You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্ৰচণ্ড বেগে বইছে ঝড়।

মাঝে মাঝে ঝাপটা মেরে তাঁবুটা উড়িয়ে নিতে চায়।

তাঁবুর ভেতর আমরা পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধা। সবাই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি জেগে বসে আছি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের হাত মুখের সামনে মেলে ধরলেও দেখা যায় না।

তাঁবুর এক কোনায় রাখা হারিকেনটা ঝড়ের দাপটে অনেক আগেই নিভে গেছে।

তাঁবুর সামনের পর্দার ফাক দিয়ে বাইরে তাকালাম।

কিছুই দেখা যায় না। অঝোর ধারায় বৃষ্টি আর প্রচণ্ড বাতাস বাইরের অন্ধকারকে করেছে আরো গাঢ়। একেই বুঝি বলে পাহাড়ি ঝড়।

আমরা যেখানে তাঁবু গেড়েছি সে জায়গাটার নাম মনিঅন্দ।

জায়গাটা বেশ উচু। ঠিক পাহাড় নয়।

অনেকটা মালভূমির মতো । দিনের বেলায় দেখেছি কী সুন্দর সবুজ। এখান থেকে দাঁড়িয়ে নিচের ঘর-বাড়ি আর গাছ-গাছালির মাথার ওপর দিয়ে দেখা যায় তিতাস নদীর রুপালি শরীর।

আমাদের লক্ষ্য ওই তিতাস নদী। পাকিস্তানি মিলিটারির চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের আখাউড়া-ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া সড়ক পেরিয়ে পড়তে হবে তিতাস নদীর বুকে। তিতাসে পৌছলে আর কোনো চিন্তা নেই। কেননা কোনোভাবে দিন সাতেক নৌকা চালিয়ে পৌঁছে যাবো ঢাকা।

আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকা উত্তর অর্থাৎ সাভার-ঢাকা অঞ্চলের পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনীকে খতম করার।

আগস্টের শেষ প্রায়। আমরা বাহান্নজন মুক্তিযোদ্ধা এই উত্তেজনার্পূন কাজে ঢাকা যাবো। ঢাকা যেতে হলে এই মনিঅন্দে আসতে হয়। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় ক্যাম্প রয়েছে। এরা সব খবরাখবর রাখে। এরাই পার করে দেয় মুক্তিযোদ্ধা দলগুলোকে।

আমাদের জন্য সব ঠিকঠাক ছিল।

গত পরশু সন্ধ্যা নাগাদ আমরা ঢাকা কোম্পানির বাহান্নজন এবং ফরিদপুর কোম্পানির একশ’ পঞ্চাশ জন রওনা দিয়েছিলাম। রওনা দেয়ার আগে ক্যাম্প কমান্ডার ক্যাপ্টেন আইনুদ্দীন সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। সঙ্গে দিয়েছেন তিরিশ জন সৈনিক। ওরা নিরাপদে আমাদের পার করে দেবে আখাউড়া-ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া মহাসড়ক।

পার হওয়ার নকশাটি ছিল-দশটি বড় নৌকায় আমরা অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে প্রথমে পার হবো ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া-আখাউড়া রেলসেতু। ওই সেতু পার হলে পানিতে সয়লাব একটি বড় বিলে গিয়ে পড়বে আমাদের নৌকাবহর। ওই বিল আড়াআড়ি পাড়ি দিলে দেখা মিলবে আখাউড়া-ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া মহাসড়ক। ওই সড়কের একটি নির্দিষ্ট সেতুর নিচ দিয়ে আমাদের নৌকা পার হয়ে যাবে তিতাসের বুকে। নকশা অনুসারে আমরা সন্ধ্যার পর নেমে আসা নিস্তব্ধ রাত্রির ঘুটঘুটে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে নিরাপদে পার হয়ে যাই রেলসেতু। নৌকা দশটি আস্তে আস্তে পানি কেটে বিল পাড়ি দিয়ে প্রায় আখাউড়া-ব্ৰাক্ষণবাড়িয়া মহাসড়কের নির্দিষ্ট সেতুর কাছে পৌঁছে যায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বুকের হৃৎপিণ্ডের টিপটপ শব্দ। আমরা তখনো জানি না কী ভয়াবহ সময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সামনে ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের সাতটি নৌকা। পেছনে আমাদের তিনটি। সেতুর একেবারে কাছে ওরা। হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে গর্জে উঠল শত শত রাইফেল আর মেশিনগান। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনের সাতটি নৌকার চারটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কী করবো বুঝতে পারছি না।

তড়িৎ গতিতে বাকি নৌকার মাঝিরা নৌকা ঘুরিয়ে ছুটি দিল। বুঝতে পারলাম আমরা ফাঁদে পড়েছি। যেভাবেই হোক পাকিস্তানিরা আমাদের প্ল্যান আগেই টের পেয়ে মহাসড়ক ও সেতুর ওপর স্থান নিয়েছে। মেশিনগান, রাইফেলের বিরতিহীন গুলি আর মটারের গোলায় আমরা ছিন্নবিচ্ছিন্ন। সামনের নৌকার মুক্তিযোদ্ধাদের আর্তচিৎকার আর কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। আমরা দ্রুত নৌকা ঘুরিয়ে অথৈ পানির মাঝে জেগে থাকা ছোট্ট একটি মাটির ঢিবির আড়ালে চলে আসি। নৌকা থেকে নেমে সাতার কেটে কেটে নৌকা তিনটিকে আমরা নিয়ে আসি আরো নিরাপদ স্থানে। সারারাত ধরে চলে গোলাগুলি। আমাদের কিছুই করার নেই । পানির ওপর মাথা জাগিয়ে অপেক্ষা করি কখন ভোর হবে। ক্রমেই পাকিস্তানিদের গুলি থেমে আসে। ভোরের আলোতে দেখতে পাই মহাসড়কের সেতু হতে মাত্র ৫০ গজ দূরে আমরা। সেতুর ওপর পাকিস্তানি ঘাতক সৈনিক। চারপাশে সহযোদ্ধাদের লাশ। ক্ষোভ, দুঃখ আর ক্ৰোধে পানির ভেতর সারারাত থাকা শরীরের রক্ত চনচন করে ওঠে। প্রতিশোধ, প্ৰতিশোধ নিতে হবে। তবে এখনই কিছু করতে যাওয়া মানে আত্মহত্যা। প্রথমে ফিরে যেতে হবে ক্যাম্পে। কতজন বেঁচে আছি আমরা। এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। প্রথম কাজ যারা বেঁচে আছে সবাইকে একত্রিত করে ঘাঁটিতে ফেরা। পানিতে নুইয়ে থাকা ঝোপ আর বাঁশঝাড়ের আড়ালে সাঁতার কেটে ক’জন যোদ্ধা ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে জীবিত সবাইকে একত্রিত করে ফেললো। হিসাব করে দেখা গেল চুয়াল্লিশ জন নেই। আমরা বুঝে নিলাম চুয়াল্লিশ জন সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছে। এবার ফিরে চলা। সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পে পৌঁছলাম। উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করছিল মনিঅন্দ ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা। হতভম্ব, ক্লান্ত, শ্ৰান্ত মুক্তিযোদ্ধারা সবাই দাঁড়ালো সারি বেঁধে ক্যাম্প কমান্ডারের সামনে নতমুখে। সবার চোখে দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। বিষাদ করুণ কণ্ঠে কমান্ডার সান্তুনা দিলেন। তারপর সবাইকে বিশ্রাম নিতে বললেন। আমরা যার যার তাঁবুতে চলে গেলাম। সন্ধ্যার পরপরই মুষলধারে বৃষ্টি নামল, সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া। যেন প্রকৃতি রাগে আর ক্ষোভে কাঁদছে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। সাখী হারানোর বেদনায় ভারাক্রান্ত দীর্ঘ যাত্রায় পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা বৃষ্টি ও ঝড়ের ঠাণ্ডায় আস্তে আস্তে সবাই নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লো।

চলবে
বর্ননা – বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!