণ্ঠস্বরে বুঝলাম আমাদের দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ। সঙ্গে সঙ্গে পর্দা খুলে বাইরে এসে বললাম, স্যার এই তো আমরা”। তিনি দ্রুত তাবুর ভেতরে ঢুকলেন। পেছনে দেখি ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী। তার পেছনে একজন যুবক ও একটি কিশোর। তাড়াতাড়ি হারিকেন জ্বালালাম। যুবকের গায়ের রং মিসমিসে কালো। কিশোরের গায়ের রং শ্যামলা। চোখ দু’টি ভারি সুন্দর কেমন ভাসাভাসা। ছোট্ট নাক। খালেদ মোশাররফ মাথা নিচু করে গত রাতের সব ঘটনা শুনলেন। তারপর বাইরের অন্ধকারের দিকে মুখ ফিরিয়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম ওর চোখ দিয়ে অশ্রু পড়ছে। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকার জন্য আমি প্ৰস্তুত হতেই তিনি বারণ করছেন। বললেন, “না থাক। সবাই খুব ক্লান্ত, ওরা ঘুমাক। আমি কাল সকালে আবার আসব। তুমি এ দু’জনকে তোমাদের সঙ্গে ঢাকা নিয়ে যাও। এরা দু’জন মানিকগঞ্জের ছেলে’।
ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরী কালো যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এর নাম নিজাম আর ও টিটো’। আমি টিটওর দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালাম। ও কেন যাবে যুদ্ধে? ও কীভাবে করবে যুদ্ধ? কত বয়স হবে ওর? বড় জোর তেরো-চৌদ্দ। সম্বিৎ ফিরে পেলাম খালেদ মোশাররফের ফিরে যাওয়ার শব্দে। বললেন, যাই কাল দেখা হবে’। আমি টিটো আর নিজামকে শোয়ার ব্যবস্থা করে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকাল ৯টা নাগাদ এলেন খালেদ মোশাররফ। আমরা সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালাম সেই দীর্ঘকায় সাহসী মানুষটির সামনে। অনেক কথা বললেন তিনি। সাহস দিলেন। মৃত্যু মানুষের জন্য অবধারিত সত্যটি বারবার বললেন। সবশেষে বললেন, মনে রেখে—স্বাধীন দেশের মানুষ জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবাসে না। স্বাধীন দেশ মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবাসে। জীবিত নয় মৃত গেরিলা চায় স্বাধীন দেশের মানুষ। আমরা ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে। টিটো অবাক বিস্ময়ে শুনছিল কথাগুলো। আমি ওর চোখে প্রত্যয়ের বিশ্বাসের দুতি খেলতে দেখলাম। পরেরদিন সন্ধ্যায় আবার যাত্রা। একই রাস্তা। এবার নিরাপদ। কেননা গত রাতে আমাদের সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এক মরণ আঘাত হেনেছিল পাকিস্তানিদের ওপর। সন্ধ্যার পরপরই আমাদের নৌকা তিনটি আখাউড়া-ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া মহাসড়ক অতিক্রম করে তিতাসের বুকে গিয়ে পড়ল। টিটো আমার নৌকায়। উত্তেজনায় ছটফট করছে। বাইরে বৃষ্টি। ছাইয়ের নিচে আমরা বিশজন। টিটোকে বারণ করলেও শুনছে না। পাটাতনের নিচে আমাদের অস্ত্রশস্ত্ৰ আর বিস্ফোরক। কিছুক্ষণ পরপর দেখতে হচ্ছে কাঠের ফাঁক দিয়ে পানি প্রবেশ করে মেশিনগান, রাইফেল, গ্রেনেড, ডেটানেটরগুলো ভিজছে নাকি! কাঠের ফাঁক দিয়ে নৌকার খোলে যে পানি জমে, তা মাটির খোরা দিয়ে নদীতে ফেলে দেয়ার জন্য পালাক্রমে একেকজন কাজ করছিল। টিটোর জ্বালায় কেউ কাজটি করতে পারছিল না। টিটো একাই কয়েক মিনিট পরপর পানি সেচতে লাগল। রাত গভীর হয়ে আসে। বৃষ্টির ফোঁটা পানিতে পড়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। মাঝি ছ’জন আর দু’জন মুক্তিযোদ্ধা প্রহরী ছাড়া সবাই শুয়ে পড়ে। আমি টিটোকে বললাম শুয়ে পড়তে। টিটো একটু মোড়ামুড়ি করে আস্তে শুয়ে পড়ল। একটু পর টের পেলাম টিটো ঘুমায়নি। ও একটু একটু করে এগিয়ে ছাঁইয়ের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমি ধমকে উঠলাম, “এই টিটো কী হচ্ছে? টিটো উঠে বসে বলল, “আমার ঘুম আসছে না। আপনিও তো ঘুমান নাই’। আমি বললাম, “আমার কথা আলাদা’ তুমি ঘুমাও। টিটো বলল, “না আমার ঘুম হবে না। আমি বাইরে বইসা পাহারা দেই’। আমি আবার ধমক দিয়ে উঠি। টিটো চুপ করে গেল। আমার একটু খারাপই লাগছে। আশ্চর্য এই দেড়দিনে টিটো সম্পর্কে কিছুই জানা হয়নি। আস্তে আস্তে ডাকলাম, ‘টিটো, টিটো”। টিটো তিড়িং করে একলাফে আমার কাছে চলে এলো। মানিকগঞ্জের কোথায় তোমার বাড়ি’? টিটো বলল, “জানেন আমাদের বাড়ির কাছে না একটা নদী। আমি ওই নদীতে কত সাতার কাটছি। কত নৌকা বাইছি’ আবার বকবক শুরু করে টিটো। “জানেন আমি না ফাদ পাইতা ঘুঘু ধরবার পারি’ । আচ্ছা টিটো তুমি কী স্কুলে পড়ো’-আমি জিজ্ঞেস করি। “আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি।” বাড়িতে কে আছে তোমার,? “বাবা-মা আর এক বইনা”। “তুমি এত ছোটো, যুদ্ধ করবে কেমন করে?, “ক্যান। সবাই আপনেরা যেমনে করবেন। আমিও হেইভাবে করুম। “তোমার তো ট্রেনিং নাই’ ‘ওহ। খাড়ান’ । বলেই টিটো একলাফে পাশে রাখা আমার এসএলআর (সেলফ লোডিং রাইফেল) তুলে নেয়। হাতে, “দ্যান শিখাইয়া দ্যান” । আমি আঁতকে উঠি ‘সাবধান টিটো”। চকিতে ওর হাত থেকে রাইফেল নিয়ে নিই। ও নাছোড়বান্দা। আমি ধীরেসুস্থে ওকে রাইফেলের সব কাজ ও চালানোর নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দেই। কোমর থেকে গ্রেনেড খুলে দেখিয়ে দিই কীভাবে দাঁত দিয়ে পিন খুলে হাতের আঙ্গুল দিয়ে লিভারটা চেপে ধরে ছুড়ে মারতে হয় শত্রুর দিকে ।
খুব খুশি টিটো আমার ওপর। বলে, “মুড়ি খাইবেন? আমি কিছু বলার আগেই ও ছালার মুখ খুলে মুড়ি-গুড় বের করে গামছায় করে নিয়ে আসে। মুড়ি চিবোতে চিবোতে জিজ্ঞেস করি, টিটো কেন তুমি যুদ্ধ করবে?’ মুড়ি চিবানো বন্ধ হয়ে যায় টিটোর। ও চুপ করে থাকে। আবার জিজ্ঞেস করি, কী হলো?”। খানিকক্ষণ চুপ থেকে ও খুব নিচু গলায় বলল, “ওই মিলিটারিরা আমার ভাইরে রাইফেলের আগার ছুরি দিয়া খোচাইয়া খোচাইয়া মারছে। আমি গুইনা দেখছি, আটচল্লিশটা ঘা আছিল আমার ভাইয়ের শরীরে। আমি ওগো বেবাকরে মাইরা ফালামু’। আমার মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। টিটো বলে চলে ‘ওরা আমাগো পুরা গ্রাম জ্বালাইয়া দিছে। কয়েকশ’ মানুষ মাইরা আগুন দিয়া পুইড়া ফালাইছে। আমি ওগোরে আগুনে পুইড়া ছাই কইরা ফালামু’। আলো-আঁধারের ভেতর আমি টিটো চোখে আগুনের ফুলকি দেখতে পেলাম। ক্রমে ভোর হয়। আমাদের নৌকা মেঘনা নদীর ওপর। আরো ছ’দিন লাগবে আমাদের ঢাকার উত্তরে সাভার-ধামরাই পৌছাতে। ওখানে ক্যাম্প গড়ে আমাদের অপারেশন চালাতে হবে ঢাকা শহর ও তার আশপাশে।
দিনের বেলায় আমরা সবাই নৌকার ছই-এর নিচে । পাশ দিয়ে পাকিস্তানি গানবোটগুলো গুমগুমা শব্দে চলে যায়। টিটো ছটফট করে ওঠে আমি ওকে চেপে ধরে রাখি। মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী হয়ে সাত দিনের মাথায় আমরা পৌঁছলাম ধামরাই রোহা গ্রামে। গ্রামবাসী ব্যস্ত হয়ে পড়ল আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। নারী-পুরুষ সবাই কুশল জানতে চায়। যেন আমরা তাদেরই সন্তান, অনেকদিন পর ফিরছি বাড়িতে। বাহান্ন জনের জন্য ছিল বাহান্নটি অস্ত্ৰ। টিটো আর নিজাম পরে যোগদান করাতে ওদের জন্য কোনো অস্ত্র ছিল না। টিটোর তাতে ভারি মন খারাপ। আমরা সবাই মিলে ওকে বোঝাই, সবাই তো আর একসঙ্গে যুদ্ধ করবে না। তাই তুমি অন্য কারোরটা নেবে প্রয়োজন হলে”। কিন্তু ও কিছুতেই একথা মানতে চায় না। রোঁহা পৌঁছার পরের রাতে পাকিস্তানিরা খবর পেয়ে আমাদের ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ চালায়। আমরা পাক বাহিনীর আক্রমণের আগেই পেয়ে যাওয়াতে প্ৰস্তুত ছিলাম। মাত্র পনেরো মিনিটের যুদ্ধে পরাস্ত হলো পাকিস্তানিরা। ওদের হাত থেকে দখল করা একটি অস্ত্ৰ হাতে নিয়ে টিটোর সেকি উল্লাস! টিটোকে কখনোই আমরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে দিতে সম্মত ছিলাম না। ওকে দায়িত্ব দেয়া হলো সবার দেখাশোনা করার। বিশেষ করে খাবার-দাবার। একমাসের মধ্যে আমাদের যোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচশ’। দলে দলে গ্রামের যুবক-কৃষকরা এসে যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে। গ্রামের জনগণ দিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রতিদিনের খাবারের জন্য চালডাল,তারি-তরকারি, মাছ। সবার প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য রোহা আর শিমুলিয়ায় আঠি ভাওয়ালে খোলা হলো ট্রেনিং ক্যাম্প। একদিকে প্রশিক্ষণ, অন্যদিকে শক্রর ওপর হামলা। খুব অল্প সময়ে আমরা ঢাকা-সাভার-আরিচা সড়কের দু’পাশের অঞ্চল দখলে নিয়ে নিলাম ।
দেখতে দেখতে আমাদের যোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়াল নয়শ’। শিমুলিয়া ক্যাম্পে টিটো ভীষণ ব্যস্ত। প্রায় পাঁচশ’র মতো মুক্তিযোদ্ধা। দম ফেলার সময় নেই। ভোর পাঁচটা হতে রাত দশটা অবধি ওর কাজ। খাওয়া-দাওয়া ছাড়াও সবার খবরাখবর নেয়া, আহত বা অসুস্থ যোদ্ধাদের সেবা-সব টিটোকে ছাড়া কারোরই চলে না।
গ্রামের সব জেলে রাতে কালিগঙ্গায় জাল ফেলে মাছ ধরে নিজের সংসারের জন্য যৎসামান্য রেখে বাকি সব দিয়ে যায় টিটোর হাতে, ভোরের আলো ফোটার আগে। দূর-দূরান্তের কৃষকরা মাথায় করে বয়ে নিয়ে আসে নিজের ক্ষেতের তারি-তরকারি, ঘরের চাল-ডাল। টিটোকে হিসাব রাখতে হয় সবকিছুর। কে কী খায় না খায়।
যে টিটো ক’দিন আগেও আমার ছায়ার মতো লেগে থাকতো তার এখন আমার সঙ্গে কথা বলার সময় থাকে না । মাঝে মাঝে এসে আমার পাশে বসে। কীভাবে অপারেশন করলাম। ক’জন পাকিস্তানি সেনা খতম করেছি, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে। অপারেশনের গল্প বলার ফাঁকে দেখেছি ওর চোখ থেকে ঠিকরে বেরুতো আগুন। মাঝেমধ্যে আমি অপারেশনে যাওয়া থেকে বিরত থাকতাম ইচ্ছে করেই। অনেকটা ছুটি কাটানোর মতো। টিটো আগেই টের পেয়ে যেতো আমার হাবভাব দেখে ।
সন্ধ্যার পরপরই টিটো কাজকর্ম শেষ করে ফেলতো। তারপর হাঁড়িতে করে জ্বলন্ত কয়লা এনে আমার সামনে রাখত। শীতের রাতে জ্বলন্ত কয়লার আঁচে হাত সেঁকতে খুব আরাম। আঁচে হাত সেঁকতে সেঁকতে টিটোকে গল্প শুনাতাম বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের। টিটো তার ছোট্ট চোখ দুটো মেলে অবাক হয়ে শুনতো। একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি স্বাধীনতা বোঝ’? ও একটু ইতস্তত করে বলল, “হ সবাই কয় দেশ স্বাধীন হইলে সবাই নাকি সুখে থাকব। ভাত-কাপড়ের অভাব হইব না। দেশ থিক্যা অশান্তি দূর হইব। আইচ্ছা আমি স্বাধীনতা দেখুম না? নিশ্চয়ই দেখবোঁ বলি আমি। ‘হ নিশ্চয় দেখুম”। অক্টোবরের মাঝামাঝি একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ দূরের গ্রামের ক’জন গ্রামবাসী ছুটে এলো। বেশকিছু রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনারা এসে ওদের গ্ৰাম লুট করছে। তৎক্ষণাৎ তিরিশজনের একটি দল ছুটল। টিটোও ওদের সঙ্গে, হাতে রাইফেল। আমি ক্যাম্পে ছিলাম না। নয়ারহাট গিয়েছিলাম। ঘাটের দু’পাশে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে। ফেরার পথে দেখি টিটো দৌড়াচ্ছে দ্রুতগতিতে, হাতে রাইফেল। সামনে কয়েকটা রাজাকার দিগ্বিদিক জ্ঞানহীন দৌড়াচ্ছে। আমি চিৎকার করে ডাকলাম, টিটো, টিটো। কে শোনে কার কথা। হঠাৎ ক’টা রাজাকার উপায়ান্তর না দেখে ঝাঁপ দিয়ে পড়লো সামনের পুকুরে। টিটো রাইফেল হাতে পুকুর পাড়ে। রাজাকাররা একবার মাথা তোলে, আর টিটো একটা করে গুলি ছোড়ে। রাজাকাররা আবার ডুব দেয়। আমি বেশ আনন্দের সঙ্গে দৃশ্যটা উপভোগ করছিলাম। এভাবে চলে অনেকক্ষণ। গ্রামবাসী বেশ মজা পেয়ে যায়। প্ৰায় চার ঘণ্টা এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি চলে। পুকুরের ঠাণ্ড পানিতে রাজাকারদের মরণব্দশা। আমি এগিয়ে গিয়ে টিটোকে বলি অনেক হয়েছে, এবার ওদের নিয়ে চলো ক্যাম্পে। ও খুব বিরক্ত হলো বললো, “কী কন আপনে ওগোরে ওই পানিতে ডুবাইয়া মারুম। একটা গুলিও খরচ করুম না’। এবার আমি ধমকের সুরে বলি, ও চুপ হয়ে যায়। রাজাকারদের ইঙ্গিত করে মাথার ওপর হাত তুলে পাড়ে উঠে আসতে বলি। রাজাকারগুলো কোনোভাবে পুকুর হতে উঠে আসে। তারপর বিজয়ীর মতো টিটো ওদের তাড়িয়ে নিয়ে চলে ক্যাম্পের দিকে। নভেম্বরের চৌদ্দ তারিখ আমাদের কমান্ডার মানিক ধামরাইর কাছে ভায়াডুবি ব্রিজ অপারেশনে শহীদ হন। ভায়াডুবি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে আমরা উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করি। নভেম্বরের চৌদ্দ তারিখ আটটা নাগাদ আমরা ভায়াডুবি ব্রিজের কাছে পৌছি। অপারেশনে আসার আগে টিটো খুব কান্নাকাটি করেছিল আমাদের সঙ্গে আসার জন্য। কিন্তু মানিক আর আমার নিষেধ ও অমান্য করতে পারেনি। ও থেকে গিয়েছিল ক্যাম্পে। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ আমরা ভায়াডুবি ব্রিজের ওপর অবস্থানকারী, পাকিস্তানি পাহারাদার সৈন্যদের ওপর আক্রমণ শুরু করি। তখন মুক্তিযোদ্ধারা ব্রিজ উড়িয়ে দেবে এ আশঙ্কায় সব মহাসড়কের ব্রিজগুলোয় পাকিস্তানিরা পাহারা বসিয়েছিল। ভায়াডুবি ব্রিজের দু’পাশে পাকিস্তানি সেনারা বাঙ্কার অর্থাৎ মাটি খুঁড়ে উপরে চালা দিয়ে তার ওপর বালির বস্তা দিয়ে ছোট ছোট ঘাঁটি তৈরি করে ওই ঘাটির ভেতর অবস্থান করতো। যত সহজে ব্রিজ দখল করবো ভেবেছিলাম তা হলো না। পাকিস্তানিদের পাল্টা আক্রমণ আমাদের কাজকে কঠিন করে তোলে। প্ৰায় পনেরো মিনিট বিরামহীন যুদ্ধ এবং আমাদের সাড়াশি আক্রমণের মুখেও পাকিস্তানিরা তাদের অবস্থান ছাড়ছে না দেখে মরিয়া হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের পরোয়া না করে রাইফেল হাতে চতুর্দিক থেকে দৌড়ে, বুকে ভর দিয়ে ব্রিজের ওপর উঠে পড়ে এবং পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাতে হাতে লড়াই করে ওদের পরাজিত করে ।
ব্রিজ পুরো আমাদের দখলে এলে আমরা তিনভাগে ভাগ হয়ে দু’ভাগ ব্রিজের দু’পাশে পাহারা এবং একভাগ ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত হই। ব্রিজ উড়ানোর জন্য আমরা যখন এক ধরণের বিস্ফোরক ব্রিজের ওপর বসাচ্ছিলাম, ঠিক তখন আমরা লক্ষ্য করি আরিচার দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ট্রাকবহর এগিয়ে আসছে। ব্রিজের ওপাশের মুক্তিযোদ্ধারা প্ৰাণপণ লড়াই করেও ওদের থামাতে পারে না। আমরা আত্মরক্ষার্থে বিস্ফোরক বসানো থামিয়ে দৌড়ে ব্রিজের আরেক পাশে এসে যেখানে মানিকের অবস্থান সেখানে অবস্থান নেই। পাকিস্তানি ট্রাকগুলো ব্রিজে উঠে এলে আমরা আক্রমণ শুরু করি। আমাদের আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা পালিয়ে যায়। কিন্তু শহীদ হন আমাদের অধিনায়ক মানিক। সে রাতের মতো অপারেশন স্থগিত রেখে আমরা মানিকের লাশ নিয়ে আসি ক্যাম্পে। মানিকের মৃত্যুতে মুষড়ে পড়া পুরো দলকে সচল করার জন্য আঠারো নভেম্বর অর্থাৎ মানিকের মৃত্যুর মাত্র চারদিন পর আমরা সাফল্যের সঙ্গে ভায়াডুবি ব্রিজ অপারেশন করি এবং তার দুদিন পর সাভারের ডেইরি ফার্মের পেছনে জিরাবো নদীর ধারে আমাদের নতুন ক্যাম্প স্থাপন করি।
নভেম্বরের শেষ নাগাদ সাভার, ধামরাই, মানিকগঞ্জ এলাকার সিংহভাগ অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধারা শক্রমুক্ত করে নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। মুক্ত গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। সাভারের জিরাবো ক্যাম্প থেকে রেডিও সম্পপ্রচার কেন্দ্র আক্রমণ, সাভার মিলিশিয়া ক্যাম্প ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলিটারি ক্যাম্প দখল এবং ঢাকা-আরিচা সড়কের টহলদাতা পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর কয়েকদফা সফল আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। আমি জিরাবো অগ্রবতী ক্যাম্পে, সঙ্গে টিটো। টিটো আমার পেছনে ছায়ার মতো। আমারও মায়া পড়ে গেছে এই ছেলেটির ওপর। প্রতিটি অপারেশন থেকে ফিরে আসার পর টিটো আদর-আপ্যায়নে অস্থির করে তুলতো, শুধু আমাকে নয়, দলের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার মন আর হৃদয় ভরিয়ে দিতো পিতা-মাতার মতো স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে। কখনো টিটো মা, কখনো বাবা । কখনো অবুঝ ছোট্ট ভাই, কখনোবা পাখি।
ডিসেম্বরের তেরো তারিখে সাভার থানা দখল করার জন্য আমরা ষাটজন মুক্তিযোদ্ধা থানার দিকে অগ্রসর হই। আমাদের লক্ষ্য ছিল কোনো প্রকার গুলি ক্ষয় না করে ওদের আত্মসমৰ্পণ করানো। থানা ঘেরাও করে আমরা শক্ৰপক্ষকে আহবান জানালে ওরা কোনো প্রতিরোধ ছাড়া আত্মসমৰ্পণ করে। ভোররাতে আমরা ক্যাম্পে ফিরে আসি।
সারারাতের ধাকলে আমরা ক্লান্ত । শোয়ার আয়োজন করছে টিটো । হঠাৎ বাইরে কোলাহল শুনে বেরিয়ে দেখি ক’জন গ্রামবাসী, ওরা বেশ উত্তেজিত। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ওরা জানাল, উত্তরদিক থেকে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের ক্যাম্পের দিকে আসছে। আমাদের প্রশ্নের জবাবে ওরা আরো জানাল, প্ৰায় আধা ঘণ্টা আগে পাকিস্তানিদের, এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে দেখে এসেছি। মহাসড়ক দিয়ে নয়, উত্তরমুখী বঁকা রাস্তা দিয়ে ওরা আসছে। পাকিস্তানিদের দেখে এই গ্রামবাসী দুটি সাইকেলে করে দ্রুত খবর দিতে এসেছে। হঠাৎ পূর্বের আকাশের দিকে চোখ পড়ল। রাতের অন্ধকার কেটে পূর্বদিকের আকাশে রুপালি ছটা। শরীরের ভেতর বিদ্যুৎ খেলে গেল। এই তো সময়।
“জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে সবাইকে জড়ো হতে বলে নিজেও তৈরি হয়ে নিলাম। টিটো আমার পেছনে। চারশ’ পঞ্চাশ জন মুক্তিযোদ্ধা সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে। সবাইকে বললাম, শেষ যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে। সবার চোখে প্রত্যয় আর বিশ্বাস। সবাই প্রস্তুত। জয় অথবা মৃত্যুর জন্য। সাড়ে চারশ’ থেকে চারশ’ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আলাদা করে চারভাগে ভাগ করা হলো। দ্রুত পরিকল্পনায় নির্ধারণ করা হলো অবশিষ্ট পঞ্চাশ জন থাকবে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য। একশ’ জনের চারটি দলের একটি থাকবে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে, প্রয়োজনে ওরা কাভারিং ফায়ার দেবে। তিনটি একশ’ জনের দল থাকবে আক্রমণে । একশ’ জনের একটি দল নিয়ে আমি থাকব মাঝে, আর আমার বাম ও ডান পাশে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থান নেবে বাকি দু’টো একশ’ জনের দল। টিটো পড়ে গেল জরুরি অবস্থা মোকাবেলার দলে। ও কেঁদে ফেলল। “আমারে নিয়া যান। আমি যুদ্ধ করুম। আমি স্বাধীনতা দেখুম। আজই তো শেষ যুদ্ধ’।
আমি হেসে বললাম, ‘কে বলল আজ শেষ যুদ্ধ? কেন? আপনিই তো কইলেন’, টিটো বলল। আমি বুঝিয়ে বললাম, ‘ধুর বোকা । শেষ যুদ্ধ মানে আমাদের জন্য হয়তো শেষ। আমরা অনেকেই আর নাও ফিরতে পারি’। তাই সবাইকে বোঝালাম। ও লাফ দিয়ে উঠল, “আপনেরা মইরা যাইবেন আর আমি বঁইচা থাকুম ক্যান? আমার ভাই মরছে। আমি আইছি যুদ্ধে। আমিও মরুম’। আমি ওকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে বললাম, ‘শোনো টিটো, তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। তুমি না স্বাধীনতা দেখতে চাও। তুমি এখানে থাকো। কেউ আঘাত পেলে ওদের সেবা-শুশ্ৰষা করবে। এটাও যুদ্ধের চেয়েও বড় কাজ । টিটো চুপ হয়ে গেল। আমরা দ্রুত রওনা দিলাম। পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম মাটির রাস্তার ওপরে। পরিকল্পনা মতো রাস্তার পূর্ব পাশে। রাস্তার সমান্তরাল প্রায় একহাজার মিটার বিস্তৃত হয়ে আমরা অবস্থান গ্ৰহণ করলাম। রাস্তাটি উত্তর-দক্ষিণমুখো। আমরা রাস্তার পূর্বপাশে ছোট ছোট মাটির ঢিবি, ঝোপ, আর খানাখন্দে লুকিয়ে থেকে অপেক্ষা করতে থাকলাম শক্রর জন্য। মাঝখানে আমাদের দল। ডানে প্ৰায় পাঁচশ’ মিটার ও বায়ে পাঁচশ’ মিটার জায়গাজুড়ে বাকি দুটো দল। গেরিলা যুদ্ধে আমাদের অবস্থানকে অ্যাম্বুশ বলা হয়। আর আমাদের মাঝের দল মেইন বডি, ডান ও বায়ের দলগুলোকে ফ্রাঙ্ক বলে। বোঝার সুবিধার জন্য ডানদিকেরটা ফ্লাঙ্ক-১ ও বামদিকেরটা ফ্লাঙ্ক-২ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলের পর্যুদস্ত পাকিস্তানি বাহিনীর এই সাভার দিয়ে ঢাকা যেতে হবে। ওরা বুদ্ধি করে কাঁচা রাস্তা ধরেছে। পাকা রাস্তায় বিপদ হতে পারে। ওরা ক্লান্ত এটা জানা কথাই। পরিকল্পনা হলো ওরা যখন হাঁটতে হাঁটতে ফ্লাঙ্ক-১ ও মূল দলকে অতিক্রম করে ফ্লাঙ্ক-২-এর দিকে এগুবে ঠিক তখন মূল অর্থাৎ আমরা গুলি করব। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে দুই ফ্লাঙ্ক হতেও আক্রমণ শুরু হবে এবং আমরা নিশ্চিত কয়েক মিনিটের যুদ্ধে পরাস্ত হবে পাকিস্তানিরা। যদিও আমরা খবর পেয়েছি, ওরা সংখ্যায় অনেক। ওদের সঙ্গে রয়েছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র।
ভোরের আলো-আঁধারি কেটে কুয়াশা ভেঙে সূর্যালোকে প্রকৃতি হেসে ওঠে। কিন্তু আমাদের কিছুই ভালো লাগছে না। মুহূর্তগুলো তেলাপোকার মতো মাথা হতে গড়িয়ে পিঠ হয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। অস্থির হয়ে উঠছি আমরা। নানা ধরনের শীতের পোকা নিশ্চিন্ত হেঁটে বেড়ায় মুখ-নাক, হাতপায়ের ওপর দিয়ে। কিছু করার উপায় নেই। নড়াচড়ার সুযোগ নেই। অপেক্ষায় পাথর হয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ নিস্তব্ধতার পাথর ফুড়ে কানে বেজে ওঠে ধুপধাপ শব্দ। বুটের আওয়াজ। অনেক সৈন্যের। নড়েচড়ে অবস্থান নিল সবাই। ক্রমেই শব্দ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানিদের। ধীর পায়ে সাবধানী হিংস্র জন্তুর মতো এগিয়ে আসছে। তিনশ’ মুক্তিযোদ্ধা দিম আটকে মরণাঘাত হানার জন্য অপেক্ষা করছে। পাকিস্তানিরা ঢুকে পড়েছে আমাদের অ্যাম্বুশ বা ফাঁদে। এগিয়ে যাচ্ছে তীক্ষ চোখ রেখে সবদিকে। পরিকল্পনা অনুসারে ফ্লাঙ্ক-১ কোনো গুলি করছে না। প্রথম করছে মূল দল। তারও দেরি আছে। ওরা মূল দলের সোজাসুজি এলে তারপর আক্রমণ করা হবে। মূল দলের সোজাসুজি আসতে আর মাত্র পঞ্চাশ মিটার বাকি হাতের মুঠোয় ঘামে ভিজে ওঠে অস্ত্ৰ। কিন্তু চোখের সামনে এত শক্ৰ দেখে ঠিক থাকতে পারল না। আমাদের এক সহযোদ্ধা। পুরো শত্রু বাহিনী অ্যাম্বুশে ঢোকার আগেই গুলি ছুড়ল। তড়িৎ গতিতে পজিশন নিল শক্ৰপক্ষ। আমরা সবাই হতবাক। প্ৰচণ্ড পাল্টা আক্রমণ শুরু করল শক্ৰ বাহিনী। শুরু হলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। শত্রু বাহিনীর একাংশ যারা ফাঁদের বাইরে, তারা অবস্থান নিল অত্যন্ত সুসংহতভাবে। সম্মুখের যারা অ্যাম্বুশে প্রবেশ করেছিল তারা রাস্তার পশ্চিমে অবস্থান নিল পূর্বমুখী হয়ে এবং গুলি ছুড়তে ছুড়তে নিজেদের সংযুক্ত করে ফেললো বাইরের দলটির সঙ্গে।
দ্রুত আমাদের পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হলো। ফ্লাঙ্ক১-কে মূল দল হিসেবে যুদ্ধ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠিয়ে আমি মূল দল নিয়ে ছুটে পেছনে হেঁটে এসে ফ্লাঙ্ক-১-এর ডানে অবস্থান নিলাম। এখন আমাদের অবস্থান ফ্লাঙ্ক-১ । পরিবর্তিত পরিকল্পনায় আমরা পাকিস্তানিদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেললাম, দুর্ধর্ষ সেই পাকিস্তানি রেজিমেন্টের সঙ্গে পেরে ওঠা কষ্টসাধ্য। ওরা অবস্থান নিয়েছে সুবিধাজনক অবস্থানে। ওদের ভারী মেশিনগান বসিয়েছে একটু উচুতে। তার সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ঝোপের আড়ালে সৈন্যরা। ওরা মাঝে মাঝে আক্রমণের তীব্ৰতা বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের অবস্থানকে চিরে বের হয়ে যেতে চাচ্ছে সোজা। আমরা পিছিয়ে গিয়ে আবার একত্রিত হচ্ছি পূর্বের অবস্থানের কাছাকাছি এবং পাল্টা আক্রমণ করছি। এ যেন দাবা খেলা। প্রায় আধঘণ্টা চললো যুদ্ধ, কিন্তু কিছুতেই ওদের কাবু করতে পারছি না। ওদের মূল শক্তি ওদের নিয়মিত ওই ভারী মেশিনগান ও দু’পাশের আরো আটটি হালকা মেশিনগান। যেভাবে হোক ওদের ভারী মেশিনগানটিকে নিস্তব্ধ করে। দিতে হবে। আমাদের ফ্লাঙ্ক-১-এর অবস্থান নিচু কাঁঠালবাগানে। আমরা দেখতে পাচ্ছি। ওদের মেশিনগানের অবস্থান; কিন্তু আমরা নিচে অবস্থান করাতে কিছুই করতে পারছিলাম না।
মাথা তোলার কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র ফ্লাঙ্ক-২ পারে, একটু বায়ে পশ্চিমে সরে শক্রর পেছনে অবস্থান নিয়ে যদি কেউ জীবন বাজি রেখে ওই মেশিনগান যে চালাচ্ছে তাকে খতম করতে পারে, তবে আমরা ওদের কাবু করতে পারবো। আমার পাশে আরিফ। আরিফকে বললাম, দৌড় দিয়ে ফ্রাঙ্ক-২-এ নূরুকে নির্দেশ পৌঁছে দিতে যেন ওই ভারী মেশিনগানটিকে নিস্তব্ধ করে দেয়। আরিফ নিজে না গিয়ে পাশের যুদ্ধরত টিটোকে যেতে বলল। টিটো যে নির্দেশ অমান্য করে আমার পাশেই শুয়ে রাইফেল চালাচ্ছে আমি জানি না। যুদ্ধের নিয়ম কিশোর টিটো জানত না। টিটো লাফ দিয়ে উঠে সোজা দৌড়ে গেল নূরুর দিকে চিৎকার করতে করতে। গর্জে উঠল শত্রুর ভারী মেশিনগান। একঝাক গুলি টিটোর বুক চিরে ফেলল। মাটি থেকে প্রায় দু’হাত উপরে ছিটকে উঠল টিটো । তারপর পড়ে গেল। চোখের সামনে ঘটে গেল ঘটনাটা। মাত্র দশ মিটার সামনে। টিটো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে যুদ্ধের সব নিয়ম-কানুন ভুলে আমরা মরিয়া হয়ে সামনে এগুতে থাকলাম। শক্রর প্রচণ্ড গুলিতে আমাদের তিনজন আহত হলো। সামনের সমতল ভূমিতে টিটো। আর এগোনো যাচ্ছে না। হঠাৎ দেখি দ্রুত এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে নূরু পাকিস্তানিদের পেছন থেকে এগিয়ে আসছে মেশিনগান পোস্টের দিকে। কী অবিশ্বাস্য গতি। মুহূর্তের মধ্যে নুরু মেশিনগান পোস্টের বিশ মিটারের মধ্যে চলে এলো এবং নির্ভুল নিশানায় হত্যা করল ঘাতক মেশিনগান চালককে । পেছন থেকে অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে দিশেহারা শক্ৰপক্ষ ।
এ সুযোগের ব্যবহার করল ফ্রাঙ্ক-২ এবং মূল যোদ্ধারা। একের পর এক শক্র হনন করে চলল নূরু ও তার সাথীরা। আমরা দ্রুত টিটোর কাছে পৌঁছে তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনলাম। শত্রু তখন বিচ্ছিন্ন-বিপর্যস্ত। কেউ করছে আত্মসমর্পণ কেউবা মৃত্যুবরণ। আরিফ ও কয়েকজন মিলে টিটােকে নিয়ে গেল ক্যাম্পে। চিকিৎসার প্রয়োজন। আধঘণ্টা খানিক যুদ্ধের পর পাকিস্তানিদের প্রায় সবার অবস্থান নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বাকি দু’একটি অবস্থান নিশ্চিহ্নের দায়িত্ব নূরুদের ওপর দিয়ে আমি ক্যাম্পে ফিরে এলাম। ক্যাম্পে তখন আরো অনেক আহত যোদ্ধা । টিটোর জখম সবচেয়ে বেশি। বুকের ডান পাশের কোমর থেকে কাঁধ পর্যন্ত অসংখ্য গুলি ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। ক্যাম্পের ধূসর ধুলাময় উঠান টিটোর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। একটি পাটির ওপর শোয়ানো হয়েছে টিটোকে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ওর শরীর ঢেকে দেয়া হয়েছে বিশটি কম্বল দিয়ে। টিটো বলছিলো শীত লাগছে, ব্যথা করছে। কম্বল দিয়ে ঢেকে ওর মৃত্যুকষ্টই কমাতে চাচ্ছিল ওর সহযোদ্ধারা। আমাকে দেখে টিটো চিৎকার করে বলল, “ভাই, ভাই, আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই। আমারে বাঁচান, আমি স্বাধীনতা দেখুম। স্বাধীনতা দেইখ্যা আমি মরুম’। সবার চোখে অশ্রু । সবার চোখে একটাই প্রশ্ন, টিটো কেন? আমরা তো কেউ একজন মরতে পারতাম। ওই কিশোরটি কেন? টিটো কেন মরবো? সূৰ্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে। গাছের ছায়া ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ-নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে টিটো । কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসছে। ‘আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই।
স্বাধীনতা স্বাধীনতা…’ ।
আমাদের সবাইকে ফেলে টিটো চলে গেল। সাভারের লালমাটি আরো লাল হলো। টিটো চলে গেলো। টিটোর কবর হলো সাভারের ডেইরি ফার্মের গেটে । অতি সাধারণভাবে ছোট কবর। সাভার ডেইরি ফার্মের গেটে ডান ধারে ছোট্ট যে কবরটি দেখা যায় সেই স্থানে মাটির নিচে শুয়ে আছে-নীরবে। ঘন বর্ষার ভারী জলের ফোটা আর শীতের ভোরের শুভ্ৰ-শিশির ফোটা নিয়ত ঝরে ওর কবরের ওপর।
হয়তো ওরা শুনতে পায় টিটোর ক্ষীণ কণ্ঠের উচ্চারণ-“আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা ‘ ।