You dont have javascript enabled! Please enable it!

৪০ হাজার মুক্তিযােদ্ধা ঢাকার দিকে এগিয়ে চলেছে
(বিশেষ প্রতিনিধি)

দেশজননীর শৃঙ্খল মােচনে স্বাধীনতার পতাকাবাহী মুক্তিযােদ্ধা গেরিলাদের বিজয়রথ এগিয়ে চলেছে পাকিস্তানি জঙ্গীশাহী উপনিবেশবাদী ভাড়াটিয়া হানাদারবাহিনীকে পিষ্ট, নিশ্চিহ্ন, নির্মূল করে। অনিবার্য চূড়ান্ত পরাজয়ের মরণভয়ে ভীত পাকিবাহিনী ক্রমাগত পিছু হটছে আর নিত্য নতুন অঞ্চল মুক্ত হয়ে সেখানে বাঙলাদেশের পতাকা উড়ছে। জলে-স্থলে সর্বত্র মুক্তিযােদ্ধা গেরিলারা হানাদারবাহিনীর বুকে আঘাত হেনে যমদূতের মতাে ত্রাসের সঞ্চার করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত এলাকায় গড়ে উঠছে বাঙলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামাে, মুক্ত এলাকায় জেলা শাসক, পুলিশ সুপার নিযুক্ত হচ্ছে। চালু হচ্ছে থানা, সাব-রেজিস্টারি অফিস, ইউনিয়ন বাের্ড অফিস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র। মুক্ত এলাকায় ডাকঘর চালু হয়েছে, টেলিগ্রাম চালু হয়েছে, এমনকি দুইটি অঞ্চলে টেলিফোনও চালু হয়েছে। মুক্ত এলাকার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে সমস্ত অঞ্চলে। টাঙ্গাইল শহর মুক্ত, মুক্ত হয়েছে কুড়িগ্রাম। মুক্ত হয়েছে রংপুর জেলার, দিনাজপুর জেলার বিরাট অঞ্চল। রংপুর জেলার পাশাপাশি আটটি থানা মুক্ত হয়ে সেখানে পূর্ণ বেসামরিক প্রশাসন কায়েম হয়েছে। এই আটটি থানার ১২ শত স্কোয়ার মাইল নিয়ে … গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী …। সে … স্থলপথে অথবা বিমানপথে হানা দেবার চেষ্টা করা হলে বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা বিমান আক্রমণের জবাব বিমানে দেবেট্যাঙ্ক এগিয়ে এলে ট্যাঙ্কই তার মােকাবিলা করবে। থানা ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে টেস্ট রিলিফের কাজ শুরু করা হয়েছে। পাটগ্রাম, ফুলবাড়ী, সােনাহাট, হাতিবাধা—প্রতি থানা এলাকায় চলছে নিরাপদ, নিশ্চিন্ত ও স্বাধীন জনজীবন। বাঙলাদেশের মােট ৫৯০০০ বর্গমাইল এলাকার মধ্যে ১২০০ বর্গমাইল আজ মুক্তাঞ্চল ; এছাড়া ১৮০০০ বর্গমাইল কার্যত মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।
কিন্তু এইখানেই শেষ নয়। ঢাকা নগরীর ক্রমেই কাছে চলে আসছে মুক্তাঞ্চলের সীমানা। ঢাকা জেলা ঘিরে যে জেলাগুলাে আছে সেই জেলাসমূহের প্রতিটি থেকেই মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলেছে ঢাকার দিকে। ইতিমধ্যে ঢাকা শহরে আশ্রয় নিয়ে অ্যাকশন শুরু করে গেরিলারা। শিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ এলাকার সাধারণ মানুষ। গেরিলা মুক্তিযােদ্ধাদের মারে অতিষ্ঠ হয়ে গত বুধবার ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা শহরে অনিদিষ্ট কালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করেছিল। সান্ধ্য আইন জারির পরই ব্যারাক থেকে হাজার হাজার পাঞ্জাবী সেনা বেরিয়ে এসে আক্রমণ শুরু করেছিল সাধারণ মানুষের উপর। সেই সঙ্গে চলেছিল পাশবিক অত্যাচার। গত বুধবার এইভাবে বাড়ি বাড়ি ঢুকে প্রায় এক হাজার মানুষকে রাস্তায় টেনে বের করে ও গুলি করে হত্যা করে। অজস্র মহিলা যাদের বয়স ১২ থেকে ৪২ এর মধ্যে তাদের হতে হয় পাশবিক অত্যাচারের শিকার।
কিন্তু দিনের আলাে শেষ হতেই হাওয়া ঘুরে যায়। শুরু হয় গেরিলাদের পাল্টা মার। পুরাতন ঢাকার অলিতে গলিতে শুরু হয় সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধা গেরিলাদের খণ্ড যুদ্ধ। এই যুদ্ধ অন্ধকারের পাকি সৈন্যরা পিছু হটতে শুরু করে। যে সান্ধ্য আইন জারি করে গেরিলা খুঁজে বের করতে চেয়েছিল বিজয় সেই সান্ধ্য আইন গেরিলাদের অনুকুলে চলে যায়। অর্থাৎ রাস্তায় সাধারণ মানুষ না থাকায় গেরিলাদের সামরিক বাহিনীর প্রতি আক্রমণ সুনির্দিষ্ট করার সুবিধা হয়। অবস্থা খারাপ বুঝে অনির্দিষ্ট কালের জন্য জারি করা সান্ধ্য আইন ১২ ঘণ্টা মেয়াদ শেষ হবার আগেই তুলে নিতে হয়।
ঢাকার আর-এক সংবাদ হলাে, ডা. মালেকের পুতুল মন্ত্রিসভার সদস্যরা সকলে এখন বাড়িঘর ছেড়ে একটা সার্কিট হাউসে আশ্রয় নিয়ে আছে। সেই সার্কিট হাউসটি সামরিক বাহিনী দুর্গের মতাে পাহারা দিচ্ছে। রাজভবনকেও একটি সামরিক দুর্গে পরিণত করে গভরণর ডা. মালেককে পাহারা দিচ্ছে। ঢাকার বড় বড় পয়সাওয়ালা ব্যক্তিরা অনেকেই ইতিমধ্যে ঢাকা ছেড়ে করাচী রাওয়ালপিণ্ডি চলে গেছে। কেউ কেউ সুদূর আমেরিকা গ্রেট ব্রিটেনে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কারণ এরা সকলেই বুঝে গেছে, রমনার রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় ময়দানে মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় উৎসবের দিন আর দূরে নয়।

সূত্র: সপ্তাহ, ২৬ নভেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!