দখলদারী সৈন্য কবলে বঙ্গদেশ
ইয়াহিয়া খান পালিয়েছেন। পালাবার আগে পাঞ্জাবী সৈন্যদলের হাতে বঙ্গদেশ তুলে গিয়ে গেছেন। ওরা এখন নিরস্ত্র জনতার উপর তান্ডব চালাচ্ছে। গত দশদিন টালবাহনা করেছেন ইয়াহিয়া খান। তার সঙ্গে জুটেছিলেন সিদ্ধি নেতা ভুট্টো। এই দুষ্ট চক্রের শয়তানী তুলনাহীন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নূতন সৈন্য পৌছানাের জন্য হয়ত তার সময় কাটাচ্ছিলেন। আর আশায় আশায় রেখেছিলেন বাঙালীকে। সমুদ্রপথে পাঞ্জাবী চম্ এসেছে। ইয়াহিয়া খানও রাত্রের অন্ধকারে ঢাকা ছেড়েছেন। মুজিবরের সঙ্গে তার কতটুকু মতৈক্য ঘটেছিল তা জানা যাবে পরে। বিশ্বাসঘাতকতায় এই পাঠান ডিকটেটর দুনিয়াকে তাজ্জব বানিয়েছেন। পাঠানের স্বভাবজাত সততা ইয়াহিয়াকে স্পর্শ করেনি। হয়ত তিনি পাঞ্জাবী সামরিক চক্রের বন্দী। নিজের খুশিমত চলার অধিকার তার নেই। তা হলেও তিনি সভ্য সমাজের লজ্জা। তার চরিত্রে নগ্ন পশুবল ছাড়া অন্য কোন নৈতিক বলের ছাপ নেই তিনি যেকোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের আসন দখলের অযােগ্য। বঙ্গদেশে বর্বরের শাসন চালু করেছেন ইয়াহিয়া খান। ঢাকা বেতার কেন্দ্র সামরিক দখলে। শহরে চব্বিশ ঘণ্টা কারফিউ। বাধা-নিষেধের অক্টোপাসে জড়িয়ে পড়েছে বিপ্লবী পূর্ব বাঙলা। জান কবুল করে প্রতিরােধের প্রাচীর তুলে ধরেছেন বাঙালী। একদিনের স্বৈরাচার এবং অপরদিকে গণতন্ত্রী জনতা। এ দুয়ের সংঘর্ষে রক্তস্নান করছে বঙ্গদেশ।
আওয়ামী লীগের ছ’দফা দাবী অজানা নেই কারও। মুজিবর বহুবার বলেছেন, এ দাবীর নড়চড় হবে না। জাগ্রত জনতা অচল করে দিয়েছিলেন পাঞ্জাবী শাসন কাঠামাে। সব জেনে শুনেই ঢাকায় এসেছিলেন। ইয়াহিয়া খান। নির্বাচনের রায় তিনি দেখেছেন। আর দেখেছেন ঐক্যবদ্ধ বাঙালীর অন্তরের আবেগ। মন ঠিক করার জন্য দশদিন অবিশ্রান্ত আলাপ আলােচনার দরকার ছিল না। খােলাখুলি বলে দিলেই পারতেন—পাঞ্জাবী কায়েমী স্বার্থের অপসান ঘটিয়ে কোন গণতান্ত্রিক দাবী তিনি মানবেন না। তাহলে অন্তত স্পষ্টভাষী বলে তার সুনাম অব্যাহত থাকত। সামরিক চক্রের সমর্থনে দু’বছর আগে আয়ুব খানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। আজ তাকেও হয়ত জঞ্জালেন মধ্যে ফেলে দেবার লােক গজিয়েছে সৈন্যবাহিনীতে। ইয়াহিয়া প্রমাণ করেছেন, তিনি ব্যাঘ্রচর্মাবৃত মেষ কিম্বা শঠতায় পূর্ণ অবতার। মুখে গণতন্ত্রের বুলি, অন্তরে কেউটের বিষ। এই নরঘাতককে নিয়েই নাচানাচি করছেন বৃটিশ ধুরন্ধররা। তাঁরা। চান ভারতের উপর দিয়ে পাক সামরিক বিমান চলাচলের অধিকার। ভারতীয় বিমান নিয়ে পাক বােম্বেটেগিরির সময় এসব মাতব্বরেরা কোথায় ছিলেন? বঙ্গদেশে পাঞ্জাবী সৈন্যদের গণহত্যার সুযােগ। দেবে ভারত? এই অলীক কল্পনা উন্মাদের মাথায় ছাড়া আর কারও মাথায় আসতে পারে না। পূবের বাঙালীর দাবী স্বায়ত্বশাসন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত দাবী এটা। একজন ডিকটেটরের ভ্রুকুটিতে এ দাবী নস্যাৎ হতে পারে না।
আগুন জ্বলেছে বঙ্গদেশে। আজ সেখানে যা চলছে তা গৃহযুদ্ধ নয়, মুক্তি সংগ্রাম। অনেক খেলা দেখাবেন। ইসলামাবাদের নেকড়ের দল। ওরা হয়ত ভারত সীমান্তে হানা দেবেন। তারপর প্রচার শুরু করবেন, বঙ্গদেশের দাবীর সক্রিয় সমর্থনে সীমান্ত হাঙ্গামা বাধিয়েছেন দিল্লী। স্বার্থান্বেষী ছাড়া সম্ভাব্য পাকঅপপ্রচারে ভুলবে না দুনিয়া। বাঙালী জনতা রুখে দাঁড়িয়েছেন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে। ভারতের নৈতিক সমর্থন অবশ্যই পাবেন গণতান্ত্রিক মুক্তিযােদ্ধারা। পাঞ্জাবী শাসক গােষ্ঠী শ্বেতাঙ্গ ফ্যাসিস্তদের বাদামী প্রেপাত্মা। মুষ্টিমেয়র শাসন এবং শােষণ ওরা কায়েম রাখতে চান সংখ্যাগুরুর উপর। নির্বাচনের রায় তাদের কাছে অর্থহীন। বঙ্গদেশের অশান্তি ডেকে এনেছেন ইয়াহিয়া খান। তার পরামর্শদাতারা জ্বলন্ত অঙ্গার ঢুকিয়েছেন ভুইফোড় ডিকটেটরের মুখে-তিনি পুড়বেন এবং বাঙালীকে পােড়াবেন। বঙদেশ তাতে ধ্বংস হবে না। এক শহীদের কবর থেকে বেরিয়ে আসবেন সহস্র মুক্তিযােদ্ধা। সৈন্য দিয়ে তাঁদের দাবিয়ে রাখা অসম্ভব। দখলদারী বাহিনীর বিড়ম্বনা বাড়বে। রাস্তায় রাস্তায়, গলিতে গলিতে এবং গ্রামাঞ্চলে চলবে নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম। পাঞ্জাবী বাহিনীর বেয়ােনেট অবশ্যই খসে পড়বে। মুক্তিযােদ্ধাদের ধ্বংস নেই। তারা আত্মস্থ এবং দুর্জয়। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সামনে মহাপরীক্ষার দিন। চোখের উপর পাইকারী গণহত্যা বরদাস্ত করা চলে না। পাঞ্জাবী ঘাতকদের বিশ্বাস নেই। ইয়াহিয়া খানের কোন প্রতিশ্রুতির মূল্য নেই। ওরা নরঘাতী দস্যু। বিশ্ব-বিবেকের উপর একদল ফ্যাসিস্ত পদাঘাত করেছে। দিকে দিকে প্রতিবাদের ঝড় তুলতে হবে। সহস্র ধিক্কারের মধ্যে ওদের জানাতে হবে বঙ্গদেশ থেকে স্বৈরাচারী হাত গুটাও। বাঙালীর গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকার কর। নইলে সভ্য দুনিয়া তােমাদের বর্জন করে চলবে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৭ মার্চ ১৯৭১