You dont have javascript enabled! Please enable it! বধ্যভূমির গদ্য (Unicoded) Part 3 - সংগ্রামের নোটবুক

বধ্যভূমির গদ্য (Unicoded) Part 3

বধ্যভূমির গদ্য- তৃতীয় খণ্ড

ইউনিকোড রূপান্তরঃ জুলকার নাইন

 

 

চুয়াডাঙ্গা জেলা

আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন থেকে আধা কিলোমিটার দূরে আলমডাঙ্গা লাল্ব্রিজের পাশে ছিল একাত্তরের বধ্যভূমি। এই ব্রিজের ওপর ছিল ট্রেন থামিয়ে মেয়েদের ও যুবকদের নামিয়ে নেওয়া হতো। তাঁদের উপর চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। নারীদের ধর্ষণ করা হতো। তারপর তাঁদের হত্যা করে পাশের ফাঁকা স্থানে মাটিচাপা দেওয়া হতো। একাত্তরের জুন থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই স্থানে প্রায় ২ হাজার মানুষ হত্যা করে।

 

আলমডাঙ্গা বধ্যভূমি

আলমডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা এম সবেদ আলী জানান, “আলমডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন থেকে আধা কিলোমিটার দূরে আলমডাঙ্গা লাল্ব্রিজের পাশে ছিল একাত্তরের বধ্যভূমি। এই ব্রিজের ওপর ছিল ট্রেন থামিয়ে মেয়েদের ও যুবকদের নামিয়ে নেওয়া হতো। তাঁদের উপর চালানো হতো অমানুষিক নির্যাতন। নারীদের ধর্ষণ করা হতো। তারপর তাঁদের হত্যা করে পাশের ফাঁকা স্থানে মাটিচাপা দেওয়া হতো। একাত্তরের জুন থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই স্থানে প্রায় ২ হাজার মানুষ হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়”।

 

ওয়াবদা গার্ড কোয়াটার বধ্যভূমি

আলমডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা এম সবেদ আলী জানান, “আলমডাঙ্গা ওয়াবদা ডিভিশনের বাংলোতে পাক সেনা অফিসারদের ক্যাম্প ছিল। ট্রেন থেকে নামিয়ে নেওয়া নারীদের ওই ক্যাম্পে সরবরাহ করা হতো। তারপর তাএর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে পাঠানো হতো লালব্রিজের পাশের নির্যাতন কেন্দ্রে। ওখানে সাধারণ সৈণিকরাও পাশবিক নির্যাতন চালাতো মেয়েদের ওপর। পরে তাঁদের হত্যা করে লাশ মাটি চাপা দেওয়া হতো”। “স্বাধীনতার পর ঐ স্থানটি সনাক্ত করা হয় এবং ওখান থেকে উদ্ধার করা হয় অনেক মানুষের কঙ্কাল”।

 

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল বধ্যভূমি

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইবাদত আলী বলেন, “চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের পেছনে ছিল একাত্তরের গণকবর। সদর হাসপাতালের টর্চার সেলে নারী পুরুষদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। তারপর তাঁদের হাসপাতালের পিছনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক গণকবর। স্বাধীনতার পর এখান থেকে শত শত মানুষের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়”।

 

চুয়াডাঙ্গা দক্ষিণ হাসপাতাল পাড়া বধ্যভূমি

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের দক্ষিণ দিকে বেশ কয়েকটি গণকবর ছিল। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান বাবু বলেন, “পাকিস্তানী বাহিনীর আর্টিলারি রেজিমেন্ট চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল ভবনে মূল ঘাঁটি স্থাপন করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সদর হাসপাতালের একটি কক্ষে লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন চালানো হতো। অনেক সময় প্রকাশ্যে গাছে ঝুলিয়ে মারা হতো। হত্যার পর হানাদার বাহিনী দক্ষিণ হাসপাতাল পাড়ার গণকবরে তাঁদের মাটিচাপা দিয়ে রাখতো।

 

শান্তিপাড়ার বাবলা বাগান বধ্যভূমি

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান বাবু বলে, “সদর হাসপাতালের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে বর্তমান শান্তিপাড়ায় তখন ছিল ফাঁকা মাঠ। সেখানে অসংখ্য বাবলা গাছ ছিল। এখানে অনেক লোককে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। প্রায় রাতেই এ এলাকায় গুলির শব্দ শোনা যেত। যাদের হত্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো তাঁদের ধরে এনে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হতো। তারপর তাঁদের বাবলা বাগানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হতো।

 

থানা কাউন্সিল পাড়া বধ্যভূমি

রাজিব আহমেদ লিখিত ‘চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে অগণিত মানুষকে শান্তিপাড়ায় গণকবরে মাটিচাপা দেওয়া হলেও গণকবরগুলো চিহ্নিত কতা হয়নি। স্বাধীনতার পরপরই থানা কাউন্সিলের দক্ষিণ-পূর্বদিকে রেললাইনের কাছে খালের পাশে গণকবর থেকে শতাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়। বর্তমান রেলস্টেশনের দক্ষিণ-পূর্বদিকের খাদেও বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়”।

 

উপজেলা পরিষদের বধ্যভূমি

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান বাবু বলেন, “বর্তমানে যেখানে উপজেলা পরিষদ তার ভেতরের মাঠে ছিল একাত্তরের গণকবর। এখান থেকে আদালতের পেশকার আজিজুল হক মল্লিক, পেশকার দাউদ হোসেন, সাংবাদিক আবুল কাশেমসহ আরো অনেকের লাশ উদ্ধার করা হয়”।

 

জীবননগর থানার পেছনের বধ্যভূমি

মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দীন বলেন, “জীবননগর থানা ভবন ছিল পাক বাহিনীর টর্চার সেল। এখানে নিরীহ ও মুক্কতিকামী লোকদেরকে ধরে এনে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হতো এবং টর্চার সেলের পিছনে লাশ পুঁতে রাখা হতো। থানার পিছনের ঐ অংশটি পরবর্তীতে কবরস্থানে পরিণত হয়েছে”।

 

জীবননগর স্টেডিয়াম মোড়ের বধ্যভূমি

মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দীন বলেন, “তৎকালীন সময়ের জীবননগরের ঝাউতলার নিকট একটি বড় গর্তে (বর্তমানে জিবননগর স্টেডিয়াম মোড়ের পাশে) ৩০ থেকে ৩৫ জনের লাশ পাওয়া যায়।

 

জীবননগর কলাবাগান বধ্যভূমি

মুক্তিযোদ্ধা মীর মাহতাব উদ্দীন বলেন, “জীবননগর মৎস্য হ্যাচারীর দক্ষিণে বর্তমানে অফিসার্স ক্লাবের পাশে ঐ সময় বিশাল এক কলাবাগান ছিল। এখানে ৮-১০ জনের লাশ পাওয়া যায়। দৌলৎগঞ্জ শাহদত মোল্লার বাড়ির পাশে ৬টি লাশের সন্ধান মেলে”।

 

উথলী-আকন্দবাড়িয়া বধ্যভূমি

মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দীন বলেন, সবচাইতে বেশি লাশ পাওয়া গিয়েছিল উথলী-আকনবাড়িয়ায় (বর্তমানে গুচ্ছগ্রাম) ও ট্রেন লাইনের ধারের ইটভাটায়। পাকবাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক ধরে দর্শনায় জড়ো করতো। বিশেষ ট্রেন যোগে উথলী রেল ইয়ার্ডে লোক জড়ো করে কসাইখানা খুলে জবাই করতো। পরে ঐ ভাটার পাশে লাশ ফেলে রাখা হতো। এছাড়াও লাশগুলো পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করা হতো।

 

নাটুদহ বধ্যভূমি

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার রহমান জানান, “দামুঢ়ুদার হাজার দুয়ারি স্কুলের প্পেছনে ছিল গণকবর। ওই স্কুলেই হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এলাকার শত শত মানুষকে এখানে ধরে এনে নির্যাতন করে স্কুলের পেছনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো”।

 

জগন্নাথপুর আটকবর

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার রহমান জানান, “দামুড়হুদার জগন্নাথপুরে আছে আট শহীদের কবর। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে নিহত হন আটজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদেরকে এখানে কবর দেওয়া হয়”। আট শহিদের কবরের ওপর নির্মিত হয়েছে স্মৃতিসৌধ।

 

হাটবোয়ালিয়া গণহত্যা

আলমডাঙ্গার হাটবোয়ালিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম মাস্টার জানান, “হানাদার বাহিনী আলমডাঙ্গা থেকে কয়েকজনকে ধরে এনে হাটবোয়ালিয়া ব্রিজের কাছে গুলি করে হত্যা করে”।

 

সরোজগঞ্জ গণহত্যা

হানাদার বাহিনী ঝিনাইদহ থেকে চুয়াডাঙ্গা শহরে ঢোকার সময় বৈশাখ মাসের ২ তারিখ বিকেলে চুয়ায়ডাঙ্গার সরোজগঞ্জ বাজারে গুলিবর্ষণ করে হাটে আসা মানুষদের হত্যা করে। ঐদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন শাহাপুর গ্রামের আজগর আলি। তিনি জানান, হানাদার বাহিনী ওইদিন ৬০/৭০ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। অনেকের লাশ পড়ে ছিল হাটের পাশের মাঠে। এলাকার যারা তাঁদের স্বজনদের লাশ সনাক্ত করতে পেরেছিল তারা লাশ নিয়ে গিয়েছিল। তবে অনেকের লাশ পড়ে ছিল হাটের পাশের মাঠে। কুকুর শেয়ালে এখানে অনেক লাশ টানা হ্যাচড়া করেছে।

 

দশমাইল বধ্যভূমি

চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করে পাকবাহিনী ১৫ ও ১৬ এপ্রিল এলাকায় হত্যা, লুট ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে দেয়। ের এক পর্যায়ে তারা দশমাইলে আসে এবং এখানে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-২২৩, ৪০১)

 

শরৎগঞ্জ বধ্যভূমি

পাকবাহিনী একাত্তরের ১৫ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা জেলায় ঝিনাইদহ সড়কের দশ মাইল দূরে শরৎগঞ্জ এলাকায় আসে এবং শরৎগঞ্জ বাজার আক্রমণ করে বাজারের মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে সেদিন ঘটনাস্থলেই ৭০/৮০ জন শহীদ হন। শরৎগঞ্জ বাজার পরিণত হয় একটি বধ্যভূমিতে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.- ২২২-২২৩, ৪০১)

 

মাথাভাঙা নদী গণকবর

চুয়ায়াডাঙ্গা শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মাথাভাঙ্গা নদীর তীর এবং তার আশেপাশে রয়েছে অসংখ্য গণকবর। স্বাধীনতার পর এসব গণকবরে পাওয়া গেছে অসংখ্য মৃতদেহ ও বহু শাড়ি-ব্লাউজের ছিন্ন অংশ। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-২২৩, ৪০১; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, তৃতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-২৬৫)

 

মানিক আকবর

তথ্যসংগ্রহ-সাংবাদিক শাহ আলম মন্টু, সভাপতি আলমডাঙ্গা প্রেসক্লাব। সাংবাদিক মো. জহিরুল ইসলাম, সাংবাদিক, জীবননগর।

 

জয়পুরহাট জেলা

১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী গভীর রাতে রেলগাড়িতে করে এসে দখল নেয় তৎকালীন জয়পুরহাট মহকুমা শহর। ২৫ এপ্রিল থেকে হানাদার বাহিনী শুরু করে অগ্নিসংযোগসহ হতাযজ্ঞ। জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি, আক্কেলপুর, কালাই, ও ক্ষেতলাল উপজেলার গ্রামেগঞ্জে হানাদার ও দালালরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর বর্বরতা চালায়।

 

কড়ই কাদিপুর

জয়পুরহাট সদর উপজেলার কড়ই-কাদিপুর গ্রাম। স্বাধীনতার আগে হিন্দু ধর্মালম্বী ৫ শতাধিক কুমার বা মৃৎ-শিল্পী পরিবারের এ গ্রামে বাস করতো। হাঁড়িপাতিল, সানকি-বাসন, কলসী, তৈজসপত্র, খেল্বা, প্রতীমা তৈরিসহ মাটির নানা জিনিসপত্র বানানোর সুনাম ছিল এদের। ১৯৭১ ের ২৬ এপ্রিল কড়ই কাদিপুর গ্রামে দালালদের সহযোগিতায় পাক হানাদাররা এদের ৩৭১ জনকে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ পরিবারের সন্তান হীরেন্দ্রনাথ মহন্তসহ স্বজন হারানো অনেকেই জানান, কড়ই কাদিপুরের ৩৭১ জন হিন্দু মৃৎ শিল্পিকে রাজাকার ও পাক হানাদাররা ধরে এনে লাইন করে চোখ ও হাত-পা বেঁধে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে লাশ পুঁতে রাখে।

গ্রামের রঞ্জিত কুমার বলেন, “যুদ্ধের সময় তার বয়স ১৩/১৪ বছর। বাবাকে তার চোখের সামনে পাক হানাদাররা গুলি করে হত্যা করে”। আত্মস্বীকৃত রাজাকার রহিমুদ্দীনের দাবি, সেদিন ৭১ জন নিহত হয়েছিলেন। এ হত্যাযজ্ঞে “জড়িত ছিলেন না’ দাবি করে তিনি জানান, ‘পাক বাহিনীর হামলার সংবাদ তিনি আগেই গ্রামে জানিয়ে দেওয়ায় অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়’। মৃৎ শিল্পীদের হত্যার পর তাঁদের সম্পদ লুটপাট করে তারা। জমিও দখল করে নেওয়া অনেক রাজাকার এখনো দাপটের সঙ্গে বেঁচে আছে জানান বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জয়পুরহাট জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার আবুল হোসেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত অন্যান্য লেখকদের বইতে এই বধ্যভূমিতে প্রায় ৩৬১ জনকে হত্যার কথা বলা হয়েছে। ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ এর সকাল এগারোটায় হঠাত পাকবাহিনীর হামলায় অগণিত মানুষ নিহত হয়। তারা গ্রামের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। কড়ইকাদিপুরের ডোমপুকুর ও ক্যাদারপুরের পাশে অসংখ্য লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শী আছির শেখের বিবরণীতে ঘটনাটি জানা যায়। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৪২৪; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-০৯-১০; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-১০৩-১০৪; দৈনিক সংবাদ, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৯২)

 

পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি

জয়পুরহাট জেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্বে পাগলা দেওয়ান গ্রাম। তার আশেপাশে চক বরকত, খাস পাহনন্দা, চিরলাসহ কয়েকটি ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম। এই গ্রামগুলোয় ’৭১ এর এপ্রিল থেকে নজর রাখতে শুরু করে হানাদাররা। যুদ্ধের সময় তখন টগবগে তরুণ চিরলা গ্রামের আবু সালেম মিয়া জানান, “ভাবলাম কয়েকজন হানাদারকে হত্যা বা বোমা মেরে তাঁদের গাড়ি উড়িয়ে দিলে ভয়ে এই এলাকায় আসবে না তার। তাই পাক হানাদার বাহিনীর চলাচলের পথে ডিনামাইট বসাই। সেদিন, সোমবার বিকেল, পাক বাহিনীর গাড়ি যাওয়ার সময় ডিনামাইটটি বিস্ফোরণ হয়ে উড়ে যায়। ৪/৫ জন পাক সেনা ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আরও ১৪ জন আহত হয়।

মোজাম্মেল হক, গণকবর থেকে বেঁচে যাওয়া আবেদ আলীসহ এলাকাবাসী জানান, ওই ঘটনার পর ১৮ জুন শুক্রবার ওই গ্রামগুলো থেকে জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বাড়ি ফেরা মুসল্লি ও মাঠে কর্মকর্তাদের দেড়।দুই শ’ মানুষকে রাজাকার ও সেনারা ধরে এনে। শান্তি কমিটির আদেশ পালনকারী ও অন্যদের দু’টি সারিতে দাঁড়াতে আদেশ না বুঝেই গ্রামবাসীরা যে যার মত দুই সারিবদ্ধ হন। শান্তি কমিটির লোক হিসেবে এক সারির ছেড়ে দিয়ে অন্য সারির ৪০/৪৫ জন লোককে দুর্বিসহ নির্যাতন করে। প্রথমে তাঁদের স্তুপকৃত বিষাক্ত কাঁটাযুক্ত তৃণ (স্থানীয় ভাষায় ‘কাঁটা খুড়া’) উপর দিয়ে হাঁটায়। যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে তার পায়ে দড়ি বেঁধে পাশের একটি পরিত্যাক্ত বাড়িতে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়।

গণকবর থেকে বেঁচে যাওয়া চিরলা গ্রামের সলিম মিয়া জানান, তাকেসহ ৫/৭ জনকে গর্ত খুঁড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়। লম্বায় ৪/৫, প্রস্থে ১০/১২ এবং গভীরে ৪/৫ হাত গর্ত খোঁড়া হলে কাঁটা বিষে অজ্ঞান হয়ে পড়াদের জবাই করে ওই গর্তে ফেলে দেওয়া হয়। সলিম বলেন, “তাকেসহ গর্ত খোঁড়ার কাজে নিয়োজিতদের শেষের দিকে একই কায়দায় জবাই করে ওই গর্তে ফেলে দেওয়া হয়”। “এ সময় বৃষ্টি আসলে পাক সেনারা ক্যাম্পে চলে যায়। সন্ধ্যার পর অন্ধকার নেমে আসে। বৃষ্টির পানিতে জ্ঞান ফিরে এলে আহত অবস্থায় ৮ জন ওই গণকবর থেকে বেঁচে যান”।

অন্য এক বেসরকারি তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, জয়পুরহাটের পাগলা দেওানে পাকবাহিনী ও তার দোসররা চার হাজার মানুষকে হয়তা, এক হাজার নারীর সম্ভ্রম হরণ এবং অসংখ্য বাড়িঘর ধ্বংস করে। পাগলা দেওয়ান ও তার আশেপাশের  চর বরকত, নামুজানিধি, পুনন্দা, নওপাড়া, চিরলা, রূপনারায়নপুর, জগদীশপুর, ভুটিয়াপাড়া, মল্লিকপুরসহ অসংখ্য গ্রামে পাক নৃশংসতার চিহ্ন বর্তমান। মাজারের পঁচিশ হাত দূরে একটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়। মাজারের পশ্চিম দিকের বাঁধানো কূপটি মৃতদেহে ঠাসা ছিল। ভারতে যাওয়ার সময় শত শত বাঙালি পাকসেনাদের হাতে প্রাণ হারায়। আবার একসাথে ৭০/৮০ টি গরু ও মহিষের গাড়ি যাত্রী বোঝাই করে ভারতে যাওয়ার সময় পাকসেনাদের ধরে এনে সবাইকে গুলি করে হত্যা করে। প্রতিদিনই ওরা গ্রাম থেকে মেয়েদের ধরে আনতো  এবং মাজারের চারপাশে নির্মিত বাঙ্কারে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করতো। স্বাধীনতার পর এর আশপাশ থেকে শাড়ি, ব্লাউজ ও অন্যান্য জিনিস পাওয়া গেছে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৪২৪; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-৩৫২-৩৫৩; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-১০২; দৈনিক সংবাদ, ১৬ এপ্রিল ১৯৯৪)

 

গণকবর থেকে বেঁচে যাওয়া চিরলা গ্রামের সলিম মিয়া বলেন, “এই পাগলা দেওয়ানেই গণকবরের পাশে প্রায় ১০০ গজের মধ্যে আরো একটি গণকবর রয়েছে। যুদ্ধ শুরু হলে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক হাজার হিন্দু ধর্মালম্বী নরনারী পাগলা দেওয়ান করিডোর হয়ে ভারতে যাবার সময় ব্রাশ ফায়ার করে তাঁদের হত্যা করে পাক হানাদাররা। খাস পাহনন্দা গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী এমদাদুল হক ও জয়পুরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সদস্য আফসার আলী জানান, সে সময় শরনার্থী হয়ে গরু গাড়িতে চড়ে ভারতে যাবার সময় প্রায় ২/৩শ’ হিন্দু নারীকে হানাদাররা ধরে গ্রামের পরিত্যাক্ত বাড়িতে রেখে পালাক্রমে রাতভর ধর্ষণ করত এবং সকাল হলে তাঁদের গুলি করে মেরে ফেলত। শিয়াল কুকুরে লাশ টানাটানি করত। ঐসব অর্ধগলিত লাশ, কঙ্কাল কুড়িয়ে জড়ো করে এই গণকবরে রাখা হয়েছে। পাগলা দেওয়ানের দুটি গণকবর সংরক্ষিত আছে।

 

জয়পুরহাট ডিগ্রী কলেজ মাঠ গণকবর

জয়পুরহাট শহরের স্টেশনের পশ্চিম পাশে জয়পুরহাট ডিগ্রী কলেজ। পাক সেনাদের ঘাঁটি ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল এটি। জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাংগঠনিক কমান্ডার আবদুল গফুর ও সদস্য নবীন মর্মূ জানান, হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা বিভিন্ন স্থান প্রায় একশ’ জন মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে এই কলেজ মাঠে গর্ত করে পুঁতে রাখে। তবে সেখানে এখন কোন চিহ্ন নেই।

 

জয়পুরহাট চিনিকল গণকবর

৩০/৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যার পর জয়পুরহাট চিনিক্ল পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। তবে তাঁদের পরিচয় পাওয়া যায়নি বলে জানান কমান্ডার আবদুল গফুর ও নবীন মর্মূ।

 

খঞ্জনপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় গণকবর

জয়পুরহাটের এই বিদ্যালয়ের মাঠে পানি পান করার জন্য একটি কুয়ো ছিল। এখানে ১৫/২০ জনকে হত্যার পর ফেলে দেওয়া হয় বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গফুর ও নবীন মর্মূ। ওই শহীদদের পরিচয় পাওয়া না গেলেও ঘটনা সঠিক বলে নিশ্চিত করেন মুক্তিযোদ্ধা আনিছুর রহমান ও হাদি।

 

পাহনন্দা মিশন

সদর উপজেলার পাহনন্দা মিশনের পূর্ব পাশে সেতু সংলগ্ন আরও একটি গণকবর আছে, যেখানে ১০/১২ জন অজ্ঞাত পরিচয় মুক্তিকামী মানুষদের দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে হত্যা করে তাঁদের লাশ পুঁতে রাখা হয়েছে বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাংগঠনিক কমান্ডার আবদুল গফুর ও মুক্তিযোদ্ধা নবীন মর্মূ।

 

আক্কেলপুর উপজেলা

আমুট্ট মাঠ, আমুট্ট সিএন্ডবি পুকুর পাড় গণকবর। এ উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা অনেক। জয়পুরহাট সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্দার আফছার আলী জানান, জেলায় প্রায় সাড়ে ৮শ’ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এর মধ্যে কেবল আক্কেলপুরেই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩শ’ ৮০ জন। ফলে আক্কেলপুরে ব্যাপক হত্যাসহ ধ্বংসযজ্ঞের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। যুদ্ধকালীন উপজেলা শহরের (তখনকার থানা শহর) দশন শ্রেণীর ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানকে পার্শবর্তী পাহাড়পুরের সম্মুখ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ধরে জয়পুরহাট শহরে (তখনকার মহকুমা শহর) নিয়ে যায়। তাকে হানাদারদের লরির পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে সারা শহর টেনে হিঁচড়ে ঘোরানো হয়। পরদিন স্থানীয় শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দানে প্রকাশ্যে জনতার সামনে পাকিস্তানি মেজর আফজাল বেগ ও স্থানীয় রাজাকার আবদুল আলিম মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানকে দেখিয়ে বলেন, “যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবে তাঁদের সকলের একই অবস্থা হবে”। এরপর তার ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। অজ্ঞান হয়ে পড়লে তাকে শহরের পার্শবর্তী ছোট যমুনা নদীর উপরে সেতুতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গুলি করে তার লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ওই যুদ্ধে ঘটনাস্থলে আরও ৫জন শহীদ হন, যাদের ঐতিহাসিক পাহাড়পুরের সীমানা প্রাচীরের ভেতরে পূর্ব-উত্তর কোণায় কবর দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর আক্কেলপুরে হানাদার বাহিনী শুরু করে নারকীয় তাণ্ডব। মুক্তিযোদ্ধাসহ শতাধিক সাধারণ মানুষকে খুন করে। যাদের ঠাই হয় আক্কেলপুরে মহিলা কলেজ সংলগ্ন আমুট্ট মাঠ, আমুট্ট সিন্ডবি পুকুর পাড় গণকবরে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে স্থানীয় সঙ্গাব্দিক রবিউল ইসলাম রুবেল ও হারুন অর রশিদ জানান, আমুট্ট রেল গেইট ও মহিলা কলেজ সংলগ্ন গণকবরে মুক্তিযোদ্ধাসহ মুক্তিকামী ৪০/৪৫ জন, আমুট্ট সিএন্ডবি গণকবরে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খোকনসহ (বগুড়ার সন্তান, যার নামানুসারে বগুড়ার খোকন পার্ক নামকরণ করা হয়) ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেওয়া হয়।

 

পাঁচবিবি উপজেলা বধ্যভূমি

ভারত সীমান্ত সংলগ্ন জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলা। যুদ্ধকালীন এখানে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এই উপজেলার কয়া, কড়িয়া, হাটখোলাসহ বেশ কয়েকটি গোপন পথে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে প্রবেশ করে আচমকা শত্রু সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। ফলে এই পাঁচবিবি সীমান্তের ওপর কড়া নজর রাখে পাকবাহিনী। এলাকাবাসীদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন করে হত্যা করত তারা। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক ভারতেগামী শরানার্থীকে হত্যা করে বিভিন্ন স্থানে পুঁতে রাখা হয়। জয়পুরহাটে চিনিকল মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক শিল্প কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বাতেন, ধলাহার ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল খালেক, স্থানীয় সাংবাদিক সুমন চৌধুরীসহ কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, পাঁচবিবিতে ৩টি গণকবর আছে।

 

ছোট মানিক গণকবর

বর্তমান পাঁচবিবি পৌর শহরে পাকা রাস্তার পাশে ছোট মানিক। এখানে ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে এখানে ও পার্শবর্তী হিলি স্থলবন্দরে বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধ হয়। এ সময় অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে। এখানে পার্শবর্তী মালঞ্চা গ্রামের ময়েজ ফকির, নওদা গ্রামের বাসিন্দা ও জয়পুরহাট ডিগ্রী কলেজের ছাত্রনেতা লোকমান হোসেনসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধরে আনা প্রায় ১৫ জনকে হত্যা করে তাঁদের লাশ এই গণকবরে দাফন করা হয়।

 

শালপাড়া বাজার গণকবর

শালপাড়া বাজারের ছোট যমুনা নদীর সেতুর পাশে ৪০/৫০ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে এই গণকবরে তাঁদের লাশ রাখা হয় বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বাতেন। তিনি বলেন, তখন তিনি দশম শ্রেণীর ছাত্র। তার জেঠা আলীমুদ্দিন নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলেন যা তিনি গর্ব করে বলতেন। এই অপরাধে স্থানীয় রাজাকার ছইমুদ্দিন তার জেঠাকে পাক বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেয়। পাক হানাদাররা জীবন্ত অবস্থায় তার জেঠা আলীমুদ্দিনের শরীর থেকে মাংশ কেটে কুকুর দিয়ে খাইয়েছে। এভাবে পৈশাচিক নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয়েছে এখানে। এই দৃশ্য দেখে প্রতিশোধ নিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন তিনি।

 

পাঁচবিবি গো-হাটি পুকুর গণকবর

শতাধিক মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে তাঁদের লাশ এ পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে মুক্তিযোদ্ধারা জানান।

মোমেন মুনি

 

জামালপুর জেলা

একাত্তরে যুদ্ধের সময় জামালপুরে শ্মশানঘাটে নিয়মিত গণহত্যা চালান হতো। পাক হানাদার বাহিনী শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালিদের ধরে এই শ্মশানঘাটে নিয়ে আসতো এবং পাড়ে দাঁড় করিয়ে তাঁদের ওপ্র গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো।

 

বক্সীগঞ্জ গণকবর

জামালপুরের বক্সীগঞ্জ ইউনিয়নে বিভিন্ন গণকবর থেকে লাশ তুলে দাফন করা হয়। কয়েকটি কবর থেকে ৫০/৬০ টি করে লাশ তোলা হয়। আরও কয়েকটি গণকবর দুর্গন্ধের কারণে সে সময় খোঁড়া যায়নি। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৭২; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, তৃতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-০১; দৈনিক বাংলা, ১০ মে ১৯৭২)

 

শ্মশানঘাট বধ্যভূমি

একাত্তরে যুদ্ধের সময় জামালপুরের শ্মশানঘাটে নিয়মিত গণহত্যা চালান হতো। পাক হানাদার বাহিনী শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালিদের ধরে এই শ্মশানঘাটে নিয়ে আসতো এবং পাড়ে দাঁড় করিয়ে তাঁদের ওপর গুলি চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হতো। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৭১-৩৭২; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, চতুর্থ খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-৯৬; দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

পিটিআই ক্যাম্প বধ্যভূমি

জামালপুরের পিটিআই ক্যাম্পে বধ্যভূমি ছিল। জামালপুরে পাকসেনাদের সহযোগী শান্তি কমিটির পাণ্ডারা শহরের বিভিন্ন জয়গা থেকে নিরীহ বাঙালিদের ধরে পিটিআই ক্যাম্পে নিয়ে আসতো এবং কখনো গুলি করে কখনো জবাই করে বা আঘাত করে হত্যা করতো। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৭১-৩৭২; দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

কলেজ ক্যাম্প বধ্যভূমি

জামালপুরের কলেজ ক্যাম্পেও বধ্যভূমি রয়েছে। একাত্তরে পাকসেনা ও তাঁদের দোসর রাজাকাররা এখানে অসংখ্য নিরস্ত্র-নিরাপরাধ মানুষকে ধরে আনতো এবং তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতো বলে এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা যায়। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৭১-৩৭২; দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

রশিদপুর ঘাট বধ্যভূমি

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক সেনাবাহিনী এদেশীয় দোসর-আলবদরদের সহযোগিতায় জামালপুর জেলার রশিদপুর ঘাটকে এক বধ্যভূমিতে পরিণত করে। এখানে তারা বহু বাঙালিকে ধরে হত্যা করেছে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৭১-৩৭২; দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

শেরপুর গোরস্থান নদীর ঘাট বধ্যভূমি

জামালপুর জেলার অন্যতম থানা শেরপুরের গোরস্থানের কাছে নদীর ঘাট ছিল একটি বধ্যভূমি। যুদ্ধকালে পাকসেনারা এখানে অজ্ঞাত অনেক বাঙালিকে হত্যা করেছে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৭১-৩৭২; দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

ইসলামপুর গোয়ালার ঘাট বধ্যভূমি

জামালপুরের ইসলামপুর থানার গোয়লার ঘাট ছিল আরেকটি বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমিতে জীবন দিতে হয়েছে বহু নিরীহ বাঙালীকে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৭১-৩৭২; দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট বধ্যভূমি

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট এলাকায় পাকসেনারা অসংখ্য মানুষকে নির্মমভাবে গুলিকরে হত্যা করেছে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৭১; দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

পিয়ারপুর গোরস্থান বধ্যভূমি

জামালপুরের পিয়ারপুর গোরস্থানের কাছে নদীর ঘাটে ছিল পাকবাহিনীর অন্যতম বধ্যভূমি। পাকসেনারা এখানে অনেককে হত্যা করেছে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৭১; দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

আশেক মাহমুদ কলেজ হোস্টেল বধ্যভূমি

জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের স্নাতক হোস্টেল ছিল আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প। যুদ্ধাকালে তারা বহু লোককে ধরে এনে কলেজ এলাকাতেই জবাই করে হত্যা করে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৭২; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, প্রথম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-২৪৮-২৪৯; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-১০৬)

লুৎফর রহমান

 

ঝালকাঠী জেলা

একাত্তরে ন’মাস ঝালকাঠীর বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনী নির্মম গণহত্যা চালায়। এরমধ্যে ঝালকাঠি সদর উপজেলার পেয়ারা বাগান এলাকার বিলাঞ্চলের বধ্যভূমিগুলোতে স্থানীয়দের মতে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কয়েকটি জায়গায় স্থানীয়দের উদ্যোগে নাম ফলক নির্মান করা হয়েছে।

 

পৌর খেয়াঘাট বধ্যভূমি

ঝালকাঠি শহরের সুগন্ধা নাদী পাড়ে বর্তমান পৌরসভার খেয়াঘাট এলাকায় একাত্তরের ৩০ মে এক দিনেই ১০৮ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের ন’মাসে সুগন্ধা নদী পাড়ের এ বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় লেখক শ্যামল সরকার, স্থানীয় সাংবাদিক হেমায়েত উদ্দিন হিমু, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা এমনটি জানান।

বিজয়ের ৪০তম বছরে স্থানীয় কয়েক যুবক ব্যক্তি উদ্যোগে এখানে একটি স্মারক নির্মাণ করে। বধ্যভূমিটি জেলার মধ্যে সবচে বড় গণহত্যার স্থান বলেই সবার কাছে পরিচিত।

 

পালবাড়ি গোডাউনঘাট বধ্যভূমি

একাত্তরের বিভিন্ন সময় ঝালকাঠী শহরের বর্তমান সরকারি খাদ্য গুদামের সামনে পালবাড়ি এলাকায় খালের ঘাটের সিঁড়ির উপরে অসংখ্য মানুষকে জবাই করে হত্যা করে পানিতে ভাসিয়ে দেয় পাকবাহিনী ও রাজাকাররা। এ স্থানের কাছাকাছি বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা দম্পতি পার্থ সারথী দাস ও রমা দাস এ গণহত্যার জায়গাটির কথা জানান। সেদিনের সিড়িটির কিছুটা ভাঙ্গা অংশ এখনও আছে। এখানেও কোনো স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হয়নি। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকাতেও এ স্থানের নাম ওঠেনি।

 

সচিলাপুর বধ্যভূমি

ঝালকাঠী সদর উপজেলার সচিলাপুর বিষখালী নদী পাড়ের একটি গ্রাম। এ গ্রামের দুই ভাই দিলীপ ও সঞ্জীব বসু এবং তাঁদের ছোত বোন রমবতী বসু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। একাত্তরের ২২ জুন গ্রামের নদীটির পাড়ে বাড়ি থেকে ধরে এনে রমাবতী বসু, তার দুই সহযোগী সোনাই ও কমলা এবং গ্রামের অপর তিন পুরুষকে (ছয় জন) গুলি করে হত্যা করা হয়। রমাবতীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। জেলার একমাত্র শহীদ নারী মুক্তিযোদ্ধার ভাই দিলীপ বসু এসব কথা জানান। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকায়ও এ স্থানের নাম নেই।

 

গাবখান বধ্যভূমি

ঝালকাঠী শহরের কাছের ইউনিয়ন গাবখান। ইউনিয়নটির পাশেই বয়ে গেছে দেশের কৃত্তিম চ্যানেল গাবখান নদী। এ নদীর পাড়ে গাবখান হাটের কাছে পাকবাহিনীর একটি ঘাঁটি ছিল। একাত্তরের বিভিন্ন সময় অনেককে নদী পাড়ের এ মাঠে হত্যা করে হানাদার ও রাজাকাররা। প্রত্যক্ষদর্শী এ গ্রামের বাসিন্দা কৃষক এনামূল হক হিরু জানান, এ বধ্যভূমিটির কথা। মাঠটি রয়েছে তবে কোন স্মৃতিস্তম্ভ গড়া হয়নি।

 

ডুমুরদিয়া বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর ৮/১০ গ্রামের বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে পেয়ারার গহীন বাগান। শতাব্দীকাল ধরে বানিজ্যিক ভাবে এখানে পেয়ারা চাষ করছে স্থানীয়রা। স্থানীয় ভাষায় গ্রামগুলোকে বিলাঞ্চল বা পেয়ারা বিল বলা হয়। জেলা সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নটির হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যূষিত এমন একটি গ্রাম ডুমুরিয়া। একাত্তরের ১০ জুন এ গ্রামের পেয়ারা বাগান থেকে ১৯ জনকে ধরে এনে ঐ গ্রামেরই স্থানীয় একটি ক্লাবের কাছে খাল পাড়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদের বেশির ভাহই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মানিক বাহিনীর সদস্য। ক্লাবটী এখনও আছে। কয়েক বছর আগে ক্লাব কতৃপক্ষ এখানে একটি শহীদ ফলক নির্মাণ করেছে। স্থানীয় বীরেন রায়, শ্যামলসহ আরো কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, এখানকার পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেওয়া আরও অসংখ্য মানুষকে এ জায়গায় বিভিন্ন সময়ে হত্যা করা হয়। শ্যামল সরকারের ঝালকাঠীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থেও এ জায়গাটির উল্লেখ রয়েছে।

 

ভীমরুলী বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের পেয়ারা বাগান ঘেরা ভীমরুলী গ্রাম। একাত্তরের ৭ জুন এ গ্রামের পেয়ারা বাগান থেকে স্থানীয় ৭ জনকে ধরে এনে গ্রামের ভীমরুলী স্কুলের পিছনে খালের পাড়ে হত্যা করা হয়। যুদ্ধের ন’মাসে অসংখ্য নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে এখানে হত্যা করা হয় বলে জানান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক ভভেন্দ্রনাথ হালদার।

 

শতদশকাঠী বধ্যভূমি

একাত্তরের গণহত্যার সাক্ষী ঝালকাঠীর শতদশকাঠী সতীলক্ষী বালিকা বিদ্যালয়ে পাকবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পেয়ারা বাগানে পালিয়ে আসা অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ধরে এনে বাংলা জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে বিদ্যালয়টির পিছনের পুকুর ও খাঁল পাড়ে হত্যা করা হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়টির পুরাতন কূপ এবং পুকুরের মধ্যে অসংখ্য মানুষের হাড় ও মাথার খুলি পাওয়া যায় বলে জানান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও ইউপি সদস্য বীরেন মিস্ত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শী প্রসান্ত হাওালাদার।

 

জগদীশপুর বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর জগদীশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে একাত্তরের বাংলা জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে গণহত্যা পাকবাহিনী। এখানে স্থানীয়দের সঙ্গে পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য মানুষকে হাত বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হতো। যুদ্ধের সময় এই হত্যাকাণ্ড ছিল নিয়মিত ঘটনা। স্কুলের দেয়ালে সেই সব হত্যার চিহ্ন স্বাধীনতার পরও অনেকদিন ছিল। এ গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা হিরালাল সমাদ্দার এ বধ্যভূমির কথা জানান। ১৯৯৬ সালে স্থানীয়দের উদ্যোগে এখানে একটি শহীদ বেদী তৈরি করা হয়েছিল। সংস্কারের অভাবে সেটি ভেঙে গেছে।

 

রামানাথপুর বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় লেখক শ্যামল সরকার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জানায়, ঝালকাঠীর সদর উপজেলার রমানাথপুর গ্রামের শরীফ বাড়ি পুকুর পাড়ে ২১ মে ৫ জনকে এবং ২৩ মে বাড়ীটির মসজিদ থেকে ১৭ জনকে ধরে এনে পুকুর পাড়ে গুলি করে হত্যা কয়া হয়। বর্তমানে মসজিদটির পাশে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে স্থানীয়রা।

 

বেশাইন খান বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর সদর উপজেলার বেশাইন খান গ্রামের স্থানীয় হাইস্কুলের সামনে খাল পাড়ে একাত্তরের ১৭ জুন ১৪ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ স্থানটির কথা জানিয়েছে। স্থানীয়দের উদ্যোগে হাইস্কুলটির সামনে ১৪ শহিদের নাম লিখে স্মৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়েছে।

 

খায়েরহাট বধ্যভূমি

ঝালকাঠী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জানিয়েছে, সদর উপজেলার খায়েরহাট গ্রামের খায়েরহাট ফজলুল হক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে ৭১’র বিভিন্ন দিনে অনেক লোককে হত্যা করা হয়। তবে তাঁদের পরিচয় এবং সংখ্যা জানা যায়নি।

 

খাজুরিয়া গাইনবাড়ি বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের খাজুরিয়া গ্রামের গাইন বাড়ির পূর্ব পাশের জঙ্গলে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। এখানে মোট কত জনকে হত্যা করা হয়েছে তা গ্রামবাসী ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জানাতে পারেনি।

 

কালীদাশ বাড়ি বধ্যভূমি

একাত্তরের কোনো একদিন সদর উপজেলার বাসণ্ডা গ্রামের কালীদাশ বাড়ির অনেককে ধরে এনে বাড়ির সামনেই হত্যা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকায় এ স্থানের নাম রয়েছে।

 

কূনীহাড়ি বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর সদর উপজেলার বাসণ্ডা ইউনিয়নের কূনীহাড়ি গ্রামের কার্তিক হালদারের বাড়ির পুব পাশে কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। তবে দিনটি স্থানীয়রা বলতে পারেনি। এ জায়গার নাম মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকায় রয়েছে।

 

নবগ্রাম নাপিতখালী বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর সদর উপজেলার নবগ্রাম, ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের খালে নির্মিত পুলের (সেতু) উপর যুদ্ধাকালীন বিভিন্ন সময় গণহত্যা চালানো হয়। স্থানটির নাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকায় আছে, তবে মোট কতজন এখানে শহীদ হয়েছেন তা জানাতে পারেনি।

 

বেড়মহল বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর সদর উপজেলার গাভারামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বেড়মহল হাটে পাকবাহিনী অনেককে হত্যা করে। হাটটি এখন আছে। তবে এখানে কোনো শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মান করা হয়নি। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকায় এর নাম রয়েছে।

 

গুয়াটন বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী গুয়াটন গ্রামে ২ অক্টোবর কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। এখানেও কোন স্মৃতি চিহ্ন নেই। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকায় এ স্থানের নাম নেই। শ্যামল সরকার এ বধ্যভূমির কথা জানান।

 

চাচৈর বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর সদর উপজেলার চাচৈর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে যুদ্ধাকালীন সময়ে কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। পরে ১৩ নভেম্বর এখানে সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকবাহিনী পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হন আবদুল আউয়াল। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এ তথ্য জানিয়েছে।

 

রাজপাশা বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর সদর উপজেলার রাজপাশা গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে ৬ ডিসেম্বর রোকেয়া খাতুন বালিকা বিদ্যালয়ের কাছে অনেককে জবাই ও গুলি করে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় লেখক শ্যামল সরকার এ তথ্য জানান। তবে স্থানটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকায় নেই।

 

নলিছটি তামাকপট্টি বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর তৎকালীন নলিছিটি পৌর এলাকায় তামাকপট্টি খালের পাড়ের (বর্তমান ফেরিঘাট সংলগ্ন) এই বধ্যভূমিতে একাত্তরের ১৩ মে কমপক্ষে ১৪ জন হিন্দু ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নলিছিটি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী সিকান্দার আলী মিয়া এ বধ্যভূমির কথা জানান। জায়গাটি এখন বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

 

মানপাশা ঋষিবাড়ি বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর নলছিটি উপজেলার মানপাশা গ্রামের ঋষি বাড়িতে একাত্তরে কোনো একদিন বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। তথ্যটি জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জানিয়েছে।

 

বাঘরী থানাঘাট বধ্যভূমি

ঝালকাঠীর রাজাপুর উপজেলা শহরের থানা সংলগ্ন বাঘরী ঘাটের কাছের বধ্যভূমিতে একাত্তরের ৩ জুলাই ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। এছাড়া যুদ্ধের পুরো সময় জুড়ে এ স্থানে ২ শতাধিক সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয় বলে জানান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম নান্নু। এখানে সরকারি উদ্যোগে আংশিকভাবে সম্পন্ন হওয়া একটি স্তম্ভ রয়েছে।

 

কাঠিপাড়া গণকবর

ঝালকাঠীর রাজাপুর উপজেলার শুক্রাগড় ইউনিয়নের কাঠিপাড়া গ্রামে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল পাকবাহিনী ও রাজাকাররা গ্রামে ঢুকে পড়লে আশপাশের দু’তিন গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষজন কাঠিপাড়া গ্রামের জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। জঙ্গলের ভেতর থেকে শিশুর কান্নার শব্দ শুনে পাক সেনা ও রাজাকাররা হানা দিয়ে অসংখ্য পুরুষকে হত্যা করে সেখানেই গণকবর দেয়। সেদিন তারা কোনো নারীকে হত্যা করেনি বলে জানান, এলাকার শহীদ পরিবারের সদস্যরা এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম নান্নু। ২০০৯ সালে মাটি খুঁড়তে গিয়ে গণকবরটি নতুন করে আবিষ্কৃত হয়। উদ্ধার হয় অসংখ্য হাড়গোড় ও মাথার খুলি।

 

দাশেরবাড়ি বধ্যভূমি

একাত্তরের ১১ জৈষ্ঠ্য বা ২৫ মে সকাল ১১টার দিকে হানাদাররা কাঁঠালদিয়া ঘাটে স্পিডবোট থামিয়ে দু’দিক থেকে গ্রামে ঢুকে পড়ে। কাঁঠালদিয়া উপজেলার আমুরা ইউনিয়নের দাশের বাড়ি নামক স্থানে ৩৯ জন সাধারণ গ্রামবাসীকে হত্যা করে তারা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণ কাঞ্জি লালা বাবুল ঠাকুর এ বধ্যভূমির কথা জানান। স্থানটি এখনও আছে, তবে কোনো স্মৃতি স্তম্ভ নেই।

 

আওরাবুনিয়া হাইস্কুল বধ্যভূমি

একাত্তরের ৯ জুন বা ২৬ জ্যৈষ্ঠ বুধবার পাকবাহিনী ও রাজাকাররা কাঁঠালদিয়া উপজেলার আওরাবুনিয়া ও আহসেপাশের গ্রামের ২৭ জনকে ধরে এনে স্থানীয় আওরাবুনিয়া হাইস্কুলের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণ কাজি লালা বাবুল ঠাকুর এ বধ্যভূমির কথা জানান। এখানেও স্মৃতিস্তম্ভ নেই। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তালিকায় এর নাম রয়েছে।

পলাশ রায়

সহযোগিতা করেন – উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী সিকান্দার আলী মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা শা আলম নান্নু, মুক্তিযোদ্ধা নারায়ণ লালা বাবুল, স্কুল শিক্ষক মো. তৌহিদ হোসেন, কলেজ শিক্ষক শামসুল আলম বাহার, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক শ্যামল সরকার, স্থানীয় সংবাদকর্মী রতন আচার্য্য, অলোক সাহা, মো. এনায়েত করিম খান, আব্দুর রহিম রেজা, মো. ফারুক হোসেন ও মো. শহিদুল আলম

 

ঝিনাইদহ জেলা

১৬ এপ্রিল পাকবাহিনী ঝিনাইদহ আক্রমণ করে। তারপরই শুরু হয় নির্যাতন ও হত্যা। পাকসেনারা ১৬ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান, অধ্যাপক হালিম খান, মালি আব্দুস সাত্তার, চৌকিদার গাজী ও চৌকিদার সইজুদ্দীন প্রমুখকে নির্যাতন করে হত্যা করে। তৈরি হয় এক বধ্যভূমি।

 

ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ বধ্যভূমি

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম থেকেই ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের সকল কর্মচারী ও অধ্যাপক যে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় পাকসেনারা বারবার তাঁদের প্রতিরোধের মুখে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, ১৬ এপ্রিল পাকবাহিনী ঝিনাইদহ আক্রমণ করে। তারপরই শুরু হয় নির্যাতন ও হত্যা। পাকসেনারা ১৬ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান, অধ্যাপক হালিম খান, মালি আব্দুস সাত্তার, চৌকিদার গাজী ও চৌকিদার সইজুদ্দীন প্রমুখকে নির্যাতন করে হত্যা করে। তৈরি হয় এক বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে পরে হত্যা করা হয়েছে বলে জানা যায়। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-১২৮-১২৯; বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড – হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, পৃ.-৫৩৫-৫৩৮; বাংলাদেশের গণহত্যা, বাংলার বাণী’র বিশেষ সংখ্যা, ১৯৭২)

 

কামান্না গণকবর

শৈলকূপা থানার কামান্না গ্রামে রয়েছে বধ্যভূমি ও গণকবর। কামান্না শৈলকূপা থানা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার পূব দিকে কুমার নদীর উত্তর পাড়ের ছোট্ট একটি গ্রাম। পাক হানাদার ও তাঁদের দোসর রাজাকাররা এই গ্রামেই ২ জন সহযোগীসহ ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করে। এখানকার ৫টি গণকবরে এঁদেরকে সমাহিত করা হয়। এঁদের মধ্যে রয়েছে মমিন, কাদের, শহীদুল, স্লেমান, রাজ্জাক প্রমুখ। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৯৭; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-১২৯-১৩০; দৈনিক সংবাদ, ২৭ নভেম্বর ১৯৭২)

 

কবিরপুর গ্রাম বধ্যভূমি

ঝিনাইদহ শৈলকূপা উপজেলার কবিরপুর গ্রামের প্রমথ ভূষণ সাহার দোকানের সামনে আম বাগান ও জামরুল গাছের নিচে পাক সেনাদের বধ্যভূমি ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করা হত। এপ্রিলে শৈলকূপার হরিদাশ সাহা, নারায়ণ সাহা, গৌর গোপাল সাহা, শিশির সাহা, নৃপেন অধিকারী ও কার্তিক চন্দ্রকে বাড়ি থেকে ধরে এনে হত্যা পর এখানে লাশ ফেলে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে আম বাগান ও জামরুল গাছের চিহ্ন নেই। এখানে গড়ে উঠেছে অনেক দোকানপাট।

 

শৈলকূপা কুমার নদের পাশে গণকবর

ঝিনাইদহ শৈলকূপা কুমার নদের সেতুর (ব্রিজ) পাশের স্থানটি গণকবর ছিল। প্রমথ ভূষণ সাহার দোকানের সামনে জামরুল তলায় ৬ জনকে হত্যার পর এখানে তাঁদের লাশ গণকবর দেওয়া হয়েছিল। জায়গাটি নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে রাখা হয়নি। বর্তমানে চারপাশে অনেক বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে।

 

কুমার নদ সেতু বধ্যভূমি

ঝিনাইদহ শৈলকূপা কুমার নদের সেতুটিও (ব্রিজ) পাকসেনা ও রাজাকারদের বধ্যভূমি ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করে তাঁদের লাশ এ সেতুর উপর থেকে নদীতে নিক্ষেপ করত পাক সেনা ও রাজাকাররা। শৈলকূপার বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. মরোরঞ্জন জোয়ার্দ্দারকে জীবিত অবস্থায় গলায় সিমেন্টের বস্তা বেঁধে এ সেতু থেকে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এমনভাবে অনেককেই এখানে পাক সেনারা হত্যা করে।

 

কবিরপুর ও আবাইপুর গণকবর

ঝিনাইদহে ৭১’র ১৪ অক্টোবর শৈলকুপার আবাইপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক সেনাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ৪১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের ৬ জনকে কবিরপুরের (ছবিতে) এই বধ্যভূমিতে গণকবর দেওয়া হয়। আবাইপুরে একটি গণকবরে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে গণকবর দেওয়া হয়। বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

বিমল সাহা

 

টাঙ্গাইল জেলা

বংশাই নদীর তীরে রয়েছে বধ্যভূমি। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনী এখানে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করেছে। টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা বাঙালিদের ধরে আনতো এবং ব্রাশ ফায়ারে ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে বংশাই নদীতে ফেলে দিতো।

 

জেলা সদর পানির ট্যাঙ্ক মাঠ বধ্যভূমি

একাত্তরে টাঙ্গাইলে পাকিস্তানিরা ব্যাপক ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইল শহরের পানির ট্যাংকের কাছে ডি-কোয়ার্টারের পিছনে ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিদের কোয়ার্টারের সম্মুখে আবিষ্কৃত হয়েছে অনেকগুলো গর্ত। এসব গর্তে পাওয়া গেছে অসংখ্য নরকঙ্কাল। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৬৮; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-১০৭)

 

মির্জাপুর বাজার বধ্যভূমি

একাত্তরের ৭ মে পাক হানাদার বাহিনীর হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে বংশাই ও লৌহজং তীরবর্তী মির্জাপুর পরিণত হয় এক ভুতুড়ে পুরীতে। সেদিন ছিল শুক্রুবার। প্রতিসপ্তাহের মতো এদিনও থানা সদরে হাট বসে। হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমাগম হয় প্রচুর। বেলা আড়াইটা। পৌণে তিনটার দিকে ক্যাপ্টেন আইয়ুব ও তার স্থানীয় সহযোগী মাওলানা ওয়াদুদের নেতৃত্বে একটি জীপ ও দু’টি ত্রাকে করে প্রায় ৭০/৮০ জন পাক সেনা কুমুদিনী হাসপাতালের প্রধান ফটকে এসে নামে। তারা দ্রুত বাশের সাকো পেরিয়ে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মির্জাপুর গ্রামকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে। যাকে সামনে পায় তাঁকেই গুলি করে হত্যা করতে থাকে। প্রায় দেড় ঘন্টার এই হত্যাযজ্ঞে মির্জাপুর ও পার্শবর্তী আন্ধরা গ্রামের আবাল বৃদ্ধা ও বনিতাসহ ২৭ জন সাধারণ বাঙালি শহীদ হন। এরপর শুরু করে লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ। সেদিন রাত ও পরদিন হানাদারদের লুটপাট ও নির্যাতনে থানা সদর ও আশেপাশের জনপদ পরিণত হয় বিরাণভূমিতে।

সেদিন যাদের হত্যা করা হয় তাঁদের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হচ্ছেন – মধুসূদন সাহা, সুভাষ সাহা, কমল সাহা, উমাচরন সাহা, মঙ্গল চন্দ্র সাহা, ধীরেন্দ্র কুমার সাহা, বলাই সাহা, কেরু শীল, যুগলপদ বণিক, গোপাল বণিক, গণেশ বণিক, সাধু মালী, রাম চন্দ্র সাহা, গণেশ নমদাস, ভ্যাবল নমদাস, ভাদুরি সূত্রধর, সুমতি বণিক, সুভাষ সাহা (২), রনজিত সাহা, গঙ্গাচরণ কর্মকার, নগনি বাশফোড়, নিতাই বণিক, হরিপদ সাহা ও সুভাস চন্দ্র সাহা। ৮ মে সন্ধ্যায় বাসায় আওয়ামী লীগের কার্যালয় থাকায় ও হানাদারদের কাজে বিরোধীতা করায় মাজম আলীকে মির্জাপুর বাস স্ট্যান্ডে দার করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। (দূর্লভ বিশ্বাস, মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক ও সাংবাদিক, মির্জাপুর এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৬৯; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, তৃতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-২৮৯; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-১০৮; দৈনিক সংবাদ, ১১ এপ্রিল ১৯৯৪, ৯ মে ১৯৯৩)

 

বংশাই নদীর তীর বধ্যভূমি

বংশাই নদীর তীরে রয়েছে বধ্যভূমি। একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনী এখানে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করেছে। টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে তারা বাঙালিদের ধরে আনতো এবং ব্রাশ ফায়ারে ও বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে বংশাই নদীতে ফেলে দিতো। পাক সেনারা মির্জাপুর থানা থেকে ধরে এনে শতাধিক বাঙালিকে এখানে হত্যা করে। এই বংশাই নদীর তীরের বধ্যভূমি থেকে বেঁচে যাওয়া দুজন প্রত্যক্ষদর্শী হলেন মির্জাপুরের সাধন ভট্টাচার্য ও গান্ধী সাহা। তারা দু’জন এখন বেঁচে নেই। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্যসূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম. এ. হাসান, পৃ.-৩৬৮; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, তৃতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-৩৮; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-১০৮; দৈনিক সংবাদ, ১১ এপ্রিল ১৯৯৪)

রহমান শফি

 

ঠাকুরগাঁও জেলা

বিভিন্ন সময়ে পীরগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৩ হাজার মানুষকে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ক্যাম্পে ধরে এনে তাঁদের হত্যা করে জগথা রাইস মিল ও সরকারী কলেজের পাশে মাটি চাপা দেওয়া হয়।

 

জেলার প্রথম শহীদ

একাত্তরের ২৭ মার্চ রিকশাচালক মোহাম্মদ আলী ও ২৮ মার্চ কিশোর নরেশ চৌহান ইপিআরের গুলিতে নিহত হয়। রাস্তার পাশেই তাঁদের সমাহিত করা হয়। তৈরি করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। ১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত প্পাক বাহিনীর দখলে চলে যায় ঠাকুরগাঁও।

 

টাঙ্গন নদীর পুরোনো সেতুর বধ্যভূমি

২০ মে ১৯৭১, বৃহস্পতিবার রাতে ঠাকুরগাঁও ইপিআর ক্যাম্প থেকে আসা পাকিস্তানি একদল সৈন্য শহরের………