রেডিও প্রাগ | চেকোস্লোভাকিয়া, ১৪ জুন ১৯৭১ | বাংলার ট্রাজেডি – আফ্রো-এশিয়ান সার্ভিসের উপরে প্রচারিত ভাষ্য
যখন একটি রাষ্ট্রের প্রধান স্বীকার করেন যে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের প্রতিহিংসামূলক কাজের সময় পাকিস্তানি বাহিনী খারাপ আচরণ করেছে তখন এটা ধরে নিতে হয় যে বিশ্বের অন্য অংশে থেকে প্রচারিত ভীতিকর রিপোর্ট সত্য। এমনকি একথা যদি স্বীকার নাও করা হত তবুও শরণার্থীদের প্রবেশ থেকে একথা অনুমান করা যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে।
এটা কোন সহজ কাজ নয় – রাজনৈতিক এডভেঞ্চার ছাড়া নিজের দেশ ত্যাগ করা। এরকম করার নিশ্চই কোন গুরুতর কারণ আছে। পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগের এত বড় বিজয়ের পরেও সেখান থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন মানুষের শরনার্থি হয়ে আসার ব্যাপারটির পেছনের নিশ্চই একটি গুরুতর কারণ রয়েছে। বাস্তবিকভাবে দলটি পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ভোট পেয়েছে এবং পুরো দেশের ৫০% এর বেশি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। পাকিস্তান পার্লামেন্ট ন্যসঙ্গত ছিল এবং তারাই জনগণের ন্যাসঙ্গত চাওয়া ও অভিযোগকে প্রকাশ করেছেন। নির্বাচণী স্লোগানের মধ্যে তারা জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টন দাবি করেছিলেন এবং একটি উঁচু মানের স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। এই উভয় পয়েন্টে দলটির অবস্থান বাস্তবসম্মত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে দেশের মোট জনসংখ্যার বেশিরভাগ লোক অবস্থান করে – সেই হিসেবে সে সাধারণ তহবিলে বেশি অবদান রাখছে।
যদিও দলের এই দাবির ফাঁকে কিছু চরমপন্থি সম্পূর্ন স্বাধীনতা চাচ্ছে – তবে আওয়ামীলীগকে দ্বিভাগপন্থী বলা যাবেনা।
পরিস্থিতি দুর্ভাগ্যজনকভাবে অন্যদিকে মোড় নিল। যখন পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ মনে করল পূর্ব পাকিস্তানের দাবি দেশের স্বার্বভৌমত্তের জন্য হুমকি স্বরূপ। ২৫ মার্চ তারা মিলিটারি দিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার দ্বার বন্ধ করে দিল। সাধারণ জ্ঞ্যান অনুযায়ী আলোচনার সদিচ্ছা নষ্ট হয়ে গেল। জনগণ এলোমেলোভাবে জোরালো প্রতিবাদ করল। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য মরিয়া হয়ে ডাক দিল। শেষ পর্যন্ত এই আক্রোশ আর্মির একশনে দমিত হল – যাদের বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানি। বিষয় হল, শরনার্থিদের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মুসলিম আছে। এতে প্রমাণ হয় আর্মি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের লোকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যাবস্থা নেয় নি।
শরনার্থিদের ভাগ্যে – যারা বাড়ীতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে – ভারতের মাটিতে শরনার্থি ক্যাম্পে বসে ক্ষুধা আর কলেরার সাথে লোরাই করছে – এটা এই টট্র্যাজেডির একটি দিক মাত্র। আরেকটি আরও গুরুতর আন্তর্জাতিক ইস্যু আছে – সেটা হল ভারত পাকিস্তানের মধ্যে টান টান উত্তেজনা। ৫ থেকে ৬ মিলিয়ন উদ্বাস্তুদের দেখাশোনা করা ভারতের জন্য বিশাল বোঝা। ভারত পাকিস্তান সীমান্তে গুলি বিনিময় এবং উভয় পক্ষের অবস্থান একটি জরুরি সতর্কবার্তা যে এর থেকে একটি আন্তর্জাতিক বিরোধ শুরু হয়ে যেতে পারে।
জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট এর নেয়া রিলিফ ব্যাবস্থাপনা গুরুত্তপূর্ন ভূমিকা রাখবে এবং নিকট ভবিষ্যতে ক্যাম্পে উদ্বাস্তুদের দুর্দশা কিছুটা লাঘব করবে। যদিও সকল রিলিফ ব্যাবস্থা নেয়া হচ্ছে পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় এবং ভোগান্তির মূল কারণের ও সৃষ্ট উত্তেজনার জন্য কোন সুরাহা করা হচ্ছেনা।
রুডে প্রাভো, চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক পত্রিকা আজ লিখেছে যে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের অবস্থা মানবিক দিক দিয়ে খুবই ধোঁয়াশার মধ্যে আছে – এবং পাশাপাশি বৈদেশিক রাজনৈতিক পরিবেশ ভয়ানক রূপ ধারণ করছে। তারা জোর দেয় যে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে অতি সত্বর শরনার্থিদের বাড়ী ফিরে যাবার মত পরিবেশ তৈরি করে দেয়া।
বিষয়ের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায় যখন গত সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং আনঅফিসিয়ালি মস্কোতে আসেন এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মিস্টার আলেক্সি কসিজিন এর সাথে সাক্ষাত করেন। কসিজিন বলেন সোভিয়েত সরকার মনে করে যে পাকিস্তান সরকার সমস্যার সমাধানে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।
এই ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা দরকার যে ৫ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে গুরুত্তপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল। তার নাম তাসখন্দ চুক্তির সফলতার সাথে লেখা রয়েছে। তাছাড়া এই সতর্কবার্তা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে আজ পৌঁছে দেয়া হবে।