কুখ্যাত ফ্যাসিষ্ট সংগঠন— আল বদর
[বিশেষ প্রতিনিধি]
ডিসেম্বরের ১২ তারিখে রাত্রি আটটা নাগাদ ঢাকা ইউনিভার্সিটির লাগােয়া প্রফেসরস কোয়াটারের একটি দরজায় কে যেন টোকা দিল। অধ্যাপক সদরুদ্দীন উঁকি দিতেই, গলা শােনা গেল, স্যার, আমি আপনার ছাত্র—একটু বাইরে আসবেন? অধ্যাপক সদরুদ্দীন বাইরে আসতেই একদল সশস্ত্র যুবক তাকে ঘিরে ধরলাে এবং গাড়িতে উঠতে আদেশ করল।
যে যুবকেরা এইভাবে সদরুদ্দীন সাহেবকে নিয়ে গেল, তারা কুখ্যাত আলব-এর গােষ্ঠীভুক্ত ছাড়া আর কেউই নয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঢাকায় অবস্থানকালে যে ১৪৫ জনের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখন আমরা জানতে পারছি। অধ্যাপক সদরুদ্দীন সেই শহিদদের মধ্যে একজন। একজন ছাত্র কেন সদরুদ্দীনের মতন অধ্যাপককে হত্যায় সাহায্য করল, এ ভেবে হয়ত বাইরের পৃথিবী বিমূঢ় হয়ে যেতে পারে কিন্তু আলবদর সংগঠন প্রণালী জানতে পারলে তাতে আশ্চর্যের কিছু কারণ ঘটে না।
আলবদূর জামাত-এ ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলের ধর্মীয় উন্মাদনা জাগানাের মজবুত একটা সংগঠন। ফ্যাসিস্ত ধরনের এই গােষ্ঠীর সকলেই প্রায় তরুণ। প্রতি বিপ্লবী কাজকর্ম এবং অত্যাচার চালানাের অবলম্বন হিসাবে এদের আগ্নেয় অস্ত্রপাতিতেও শিক্ষিত করে তােলা হয়।
বহুদিন ধরে এই ধর্মব্যবসায়ী জামাত-এ-ইসলামী দল মানুষের মনে চারিয়ে দিতে চেয়েছে যে বাঙলাদেশের মানুষের মনে প্রকৃত ইসলামী চেতনাকে জাগানাে দরকার। অর্থাৎ, বােঝানাে হয়েছে, বাঙালি মুসলমানরা বহিরাগত অর্থাৎ প্রকৃত মুসলিম নয়। এইভাবেই পাকিস্তান সৃষ্টির গােড়া থেকে চলছিল।
জামাত-এ-ইসলাম প্রথম প্রগতিবাদী বামপন্থী এবং শ্রমিক নেতাদের লক্ষ্য করে কাজ শুরু করল। নাজীদের কায়দায় হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ারও পরিকল্পনানুযায়ী কাজ শুরু হয়ে গেল। অবশেষে যেসব নিরপেক্ষ মনােভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবী জামাতের সঙ্গে হাত মেলালেন না তাদের হত্যাভিযান চলল।
২৫ মার্চ রাত্রি থেকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীর উন্মাদনা জাগাবার প্রয়ােজন হলাে, ফলে জামাত আবার তার কালাে হাতের ছায়া ফেলল। তারা নতুন লােক নিয়ােগ করলাে, গেষ্টাপাে ধরণের মানব চক্র গঠন করে তার নাম দিল আল বদু এবং আল সামস্। এই সংগঠনগুলােকে পুরােপুরি হত্যা, অত্যাচার এবং ধর্মোন্মত্ততায় বিশ্বাসী করে তােলা হলাে। তাদের সৈন্যবাহিনীর সমস্ত মর্যাদা দেওয়া হলাে।
কুখ্যাত আর বর-এর শেষদিকের কাজকর্ম সম্বন্ধে আমাদের কাছে যে তথ্য পৌচেছে তাতে মনে হয় এই জঘন্য অমানবিকতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। শেষদিকে এই দুষ্টচক্রের পরামর্শদাতা ছিলেন দশজন পাকিস্তানি অফিসার। সংগঠনের উন্দাতা ও পরামর্শদাতাও বটে। এদের মধ্যে লে. ক. হিজাজি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা। সেই খুনী এবং আরাে অফিসাররা ভারতীয় সেনাবাহিনীর হেপাজতে যুদ্ধবন্দি হিসাবে বন্দি রয়েছে। বাঙলাদেশের বিক্ষুব্ধ জনতা এখন তাদের বিচার এবং কঠিন শাস্তি দাবি করছেন।
পাকি-সেনা নায়কদের তত্ত্বাবধানে এবং আল বদূর-এর ফ্যাসিস্ত উদ্যোগে শেষমুহুর্তে যারা শহীদী বরণ করেছেন তাদের মধ্যে আছেন ঢাকার বিখ্যাত হৃদরােগ বিশেষজ্ঞ ড. ফজলে রাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স এর ডেপুটি কোঅর্ডিনেটর ড. আব্দুল কালাম আজাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. আব্দুল খন্দর, মেডিক্যাল কলেজের চক্ষু বিষয়ক অধ্যাপক ড. আলি (আলিম] চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার ড. মুর্তজা এবং রমনা ইউনিয়ন কমিটির চেয়ারম্যান হিম্মদ ইয়াকুব প্রমুখ নিহতদের মধ্যে আরাে রয়েছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক, অধ্যাপক, আইনবিদ প্রণ্ডিতেরা ।
আলব-এর অধিকাংশ সভাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বাকিদের এখন হেঁকে তােলা হচ্ছে। কিন্তু জনতা চাইছেন আলব এবং আল সামস্-এর উদ্যোক্তা হিজাজি এবং অন্য সেনানায়কদের বিচার করা হােক। বাঙলাদেশ সরকারও এখনও এই দশজন অফিসারকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে ঘােষণা করার অভিমত পােষণ করছেন। এটি একটি জটিল প্রশ্ন হিসাবে উপস্থিত হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে ভারতের মানুষের সহানুভূতি বাঙলাদেশের মানুষের দিকে।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৪ জানুয়ারি ১৯৭২