You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইয়াহিয়া-টিক্কা মুজিবর রহমানকে তিনবার খুনের চেষ্টা করেছিল
[ঢাকা থেকে সপ্তাহ-র প্রতিনিধি]

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অক্লান্ত সংগ্রাম অন্তহীন দুঃখের তপস্যার সিদ্ধিলাভের পর স্বাধীন বাঙলার রাষ্ট্রতরণীর কর্ণধার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। দুর্জয় আত্মশক্তিতে বলীয়ান নেতা পাকিস্তানি জঙ্গীশাহীর হাত থেকে বাঙলাদেশের স্বাধীনতার রক্তসূর্যকে ছিনিয়ে এনেছেন। কিন্তু জল্লাদ ইয়াহিয়া খা, টিক্কা খা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গ্রেপ্তার করার আগে ও পরে মােট তিনবার খুনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিন বারই এই খুনের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জল্লাদের জিন্দানখানা থেকে ফিরে আসবার পর এইসব খুনের পরিকল্পনা-তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে প্রথম খুনের চেষ্টা হয় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ওই দিন ছিল রমনা রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক সমাবেশ, যে সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন—এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। কিন্তু ইয়াহিয়া খাঁ টিক্কা খাঁর সহযােগিতায় ওই দিনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। গুপ্তঘাতকরা ঠিক করেছিল, বঙ্গবন্ধু যখন রেসকোর্সের ময়দানে আসবেন তখন তাকে পথে মােটরের মধ্যে গুলি করা হবে। কিন্তু যারা এই ষড়যন্ত্র করছিল, তাদের সমস্ত কার্যসূচিই শেখ সাহেব আগে থাকতে জানতে পারেন। তাই সেই দিন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের সভায় আসেন নির্দিষ্ট সময়ের একঘণ্টা পরে আর নিজের নির্দিষ্ট সাদা গাড়িখানিও বদল করে অন্য গাড়িতে অন্য পথে সভায় আসেন। ফলে পথে অপেক্ষমান গুপ্তঘাতকরা ব্যর্থ হয়। কিন্তু সভার শেষে আওয়ামী লীগ অফিসে ফেরবার সময় একই প্রচেষ্টা হতে পারে সন্দেহ করে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের সভা অতি আকস্মিকভাবে শেষ করে দেন সংক্ষিপ্তভাবে অতি প্রয়ােজনীয় কথাগুলাে বলে এবং সভা চালু থাকতেই তিনি মঞ্চ থেকে নেমে সকলের আগে চলে যান। প্রকৃতপক্ষে যখন সভা ভাঙে বঙ্গবন্ধু তার অনেক আগেই পৌছে যান তার নির্দিষ্ট স্থানে।
দ্বিতীয় চক্রান্ত হয় ২৫ মার্চ রাত্রে। ওই দিন গুপ্তঘাতকরা দুটি পাথে প্রচেষ্টা চালায়। প্রথম পথ হলাে শেখ সাহেব কোন কারণে বাড়ির বাইরে এলে তাকে গুলি করা হবে। এই সময় প্রতিদিন শেখ সাহেবকে বাড়ির সামনে সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিতে বারে বারে বাইরে আসতে হত। কিন্তু ঘাতকদের এই পরিকল্পনার কথাও শেখ সাহেবকে পূর্বাহ্নে কে বা কারা জানিয়ে দেয়। ফলে শেখ সাহেব এই দিন কোন অবস্থায় বাড়ির বাইরে আসেননি। প্রকৃতপক্ষে ২৫ মার্চ রাত্রে যখন পরিকল্পনা হয় যে, সব নেতা নিরাপদ দূরত্ব চলে যাবেন এবং বঙ্গবন্ধুও চলে যাবেন তখনও কিন্তু তিনি প্রকৃত মনােভাব একমাত্র জনাব তাজউদ্দিন ছাড়া কাউকে জানতে দেননি। ফলে সকলেই যখন জেলে গেল শেখ সাহেবও বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন তখন তিনি বাড়িতেই থাকেন ও কোনক্রমে বাইরে আসেন না। গুপ্ত ঘাতকরা যখন দেখল শেখ কোনক্রমে বাইরে এলেন না তখন রাত ১১টা নাগাদ তারা দলবদ্ধভাবে বাড়ির সামনে এসে “জয় বাঙলা, বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ” ধ্বনি দিতে থাকে। কিন্তু অন্য সময় এইরকম ধ্বনি শুনে যেমন বঙ্গবন্ধু বাইরে এসে দাঁড়ায় ও জনতার অভিনন্দন গ্রহণ করেন—এই ক্ষেত্রে তা করলেন না, উপরন্ত ঘরের একটি মাত্র জানালা খােলাছিল, সেটি বেগম মুজিব যখন বন্ধ করতে যান তখন সেই জনতা যারা বঙ্গবন্ধু ধ্বনি দিচ্ছিল তারা সেই জানালা লক্ষ্য করেই গুলি ছুঁড়তে থাকে। তখন বঙ্গবন্ধু শিশুপুত্র রাসেল ও বেগম মুজিবকে নিয়ে স্নানের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। এইভাবে সমর্থকের ছদ্মবেশে বঙ্গবন্ধুকে দ্বিতীয়বার হত্যার ষড়যন্ত্র ও ব্যর্থ হয়ে যায়। ২৫ মার্চ রাত্রে বঙ্গবন্ধুকে কুর্মিটোলায় নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু সেখানে যে অফিসারের উপর বঙ্গবন্ধুর দায়িত্ব ছিল তিনি জানতে পারেন যে, কুর্মিটোলায় ক্যান্টনমেন্টের মধ্যেও শেখ সাহেবকে আকস্মিকভাবে খুন করা হতে পারে, তাই বঙ্গবন্ধুকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে সরিয়ে ঢাকায় নবনির্মিত দ্বিতীয় রাজধানীর এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত এই দ্বিতীয় রাজধানীর বিভিন্ন বাড়িতে রাখা হয়। এক রাত্রির বেশি কোথাও রাখা হয় না। বঙ্গবন্ধুকে শেষবার খুনের চেষ্টা করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের জেলের মধ্যেই। সেই কথা আগেই প্রকাশ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেবার সমস্ত ব্যবস্থা করা হয় এবং ফাঁসির পর কোথায় কবর দেওয়া হবে সেটাও ঠিক করে সেইমতে গর্ত খোঁড়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই জেলার নিজে শেখ সাহেবকে তিনদিন লুকিয়ে রেখে রক্ষা করেন। ইয়াহিয়া খা বিদায় নেবার শেষ মুহূর্তে তিনজন বিচারপতিকে দিয়ে মুজিবকে ফাঁসিতে ঝােলাবার একটা বিচারের রায়ও বের করেছিল কিন্তু জনাব ভুট্টো সেই রায় গুপ্তঘাতক বা ফাসির হাত থেকে মুজিব বেঁচে যান।

সূত্র: সপ্তাহ, ২১ জানুয়ারি ১৯৭২

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!