You dont have javascript enabled! Please enable it! 1943 | ছাত্র ও যুবক মুজিব | মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান (তিনি বঙ্গবন্ধুর সময়ে বেকার হোস্টেলে থাকতেন) - সংগ্রামের নোটবুক

ছাত্র ও যুবক মুজিব 

মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান 

শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় কলকাতা বেকার হােস্টেলে। বেকার হোস্টেলে দুটি কলেজের মুসলিম ছাত্ররা বাস করত। মূলত হােষ্টেল ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রদের জন্যই তৈরি হয়, কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আমরা ৫০ জন ছাত্র সেখানে থাকতাম। মােট ২০০ জনের মধ্যে বাকি ১৫০ জন ছিল ইসলামিয়ার ছাত্র। শেখ সাহেব ১৯৪৩ সালে ইসলামিয়া কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হন ও বেকার হােস্টেলে থাকতে আসেন। আমি তখন তৃতীয় বর্ষে। শেখ সাহেব অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় এক দুরারােগ্য অসুখে পড়েন ও তিন বছরের জন্য তাঁর পড়াশােনা বন্ধ ছিল। অতএব তিনি কলেজে আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়লেও বয়সে আমাদের তিন-চার বছরের বড় ছিলেন।

তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী, পাতলা গড়নের কিন্তু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক যুবক স্কুল থেকেই ছাত্ররাজনীতিতে কার্যকরভাবে জড়িত। যখন তিনি কলকাতা আসেন, অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে, তখনই তিনি ছাত্ররাজনীতির একজন নেতৃত্বাধীন কর্মী। তার চলাফেরা ও হাবভাবেও তা বােঝা যেত। ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের গ্রিন অ্যান্ড হােয়াইট কোম্পানির মালিক নূরুদ্দীন তখন চতুর্থ বর্ষের ছাত্র, রাজনৈতিক ভাবে নেতৃস্থানীয় ও সোহরাওয়দী সাহেব প্রভাবিত ছাত্র অংশের নেতা। নূরুদ্দীন ছিলেন শেখ মুজিবের বন্ধু এবং শােনা যায়, তিনিই শেখ সাহেবকে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। পরিচয়ের পর সােহরাওয়ার্দী সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শেখ সাহেবের বেগ পেতে হয়নি। শেখ সাহেবের সংগঠন পড়ার শক্তি ছিল অসাধারণ। তা ছাড়া তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী ও সংগঠনে নিবেদিতপ্রাণ। মানুষ চেনার চোখ সােহরাওয়ার্দীর অত্যন্ত তীক্ষ্ন ছিল। অতএব, মুজিবের জন্য তাঁর প্রিয়পাত্র হওয়া কঠিন হয়নি।

এদিকে খাজা নাজিমউদ্দিন সাহেবেরও একটি অংশ ছিল মুসলিম ছাত্ররাজনৈতিক সংগঠনের। কারণ সােহরাওয়ার্দী ও নাজিমউদ্দিন ছিলেন বাংলার মুসলিম লীগ রাজনীতিতে প্রবল প্রতিপক্ষ। ওই অংশের ছাত্রনেতা ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। সঙ্গে শাহ আজিজুর রহমান, তীক্ষ্ন মেধাসম্পন্ন ছাত্রনেতা আনােয়ার হােসেন (‘ল্যাংড়া আনােয়ার বলে খ্যাত এবং অল্প বয়সেই প্রয়াত) প্রমুখ।

আমার বন্ধুবান্ধব বা আমি কেউ রাজনীতি করতাম না, তবে অন্য দু-দশজন ছাত্রের মতােই মাঝে মধ্যে হােস্টেল ইউনিয়নের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তাম। এ ছাড়া কাছেই অবস্থিত মুসলিম ইনস্টিটিউট ছিল বাংলার মুসলিম রাজনীতির একটি বড় কেন্দ্র। সেখানেও যেতাম মূলত দূর থেকে দেখার জন্য। তবে কখনােসখনাে যে ছাত্রদের বিভিন্ন গ্রুপের রাজনৈতিক বিরােধে জড়িয়ে পড়িনি তা নয়। পরে যখন পাকিস্তান আন্দোলন তুঙ্গে তখনাে মাঝে মধ্যে মুসলিম ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। এভাবেই নানা স্থানে শেখ মুজিব ও অন্য ছাত্রনেতাদের সান্নিধ্যে এসেছি।

শেখ মুজিবের অতীত রাজনৈতিক ভূমিকা বর্ণনার আগে ব্যক্তি মুজিবের চরিত্র সম্বন্ধে একটি ছােট অথচ আকর্ষণীয় ঘটনা উল্লেখ করা দরকার। একদিন আমার এলাকার স্কুল থেকে নাজীর আহমদ নামের এক ছাত্র প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে বেকার হোষ্টেলে থাকতে এসেছে। নাজীরের উচিত ছিল বন্ধুবান্ধব কাউকে খবর দেওয়া কিংবা কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা। কারণ তখন গ্রাম থেকে কলকাতা আসা আজকের ঢাকা থেকে লন্ডন যাওয়ার মতোই ছিল। কিন্তু নাজীরের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

নাজীর বেলা ১১টার দিকে একাই কুলির মাথায় বাক্স ও বিছানা নিয়ে হোস্টেলে উপস্থিত। নাজিরকে কুলি এত ভারী ধরনের বাক্স ও বিছনা (হােল্ড ) নিয়ে এসে নিচের তলার সিড়ির কাছে নামিয়ে নিয়ে গেছে। কামরা দােতলায় ৩২ কি ৩৩ নম্বর । নাজীর কী করবে, কাকে জিজ্ঞেস করবে, কার সাহায্য চাইবে ভাবছে। বলতে গেলে ভীতই হয়ে পড়েছে সে। ১১টার দিকে বেশির ভাগ ছাত্র কলেজে গেছে ও ব্লক পরিচারকেরা খেতে গেছে। দু-চারজন ছাত্র সিতু নিয়ে নেমে গেল আর কেউ কেউ ওপরে উঠে গেল । সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা নাজীরকে কেউ দেখেও দেখল না। এমন সময় দীর্ঘদেহী এক ছাত্র, অর্থাৎ শেখ মুজিব, তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছেন। কোথাও যেতে হবে, একেবারেই সময় নেই। নাজীরকে পাশ কাটিয়ে দুই পা এগিয়ে গেলেন। তারপর ফিরে এলেন। আসসালামু আলাইকুম। আপনি কি হােস্টেলে নতুন এসেছেন?’ নাজীর বলল, “জি হ্যাঁ’, ‘কত নম্বর কামরা পেয়েছেন?’ ‘৩২ নম্বর। সে তো দোতলায়, আমার রুমের পাশেই। তা আপনার জিনিসগুলাে নেওয়ার জন্য লােক নেই? নাজীর নিরুত্তর। শেখ সাহেবের চিৎকার, ‘কই তােমরা? রিয়াসাত, জহুর?’ কোথাও থেকে কোনাে সাড়া নেই । অবশেষে শেখ মুজিব বললেন, আপনি আপনার বিছানাটা উঠান, আমি ওঠাই আপনার বাক্সটা । নাজীরও ছিল লম্বা ও শক্তিশালী। বললেন, ‘না, তা হয় না। যদি ধরতেই চান, তবে আপনি বিছানাটা নিন, আমি ওঠাই বাক্স । ওটা তাে ওঠানােই কঠিন। তারপর বয়ে নিয়ে অতটা ওপরে যাওয়া।’ ততক্ষণে মুজিব লােহার বাক্সটা কাঁধে নিয়ে সিঁড়ি বাইতে শুরু করেছেন।

মুজিব নাজিরকে নিয়ে গেলেন তার কামরায়। দরজা খুলে নিজের ঘর থেকে পরিত্যক্ত নেকড়ার ঝাড়ন এনে মােটামুটি খাট, টেবিল ও চেয়ার ঝেড়ে বললেন, ‘এবার বিশ্রাম করুন। প্রত্যেক ব্লকের ছাত্রদের দেখাশােনা করার জন্য একজন পরিচারক আছে। আমি ওকে নিচে থেকে খুঁজে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনার খাবারদাবার ও যা-কিছু লাগে ওকে বলবেন।’ ঘড়ি দেখে বললেন, আমার খুব তাড়া। না হলে আমি সব দেখিয়ে দিতাম। বিকেলে দেখা হবে।’ বলে চলে গেলেন।

ঘটনাটির বর্ণনা দিতে গিয়ে এখনো ডাক্তার নাজীরের (অ্যানেশথেশিয়ার ফেলাে ও বর্তমানে ইংল্যন্ডে কনসালট্যাস্ট)) স্বরটা আর্দ্র হয়ে ওঠে।
আগেই বলেছি, রাজনৈতিক ছাত্রনেতাদের পেছন পেছন গিয়ে দু চারবার মারামারিতে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে আমাদের। কোন নেতার পিছনে যাচ্ছি হয়তাে কিছুই জানতাম না। অনেকটা কৌতুহলবশই যেতাম। একদিন আসাম থেকে আসা কমিউনিস্ট নেতা সালেহ আহমদ ভাইয়ের ডাকে চললাম । কোথায় চলেছি জিজ্ঞেস করলাম না। কয়েকজন বন্ধু মিলে যাচ্ছি । পরে দেখলাম, আমরা ওয়েলেসলি স্ট্রিটে অবস্থিত মুসলিম লীগ অফিসে সামনে। আমাদের বাধা দেওয়ার জন্য আগে থেকেই অন্য একদল ছাত্র গেটে থেকে দেয়ালের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই বুঝলাম, আমরা খাজা নাজিমউদ্দিনের পক্ষ থেকে এসেছি মুসলিম লীগের অফিস দখল করতে ।

তখনকার অস্ত্রশস্ত্র পিস্তল, বন্দুক ও বােমা ছিল না। ছিল বাঁশের লাঠি ও চেয়ার। চেয়ার ভাঙা হতাে মাথায় । অফিস দখল নিয়ে মারামারি লেগে । দু-একটি চেয়ার আমার মাথায় ভাঙল আর আমিও দু-একটি আমার সামনের জনের মাথায় ভাঙলাম। একটু পরই পুলিশ। পুলিশ দেখে সবাই দৌড়, জেল হাজত খাটতে কেউ বড় একটা রাজি নয়। দৌড়ে বড় রাস্তার মােড়ে এলাম । অর্থাৎ আমাদের পরাজয় হলাে। কিন্তু দেখি, আমাদের সামনে প্রসন্ন মুখে দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ফজলুল কাদের চৌধুরী, আচকানের সব বােতাম খােলা, হাত দুটি ওপরে ছড়ানাে, শাবাশ, ভাই সব, এসাে।

তারপর কিছু রাজনৈতিক বক্তৃতা। অবশেষে মালাবার রেস্তোরাঁয় খাওয়া । প্রায় আড়াই শ ছাত্রকে পেটপুরে খাওয়ানাে হলাে। এত পয়সা ছাত্র কাদের কোথায় পেল, ভাবছি। আরও ভাবছি, মারামারির সময় আমাদের মাথায় যখন চেয়ার ছিল, তখন প্রকান্ডদেহী ফজলুল কাদেরকে কোথাও দেখিনি। মারামারি শেষে বেশ ভালাে পােশাক-আশাকে হঠাৎ তাঁর আবির্ভাব। আমার সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ মনে এই বিশ্বাসই জন্মাল যে নেতৃত্ব এভাবেই দিতে হয়। সৈন্যদল যুদ্ধ করবে, সেনাপতি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করবেন। যুদ্ধ শেষে বক্তৃতা দেবেন এবং পয়সা খরচ করে খাওয়াবেন। তবে পয়সারও কোনো উৎস থাকা চাই এবং সেই উৎস খােলার জন্য চাবিকাঠিও নেতার হাতে থাকা চাই।

কিন্তু এই নিয়ম সম্বন্ধে সন্দেহ জাগল অন্য কোনাে জায়গায় আরেকটা মারামারি দেখে। সেখানে শেখ মুজিবও ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সবার সামনে। একেবারে সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে। চরম বিপদ উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কোন নেতার জন্য মারামারি হচ্ছিল তা না জানলেও, সবাই

Page-156

অনুসরণ করছিল ওই দীর্ঘদেহী হালকা-পাতলা গড়নের লােকটিকে। মারামারি হলো। তবে মুজিবই সামনে। সবাই পেছনে পেছনে। কিছুক্ষণ পর প্রতিপক্ষ আর রইল না। সেদিন মনে হলো না, যে সেনাপতি নিরাপদ দূরত্বে পেছনে থাকে তার নেতৃত্বের চুড়ান্ত সফলতা লাভ করা তাে নয়ই, টেকসই হওয়ারও কথা নয়। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার কথা সেই নেতৃত্বের, যে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ কেন্দ্রটিতে থেকে যুদ্ধ করে। মনে আছে সেদিন থেকেই শেখ মুজিবকে বিশেষ করে মনে রাখলাম। আর এ প্রশ্নটি মনে জেগেছিল যে দেখা যাক ভবিষ্যতের রাজনীতিতে কে কত দূর অগ্রসর হতে পারে। তখনকার দিনে শেখ মুজিব গোয়ার বলে পরিচিত ছিলেন, তবে শ্রদ্ধার পাত্রও ছিলেন । সােহরাওয়ার্দীর তীক্ষ্ন চোখ তাকে চিনতে পেরেছিল। পরে মওলানা ভাসানীও এসব কারণে বিশেষ করে সংগঠন গড়ার ক্ষমতা দেখে মুজিবকে পছন্দ করতেন ও প্রকাশ্যেই বলতেন ‘মুজিব আমার সন্তান’।
একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে শােনা একটি ঘটনা। ১৯৫৮ সালে সোহরাওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখন প্রবীণ আওয়ামী নেতারা সােহরাওয়ার্দীর কাছে অনুরােধ করে তার গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করালেন। খুশিমনে সবাই যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন সােহরাওয়ার্দী সাহেব তাদের ডেকে বললেন, যাবার সময়ে নিচে বসে আছে যে গেয়ারটি (অর্থাৎ শেখ মুজিব), ওকেও সিদ্ধান্তটি সম্বন্ধে একটু বলে যান। বলবেন, আমি নিজে এ সিদ্ধান্তটি দিয়েছি। সে-ও যেন এটা মেনে নেয়।’ সােহরাওয়ার্দী সাহেব ও যুবক শেখ মুজিবের মধ্যে একটি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক ছিল।
ইংরেজের পা-চাটা পুলিশ এবং বেসামরিক অফিসারদের আমরা তখন ঘৃণা করি। ‘৭১-এ এবং এখনাে, যেমন রাজাকারদের ঘৃণা করতাম ও করি সেই হিসেবে, কলকাতার পুলিশের ডেপুটি কমিশনার দেহা সাহেবও ছিলেন ঘৃণ্য। স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের তিনি যত উৎসাহের সঙ্গে ধরতেন ও তাদের ওপর অত্যাচার করতেন, ততটা উৎসাহের সঙ্গে কোনাে ইংরেজ অফিসার ও এ কাজ করত কি না সন্দেহ। শেখ মুজিবও তাকে ঘৃণা করতেন। কিন্তু শেখ মুজিবের ঘৃণার তীব্রতা ছিল অনেক বেশি। নিজের বিশ্বাস ও উদ্দেশ্যের জন্য শেখ মুজিব চরম বিপদের মুখে নিজেকে ঠেলে দিতে বিন্দুমাত্রও দ্বিধা করতেন না।

একদিন এমনই একটি আন্দোলন বা মিছিল চলাকালে পুলিশ এসে নেতৃস্থানীয় শেখ মুজিবকেও ধরল। ধরার পর যখন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সামনে পড়লেন ডেপুটি কমিশনার দোহা। মুজিবের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি । আর যায় কোথায়! মুজিবের হাত বাঁধা, অতএব কিছু করার ক্ষমতা নেই। তাই মুখ ভরা থুতু ঘৃণাভরে নিক্ষেপ করলেন দোহার দিকে । থুতু গিয়ে পড়ল দোহার মুখের ওপর। এর পরের ঘটনা। আমি জানি । এর জন্য মুজিবকে কতটা নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল, জিজ্ঞাস করিনি। তবে অনুমান করা দুরূহ নয়। এই মুজিব,পরবর্তী জীবনে রাজনীতিতে কতটা অগ্রসর হন তা দেখার কৌতূহল কার না থাকবে।

মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যুবক বয়সেও বেশ প্রখর ছিল। একটি ঘটনা বর্ণনা দিলে তা অনেকটা পরিস্ফুট হবে। মুজিব হােস্টেল ইউনিয়নের রাজনীতি করতেন না। তবে তার গ্রুপের ছেলেরা অনেকেই হােস্টেলে থাকত। হােস্টেল ইউনিয়ন নির্বাচনের সময় মুজিব তাদের তাঁর কাছে ডেকে পরামর্শ দিতেন ও সাহায্য করতেন।

আগেই বলেছি, হােস্টেলে কেন, কোনাে রাজনীতিই আমার বন্ধুবান্ধব কেউ করত না। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেবার হােস্টেল রাজনীতিতে শফিক ইসলাম নামের এক ছাত্র আমাদের গ্রুপের নেতা হয়ে গেলেন। পরে মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির নেতা, জামায়াত নেতা গােলাম আযমের চাচা কি ভাই, বর্তমানে পাকিস্তানে বসবাসরত শফিকুল ইসলামই ছিলেন ওই নেতা। তিনিই ভিপি হবেন। শফিকুল মানুষ হিসেবে ছিলেন যেমন ধড়িবাজ, তেমনি ছিলেন উগ্র ইসলামপন্থী । আমরা শফিকুল ইসলামকে পছন্দ করতাম না। তবু তার বিরুদ্ধে রাজনীতি করার ইচ্ছে কখনােই ছিল না। কিন্তু একদিন বিকেলে আমাদের অন্তরঙ্গ বন্ধু কাৰ্জী আনােয়ারুল ইসলাম (কবি কাজী নজরুল ইসলামের ফুপাতাে ভাই, প্রয়াত) আমাদের সবাইকে তার কামরায় ডেকে নিয়ে বললেন, “শফিকুল ইসলামের মতাে ছেলে ভিপি হবে, তােমরা কি পছন্দ করাে?’ বললাম, ‘তা তাে করি না, তবে আমাদের কী করার আছে? আমরা ভােট দেন না, তাই বলে তার বিরুদ্ধে ক্যানভাস করার সময় ও আগ্রহ তােমারও নাই, আমাদেরও নাই। ‘তাই না? আনোয়ার বললেন, “সে কথা ঠিক। তবে একটা কাজ করলে কেমন হয়? চলাে আমরা আমাদের দল থেকে তাকে বহিষ্কার করি। ওখানে তখন ছিলেন। আনােয়ারুল ইসলাম (সাবেক ফাইন্যান্স ডিরেক্টর, রেডিও পাকিস্তান, প্রয়াত), দেলােয়ার হােসেন (সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ খাদ্য করপােরেশন), শাহজাহান সিদ্দিক (সাবেক সচিব, বাংলাদেশ রেলওয়ে, প্রয়াত), ড, হাবিবুর রহমান (সাবেক সচিব, বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম মন্ত্রণালয়, প্রয়াত) এবং আরও কয়েকজন। উল্লিখিতদের প্রায় সবাই বঙ্গবন্ধু সরকারের চাকরি করেছেন। এদের অনেকেই বাইরে থেকে টেনে এনে বঙ্গবন্ধু তাঁর সরকারে যোগদান করিয়েছিলেন।

যাই হােক, আনােয়ারের কথা শুনে আমরা সবাই হেসে ফেললাম । আমাদের দল? রাজনীতি যদি থাকে উত্তর মেরুতে, তবে আমি এই কজন তো বাকি দক্ষিণ মেরুতে। অতএব, আমাদের আবার দল, আমাদের আবার কাউকে বহিষ্কার করা? বরং শফিকুল ইসলামই আমাদের অবাঞ্ছিত ঘােষণা করে দেবে। আনােয়ার ছিল অত্যন্ত কৌতুকপ্রিয়, নতুন নতুন কৌতুকের বুদ্ধি সব সময়ই তার মাথায় ঘুরত । এরকম একটা নতুন কৌতুক হিসেবেই আমরা তাঁর প্রস্তাবটিতে দস্তখত করে দিলাম। পরে শুনলাম, আনােয়ার লিখিত প্রস্তাবটি হােস্টেলের নােটিশ বাের্ডে  টাঙিয়ে দিয়েছে।

আর যায় কোথায়? পরদিন দলে দলে নবীন ও মাধ্যমিক স্তরের ছাত্ররা এসে হাজির আমাদের কামরায় । ‘ভাই সাহেব, অভিনন্দন। খুব ভালাে কাজ করেছেন। আমরা সবাই আপনাদের পেছনে। আপনারা নেতৃত্ব নিন, আমরা তা-ই চাই।’ যতই বােঝানাের চেষ্টা করি রাজনীতি আমরা করি না, করবও। কে কার কথা শােনে। ওরা নিজেরাই একটি দল খাড়া করল ও পদগুলােতে নমিনেশন দিয়ে দিল। হােস্টেলময় ক্যানভাস, আমরা হতভম্ব।
এর মধ্যে হঠাৎ সিঁড়িতে শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা। হেসে বললেন, খলিল সাহেব, শেষ পর্যন্ত আপনারাও রাজনীতিতে নেমে গেলেন? আমি বললাম, ‘আপনিও পাগল হয়েছেন? কিসের রাজনীতি? এ তাে আনােয়ারের আরেক কৌতুক!’ শেখ সাহেব হাসিমুখেই বললেন, রাজনীতিতে কৌতুক বলে কোনাে কথা নেই। তবে কৌতুকের মাধ্যমে গভীর রাজনীতি শুরু হতে পারে। যাহােক, আপনাদের দল ভালাে করছে। এগিয়ে যান।’ আমি তাে হতবাক। বুঝলাম পেছনে ফেরার উপায় নেই। কিন্তু যখন বললাম, ‘আমরা যদি সফল হই, তবে আপনার সমর্থিত দল তাে হেরে যাবে। শেখ সাহেব বললেন, ‘তা হােক, তবু রাজনীতিটা সুন্দর হােক । ভালাে ও বদের মধ্যে প্রতিযােগিতা হলেই আমি খুশি। আরেকটি কাজ আপনারা ভালাে করেছেন-ওই শফিকুলকে বের করে দিয়েছেন। লােকটা নােংরা।’ বলে হেসে হেসেই তিনি নিচে নেমে গেলেন।

এ গল্প দীর্ঘায়িত না করে শেষ টানা যাক। নির্বাচনের দু-এক দিন আগে একেবারে পরিষ্কার বােঝা গেল, আমরা ভালােভাবে জিতব। এ সময়ে প্রতিপক্ষ এসে আমাদের সঙ্গে মিটমাটের প্রস্তাব দিল। আমরা ছিলাম একান্ত অনভিজ্ঞ । মিটমাট করে ফেললাম । যাক, বাঁচা গেল, নির্বাচনের ঝামেলা থাকল না।

হঠাৎ দেখি শেখ সাহেব। তিনি আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের কামরায়, ‘এ কী করলেন আপনারা? ছোটখাটো একটু আরটু কৌশলগত পদক্ষেপ আমি বুঝি। কিন্তু তাই বলে দল বিলুপ্ত করে প্রতিপক্ষের সঙ্গে একদল হওয়া? কনলেন ক আপনার? আপনারাই জিতে যাচ্ছিলেন এবং খুব ভালােভাবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এ কী করলেন? নির্বাচনের ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া? না না না। আপনাদের ঝামেলা আরও বাড়বে অত্যান্ত খারাপও হতে পারে।’ রাজনীতিতে একান্তই অনভিজ্ঞ আমি সেদিন এই যুবকটির কথা বুঝতে পারিনি। বুঝেছি পরে, যখন শেখ মুজিবের অকাঙ্খাই সত্য হলাে । হােস্টেলের রাজনীতি সেবার ভেঙে চুমার হয়ে গেল আমাদের দলের প্রত্যাহৃত হতাশ অংশ এ গুলো দলের প্রত্যাহৃত হতাশ অংশ দুটি মিলে গেল । চিৎকার করে বলতে লাগল, “এ সিদ্ধান্ত আমরা মানি না, মানব না।

এদিকে হােস্টেলের সমস্ত ছাত্রই উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল, তাতে যেন হঠাৎই পানি ঢেলে দেওয়া হলাে। যেন নিমেষেই সব ওলট-পালট হয়ে গেল। এর সুদূরপ্রসারী খারাপ ফল হয়েছিল হােস্টেলের জন্য। ঐতিহ্যবাহী এই হােস্টেলটিই ভেঙে দুভাগ হয়ে গিয়েছিল । সে বর্ণনায় না গিয়ে আমি শেষ সাহেবের কথায় ফিরে আসি। প্রায় একই বয়সের যুবক আমরা, বয়সে দু-তিন বছরের তফাত। তবে ওঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল, আমাদের ছিল না। কেবল এটুকুই কি তফাত ছিল? নাকি তাঁর প্রজ্ঞাও ছিল বয়সের তুলনায় অধিক।

তাঁর সেদিনের কথাগুলাে আমি ভুলিনি। তাঁর পরবর্তী জীবনের রাজনৈতিক ভূমিকা ও পদক্ষেপও লক্ষ্য করে দেখেছি যে তিনি মিটমাট বা কম্প্রোমাইজ অর্থাৎ, আপসের বিরােধী ছিলেন সর্বদাই । একা পড়ে গেলেও এগিয়ে গেছেন। নিজস্ব রাস্তায়। জীবন শেষে পৌছেও গিয়েছিলেন তার গন্তব্যস্থলে।

যুবক ও নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে শেখ মুজিব যখন রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন তখন উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ কেমন ছিল তার উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক। ১৯৩০ দশকের শেষের দিকেই এই উপমহাদেশে রাজনাৈতক ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন অনেকটা স্পষ্টতা লাভ করে। তার পর দ্বিতায় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বিভাজন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। যুদ্ধ শেষে ভারতের স্বাধীনতা লাভ যতই নিশ্চিত হতে থাকে, বিভাজন ততই বাড়তে থাকে।
তখনকার বাংলাদেশের মুসলমানরা এবং অন্যত্রও, বিশেষ করে যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেই সব প্রদেশের মুসলমানরা পাকিস্তান  লাভের জন্য বেশি আকুল হয়ে ওঠে। তবে সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে বাঙালি মুসলমানরাই বেশি ঐক্যবদ্ধ ছিল । হয়তাে এ কারণে যে এ
Page-160

প্রদেশেই মুসলমানরা শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষভাবে পশ্চাৎপদ ছিল। অতএব বিভাজনের প্রত্যক্ষ কারণ ধর্মভিক্তিক হলে ও আসল কারণ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য ।

এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রায় সকল মুসলমানই পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ দলের সমর্থক ছিল, এবং তাই স্বাভাবিক ছিল। বলা বাহুল্য, শেখ মুজিব ও আমার প্রায় সবাই তখন মুসলিম লীগের সমর্থক কিংবা কর্মী ছিলাম। শেখ মুজিব ছাত্ররাজনীতি করতেন এবং পাকিস্তান লাভের সময়কালে তিনি বেশ উঁচু দলেরই একজন ছাত্রনেতা ছিলেন।

তবে বেশির ভাগ ছাত্র যেমন প্রথমে ছাত্র, তার পরে রাজনীতি এবং পাস করে একটা ভালাে চাকরি পেলে আর রাজনীতি নয় এমন ছিল, সেখানে শেখ মুজিব ছিলেন ভিন্ন। তার কাছে রাজনীতিই ছিল প্রথম ও প্রধান। তার পাশাপাশি বিদ্যার্জন, কিন্তু তা চাকরির জন্য নয়। ইংরেজের কবল থেকে স্বাধীনতা আমরা সবাই চাইতাম, কিন্তু তার জন্য নিজেদের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করা কিংবা জেল-জুলুমের মুখােমুখি হওয়ার মতাে ছাত্র কম ছিল। এদিক দিয়েও শেখ মুজিব ছিলেন ভিন্ন। স্কুলজীবনেও তিনি একজন ছােটখাটো ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক সংগঠক ছিলেন এবং সংগঠক হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। স্কুলজীবনে তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছে।

শেখ মুজিব ছিলেন প্রত্যন্ত এক গ্রামের মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের সান্তান । টুঙ্গিপাড়া তথা গোপালগঞ্জ ছিল বাংলাদেশের একটি দরিদ্র জনপদ। আবার এই দরিদ্র পল্লি জনগােষ্ঠীর মধ্যে বেশির ভাগ হতদরিদ্রই ছিল মুসলমান। এই দারিদ্র্য অবশ্য ঐতিহাসিক কারণেই। তবে ইংরেজী রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর যখন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত মুসলমানরা নিজেদের পরাজিত শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে ইংরেজবিরােধিতায় মত্ত ছিল, তখন হিন্দু সম্প্রদায় ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ, ইংরেজের অফিসে চাকরি লাভ ও ব্যবসা ক্ষেত্রে ইংরেজের সমর্থনপুষ্ট হয়ে এগিয়ে যেতে লাগল । উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই অশিক্ষা ও দারিদ্র্য মুসলমান সমাজে চরম আকার ধারণ করে এবং হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য অনেকটাই চোখে পড়ার মতাে রূপ নেয়। আর এ অবস্থায় মুসলমান কৃষকদের হিন্দু অর্থলগ্নিকারী মহাজনের শােষণ থেকে বাঁচানাে, তাদেরকে হিন্দু সামন্ত জমিদারদের কবল থেকে মুক্ত করাই বাংলাদেশের মুসলমান রাজনীতির মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল । একদিকে ইংরেজের শাসন থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অন্য দিকে প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায়ের কবজা থেকে অর্থনৈতিক মুক্তি। এ সময় মুসলমানের ভয় ছিল, একবার ইংরেজ চলে গেলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মালিক হবে ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় আজ হােক কাল হোক , ইংরেজদের তাে যেতেই হবে। কিন্তু তার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম আরও কঠিন ও দীর্ঘতর হবে। অতএব ইংরেজ ভারত ত্যাগের আগেই মুসলমানদের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চাই।

তবে পাকিস্তান লাভের এই সংগ্রাম ভারতের অন্যান্য অংশের তুলনায় বাংলাদেশে কিছুটা ভিন্ন ছিল। উপমহাদেশের অন্যান্য অংশে অর্থনৈতিক কারণটি থাকলেও রাজনৈতিক দিকটাই প্রধান ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কারণেই রাজনৈতিক ক্ষমতার আবশ্যকতা সৃষ্টি হয়।

এই পরিবেশেই আমাদের ও শেখ মুজিবের কৈশাের ও যৌবনের সন্ধিক্ষণ কাটে। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই শেখ মুজিব এই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং চরম ঝুঁকি উপেক্ষা করেও ছাত্ররাজনীতি তথা জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন।

শেখ মুজিবের চরিত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল নিজের বিশ্বাস ও আদর্শের প্রতি অবিচল অঙ্গীকার। এ ধরনের ব্যক্তি আবেগপ্রবণ হয়ে থাকেন। মুজিব তা-ই ছিলেন। এঁদের অন্য এক বৈশিষ্ট্যও থাকে এবং তা হলাে, দ্রুততম পন্থায় গন্তব্যে পৌছা, অর্থাৎ ধৈর্যহীনতা। তাতে যদি কিছুটা উগ্রতার প্রকাশ ঘটে, তবু  এই বৈশিষ্ট্য কিংবা দুর্বলতা পরিণত বয়সে পরিণত ৰূপ নেয়। মুজিবেরও তা-ই হয়েছিল।
সােজা কথা, মুজিব মুসলিম লীগের ছিলেন। এ নালিশ জে এন দীক্ষিতেরও। কিন্তু দীক্ষিতের যদি বঙ্গবন্ধুকে আরও নিবিড়ভাবে দেখার সুযােগ হতাে, তবে বুঝতেন, মুজিব মুসলিম লীগের ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। পুরােপুরিভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। তিনি কোনাে ধর্মের লােকের বিরুদ্ধে ধর্মের নামে সংগ্রাম করেননি। সংগ্রাম করেছেন শােষকের বিরুদ্ধে শােষিতের পক্ষে। তৎকালীন বিশেষ সামাজিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তা ধর্মীয় বিভক্তির রূপ নেয়। তখনকার দিনে অতি অনুভূতিপ্রবণ যুবক বযসী আমরা সবাই তা-ই ছিলাম। এই আপাত বৈপরীত্য বােঝার, উপলধির ব্যাপার, তর্কের ব্যাপার নয়। মুজিব মানুষকে ভালােবাসতেন, সে ক্ষেত্রে ধর্মের পরিচয় নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন না। বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতেন আবেগতাড়িত হয়েই, অন্য কোনাে বিবেচনায় নয়। মুজিবের মুসলিম লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল, শােষিত মানুষের জন্য নিজের ভাগ্য নিজ হাতে গড়ার অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম। অতএব, পরবর্তী সময়ে যখন সেই মুসলিম লীগই বাঙালি মুসলমানেকে বঞ্চিত করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করল, তখন তিনি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম” কথাটি বাদ দেওয়ার পক্ষপাতীদের অগ্রভাগে অবস্থান নিলেন।

এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে, দীক্ষীত যেমনটি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ‘মাইন্ড সেট কাজ করছে তবুও সে মাইন্ড সেট ইসলামপন্থী মাইন্ড সেট নয়। বরং তা বাঙালিরপূর্ণ স্বাধীনতা আদায়র লক্ষ্যমুখী । বাংলাদেশ আকারে ও শক্তিতে যত ক্ষুদ্রই হোক সে কারও পক্ষপুটে স্থায়ীভাবে আশ্রয় নেওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি,জন্মগ্রহণ করেছে স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথেচ্ছ পদচারণের অধিকার আদায় করতে। শেখ মুজিবের মাইন্ড সেট ও পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ছিল এটাই, যৌবনের মুসলিম লীগের রাজনীতি নয়।

তবে হ্যাঁ, দীক্ষিতের কথায় হয়তো অন্য একটি মাইন্ড সেট পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তা হলাে, ভারতবর্ষীয় মাইন্ড সেট, বিশেষ করে উত্তর ভারতীয়, আমলাতন্ত্রের মন-স্থাপনা। কেবল আমলাতন্ত্র নয়, উত্তর ভারতের রাজনীতিবিদ, এমনকি জনগণও পূর্ব ভারতীয় ও দক্ষিণ ভারতীয় জনগণের প্রতি একটি বড় ভাইসুলভ মনােভাব পােষণ করে। এই উত্তর ভারতীয় জনগণের সঙ্গে পাকিস্তানের জনগণ ও রাজনীতিবিদদেরও শামিল করা যায় না। অতএব, বহু যুগ ধরে আমলাতান্ত্রিক জাতাকলে ধৌতমন দীক্ষিত সাহেবের বােঝার কথা নয় যে স্বাধীনভাবে বহির্বিশ্বে পদচারণের অভিলাষ শেখ মুজিবের যৌবনের মুসলিম লীগ রাজনীতির মাইন্ড সেট নয়, বাঙালির সার্বভৌমত্বের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, মুসলিম লীগ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করল ঠিকই কিন্তু নতুন রাষ্ট্রে বাংলাদেশের বাঙালির স্বাধীনতা অর্জিত হলাে না। তাতে বাঙালিদের সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের ওপর পাকিস্তানিদের তথা পশ্চিম পাঞ্জাবের সামরিক এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও সামন্ত শ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলাে। শুরু হলাে নতুন শাসন ও শােষণ। এই শােষণের তীব্রতা ইংরেজ আমলকেও ছাড়িয়ে গেল। এমনকি পাকিস্তান সংখ্যাগুরু পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনগণের ওপর তাদের মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দু চাপিয়ে দিতে চাইল। যদি উর্দু পাকিস্তানের জাতীয় ও সরকারি ভাষা হতাে, তবে বাঙালি ছাত্ররা চিরতরে পিছিয়ে পড়ত। এদিকে তখন পাটই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উপায়। বিশেষ করে, ১৯৫৩ সালের কোরীয় যুদ্ধের এই অর্জন ছিল তুলনাবিহীন। কিন্তু এই অর্জনের ৬০ শতাংশ ব্যয় করে পাকিস্তানে গড়ে উঠল শিল্প এবং পূর্ব পাকিস্তান হলাে পাকিস্তানি শিল্পের বাজার।

এই অবস্থায় বাঙালি নেতারা সংগ্রামে নেমে পড়লেন। উদ্দেশ্য বাঙ্গালির ওপর পাকিস্তানের শােষণ বন্ধ করা। এদিকে বাঙালি জনগণকে গণতান্ত্রিক উপায়ে দাবিয়ে রাখতে সমর্থ না হয়ে পশ্চিমা শাসকেরা দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তন করল। বাঙালির সংগ্রাম চলল। অবশেষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নামের দেশটি রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করল।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন বাঙালি জনসাধারণ পুনরায় শােষণ-বঞ্চন সম্মুখীন হলাে তখন শেখ মুজিবের পক্ষে, শােষকদের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের সদস্য থাকা কিংবা তাদের সহায়তাকারীর ভূমিকা পালনের প্রশ্নই না। মুজিব হলেন নবপ্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরে মুসলিম বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগেৱ অকৃত্রিম ও অঙ্গীকারবদ্ধ একজন সৈনিক। এ পর্যায়ে তাঁর রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়াল বাংলাদেশের বাঙালির স্বাধিকার অর্জন, অর্থাৎ, বাঙালির ভাগ্যের নিয়ন্তা হবে বাঙালিরাই। তাদের বন্ধু থাকবে, হিতৈষী থাকবে, কিন্তু দুনিয়াতে কর্তা বা প্রভু বলে কেউ থাকবে না।
পরবর্তী সময়ে বহু লেখক ও রাজনৈতিক আলােচক এমনকি ব্যক্তিগতভাবে তার হিতৈষী কোনাে কোনাে বাঙালিও তার রাষ্ট্রনীতিতে পরস্পরবিরােধী সিদ্ধান্ত ও অসংগতিপূর্ণ পদক্ষেপ, নীতিগত বৈপরীত্য ইত্যাদি লক্ষ্য করে তার সমালােচনা করেছেন। কিন্তু তাঁদেরও প্রয়ােজন ছিল বঙ্গবন্ধুর পূর্ববর্তী জীবনের এই অভিজ্ঞতা বা তার রাজনৈতিক পটভূমি দৃষ্টিতে রাখা এবং তার মূল লক্ষ্য অনুধাবন করা। পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় ও তার ভুল থাকা স্বাভাবিক এবং তা নিশ্চয়ই ছিল। তবে সেই ভুলভ্রান্তির অধিকাংশই হয়তাে তার উপরিউক্ত উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অতি-ব্যগ্রতার ফল।

Reference: কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-১৯৭৫ মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান