বাংলাদেশ ও দেশবিদেশ
কম্যুনিস্ট চীন কীভাবে কোন যুক্তিতে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানদের নারকীয় নিধনযজ্ঞকে সমর্থন ও মুক্তিকামী বাঙালিদের নিন্দা করতে পারলাে, এ প্রশ্ন আজ কম্যুনিস্ট ও বামপন্থী মাত্ৰকেই ভাবিয়ে তুলবে। নাম্বুদ্রিপাদও চীনের এই ব্যবহারের নিন্দা করেছেন।
আসল কথা এই, চীন এই পাক-ভারত উপমহাদেশে কোনাে শান্তি চায় না, যাকে দিয়েই হােক, যে ভাবেই হােক এখানে একটা যুদ্ধ বিগ্রহ সৃষ্টি করেই রাখতে চায়। এর পরিচয় পূর্বেও পাওয়া গেছে, এবারে আরও স্পষ্টভাবে উপস্থিত, নির্লজ্জের মতাে তার প্রকাশ অথচ মার্ক্সবাদ লেনিনবাদের নাকি ওরা সাচ্চা সৈনিক! বাংলাদেশের উপরে যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় নিষ্ঠুরতম গণহত্যা, নারী নির্যাতন, গৃহদাহ ইত্যাদির ঝড় বইয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে কোন মানুষ এই অত্যাচারীদের পক্ষে ওকালতি করতে পারে একথা কম্যুনিস্ট জগত সম্বন্ধে কখনও ভাবা যেতাে না। তাদের সংযত ও নিরস্ত্র না করে উল্টে আরও অস্ত্রশস্ত্র, এমন কি, বাংলাদেশের মুক্তিফৌজকে যদি ভারত প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করে তবে আর এক খণ্ড যুদ্ধ দিয়েও পাকিস্তানকে সাহায্য করতে আসবে বলে হাবভাব দেখাচ্ছে!
ওদের যুক্তি বােধ হয় এরকম :
১। যদি পাকিস্তান দুই খণ্ডেই বিভক্ত হয়ে যায় এবং বিভক্ত খণ্ড দুটি পরস্পরের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, তবে চীনকে দুই পক্ষকেই সমর্থন করা সম্ভব নয়। আর পক্ষ সমর্থনের ক্ষেত্রে আদর্শগত ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠিটা “বাস্তববাদী” চীনের কাছে বড় কথা নয়। একটা ছেড়ে দিয়ে অপরটার উপরেই যদি নির্জ করতে হয়, তবে চীনের ভৌগলিক-রাজনৈতিক (geo political) স্বার্থের খাতিরে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানকেই বেছে নিতে হবে। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের এখন স্থল পথেই সংযােগ হয়েছে এগিলগিট ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে একটা সশস্ত্র গোঁজ (wedge) হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান চীনের কাজে লাগবে, কেননা ভবিষ্যতে রাশিয়া ও ভারত যাতে সক্রিয় কোন কর্মপন্থা চীনের বিরুদ্ধে না নিতে পারে, সে দিকে চীনের তীব্র নজর। তৃতীয়ত, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশ করার পথও চীন পশ্চিম পাকিস্তান দিয়ে করতে পারবে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাতে চীন শত চেষ্টা করেও আজও পর্যন্ত রাশিয়া-বিরােধী কোন ঘাটি বা “বন্ধুরাষ্ট্র” তৈরি করতে পারেনি। চতুর্থত, বাণিজ্যিক সুবিধার খাতিরেও পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি বন্দরের প্রতি চীনের লােভ আছে। পশ্চিমী জগতের সঙ্গে সাক্ষাৎ বাণিজ্যিক যােগাযােগের পথ আজ চীনের পক্ষে হংকং ছাড়া কিছু নেই। পশ্চিম পাকিস্তান ও করাচি দিয়ে পশ্চিমী জগতের জন্য একটা পথ তার দরকার। আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়াতে তার রাজনীতি পণ্য ও সৈন্য প্রেরণের একটা প্রশস্ত পথ পশ্চিম পাকিস্তানই তাকে করে দিতে পারে। পাকিস্তানিদের ইদানীংকালের খবরের কাগজে প্রকাশ যে করাচি বন্দর দিয়ে বছরে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের মতাে চীনা মাল পাচার করার সুবিধা নাকি পাকিস্তান সরকার করে দিচ্ছে। করাচির একটি সংবাদপত্র (Daily News) সম্প্রতি জানিয়েছেন যে চীনা পণ্য বহন করার জন্য পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশন আরও তিরিশটি জাহাজ খরিদ করেছেন। তাছাড়া, আকাশ পথে ও স্থলপথে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগ সুবিধার জন্য পাকিস্তান এয়ার লাইনসের হাওয়াই আড্ডা ও করাচি বন্দরের সঙ্গে কারাকোরাম হাইওয়ে (পাকিস্তান-চায়না ফ্রেন্ডশিপ হাইওয়ে”-যার অপর নাম) সুদূরপ্রসারী এই উদ্দেশ্য থেকেই তৈরি করা হয়।এই থেকেই বােঝা উচিত প্রতিটি সংকটকালে চীন কেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের সর্বরকমে নির্লজ্জের মতাে সমর্থন করে আসছে তারা স্বৈরতন্ত্রী না ফ্যাসিস্ট এসব বিচার চীনের নেই।
তাই বলে পূর্ব বাংলাকে চীনারা খরচের খাতায় লিখে রেখেছে এমন ধরবার কারণ নেই। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব যতদিন গণতান্ত্রিক মুজিবর রহমানের হাতে আছে, ততদিন এই মুক্তি সংগ্রামকে চীন মদদ দিতে পারে না, কেননা এই নেতৃত্ব চীনের বশ্যতা স্বীকার করবে না। এই নেতৃত্ব ভারতের সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন। যদি এই সগ্রাম ব্যর্থ হয়, মুজিবর রহমান বিফল হন, তখন চীন হয়তাে তার অনুগামী কোন দলকে সমর্থন করতে পারেও বা ইয়াহিয়া-বিরােধী হলেও। অতএব চীন চায়, বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রাম ব্যর্থ হােক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সে ব্যর্থতার পরে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে, তা তখন তাঁবেদার কোন চীনপন্থী দল দিয়ে চীন সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করবে।
ভারত নানা কারণে বাংলাদেশের এই সংগ্রামের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, হয়তাে আরও পড়বে। কিন্তু কতটুকু এতে অংশ নেবে, কতদূর পর্যন্ত যাবে, এ বিষয়ে ভারত সরকারেরই কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেই। ভারতের এ বিষয়ে যেন কোন স্বাধীনতাও নেই, ভারত স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়ছে তা নয়, বরং ভারত এই দায়িত্ব এতকাল চোখ বুজে এড়িয়ে এসেছে। আজ ভারতের উপর এই বােঝা ও দায়িত্ব এসে চেপে বসেছে বলেই, ভারত নড়াচড়া করতে চাইছে। কিন্তু কতটুকু এবং কতদূর পর্যন্ত? | একথা এখন সর্বজন স্বীকৃত যে এই মুক্তি সম্রামের প্রথম দশটি দিন ছিল ভারত সরকারের সবচেয়ে সুবিধাজনক সময়। সেই দশ দিনের মধ্যে ২/৩টি দিনও যদি ভারত থেকে মুক্তিকামী সংগ্রামী জনতার কাছে যথােপযুক্ত অস্ত্রের সাহায্য মিলতাে যাকে massive help বলে, তবেই পূর্ব বাংলা থেকে এতদিন পশ্চিম পাকিস্তানিদের সব শক্তি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাে। কিন্তু সিদ্ধান্ত কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ভারত সরকারের নেই বা থাকবে না জেনেই ইয়াহিয়াখানেরা অমন ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ভারত ও অন্যান্য দেশ ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝতে না বুঝতেই তাদের যা কাজ তা হাসিল করে নিতে পারে। বিস্মিত পৃথিবী ব্যাপারটা কী বুঝতে বুঝতেই প্রায় দুটি মাস কাটিয়ে দিলাে। ভারত তার বৈদেশিক দূতাবাসগুলাে থেকে বিশ্ববাসীকে কিছু বোেঝাতেও সমর্থ হয়নি। ভারতীয় দূতাবাসগুলাের অযােগ্যতার আরও একটি উদাহরণ মিললাে। দূতাবাসগুলাে যে অপদার্থ কেবল খানাপিনার আড্ডা মাত্র, তার প্রমাণ মিললাে। নইলে আজ জয়প্রকাশ নারায়ণদের বিদেশে জনমত তৈরি করার জন্য যেতে হচ্ছে কেন?
যাই হােক, আজ যদি ভারত কোন সক্রিয় সাহায্যের পথ নেয়, তাকে দশবার নাকি ভাবতে হচ্ছে! বাংলাদেশের নবজাত সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারছে না ভারত! তাতে নাকি চীনের সঙ্গেও যুদ্ধ লেগে যেতে পারে! ভারত যদি স্বীকৃতি দেয়, তবে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করবে, চীন ভূটান সিকিম অধিকার করে বাংলাদেশের ও পশ্চিম বাংলার ঘাড়ের উপরে এসে দাঁড়াবে, আর এগুতে না চাইলেও নাকি তার চলবে ইত্যাদি ভয় দেখাচ্ছে ভারত সরকারের সব দরদী (!) বন্ধুরা—অর্থাৎ আমেরিকা, রাশিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্ররা। প্রথম দশদিনের মধ্যেই ভারত যদি কাজটা সেরে দিতে পারতাে, তবে এসব বন্ধুদের হিতােপদেশ দেবারও কোন ফুরসত থাকতাে না। এখন যত দিন যাবে, তত আন্তর্জাতিক বন্ধুরা ও বড় বড় রাষ্ট্রগুলাে পূর্বভারতে শান্তিরক্ষা করার নামে পূর্ববাংলায় যা ঘটছে তাই ঘটতে দেবে। বাঙালিদের বলি দেওয়া যায় (expendible materials in larger human interest.), বাঙালি শেষ হয়ে গেলে এই বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের বিবেকে কতটুকু বাঁধে কে জানে। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এ যুক্তি খাটবে না। বাংলাদেশ যদি মরে, তবে ভারতও বাঁচবে না। একদা যখন দেশ বিভাগ হয় তখন বিভাগপন্থী ভারতীয় নেতারা ভেবেছিলেন, যাক না বিশাল ভারত থেকে ২/১ খণ্ড বেরিয়ে, অবশিষ্ট যা থাকবে তাই কম কী, এতবড় স্বাধীন ভারতই বা কবে একত্র ছিল? এই সুবিধাবাদী চিন্তার বিষময় পরিণামে তাকে বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর বােঝা বহন করতে হয়েছে, এখন তাে প্রায় এককোটি শরণার্থীর জন্য তাকে এক্ষুণি প্রস্তুত হতে হবে। ভারত একটা রিফিউজির দেশ, সব দেশ থেকে ভাগিয়ে দেওয়া রিফিউজিদের দেশে পরিণত হয়েছে, পূর্ববাংলা থেকে, তিব্বত থেকে, ব্রহ্ম দেশ থেকে, আফ্রিকা থেকে, সিংহল থেকে! পূর্বভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাধারণ নিরাপত্তার বােঝা সমগ্র ভারতকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবার পথ খুলে দিচ্ছে। ভারতীয় নেতারা এ বিপদ বুঝছেন হয়তাে, কিন্তু কত দেরীতে! প্রথম দশটি দিনে ভারত এ সমস্যার সুরাহা করে দিতে পারতাে, কিন্তু আজ সে কাজ করা তার পক্ষে কত কঠিন, কত ব্যয় সাপেক্ষ ও কত বিপদজনক হয়ে উঠেছে। দুঃখের বিষয় যদি এ সিদ্ধান্তও নিতে হয় যে বর্তমানে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা সগ্রাম ছাড়া মুক্তিফৌজের অন্য কোন পথ নেই এবং সে সংগ্রামকে ভারত সর্বপ্রকারে (যুদ্ধ ঘােষণার ঝুঁকি না নিয়ে) মদদ করতে চায়, তবে তার প্ল্যান-প্রােগ্রামই বা কী এবং তাতে ভারতের দায়িত্ব কীভাবে পালিত হবে সে সম্বন্ধেও উচ্চমহলে অথবা কোথাও কোন সুষ্ঠু চিন্তা নেই! যদি সুষ্ঠু পরিকল্পনা কিছু থাকতাে, তবে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে এখনও দ্বিধা করতাে না। এই স্বীকৃতি না দেবার ফলে বাংলাদেশের লােকদেরও প্রচণ্ড রকমে আশাহত করে ছাড়বে, তাদের সগ্রামী মনােবল ভেঙে পড়বে। যদি তারা তখন একদম ভেঙে পড়ে, ভারত কী তখন এ সংগ্রাম তাদেরই সগ্রাম বলে চালাতে পারবে? আর স্বীকৃতি দেওয়া মানেই যুদ্ধ ডেকে আনা নয়। দক্ষিণ ভিয়েনামের সগ্রামী সরকারকে চীন স্বীকৃতি দিয়েছে, আরও কয়েকটি দেশ দিয়েছে রাশিয়াসহ। কই আমেরিকা তাে চীনের উপরে বম্বারি করতে যাচ্ছে না বা চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেনি! বরং এখন চীনের সঙ্গেই হাত মেলাবার জন্য আমেরিকা “পিংপং” রাজনীতিতে যােগ দিয়েছে। মােটকথা পৃথিবীর সবাই শক্তের ভক্ত, নরমের যম। ভারত যদি শক্ত হবার সাহস সংগ্রহ করতে পারতাে, তবে অবস্থার রূপটা বদলে যেতাে। অবশ্য তাতে যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত হতে হতাে, কয়েক লক্ষ লােককে মরতে হবে বলে প্রস্তুত থাকতে হতাে। কিন্তু পৃথিবীতে কোন জাতি বিশেষ করে কোন বড় জাতি এই ঝুঁকি ও মৃত্যুপণ না করে জাতিগঠন করতে পেরেছে বা বড় হয়েছে বা বড় বলে গ্রাহ্য হয়েছে? বিশাল এক ভারতের আমরা অধিশ্বর হতে চাই, অথচ প্রাণটি হবে আমাদের মুরগির মতাে, দৃষ্টিভঙ্গী হবে শশকের মতাে এতাে হতে পারে না।
রাশিয়া পূর্ববঙ্গের দুঃখকষ্টে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভারতকে হুশিয়ার করে দিচ্ছে বেশি এগিও না! রাশিয়া আজ পর্যন্ত কোন সৎসাহস দেখাতে পারেনি। চীনের সঙ্গে আমেরিকার মিতালি হয়ে যাচ্ছে দেখে রাশিয়াও হয়তাে আর পা বাড়াবার সাহস নিচ্ছে না, বাহির বিশ্বে পরের ওপর উপগ্রহ নিক্ষেপ করে সার্কাসের চমক দেখাতে তারা ব্যস্ত দেখতে পাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ইয়ােরােপের সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ নীরব! এ বিষয়ে মন্তব্য করতেও লজ্জা হয়, আমাদের।
আর আমেরিকা? আমেরিকা মুজিবর রহমানকে কত উপদেশ ও উৎসাহও হয়তাে একদিন দেখাতাে। দুই পাকিস্তান যাতে একত্র থাকে তার জন্য আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মুজিবর রহমানের ঘাড়ের উপর বসে ছিলেন ইয়াহিয়া খানদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাবার কালে। আমেরিকান রাষ্ট্রদূতেরও একই সমস্যা, কোটাকে ছেড়ে কোন্টাকে বেছে নেয় যদি দুটি পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। আমেরিকা মুজিবরকে ভুল উপদেশ দেয়, বােঝাতে চেষ্টা করে ইয়াহিয়াখান মুজিবর রহমানকেই সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করে দেবেন, তখন মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে চীন ঘেঁষা পলিসি ত্যাগ করে ভারত ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি চালিয়ে যেতে পারবে। আমেরিকা নিজেও এই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছিল, ফলে ইয়াহিয়া খানের মতলবটা ধরতেও পারেনি। ধূর্ত ব্রিটেন কিন্তু অনেক আগেই সংবাদ পেয়ে গিয়েছিল, ৮ই মার্চ তারিখেই পূর্বপাকিস্তানে যেসব ব্রিটন আছে বা ছিল তাদের সরে আসতে নির্দেশ দিয়েছিল। ভারতীয় দূতাবাস বা আমেরিকান দূতাবাস এতটুকুও বুঝতে পারেনি! এখন আমেরিকা চীনের সঙ্গে সমঝােতা করতে ব্যস্ত, কাজেই চীন যাতে চটে এমন কিছু আমেরিকা করতে প্রস্তুত নয়। আমেরিকা অবশ্য পূর্বপাকিস্তানি বিপন্ন জনতার জন্য রিলিফ পাঠাবার তােড়জোড় করছে, আহা, বেচারী বাঙালিরা, ওরা যেন দুর্ভিক্ষে শেষ না হয়; সামরিক গােষ্ঠীর গুলিগােলার হাত থেকে যারা বাঁচলাে, পালিয়ে বাঁচলাে, তাদের জন্য এখন প্রচুর আমেরিকান তবু, খাদ্য, ওষুধ আসবে। স্বাধীনতা না মিলুক রিলিফ মিলবে তাে, খিচুড়ি খাইয়ে আমেরিকা এখন তার আহত বিবেক বুদ্ধিকে ঘুম পাড়াবে! আমরা রিলিফ চাই না, স্বাধীনতা চাই একথা বলার দিন এসেছে বাঙালিদের। আর একথাও তাদের বুঝতে হবে যে দেশের কুকুরটার উপরও বিশ্বাস করা চলে, কিন্তু বাহির বিশ্বের তথাকথিত বন্ধুদের উপর, প্রগতিবাদী শান্তিকামী বাক্য-বীরদের উপর বিশ্বাস রাখা নিরাপদ নয়। আর বােধহয়, আজ এই উপমহাদেশে ভারতীয় বাংলাদেশীয় সকল জনগণের এই প্রত্যয়বােধ আসা উচিত যে শেষ পর্যন্ত আমরাই আমাদের বন্ধু যত শক্রতাই করে থাকি না কেন, শেষ পর্যন্ত নিজেদের উপর বিশ্বাস রেখেই বাচার পথ বর্তমান। আর একথাও মানতে হবে যে এই উপমহাদেশে সত্যিই শান্তি ফিরে আসুক, একটা বৃহৎ শক্তি হিসেবে আমরা দাঁড়াই এটা বােধহয় কেউ চায় না।
সূত্র: কম্পাস, ১৫ই মে ১৯৭১