বাঙলাদেশের এক গেরিলা-নেত্রী সাহানা
জয়নুল আবেদীন
দুলালের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল খুলনার দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের এক ঘাঁটিতে। তখন জুলাই মাসের মাঝামাঝি। সুন্দরবনাঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধারা পাকি হানাদারদের সঙ্গে যে-কটি সংঘর্ষে সাফল্য অর্জন করে দুলাল সেই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামগুলাের প্রায় সব কটিতে অংশ গ্রহণ করেছিল। বরিশালের কৃতী সন্তান মহিউদ্দীনের নাম উল্লেখ্য। মঠবাড়িয়া থানাতেই ওর বাড়ি। দুলালকে আমি জানি, অন্তরঙ্গভাবেই জানি। কিন্তু তার ছােট বােনকে জানতাম না। বাঙলার স্বাধীনতা সংগ্রামে যে কটি তরুণী পাক বর্বর সেনাদের মুখােমুখি লড়াই করে আত্মহুতি দিয়েছে তাদেরই একজন দুলালের বােন। এই দেশপ্রেমিক যুদ্ধে যে গ্রামবাংলার কত তরুণ-তরুণী আত্মাহুতি দিয়েছে, কত নারী যে নিজের ইজ্জত বিকিয়ে দেওয়ার বদলে । লড়াই করে শহিদের মৃত্যুবরণ করেছে তার ইতিহাস অনেকেই জানে না, হয়তাে জানা সম্ভবও নয়। এ ঘটনাও ঠিক তেমনি অনেক ঘটনার সঙ্গে বিস্মৃতির অতল তলে তলিয়ে যেত যদি না দুলালকে পেতাম। কিন্তু তার নাম? নাম ধরুন না কেন সাহানা বা অন্য কিছু। সাহানা আই এ পড়ত। বড় ভায়ের কাছে রাইফেল চালনা শিখেছে। স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা মুক্তিফৌজের গ্রুপ কমান্ডার দুলাল।
জুনের শেষের দিকে মঠবাড়িয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিদস্যুরা হিংস্র হায়নার মতাে। বহু গ্রাম পাকি দস্যুরা ভস্মীভূত করে। শত শত নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে, ধরে নিয়ে যায় অসংখ্য তরুণীকে, প্রাণভয়ে হাজার হাজার লােক পালিয়ে যায়।
বড় মাছুয়া গ্রামে দুলাল কজন সহযােদ্ধা নিয়ে আত্মগােপন করেছিল। জামাতপন্থী দালালরা পাকসেনাদের খবর দেয়। দুলালেরা দল শত্রুসেনা কর্তৃক আক্রান্ত হয়। বীর স্বাধীনতা-সংগ্রামীরা দুজন দস্যুসেনাকে খতম করলে শত্রুরা হটে যায়। এই ঘটনার পর দুলাল সহযােদ্ধাদের নিয়ে অন্য গ্রামে চলে যায়।
এদিকে দুলালদের গ্রামে পাক দস্যুসেনারা হানা দেয়, আরম্ভ হয় অবাধ লুণ্ঠন, নির্মম হত্যাকাণ্ড আর বলাৎকার। অজস্র গােলা ফেটে পড়ে সাহানাদের বাড়ির চতুর্দিকে। মুহুর্তের মধ্যে পিতা-পুত্রী স্থির করে ফেলে কর্তব্য। দুটি রাইফেল রেখেছিল দুলাল আত্মরক্ষার জন্য। পিতা-পুত্রী জানালা দিয়ে বেপরােয়া গুলি চালাতে থাকে পাক বর্বরদের ওপর। চারটি নরপশু ধরাশায়ী হয়। একটি গােলা এসে সাহানার বাবার বক্ষভেদ করে চলে যায়। হানাদারদের আগুনে গােলায় ঘরে আগুন ধরে যায়। সাহানা ভাই-এর প্যান্ট শার্ট পরে পুরুষের বেশে পেছনের দরজা দিয়ে পালাল। বাতাসে ভেসে আসে মা এবং ছােট ভাইদের আর্ত চিৎকার।
স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি পরিবার কীভাবে আত্মহুতি দিল শুনছিলাম সেই বীরত্বপূর্ণ কাহিনি আর মাঝে মাঝে বক্তার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম জলভরা চোখ দুটি। মা-বাবা ও ছােট ভাইদের নির্মম পরিণতির কথা বর্ণনা করতে তার বক্ষ কী দারুণভাবে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল সেই দৃশ্য দেখে আমারও হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলাে। বললাম, দুলালভাই—এখন থাক, পরে শুনবাে। দুলাল আমার হাত চেপে ধরে বললে,—না
—এখনই শুনুন। বার বার স্মরণ করে দুঃখ পেয়ে লাভ কী? তার চেয়ে বরং এখনই বলে ফেলি। দেখলাম—মুহূর্তের মধ্যে দুলালের চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বেরুচ্ছে যেন। সে বলতে লাগল খুব জোরে মাটির ওপর রাইফেলটা দিয়ে এক গুঁতাে মেরে, সাহানা আমার উপযুক্ত বােনই … ওর মৃত্যুতে আমার কোনাে দুঃখ বরং গর্বিত আমি নেই বলে পরিচয় দিতে। … প্রতিশােধ নিয়েছে। বীরপ্রতীক … বাঙলার বীরাঙ্গনা সে। … মর্যাদা উত্তুঙ্গ পর্বতের মতাে … রেখেছে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত।
জুলাই-এর প্রথম সপ্তাহে পিরােজপুরের কাছে আটঘর কুড়িয়ানায় সাহানা আবার লড়াই করেছে শত্রুসেনার মুখােমুখি। সাহানা ছােট্ট একটি গেরিলা দলে পাঁচজন তরুণী। নিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে। আটঘর কুড়িয়ানায় তিন দিনের লড়াই এ পাকসেনাদের পক্ষে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পর বহু গানবােট ও স্টিমারে সৈন্য আমদানি করে পাক বর্বররা আটঘর কুড়িয়ানায় প্রচণ্ড হামলা চালায়। পাকসেনারা দূর-দূরান্ত থেকে নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে এনে শতশত একর পেয়ারা বাগান কেটে ফেলতে বাধ্য করে কারণ গেরিলারা এখান থেকেই আক্রমণ পরিচালনা করছিল। গেরিলারা চতুর্থ দিনের লড়াই এ শত্রুপক্ষের দুটি গানবােট বিধ্বস্ত এবং ৫০ জন দস্যুসেনা খতম করে সরে পড়ে। কিন্তু সাহানা তার ছােট্ট দলটি নিয়ে … মধ্যে আটকা পড়ে।
তাদের কাছে তিনটি পিস্তল এবং দুটি রাইফেল ছিল। সাহানার নির্দেশে সাহযােদ্ধারা রাইফেল ফেলে দিল। নরপশুরা ওদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে। সাহানা কামার্ত পশুদের প্রলুব্ধ করতে সক্ষম হয়। বর্বরগুলাে ওদের সামনে আসতেই সাহানাদের পিস্তলগুলাে গর্জে উঠলে। ভুলুষ্ঠিত হলাে দস্যুরা। দলের সেনাদের এই পরিণতি দেখে অন্যান্য পাকি সেনারা ওদের কাছে আসতে ভরসা পেল না। দূর থেকে ওদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয় এবং গুলি করা হবে না বলে ঘােষণা করে। | সাহানা বুঝতে পারে, নরপশুদের চাতুরী। সে পরবর্তী কর্মসূচি স্থির করে ফেলে মুহূর্তের মধ্যে। তার
যাদ্ধা বীরাঙ্গনাদের মৃত্যুর জন্য তৈরি হতে নির্দেশ দেয়। পাকজঙ্গীদের হাতে ধরা পড়ে কলঙ্কিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে শহিদের মৃত্যুই শ্রেয়। আবার ওদের পিস্তলগুলাে গর্জে উঠল। এবার নিশানা শত্রুসেনা নয়। নিজেরাই নিজেদের বক্ষে শেষ বুলেট বিদ্ধ করল। বাঙলার স্বাধীনতা-সংগ্রামে এমনি করে শেষ হলাে বীরাঙ্গনা সাহানার সম্ভাবনাময় জীবন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় প্রােজ্জ্বল হয়ে রইল। সাহানা আর তার কজন সহযােদ্ধা তরুণীর বীরত্বপূর্ণ কাহিনি।
সূত্র: সপ্তাহ, ০৩ ডিসেম্বর ১৯৭১