You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী ১৪ মে ১৯৭২ তারিখের মূল পত্রিকা

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/01/1972.05.14-bani.pdf” title=”1972.05.14 bani”]

বাংলার বাণী

ঢাকাঃ মঙ্গলবার, ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৯

 

বাঙালী উদ্ধারের নামে —-

 

স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশে সমিতি সংঘের সংখ্যা বেড়েছে। নানাবিধ উদ্দ্যেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে এস্তার সভা সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে। আর এই সকল সভা সমাবেশে নিজেদের বক্তব্য রাখছেন পরিচিত অপরিচিত নানা শ্রেণীর বক্তারা। সকলেই সৎ উদ্দ্যেশ্য নিয়ে সমিতি সংঘ গড়ছেন এমন মনে করবার কোন কারণ নেই। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে নিজেদের খুটি গাড়বার প্রচেষ্টায় দেশী বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্রাজ্যবাদী মহল তৎপর হবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের পর বাংলাদেশের মানুস প্রতিক্রিয়াশীলতার খাটি এবং প্রগতিবিরোধী শক্তিসমূহকে উচ্ছেদ করবার দৃহ শপথ গ্রহণ করেছেন এবং পুরোন ও চিহ্নিত প্রতিক্রিয়াশীল সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই বেয়াইনী বলে ঘোষিত হয়েছে। তাই তারা নূতন সংস্থা ও ব্যানারে আশ্রয়ে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে চাইছেন এবং নিজেদের কার্যকলাপ এবং বক্তব্যের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের শত্রুদের সহায়তা করে চলেছেন।

রাজধানী ঢাকার বুকে যে সকল সমিতি সংস্থার নয়া উদ্ভব ঘটেছে বাঙালী উদ্ধার সমিতি এবং জাতীয় মহিলা ফেডারেশন তাদের অন্যতম। বেশ ক’দিন সাবত তারা সভা সমাবেশের আয়োজন করেছেন। দৃদুনন্দভাবে তারা এগিয়ে চলেছেন বিশেষ লক্ষ্যপথে। পাকিস্থানে আটক বাঙালীদের জন্যেই মূলতঃ এদের দরদ উছলিয়ে পড়ছে। রাজধানী ঢাকার কিছু ‘গো গো গার্ল’ এবং পাকিস্থানী সামরিক বাহিনীর যোগসাজশকারী ব্যক্তিদের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের কর্মততপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাঙালীদের হ্রদয়তন্ত্রীর এক কোমল স্থানে অত্যন্ত সুচতুরতার সঙ্গে আঘাত করে তারা চাইছেন তাদের লক্ষ্য হাসিল করতে।

এই লক্ষ্যটি কি? উদ্দ্যেশ্য তাদের কতটুকু মহৎ! জনসাধারণ তাদের এই প্রশ্নের জবাব খুজতেই হাজির হয়েছিলেন সেদিন বাঙ্গালী উদ্ধার সমিতি ও জাতীয় মহিলা ফেডারেশন আয়োজিত সভায়। কর্মক্ষমতা ও দক্ষতার যুক্তি তুলে সভার উদ্যোক্তরা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর দালাল ও স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণকারী কিছু ঝানু বুরোক্রাটদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করেছেন।

বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য যার নিপুণ ও দক্ষ হস্ত সব সময় সক্রিয় থাকত সেই শফিউল আজম এবং তদানীন্তন পাকিস্তান ষ্টেট ব্যাংকের গভর্নর জনাব রশিদ সাহেবের জন্য এদের দরদটা যেন খানিক বেশী। বক্তাদের মধ্যেও ছিলেন পাক হানাদার বাহিনীর সহায়তাকারী ও পিডিপি-জামাত চক্রের বিশিষ্ট নেতৃবর্গ। বক্তব্য ও বক্তাদের চরিত্র ও অতীত কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াকাবহাল হবার পর জনসাধারণ স্বভাবতই প্রশ্ন তুলেছেন এই রাজাকার দালালের দল আবার মাঠে নামার সাহস পেল কোথা থেকে?

বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ নিয়ে দেন দরবার চলছে। প্রশ্নটি জটিল বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মিঃ ভুট্টো সমস্যাটিকে অত্যন্ত জটিল করে তুলেছেন। এখন প্রয়োজন রয়েছে সমস্যাটি অত্যন্ত বিজ্ঞতা ও সুষ্ঠুতার সঙ্গে মোকাবিলা করার। বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এ বিষয়ে ব্যক্তিগত ও সরকারী পর্যায়ে এমন অনেক ব্যবস্থায় গ্রহণ করেছেন যা হয়ত অন্ততঃ পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের নিরাপত্তার জন্যই জনসাধারণ্যে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে আটক চার লাখ বাঙালী পরিবার উদ্ধারের নামে অতি পরিচিত কিছু সংখ্যক আমলাদের জন্য বিশেষ উদ্দ্যেগ প্রকাশ কি উদ্দ্যেশ্য প্রণোদিত নয়? পাকিস্তানে আটক বাঙালীরা অবশ্যই স্বদেশে ফিরে আসবেন কিন্তু বাঙ্গালী পরিচয়ে কোন শফিউল আজম, রশীদ, নুরুল আমীন যাতে পুনরায় বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে না পারে সেজন্য বাংলার সচেতন জনগোষ্ঠী সদা সতর্ক রয়েছেন।

দূর হোক অজ্ঞতা ও অন্ধতা

গত পরশুদিন রাষ্ট প্রধান জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক সাধারণ সভায় বক্তৃতা দানকালে অজ্ঞতা দূরীকরণের জন্যে বুদ্ধিজীবীদেরকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এই অজ্ঞতা দূর করার ব্যাপারে বুদ্ধিজীবীদের মহান দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন – ‘জনসাধারণের মানসিকতায় আজ মুক্তবুদ্ধির দীপশিখা প্রজ্বলিত করা আবশ্যক। মুক্ত চিন্তাই আত্নিক মুক্তির প্রেরণার উৎস। মনের মুক্তি না ঘটলে প্রকৃত স্বাধীনতারও আস্বাদন সম্ভব নয়। এজন্যেই, মানসিক তামসিকতা অবসানের দায়িত্ব বুদ্ধিজীবীদের’। বস্ততঃ দেশের আপামর মানুসের শিক্ষা ও নৈতিকতার মানোন্নয়নে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব অপরিসীম। সরকার বিঘোষিত নীতি সমূহকে সত্যিকার বাস্তব রূপদানের ব্যাপারে দেশের শিক্ষিত ও জ্ঞানীজনের দায়িত্ব অনেক। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায়ই মানুষের নৈতিকতা, শিক্ষা- দীক্ষা  ও মুক্ত চিন্তার দ্বারা স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ নিরূপণে সকল অজ্ঞতার অবসান হতে পারে। অতীতে দেশের নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য অনেক আশার বাণী প্রচার করা হতো। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তার সুফল দেশবাসী দেখতে পায়নি। বরং অশিক্ষা ও কুশিক্ষার দ্বারা দেশের মানুসকে চিরদিন গোলাম করে রাখার ষড়যন্ত্র অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে করা হয়েছিল। আজ স্বাধীনতার পর সেই অজ্ঞতা মোচনের জন্যে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। একটি জাতির সার্বিক উন্নতিও নির্ভর করে তার শিক্ষার মানের উন্নয়নের উপর। তাই দেশের বর্তমান বিভিন্ন প্রকার কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সময় জনগণের শিক্ষা ব্যবস্থারও বিপ্লবাত্নক পরিবর্তনের প্রয়োজন। নিরক্ষরতা একটি জাতীয় অভিশাপ বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষকে বাস্তব ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, বয়স্কদের শিক্ষাদানের বিষয়টা ইতিপূর্বে কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করেছেন। সহজ ও গণোমূখী শিক্ষার প্রবর্তন করে দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে হবে। এ ব্যাপারে দেশের সচেতন শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদেরকেও সরকারের সঙ্গে একাত্ন হয়ে কাজ করতে হবে। যতদিন আমরা অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোয় পৌছাতে না পারব ততদিন জাতির সার্বিক উন্নতি আশা করা বৃথা। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে সকল অজ্ঞতা ও অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমাদের সংঘবদ্ধ অভিযান চালাতে হবে। কর্তৃপক্ষ এ পরিবর্তনের জন্যে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলেই বিশ্বাস রয়েছে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!