You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.01.14 | ঢাকা থেকে ফিরে | সপ্তাহ - সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকা থেকে ফিরে
[বিশেষ প্রতিনিধি]

ঢাকার সবচেয়ে বড় মসজিদ বায়তুল মােকারামের পাশ দিয়ে টেলিগ্রাফ অফিসের দিকে যচ্ছিলাম, হঠাৎ কানে বাজল বাউল সুর। তাকিয়ে দেখি এক অন্ধ বউল আকাশ পানে মুখ তুলে গাইছে : “মা তাের বদন মলিন কেনে বল?” অন্ধ গায়কের দুচোখে চলের ধারা আর একতারার মর্মভেদী বিলাপ উপস্থিত সকলের চোখ সজল করে তুলেছে। সহসা মনে হলাে, বাঙলাদেশের মানুষের হৃদয়ের অন্তরতম ভাবনার ছোঁয়াচ পলকের জন্যে পেলাম।
পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর চরম পরাজয়ের পর ঢাকা, কুমিল্লা, চাঁদপুর, টাঙ্গাইল প্রভৃতি যেখানেই গেছি সর্বত্রই স্বাধীনতা লাভের আনন্দে আকাশ-বাতাস মুখরিত হতে দেখেছি। শৃঙ্খলমুক্তির আনন্দে সমস্ত দেশ উত্তেজনায় থরথর কাপছে। অত্যাচারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের শােষণ থেকে মুক্ত হওয়ার আনন্দে বাহ্যিক যে তাদের অন্তরের অন্যান্য ভাবনাগুলাের খবরাখবর সংগ্রহ করার সুযােগ ঘটছিল না। অন্ধ গায়ক আমাকে সেই পথ দেখিয়ে দিল।
আজ এই মুহূর্তে বাঙলাদেশে মুজিব ভাইকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ স্বাধীনতা লাভের আনন্দকে বহুগুণ ছাড়িয়ে গেছে। শত্রুকে পরজিত করার আনন্দের তলায় স্বজনবিয়ােগ অথবা প্রিয়জন হারানাের যে ব্যথা লুকিয়ে ছিল মুজিব ভাইকে ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙলাদেশের প্রতিটি পরিবার সেই দুঃখকে ভুলতে চাইছে।
প্রকৃতপক্ষে আজ বাঙলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের বুকের মধ্যে আনন্দ-বেদনার এক মিশ্র ভাবাবেগ সৃষ্টি হয়েছে। যেখানেই গেছি, স্থানীয় লােক ‘জয় বাঙলা’ বলে আমাকে আলিঙ্গন করেছে। আনন্দের প্রথম উচ্ছ্বাস কেটে যাবার পর যখন জিজ্ঞেস করেছি : “বাড়ির লােকজন সব কেমন?” এই প্রশ্নের পর সহসা তাদের মুখ মলিন হয়ে গেছে। অশ্রুধারায় সিক্ত হয়ে তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারের কাহিনি বর্ণনা করেছে। কেউ হারিয়েছে বাবা অথবা মাকে, কেউ নিহত ছােট ভাইটির শােকে উদ্বেল আর কেউবা হারিয়ে-যাওয়া বােনের কথা বলতে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাে। বার কয়েক এই অভিজ্ঞতার পর বাঙলাদেশে কোন লােককে আমি আর বাড়ির খবরাখবর জিজ্ঞেস করিনি। কারণ, আমি তাে সেখানে কারাের মুখ মলিন করে দেবার জন্য যাইনি।
ঢাকায় শাঁখারিবাজারে গিয়েছিলাম, অত্যাচারের নিদর্শন দেখতে। প্রথমে মনে হলাে উত্তর কলকাতার কোনাে এক গলিতে এসে উপস্থিত হয়েছি। সরু রাস্তার দুপাশে পাতলা তিনতলা বাড়ি। পরে গলির মধ্যে একটু ঢােকার পর মনে হলাে মহেঞ্জদাের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে উপস্থিত হয়েছি। শতকরা ৯০টি বাড়ি ডিনামাইট, গ্রেনেড, আগুন দিয়েও ধ্বংস করা হয়েছে, যেন কোন শয়তান ক্ষেপে গিয়ে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছিল। কয়েকটা বাড়ি সামনে থেকে দেখলে ভালাে আছে মনে হয়, কিন্তু ভেতরে হঁট আর কাঠের পাহাড় ।
শাঁখারিবাজার আর তাঁতীপাড়ায় অনেকগুলাে মন্দির ছিল এবং কাছাকাছি কয়েকটি মসজিদও ছিল। . প্রত্যেকটি ধর্মস্থানকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এলাকাটা ঘুরে যখন চলে আসছি তখন দেখি আমাদের গাড়ির অদূরে এক মধ্যবয়স্কা বিধবা মহিলা মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন আমরা গাড়িতে না উঠে তার দিকে দু-এক পা এগিয়ে যেতে তিনি নিজেই আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। পরনে একটি ময়লা কাপড়। ভাবলাম হয়তাে সাহায্যপ্রত্যাশী। কিন্তু আমাদের কাছে উনি কোনাে সাহায্য চাইলেন না। উনি যা বললেন তার সারমর্ম হলাে : বাবা, তােমরা তাে সাংবাদিক। সবই তাে দেখলে। উপরওয়ালাদের বলাে পশুগুলাে সমস্ত মন্দির-মসজিদ ভেঙে দিয়েছে। ওরা যেন তাড়াতাড়ি সম্ভব ধর্মস্থানগুলাে সারাবার ব্যবস্থা করে। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল। আশ্চর্য ! মুজিব ভাই, তুমি এ কী করেছ। হিন্দু বিধবা মহিলা একই আন্তরিকতা ও বিশ্বাস নিয়ে মন্দির ও মসজিদ সংস্কারের আবেদন জানাচ্ছে। আমি জানি না ভারতবর্ষে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তব জীবনে এতখানি সার্থক হয়েছে কিনা ; কিন্তু চোখের সামনে যা দেখলাম তা কোনাদন ভুলতে পারব না।
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙলাদেশের মানুষ আর কিছু করতে সক্ষম হােন আর নাই হােন বাঙলার মাটি থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ উপড়ে ফেলার জন্য ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তারা যে লােকাশিক্ষার প্রবর্তন করছেন এই উপমহাদেশের ইতিহাসে যেসমস্ত অন্ধকার কলঙ্কজনক অধ্যায় সূচিত হয়েছে, বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বুকের রক্ত দিয়ে চিরতরে তার অবসান ঘটিয়েছে। যে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য এতদিন ভারত ভূখণ্ডে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে এসেছে তাদের সাবধন হবার দিন এসেছে। বাঙলাদেশের মানুষ, ভারতবর্ষের মানুষ আর অন্ধ বিদ্বেষের বলি হতে রাজী নয়। ভবিষ্যতে কেউ যদি এই অপচেষ্টায় লিপ্ত হয় তাহলে এই দুই দেশের সদাজাগ্রত জনমানস তাদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেবে।

সূত্র: সপ্তাহ, ১৪ জানুয়ারি, ১৯৭২