You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিবরের দাবী না মানলে মহা প্রলয়

শহীদের রক্তস্নাত পূর্ববাংলার আর প্রত্যেকটি জনপথ শবাকীর্ণ। সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে ইয়াহিয়া খানের ঘাতকদল। হাজার হাজার আহত মুক্তিযােদ্ধা হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। সন্তান হারার অভিসম্পাত প্রতিদিন। জড়াে হচ্ছে সামরিক ডিকটেটরের মাথায়। বিক্ষুব্ধ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছেন শেখ মুজিবর রহমান। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে পূবের বাঙালীর রুদ্ররােষ। ইয়াহিয়া খানের বেইমানীর উপর প্রচণ্ড ধিক্কার। পূবের জাগ্রত বাঙালী শয়তানি জানে না। তাদের দাবী স্পষ্ট। কোন কারচুপি নেই তাতে। মুজিবর শােষিত, অবহেলিত এবং অপমানিত জনতার ভবিষ্যৎ আশা। তাদের দুর্বার আকক্ষার জ্বলন্ত প্রতিধ্বনি । ইয়াহিয়া খান আগামী ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছেন। ভুট্টো সংখ্যালঘু দলের নেতা। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে দিন ধার্য করেছেন ইয়াহিয়া খান। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মুজিবরকে জিজ্ঞাসা করার কোন দরকার বােধ করেন নি তিনি। গত ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তের আগেও শক্তিমত্ত ডিকটেটর সাত কোটি বাঙালীর নেতা মুজিবরের মতামত নেন নি। তার স্বৈরাচার চরমে উঠেছে। ইয়াহিয়া খানের ধারণা, পাকিস্তান তার ব্যক্তিগত সম্পতি। আর মানুষগুলাে ক্রীতদাস। ইচ্ছামত তিনি তাদের ডাইনে-বাঁয়ে চালাতে পারেন।
আহত বাঘের মত গর্জে উঠেছেন মুজিবর। ঢাকার ময়দানে তাঁর ভাষণ বাঙালীর নবযৌবনের দুরন্ত প্রকাশ। গণতন্ত্রের মৌল নীতির উপর পূবের রক্তাক্ত স্বাক্ষর। জাতীয় পরিষদে যােগ দিতে ইচ্ছুক আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ পরিষদের সত্যিকারের ক্ষমতা কতটুকু? গত ক’দিন ইয়াহিয়া খান যে শঠতার পরিচয় দিয়েছেন। তাতে তার উপর আর আস্থা রাখা চলে না। জনতার সামনে তাকে সদাচারের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তাকে স্বার্থহীন ভাষায় বলতে হবে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত। জন প্রতিনিধিদের হাতে অবিলম্বে শাসনভার অর্পন ছাড়া ইয়াহিয়া খানের সদিচ্ছার পরিচয় পাওয়া যাবে না। তিনি বহুবার ডিগবাজী খেয়েছেন। এ সুযােগ আর তিনি পাবেন না। জাতির ভাগ্য নিয়ে এই উন্মাদ ডিকটেটরকে বেশী বাড়াবাড়ি করতে দেওয়া গােটা জাতির আত্মহত্যা। এই আত্মহত্যার পথ বন্ধ করতে চাচ্ছেন মুজিবর রহমান। তার দাবী অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর। কোন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন ইয়াহিয়া খান? ভুললে চলবে না যে, জাতীয় পরিষদের সদস্যরা জনসাধারণের ভােটে নির্বাচিত। ইয়াহিয়া খানের মত বেয়ােনেটের জোরে তারা জাতির বুকে চেপে বসেন নি। এদের উপর ফোপর দালালী করছেন জনতার সঙ্গে সংস্রববিবর্জিত একজন ভুইফোড় স্বৈরাচারী। সংখ্যাধিক্যের রচিত সংবিধান ইচ্ছা হলে তিনি মানবেন, না হলে তিনি মানবেন না। এই শর্তের পর জাতীয় পরিষদের কোন মূল্যই থাকে না। তার উপর রয়েছে মার্শাল। চারদিকে কাঁটা তারের বেড়ায় বন্দী জাতীয় পরিষদ। মুজিবর তার মুক্তি চান। বাঞ্ছিত এই মুক্তি ছাড়া জনগণের আকাঙ্খার পূর্ব সম্ভব হবে না সেখানে। একদিকে পিন্ডি সহস্র নাগিনী বিষ নিঃশ্বাস ছাড়বে, আর অন্যদিকে জাতীয় পরিষদ বসবে—এ অবস্থা অসহনীয়। ভারতের সংবিধান রচনা করেছে গণপরিষদ। এ গণপরিষদ ছিল। সার্বভৌম সংস্থা। আর সংবিধান রচনার ভারপ্রাপ্ত পাক জাতীয় পরিষদ ইয়াহিয়া খানের হাতের পুতুল। তা দিয়ে তিনি ছিনিমিনি খেলছেন। এ খেলা সহ্য করতে পারে না কোন আত্মমর্যাদাবান জননেতা। মুজিবর দাবী করেছেন মার্শাল ল’র অবসান। ইতিমধ্যে ইয়াহিয়া খানের জংলী আইন তছনছ করে ফেলেছে বিদ্রোহী বাঙালী জনতা। যতটুকু বাকী আছে তা নিশ্চিহ্ন করা দরকার।
ইয়াহিয়া খান বহু পায়তারা করেছেন। ভুট্টোর সঙ্গে গুটিছড়া বেধে তিনি সেনা বাহিনীকে বাঙালীর উপর লেলিয়ে দিয়েছেন। গনআদালতে পাক-ডিকটেটর ধিকৃত আসামী। যে পাপ তিনি করেছেন তার প্রায়শ্চিত্ত নেই। পাঞ্জাবী ঘাতকদের দ্বারা যারা নিহত এবং আহত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ টাকার অঙ্কে সম্ভব নয়। শােকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের হাহাকার পূর্ব বাংলার আকাশ বাতাস ভারাক্রান্ত করে তুলছে। বাঙালীর ঘরে ঘরে ধিকিধিকি জ্বলছে তুষের আগুন। মুজিবরের দাবী ক্ষতিপূরণ। ক্ষতির তুলনায় এ দাবী সমান্য। ইয়াহিয়া খান দেয়ালের লিখন একবার পড়ে দেখার চেষ্টা করুন। ভুট্টো হয়ত দুহাত দিয়ে তার চোখ দুটো চেপে ধরে রেখেছেন। রাজনৈতিক ব্যাধিগ্রস্ত এ হাত তিনি সরিয়ে ফেলুন। দেখবেন পূবের নবসূর্য লাল মৃত্যু ভয় সেখানে নেই। রক্ত দিতে সে অকৃপণ। মুজিবর এবং তার আওয়ামী লীগ যদি জাতীয় পরিষদে যােগ না দেন তবে মহা প্লাবন আসবে। ইয়াহিয়া খান তাতে ডুববেন।। সতর্কতার সময় এসেছে। মুজিবরের দাবী মানতে হবে। না মানলে আয়ুব-ইস্কান্দারের দলে তার স্থান নির্ধারিত হয়ে থাকবে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১০ মার্চ ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!