You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.15 | হিন্দুশূন্য বাংলাদেশ? | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

হিন্দুশূন্য বাংলাদেশ?

সাংঘাতিক পরিকল্পনা এঁটেছেন ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশ থেকে এক কোটি হিন্দু উচ্ছেদে তিনি দৃঢ় সঙ্কপ। যেসব অসাম্প্রদায়িক মুসলমান এই জঘন্য উন্মাদনায় মদৎ দিতে অনিচ্ছুক তারাও রেহাই পাবেন না। ইসলামাবাদের ঘাতকবাহিনী বেছে বেছে হিন্দু নিধন করছেন। যারা কোন মতে প্রাণে বেঁচেছেন তারা আশ্রয় নিচ্ছেন ভারতে। সংখ্যালঘুদের বাড়ীঘর লুণ্ঠনে পাক-সরকার উস্কানি দিচ্ছেন স্থানীয় সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের। তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির দখল নিচ্ছে এইসব গুন্ডার দল। জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা পড়ছেন বিষম বিপদে। হিন্দুর রক্তে হাত না রাঙালে কপালে জুটবে লাঞ্ছনা। তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, দেশত্যাগ এবং ভারতে আশ্রয়ের সন্ধান। আর জঙ্গীশাহীর হুকুম তামিল করলে ঘটবে আদর্শচ্যুতি। নিরূপায় আদর্শনিষ্ঠারা সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছেন অনিশ্চিতের পথে। তার জন্য মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালাতেও পাকসামরিক অফিসাররা পিছ পা নন এই লােমহর্ষক বিবরণ আমাদের অজানা ছিল না। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বলেছেন শরণার্থীরা। তাঁদের কাহিনীর প্রতিধ্বনি এসেছে লন্ডনের সান্ডে টাইমস থেকে। লিখেছেন করাচী “নিউজ” এর প্রাক্তন সহকারী সম্পাদক এন্থনী মাসকারেনহাস। আড়াই পৃষ্ঠাব্যাপী তার লেখা বিবরণ। পড়রে ধমনীর প্রতিটি রক্তবিন্দু গরম হয়ে ওঠে। নরপশুদের গলাটিপে ধরতে ইচ্ছা হয়।
মাসকারেনহাস জাত-সাংবাদিক। দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন পাকিস্তানে। অর্থাৎ যশ এবং সামাজিক মর্যাদার অভাব ছিল না তার। তিনি হিন্দুও নন মুসলমানও নন তিনি খৃষ্টান। এপ্রিল মাসে আটজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে পাক-কর্তৃপক্ষ নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ দেখাতে। তাদের উপর নির্দেশ ছিল, চোখে যা। তারা দেখবেন কাগজে তা লিখতে পারবেন না। লিখতে হবে বাংলাদেশ শান্ত। সেখানে নেই কোন অস্বাভাবিক পরিবেশ। অন্য সবাই নাকে খত দিয়েছিলেন। ব্যতিক্রম শুধু মাসকারেনহাস। সত্য এবং মানবতার তাগিদে সব ছেড়ে পরিজন নিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন লন্ডনে। সান্ডে টাইমসের করাচীর সংবাদদাতা হিসাবে সেখানে ছিল তার পরিচয়। মাসকারেনহাসের বিবরণের সত্যতা যাচাই করেছেন কর্তৃপক্ষ। তারপর ছাপিয়েছেন বাংলাদেশের কাহিনী। তাতে নেই কোন কল্পনার বিলাস এবং অনাবশ্যক চটকদারিতা। ইয়াহিয়ার সেনাপতিরা এক-একটি হিংস্র জানােয়ার। ওদের কথা বার্তায় ফুটে উঠেছে আদিম যুগের পাশবিক মনােবৃত্তি। বাংলাদেশকে শায়েস্তা করবে তারা। ওখানে থাকতে পারবে না কোন হিন্দু কিংবা জাতীয়তাবাদী মুসলমান। দরকার পড়লে বিশ লক্ষ বাঙ্গালী খুন করতেও তারা তৈরী। তাতেও যদি অভীষ্ট ফল না পাওয়া যায় তবে ইসলামাবাদের উপনিবেশ হিসাবে তিরিশ বছর কাটাবে বাংলাদেশ। তা না হলে এ অঞ্চলে কায়েম হবে না ঐশ্লামিক বুনিয়াদ। মনে পড়ে একজন মার্কিন ইঞ্জিনিয়ারের কথা। চট্টগ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। তাকে বলেছিলেন জনৈক পাক-মেজর লড়াই যখন শেষ হবে তখন বাংলাদেশে কোন বাঙালী চালাতে পারবে না মােটরকার। কেবল বিদেশী এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের থাকবে এ অধিকার। চট্টগ্রাম ক্লাবে ঢুকতে দেওয়া হবে না কোন বাঙালীকে। আমি নিজে রাখব একজন বাঙালী রক্ষিতা। পাক-সেনারাও পাবে একটি করে বাঙালী নারী। কুকুরগুলাে এক মাস ধরে অনাহারে ছিল। তাদের আহার জোটাবার জন্যই পাইকারীহারে করা হয়েছে বাঙালী নিধন। মাসকারেনহাসের বিবরণেও পাওয়া গেছে পাক-অফিসারদের এমনিতর জল্লাদী প্রবৃত্তি।
নিষ্ঠুর সত্য চোখের সামনে তুলে ধরেছেন মাসকারেনহাস। বাংলাদেশে এক কোটি হিন্দুর সমূল উচ্ছেদ নিশ্চিত। তাদের সঙ্গে সহমরণে যাবেন কিম্বা নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরুবেন কলক্ষ জাতীয়তাবাদী মুসলমান।
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী এখন কি করবেন? বিশ্ববিবেক আজ কোথায়? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিজয়ীরা ফাসীর দড়িতে ঝুলিয়েছিলেন হিটলারের চেলা-চামুন্ডাদের। আজ তারা সম-অপরাধী ইয়াহিয়াকে ধিক্কার দিতে নারাজ। তাঁর সাহায্য বন্ধ করতে অনিচ্ছুক। ন্যায়বিচারের জন্য এদের মুখের দিকেই চেয়ে আছেন নয়াদিল্লী। হিন্দু এবং জাতীয়তাবাদী মুসলমান বিতাড়ন ইসলামাবদের সুপরিকল্পিত নীতি। যতদিন ইয়াহিয়ার শাসনের অস্তিত্ব থাকবে বাংলাদেশে ততদিন শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না স্বদেশে। কাতারে কাতারে নির্যাতিত হিন্দুরা আসবেন আশ্রয়ের আশায়। যারা পারবেন না তারা মরবেন কিম্বা ধর্মান্তরিত হবেন। নিজেদের বাড়ীঘরে ফিরে যাবার কোন প্রশ্নই উঠবে না বিশেষ শ্রেণীর শরণার্থীদের পক্ষে। ইসলামাবাদ ওদের ফেরত নেবে না। জোড়াতালির রাজনৈতিক সমাধানও কোন কাজে আসবে না। বিশ্ববিবেক আজ যেমন সুপ্ত সেদিনও থাকবে তেমনি সুপ্ত। ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে দেখুন নয়াদিল্লী—সব অন্ধকার। পথের সন্ধান ফিরে পাবে শুধু কামানের গােলা, ট্যাঙ্কের ঘর্ঘর শব্দ এবং শূন্যে জঙ্গী বিমানের গর্জন। স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব। এই বাস্তবকে সুনিশ্চিত করতে পারলেই হবে সমস্যার সত্যিকারের সমাধান। ইয়াহিয়া নরঘাতক। তার রক্তের তৃষ্ণা মিটে নি। বাংলাদেশের এক কোটি হিন্দু এবং জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের রক্তের জন্য তিনি থাবা বাড়িয়েছেন। এ থাবা গুঁড়িয়ে ফেলুন। শােণিতসিক্ত দাতগুলােকে টেনে তুলুন। তা না হলে বাচবে না ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ এবং বাচবে না ভারত।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৫ জুন ১৯৭১