পূর্ব বাঙলার পাশে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ
পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিমে অগণিত গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের সংগ্রামী সহযােগিতার মাঝখানে কিছু দল ও ব্যক্তি সুচতুরভাবে ফাটল ধরাতে চাইছে। পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ব বাঙলার অসীম সাহসী জনতা যে মরণপথ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই দেশের পশ্চিমাংশের জনতার কাছে তা উৎসাহ ও প্রেরণার বিষয় হয়ে উঠেছে। সারা পাকিস্তান জুড়েই আজ ঘৃণিত সামরিকতন্ত্রকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করার সুবর্ণ সুযােগ এসেছে। এই বিশাল গণ অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় কিছু ঘৃণিত শক্তি পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের মধ্যে বিভেদ-সেতু রচনা করতে উদগ্রীব। সেই বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শতাধিক বুদ্ধিজীবী ট্রেড ইউনিয়ন ও ছাত্র সংস্থার নেতা এবং শিল্পী ও সাহিত্যিকদের একটি অসময়ােচিত বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। পূর্ব বাঙলার মহান জনগণের অশান্ত রক্তক্ষরণ ও কালজয়ী সংগ্রামকে তারা সারা পাক ভূখণ্ডের স্বৈরতান্ত্রিক শাসক থেকে মুক্তির সংগ্রাম হিসাবে অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানিয়েছেন। একটি রাষ্ট্রের জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও সংহতি রক্ষার শত্রুরূপে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ইয়াহিয়া চক্রকে উল্লেখ করেছে। এই বক্তব্যের সঙ্গে পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচারিত উপরােক্ত বিবৃতিটি। আমরা পাকিস্তানের এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের সঙ্কল্পের প্রতি পূর্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি।
বাঙলার সংগ্রাম ও আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র
বিলেত, আমেরিকা ও জাপান সবকটিই সাম্রাজ্যবাদী দেশ। ইয়াহিয়া এদেরই বংশবদ। আর ঐসব সাম্রাজ্যবাদী দেশের বড় বড় সংবাদপত্র সাম্রাজ্যবাদীদেরই জয় ঢাক। তবুও কিন্তু সে সব সংবাদপত্র ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন করতে তাে পারছেই না, বরং হঠকারী বলেই ধিক্কার দিচ্ছে। বিলেতের দি সানডে এক্সপ্রেস, অবজারভার, দি সানডে টেলিগ্রাফ প্রভৃতি পত্রিকার বক্তব্য একই ইয়াহিয়া নিজেকে এক আত্মঘাতি পথে ঠেলে দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, রক্তাক্ত দমন পদ্ধতি ঐক্য ধ্বংস করবেই।’
ওয়াশিংটন ইভিনিং স্টার লিখেছে, পাঞ্জাবী বেয়নেটের দ্বারা নতুন করে পাকিস্তান জাতীয়তাবােধ সৃষ্টি করা যাবে না। জাপানেই মাইনিচি সিমুন, পঞ্চাশ লক্ষ বিক্রি হয়, সে লিখেছে— গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হিসাবে না-ও থাকতে পারে এবং পূর্ব এশিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আঘাত করতে পারে।
এই গৃহযুদ্ধে পূর্ব এশিয়ার আন্তর্জাতিক ভারসাম্যকে উল্টে দেয়ার বিপদ রয়েছে। এরই সঙ্গে স্মরণ করতে হবে, যে-সমস্ত সাংবাদিকদের পূর্ব বাঙলা থেকে জোর করে বার করে দেওয়া হয়েছে তাদের ভােলা সব ছবি, কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য পরিস্কার। ঢাকায় যে বিভৎস গণহত্যা চলেছে তার সংবাদ যাতে বাইরে যেতে না পারে।
ইয়াহিয়া আজ এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে তার প্রভু সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির পক্ষেও তাকে সমর্থন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অবশ্য ফৌজ, কামান, ট্যাঙ্ক, বােমারু ও যুদ্ধ জাহাজের উপর নির্ভর করে যে “জং” জেতা যায় না তা ইয়াহিয়া ও বােঝে। এবং বিদ্রোহী পূর্ববঙ্গকে রক্তে ভাসিয়ে দেওয়ার স্পর্ধার পেছনেও পেছনেও তার আশা যে, প্রভুরা তাকে মদত দেবেই।
এখন দেখা যাক বিশ্ব বিবেককে উপেক্ষা করে সামাজ্যবাদীরা পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধিকারের মরণজয়ী সংগ্রামের বিরুদ্ধে কতটা কি সাহায্য ইয়াহিয়াকে দিতে পারে। সংবাদপত্রের মতামত দিয়ে যদি হাওয়া কোন দিকে ধরতে হয়, তাতে স্পষ্ট যে, পূর্ববঙ্গের এ সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদীরা মােটেই স্বস্তি বােধ করতে পারছে না।
উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার
পাকিস্তানের সামরিক গােষ্ঠী স্ব-রাষ্ট্রের অভ্যন্তর যখনই কোন সমস্যার সম্মুখীন হন তখনই তারা ছুতাে খোঁজেন কিভাবে সমগ্র দায়িত্বটা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সরকারের কাঁধে চাপানাে যায়।
নিজেদের স্বৈরাচারী নীতির কবলে পাকিস্তানের জনতা যখন অত্যাচার লাঘব এবং মুক্তির জন্য আন্দোলন করেন ঐ রাষ্ট্রের জঙ্গী শাসক আন্দোলনকারীদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলেন ওরা ভারতের চর।
ওরা ভারতের উস্কানীতে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে দুর্বল করার জন্য এসব করছে। আর তারপরই ভারতের উদ্দেশ্যে… করেন তােমরা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ প্রশ্নে নাক গলচ্ছাে। অতএব সাবধান।
অতীতে এ ধরণের কথায় লাভ একেবারে হয় নি এমন নয়। একবার ত আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবর রহমানকে উড়িয়ে দেওয়া হলাে এক মামলায় যার নাম হলাে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। জনসাধারণের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য কয়েকজন ভারতীয় অফিসারকেও জড়িয়ে দেওয়া হল। এমন সােরগােল ফেলা হল যাতে রাজনীতি-অজ্ঞ লােকজনের কাছে মনে হতে পারে ভারত সরকার পাকিস্তানকে দুর্বল করার জন্য সত্য সত্যই কিছু করছিল। শেষে প্রমাণিত হলাে যে ওটাও ছিল পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসকদের ঘৃণা ও কুট চাল।
আজ আবার যখন ঐ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে বাঙলাদেশের আবাল বৃদ্ধ বনিতারা স্বাধীন বাঙলার জন্য দেশের মাটি তাজা খুনে ভিজিয়ে দিচ্ছেন, বাঙলাদেশের একটি নর নারীর ওপরও আজ যখন ইয়াহিয়া চক্রের বিন্দুমাত্র কর্তৃত্ব নেই তখন শুরু হয়েছে আবার সেই ভারত বিরােধী কুৎসা।
পাক-সরকার অভিযােগ করেছেন “হুগলী নদীতে একটি জাহাজ থেকে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। ভারত সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রাম সম্পর্কে মিথ্যা, ক্ষতিকারক এবং বিরুদ্ধাচরণ সংবাদ প্রচার করছে।” ইত্যাদি।
নিজের দেশবাসী যাদের মানে না, যাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, যাদের বর্বর, অত্যাচারী বলে ধিক্কার দেয় সে হেন সরকার কি করে অন্য রাষ্ট্রের কাছে কৈফিয়ত দাবি করে?…
সূত্র: কালান্তর, ৩০.৩.১৯৭১