You dont have javascript enabled! Please enable it!

বধ্যভূমির গদ্য (Unicoded) Part 2

বধ্যভূমির গদ্য-দ্বিতীয় খণ্ড

ইউনিকোড রূপান্তরঃ জুলকার নাইন

 

‘সকলের চোখের সামনে দিনের বেলায় পিঠ মোড়া দেওয়া ট্রাক ভর্তি বাঙালিদের নিয়ে যাওয়া হতো আর ঘন্টাখানেক পর শূন্য ট্রাক ফিরে আসতো-গল্লামারিতে পড়ে রইতো কিছুক্ষণ আগের যাওয়া সেই সব মানুষের শীতল দেহগুলো। খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারি থেকে দুই ট্রাক মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিল। অজস্র মাথার খুলি ও শরীরের হাড় আজও গল্লামারিতে পরে আছে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৮৯-৯১; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯৪; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-৭১; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড – হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, পৃ.-৪৭১; দৈনিক বাংলা, ২৯ জানুয়ারি ও ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

কাস্টমঘাট বধ্যভূমি

খুলনার রূপসা নদীর তীরে কাস্টমঘাট ছিল একটি বধ্যভূমি। এই কসাইখানাটি পাকিস্তানিদের সদর দপ্তরের সামনে ছিল। এখানে বাঙালিদের হাত পা বাধা অবস্থায় বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত হানাদার জল্লাদরা। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৮৮; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯৩; দৈনিক বাংলা, ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২)

 

ফরেস্ট ঘাট বধ্যভূমি

খুলনায় জজকোর্টের পিছনে ফরেস্ট ঘাটে বাঙালিদের জবাই করে হত্যা করা হতো এবং লাশগুলোর পেট চিরে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। সেসময় প্রতিরাতে অন্তত ২০ জনকে জবাই করে হত্যা করা হতো বলে ধারণা করা হয়। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৮৯; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯৩; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড – হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, পৃ.-৪৭০; দৈনিক বাংলা, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

গোয়ালখালি বধ্যভূমি

খুলনার গোয়ালখালিতে একটি বধ্যভূমি ছিল। এই বধ্যভূমিতে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর এখানে বহু নরকঙ্কাল ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৮৮; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯৩)

 

ক্রিসেন্ট জুট মিল বধ্যভূমি

খুলনা সদরে ভৈরব নদীর তীরে ক্রিসেন্ট জুট মিল ছিল আরেক বধ্যভূমি। পাক হানাদার বাহিনী এই মিলের হতভাগ্য বাঙালি শ্রমিকদের হত্যা করে তাঁদের লাশ নদীর পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৮৮; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯৩; দৈনিক বাংলা, ২৯ জানুয়ারি ও ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

কান্তপুর বধ্যভূমি

স্বাধীনতার পর খুলনা শহরের উপকণ্ঠে কান্তপুরের চিলমারীতে বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। ১৯৭২ সালে ‘পূর্বদেশ’ প্রতিবেদন বলা হয়, ‘এই বধ্যভূমিতে বহু নরকঙ্কাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কঙ্কাল গুলোতে জড়ানো রয়েছে শাড়ি কিংবা লুঙ্গি। প্রতিরাতে স্থানীয় লোকজন এখানে অসহায় নরনারীর আর্তচিৎকার ও ক্রন্দনের শব্দ শুনতে পেতেন। আর শুনতে পেতেন বুলেটের শব্দ’। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৮৮; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯৩; দৈনিক পূর্বদেশ, ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২)

 

প্লাটিনাম জুট মিল বধ্যভূমি

খুলনা সদরে পালতিনাম জুট মিলের হত্যাকাণ্ড ছিল যেমন লোমহর্ষক, তেমনি নির্মম ও নিষ্ঠুর। মিলের জ্বলন্ত বয়লারের ভেতরে ফেলে কমপক্ষে ৫৬ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করে হানাদাররা। বয়লারের সামনে বিশ ফুট উঁচু পাকা প্রাচীরের পাশে বাঙালি শ্রমিকদের এনে বসানো হতো। এরপর তাদেরকে বস্তাবন্দী করে পায়ের দিক থেকে জ্বলন্ত বয়লারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। ঢোকানো অংশ পুড়ে গেলে দেহের বাকি অংশ  মাথা একটু একটু করে বয়লারে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এসব হতভাগ্যদের মধ্যে হারুন, হেমায়েত, আজিজ প্রমুখের নাম জানা যায়। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৮৯; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯৩)

 

চরেরহাট বধ্যভূমি

খুলনার চরেরহাটে রয়েছে বধ্যভূমি। একাত্তরের এপ্রিলে দৌলতপুরের দিক থেকে কয়েকটি লঞ্চ খুলনার দিকে আসছিল। লঞ্চগুলো ছিল যাত্রীভর্তি। এই চরেরহাটে পাকিসেনারা একে একে সব লঞ্চ থামিয়ে লঞ্চের ভেতর থেকে সবাইকে বের করে এনে নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। এরপর পাকসেনারা তাঁদের মালামাল লুট করে গুলি করে হত্যা করে। প্রায় পাচ’শ মানুষের রক্তে নদীর পানি লাল হয়ে যায় সেদিন। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৮৯; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯৪; মহানগরী খুলনা ইতিহাসের আলোকে, ড. শেখ গাউস মিয়া, পৃ.-৩৫২; দৈনিক বাংলা, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

নিউজপ্রিন্ট মিল বধ্যভূমি

খুলনার খালিশপুর উপশহর ছিল একটি শিল্প এলাকা। এই খালিশপুরে পাওয়া গেছে অসংখ্য গণকবর ও বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে খালিশপুরের নিউজপ্রিন্ট মিল বধ্যভূমিটি অন্যতম। পাকহানাদাররা সুপরিকল্পিতভাবে এই মিলের শ্রমিকদের হত্যা করেছিল। সেসময় খুলনা বেতারের মাধ্যমে ঘন ঘন শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার কথা সম্প্রচার করা হতো। কাজে যোগ না দিলে বরখাস্ত করার কথাও এ সব ঘোষণায় বলা হতো। পেটের তাগিদে অনেক গরিব বাঙালি শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু তারা জানতো না কি মরণফাদ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। শ্রমিকরা সেদিন কাজে যোগ দিলে পাকসেনারা তাঁদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে একে একে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৮৭; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯২; দৈনিক বাংলা, ১০ জানুয়ারি ও  ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক পূর্বদেশ, ২৯ জানুয়ারি ১৯৭২)

 

শলুয়া বাজার বধ্যভূমি

শলুয়া বাজার খুলনার অন্যতম একটি বধ্যভূমি। এটি দৌলতপুরের কাছে রংপুর গ্রামে অবস্থিত। ১ বৈশাখ ১৩৭৮ বঙ্গাব্দে হঠাত করে শলুয়াবাজারে হামলা চালিয়ে পাকহানাদার বাহিনী অসংখ্য বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে। আজওএই গ্রামের মানুষ ১ বৈশাখে এই শহীদদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: গবেষক, লেখক ও অধ্যাপক ড. শেখ গাউস মিয়া)

 

চুকনগর বধ্যভূমি

চুকনগর এলাকাটি খুলনা শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে ভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত। একাত্তরের ২০ মে খুলনার ডুমুরদিয়া থানার চুকনগরে সবচেয়ে বড় গণহত্যাটি সংঘটিত হয়। ২০ মে-এর কয়েকদিন আগে থেকে যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য শরনার্থী পাকহানাদার বাহিনী ও তাঁদের এদেশীয় দোসরদের হাতে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়ে বাঁচার তাগিদের ভারতে যাওয়ার জন্য এই চুকনগরে এসে আশ্রয় নেয়। চুকনগরে তারা ভারতে যাবার ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। ২০ মে সকাল সাড়ে দশটা। এগারোটার দিকে সাতক্ষীরা সড়ক ধরে পাকবাহিনীর দু’টি ট্রাক (মতান্তরে ৩টি/৪টি) চুকনগরে এসে পৌছে এবং শরনার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। চার-পাচ ঘণ্টার মধ্যে চুকনগর পরিণত হয় মৃতের জনপদে। ছয় থেকে দশ হাজার বাঙালি সেদিন নিহত হয় বলে ধারণা করা হয়। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: বাগেরহাটের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড – ড. শেখ গাউস মিয়া, পৃ.-২৮৪-২৮৭; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯৫; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-১২৩-১২৪; মুক্তিযুদ্ধে খুলনা ও চুয়াডাঙ্গা, – সুকুমার বিশ্বাস সম্পাদিত, পৃ.-১৭৯-১৮২; মহানগরী খুলনা ইতিহাসের আলোকে, ড. শেখ গাউস মিয়া, পৃ.-৩৫২-৩৫৩)

 

আজগড়া বধ্যভূমি

আজগড়া খুলনা শহর থেকে উত্তরে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে আজগড়াতে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। পাকবাহিনী ও তার দোসররা লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে অসংখ্য মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছিল। আজগড়ার গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন, কালিদাস চক্রবর্তী, ধীরেন্দ্র নাথ ঘোষাল, দৈবচরণ, হীরালাল গোসাই, মন্সুর শিখদার, বৈদ্যনাথ পাড়, অতুল চন্দ্র বাছাড়সহ আরও অনেকে। (তথ্য সূত্র: অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনি-একাত্তরের খুলনার গণকবর ও বধ্যভূমি)

 

 

 

 

সেনের বাজার বধ্যভূমি

খুলনা শহরের জেলখানা ঘাটের অপর পারে শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে রূপসা উপজেলার সেনের বাজার। ১৯৭১ সাল্লের ১ মে পাক বাহিনী ও তাঁদের দোসররা সেনের বাজারে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা সেনীর বাজারে আশেপাশের অনেক মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। যজ্ঞেশ্বরসহ আরও অনেকে সেদিন নিহত হন। (তথ্য সূত্র: অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনি – একাত্তরের খুলনার গণকবর ও বধ্যভূমি)

 

দুর্জনীমহল বধ্যভূমি

১৯৭১ সালে খুলনার দুর্জনীমহল এলাকায় পাক সেনারা ও তাঁদের দোসররা অনেক লোককে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১ সালে ৭ মে দুর্জনীমহলে নিধনযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। তারা এই গ্রামের অনেক নারী পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। (তথ্য সূত্র: অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনি – একাত্তরের খুলনার গণকবর ও বধ্যভূমি)

 

পাইকগাছা বধ্যভূমি

খুলনার পাইকগাছা থানার বিভিন্ন স্থানকে পাকবাহিনী ও তাঁদের দোসর বাহিনী ১৯৭১ সালে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল। এর মধ্যে সিলেমান পুর, সলুয়ার মুচিপাড়া ও বারোয়াড়ি বাজারের দর্জ্জি গুরুপদ, তার ছেলে অংশুপতি খোকন, মেয়ে মঞ্জু, ডলি ও পারুলকে একে একে গুলি করে হত্যা করেছিল রাজাকাররা। দর্জ্জি গুরুপদ’র স্ত্রীর নাম ছিল গুরুদাসী। মুক্তিযোদ্ধা স. ম. বাবর আলী বলেছেন, সবাইকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। গুরুদাসীকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। (পাশবিক অত্যাচারের পূর্বে) তাকে মেরে ফেলার জন্য হায়েনাদের অনুরোধ করেছিলেন গুরুদাসী। কিন্তু তার এই মিনতি রক্ষা হয়নি সেদিন। (তথ্য সূত্র: অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনি – একাত্তরের খুলনার গণকবর ও বধ্যভূমি)

সুবির রায়

 

গাজীপুর জেলা

১৯৭১ এ ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদারদের প্রবেশ ঠেকাতে টঙ্গীর তুরাগ নদীর উপর সেতু ভেঙ্গে এলাকাবাসী সমবেত হয়। প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সোলায়মান আতিক জানান,জনতা পাকা সেতু ভাঙ্গতে না পেরে পাশের কাঠের সেতুটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় পাকসেনারা নদীর ওপার থেকে মেশিনগান থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকে।

 

টঙ্গি গণহত্যা ও গণকবর

১৯৭১ এ ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদারদের প্রবেশ ঠেকাতে টঙ্গীর তুরাগ নদীর উপর সেতু ভেঙ্গে এলাকাবাসী সমবেত হয়। প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সোলায়মান আতিক জানান,জনতা পাকা সেতু ভাঙ্গতে না পেরে পাশের কাঠের সেতুটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় পাকসেনারা নদীর ওপার থেকে মেশিনগান থেকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকে। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মানুষজন এলাকা ত্যাগ করতে গিয়ে অনেকে গুলিতে আহত হয়। বেশ কজন শ্রমিক ও এলাকাবাসী দৌড়ে টঙ্গী রেলস্টেশনের পুবদিকে টঙ্গী বিসিক এলাকার পেসোসকার কারখানার মাঠে অবস্থান নেয়। পাকসেনারা সেদিকেও গুলি করতে করতে এগুতে থাকে। কজন কারখানার মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ত্রাকের নিচে আশ্রয় নেন।  এ সময় পাক সেনাদের গুলিতে আবদুল মান্নান, মো. আমিন, হাবিব উল্যাহ, মান্নান প্রমুখ শহীদ হন। পরে স্থানীয় বিসিক কবরস্থানে তাঁদের কবর দেওয়া হয়।

 

টঙ্গীর আরিচপুরের গণহত্যা

টঙ্গী পৌরসভার কমিশনার ইসমাইল হোসেন বাবু ও বিসিকের শহীদ স্মৃতি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম জানান, ১৭ এপ্রিল টিআইসি (বর্তমান টেলিফোন শিল্প সংস্থা টেশিস) থেকে পাকিস্তানি সেনারা আরিচপুরে এসে ঘরে ঘরে ঢুকে প্রায় ৩০ জন গ্রামবাসীকে ধরে ধরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে নিয়ত আলি, মো. হাবিব, তালেব আলী, মো. মান্নানের নাম জানা গেছে। পরে তাঁদের বিসিক কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়।

এছাড়া, ১৯৭১ এর ২৭ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী টেশিস’র  কর্মকর্তা বদিউল আলম, বিপিআই’র মোশারফ হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে গুলি করে। ২৮ মার্চ তারা টেশিস-এ ঢাকা উত্তর জোনের প্রশান দপ্তর স্থাপন করে এবং এলাকায় ব্যাপক অগ্নিসংযোগ গুলিবর্ষণ করে। মেজর আরিফের নেতৃত্বে এখানে ৫ শতাধিক সৈন্য মোতায়েন করা হয়। পাকসেনারা স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ মানুষ ও নারীদের ধরে টেশিসের একটি ঘরে নির্যাতন করে হত্যা করত।

ব্রিগেডিয়ার করিমুল্যাহর নির্দেশে জয়দেবপুর সমরাস্ত্র কারখানার ওয়ার্কস ম্যানেজার এ. কে. এম. মাহবুব চৌধুরী, ডা. মেজর নঈমুল ইসলাম, আ. কুদ্দুস মাস্টার, ওয়েফেয়ার অফিসার মাহবুবুর রহমানসহ বেশ ক’জনকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়।

 

শ্রীপুরের গণহত্যা ও গণকবর

মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় অপরাধে স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পাক সেনারা শ্রীপুরের সাতখামাইর গ্রামের আ. সাত্তার, সোনাব আলী, ইসমাইল হোসেন, ইউসুফ আলী, আতর আলী, আজম আলী মানিককে ধরে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। তাঁদের মৃতদেহগুলো ঐ গ্রামের এরশাদ আলীর জমিতে গণকবর দেওয়া হয়।

 

শ্রীপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ মাঠ

শ্রীপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. নূরুন নবী জানান, শ্রীপুরে স্থাপিত ক্যাম্পে পাকসেনারা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের স্বজনদের ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করতো। পরে তাঁদের লাশ এনে শ্রীপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মাঠের দক্ষিণে গণকবর দেওয়া হতো। ১৯৭১ এ ১৭ জুন স্থানীয় উজিলা গ্রামের আলী প্রধান, আ. ছামাদ, তার ভাই আলাউদ্দিন, নাজিম উদ্দিন, লিয়াকত আলী, আবদুল আলী, কেওয়া গ্রামের আ. ছাত্তার, আ. খালেক, বাদশা আকন্দ প্রমুখকে ধরে এনে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যার পর ঐ গণকবরে দাফন করা হয়। কবরটি পরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

 

 

 

 

গাজীপুর সদর উপজেলার ইছর কান্দি গণহত্যা

১৯৭১ এ গাজীপুর সদরের ইছরকান্দি গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হয়। অনেকেই পাক হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা পেতে তুরাগ নদী পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যায়। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক সেনারা এক রাতে সেখানকার ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং গুলি চালায়। এতে বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। এদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু ধর্মালম্বী।

 

জয়দেবপুরে গণহত্যা

গাজীপুর শহর তৎকালীন জয়দেবপুর সদরের ভাওয়াল রাজবাড়ির পুব পাশে বর্তমান জজকোর্ট সংলগ্ন পুকুর, নিচু ভূমি এবং সরকারি আবাসিক ভবন ও পাশের ফাঁকা জায়গায় বিভিন্ন এলাকার শতাধিক মানুষ ধরে এনে ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল দুপুরে বোমা ও গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। এখানে বরুদা গ্রামের রমিজ উদ্দিন, চান্দনা গ্রামের রওশন আলীসহ অনেকের লাশ স্তুপাকারে পড়েছিল বলে জানান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার মিয়া।

 

কালীগঞ্জ বধ্যভূমি

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুরের ন্যাশনাল জুট মিলের পাশে খলাপাড়া বধ্যভূমিটি। ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর এখানে পাক হান্দার বাহিনী ন্যশনাল জুট মিলের ১০৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হত্যা করে। এঁরা বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতেন। নভেম্বর মাসে ঐ কারখানার শ্রমিকরা মুক্তিযোদ্ধাদের শীতবস্ত্র প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেন। এ খবর চলে যায় ঘোড়াশাল সেতুর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত পাক ক্যাম্পে। বধ্যভূমি থেকে ঐ ক্যাম্পের দূরত্ব ছিল প্রায় দেড় কিলোমিটার। ১ ডিসেম্বর সকাল ১১টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে পাকসেনারা ঐ জুট মিলে যায়। সেখানে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে না পেয়ে তারা জামালপুরের দিকে রওনা হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে আবার জুট মিলে ফিরে যায় পাকসেনারা। এখানে মিলের ১০৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ধরে এনে মিলের ভেতরে পুকুর পাড়ে দু’লাইনে দাঁড় করায়। পরে বিকেলে গুলি ও বেয়োনেট চার্জ করে তাঁদের হত্যা করে। এই শহীদরা বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা ছিলেন। নিহতদের মধ্যে মিলের কোয়ালিটি কন্ট্রোলার আবু তালেব, টাইম কিপার আহসান উল্যাহ ও শ্যাম চরণ ঘোষ। এ তিনজনকে জামালপুর বাজারের পাশে এবং অন্য ১০১ জনকে জুট মিলের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দুটি গর্তে গণকবর দেওয়া হয়। ঐ জায়গার উপর মিল কতৃপক্ষ ১৯৯৬ সালে স্মৃতির ফলক ‘শহীদ স্মরণে’ নির্মাণ করে বলে জানান স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান এস. এম. নজরুল ইসলাম।

 

কাপাসিয়ায় বধ্যভূমি

গাজীপুরের কাপাসদিয়া উপজেলার বরুন গ্রামের দাসপাড়া এলাকার এক জঙ্গলে বধ্যভূমিত সন্ধান পাওয়া গেছে। সেখানে পাওয়া কঙ্কালগুলো সংরক্ষণের লক্ষ্যে তাঁদের স্মরণে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে ফলক উন্মোচন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন, স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মোতাহার হোসেন।

 

 

 

মরকুন বধ্যভূমি

টঙ্গীর মরকুন এলাকাতে পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের নৃশংস চিহ্ন রয়েছে। যুদ্ধকালে তারা এখানে অনেক বাঙালিকে হত্যা করেছিল। (মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৪৬১; দৈনিক সংবাদ, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৩)

 

গাইবান্ধা জেলা

পাক হানাদার বাহিনীরা রংপুর থেকে এসে ’৭১ এর ১৭ এপ্রিল গাইবান্ধা স্টেডিয়ামে ঘাঁটি করে এবং তার কিছু দূরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজে থাকতো পাক সেনা কর্মকর্তারা। শুরু করে তাঁদের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন। প্রতি রাতেই অসংখ্য মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে স্টেডিয়াম সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে কফিল সাহার গোডাউনে মাটি চাপা দিতো।

 

গাইবান্ধা সদর স্টেডিয়াম সংলগ্ন বধ্যভূমি

পাক হানাদার বাহিনীরা রংপুর থেকে এসে ’৭১ এর ১৭ এপ্রিল গাইবান্ধা স্টেডিয়ামে ঘাঁটি করে এবং তার কিছু দূরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজে থাকতো পাক সেনা কর্মকর্তারা। শুরু করে তাঁদের পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতন। প্রতি রাতেই অসংখ্য মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে স্টেডিয়াম সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে কফিল সাহার গোডাউনে মাটি চাপা দিতো। বিভিন্ন বয়সী মেয়েদের ধর্ষণের পর ওখানে পুঁতে রাখা হতো।

পাক সেনারা গাইবান্ধায় আসার পর শহরের দোকান পাঠ, বাড়িঘরের দরজা-জানালা সব হয়ে যায় বন্ধ। শহরের প্রায় সব বাসিন্দারা গ্রাম গঞ্জে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদিকে প্রথম দিনে বেশ কয়েকজন যুবক তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ হিন্দু ধরে এনে স্টেডিয়ামের পাশে রেল লাইনের ধারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পানি খেতে চাইলে মুমূর্ষ এ হতভাগ্যের মুখে প্রসাব করে দেয় পাক সেনারা।

প্রতিদিনই মহকুমার বিভিন্ন থানার গ্রামের বাড়ি-ঘর পোড়ানোর অভিযানে নামতো তারা। লোকজনকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করে পুঁতে ফেলতো লাশগুলো। ইতোমধ্যে গঠন করা হলো মহকুমা শান্তি কমিটি। কমিটির আহবায়ক হলেন সাবেক মুসলিম লীগ নেতা খন্দকার আজিজুল ইসলাম। সদস্যরা হলেন মুসলিম লীগ ও জামাতপন্থি লোকজন। এবার সেই রাজাকাররা পালাতক আওয়ামী লীগ নেতা ও হিন্দু ব্যবসায়ীদের বাড়ীঘর ও দোকান লুট করে। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কারো কারো ঘরবাড়ি। রাজাকারদের কেউ কেউ নিজেদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে নিরীহ লোকজনদেরও পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয়। পলাতক হিন্দু ব্যবসায়ীদের বাড়ি ও দোকান দখল করে নেয় রাজাকাররা। সে সময় পাক সেনাদের হাতে শহীদ হন – শহরের ব্যবসায়ী বিজয় কুমার রায়, পরেশ নাথ প্রসাদ, কেদার নাথ প্রসাদ, রামবাবু সাহা, জগত কর্মকার, ননী সাহা, মদন মহন দাস, উপেন্দ্র চন্দ্র দাস, যোগেশ চন্দ্র যায়, আনোয়ার হোসেনসহ নাম না আরও অনেকে। এ সংখ্যা হাজারেরও বেশি। রেললাইনের ধারেও গর্ত করে লাশ পুঁতে রাখা হত। এছাড়াও বিভিন্ন বধ্যভূমিতে লাশ পুঁতে রাখতো। অনেক খহেত্রে যাঁদেরকে হত্যা করা হতো তাদেরকে দিয়েই সেই গর্ত খুঁড়িয়ে নেওয়া হতো।

৮ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দু’টি বিমান গাইবান্ধা রেল স্টেশনের পাশে বোমা ফেলে। পরদিন ৯ ডিসেম্বর তিন ট্যাংকসহ কর্ণেল দত্তের নেতৃত্বে ভারতীয় যৌথবাহিনী সাদুল্লাপুর থেকে দুপুরে গাইবান্ধা রওনা হয়। তবে ওই দিন সকালেই কোম্পানি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব এলাহি রঞ্জুর নেতৃত্বে দেড় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা গাইবান্ধা শহরে প্রবেশ করে। আগে আচ করতে পেরে সকাল ১০টার মধ্যেই গাইবান্ধা স্টেডিয়াম ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে রেস্ট হাউস অবস্থান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পাক সেনারা বগুড়ার দিকে পালিয়ে যাবার পর স্টেডিয়ামের ক্যাম্পে মেয়েদের অসংখ্য পরিধেয় বস্ত্র পাওয়া যায়। (তথ্যসূত্র: ১. গাইবান্ধার ইতিহাস ও ঐতিহ্য: গাইবান্ধা ফাউন্ডেশন; একাত্তরে গাইবান্ধা: ড. মো. মাহবুবর রহমান, ‘আমার উপলব্ধিতে মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধা’ মুহম্মদ আজিজুল হক ও জেলা বধ্যভূমি সংরক্ষন কমিটির আহবায়ক জি. এম. মিঠুর সাক্ষাৎকার।)

 

সাঘাটা সুজালপুর বধ্যভূমি

একটু অজ পাড়াগাঁ সুজালপুর। এই পাড়া গাঁয়েই কোন কারণ ছাড়াই ৬ ডিসেম্বর সকাল ৯ টার দিকে পার্শ্ববর্তী মেনের পাড়া, পূর্ব ছিলমনের পাড়া, পবনতাইড়, খামার পবন তাইড় গ্রামেও হানা দেয় তারা। তারা গ্রামগুলি থেকে যার যা পেয়েছে তাই লুটপাট শেষে আগুন দিয়ে পুড়ে দেয় তারা।

ভিটেমাটির মায়ায় বাড়িতে ছিল যারা তাঁদের মধ্যে পূর্ব ছিলমনের পাড়ার ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ, জালাল উদ্দিন আহম্মেদ, আমিনুল ইসলাম, ইউসুফ আলী, ছিলমনের পাড়া সিনিয়র মাদ্রাসার আরবি শিক্ষক মৌলভী মো. মোজাম্মেল হক, সুজালপুর গ্রামের মনির উদ্দিন কবিরাজ, ময়ছেন আলী কবিরাজ, শুকালু শেখ, সুজালপুর গ্রামের (বর্তমান বোনারপাড়া ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ) আবদুল মতিন খন্দকারসহ ১১ জনকে ধরে মাদ্রাসা মাঠে (বর্তমান সুজারপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) নিয়ে আসে হানাদাররা। তাঁদের কাছ থেকে মুক্তি বাহিনীর সন্ধান চায়; পাক সেনাদের কাছে থাকা ওই গ্রামগুলির ম্যাট্রিক (এসএসসি) ও আইএ (এইসএসসি) পাশ করা ছাত্রদের ঠিকানা তাঁদের কাছে জানতে চায়। কিন্তু তথ্য না দেওয়ায় তাঁদের উপর নেমে আসে নির্যাতন। এক পর্যায়ে মাদ্রাসা মাথের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে দড়ি দিয়ে বেঁধে সার করে তাঁদের দার করানো হয়। এরপর তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

১১ জএর মধ্যে ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যান সুজালপুর গ্রামের (বর্তমান বোনারপাড়া ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ) আবদুল মতিন খন্দকার, ছিলমনের পাড়া সিনিয়র মাদ্রাসার আরবি শিক্ষক মৌলভী মো. মোজাম্মের হক ও পূর্ব ছিলমনের পাড়ার মো. আমিনুল ইসলাম মারা গেছেন। সেই অসহ্য যন্ত্রণার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে যান তারা দুই জন।

সুজালপুর গ্রামের আবদুল মতিন খন্দকার (সে সময় তিনি ১০ম শ্রেণীর ছাত্র) জানান, ৪০ টি বছর কেটে গেল, এখনও তাকে প্রতিরাতে ঘুমের মধ্যে পাক সেনা ও তাঁদের দোসররা তাড়া করে। এ তাড়া থেকে বাঁচতে কত চেস্টাই না করেছেন তবুও মুক্তি পাননি তিনি। তবে রাজাকারদের বিচার হলে হয়তো পাকসেনা ও তাঁদের দোসরদের তাড়া থেকে তিনি রেহাই পাবেন।

গত ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ঐ মাঠে সে দিনের ৮ শহীদসহ সাঘাটায় ২৪ অক্টোবর সম্মুখ সমরে শহীদ ১৭ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিতে এখানে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিসৌধ। (তথ্যসূত্র: সুজালপুর গ্রামের (বর্তমান বোনারপাড়া ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ) আবদুল মতিন খন্দকার ও জেলা বধ্যভূমি সংরক্ষন কমিটির আহবায়ক জি. এম. মিঠুর সাক্ষাৎকার)

 

 

 

 

কামারজানি বাজার বধ্যভূমি

শহীদের বুকের উপর কাঠ চেরাই কল, কেটে চলছে কাঠ। কাঠের গুড়া নয়, যেন সর্বক্ষণ ঝরছে রক্ত। সেই রক্ত কি তবে কারো গায়ে লাগছে না। ৪০ বছর তো পার হয়ে গেল অসংখ্য শহীদদের বুকের উপর একটু স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হলো না। বসানো হল কাঠ চেরাই কল। কামারজানি বাজারের পান-সিগারেট ব্যবসায়ী বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. মেহের আলী এমন ভাবে তার অভিব্যক্তি ব্যাক্ত করেন।

তিনি জানান, গাইবান্ধা সদর উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে কামারজানি গ্রাম। কামারজানি হাইস্কুল ’৭১ এ ছিল পাক সেনাদের ক্যাম্প। ক্যাম্পের পশ্চিমে বাজার। ওই বাজারে গাইবান্ধা শহর থেকে দাড়িয়াপুর হয়ে বাজারে ঢুকতেই হাতের ডান ধারে কামারজানি বধ্যভূমি। বর্তমানে ঐ জায়গাটিতে অবু হোসেনের কাঠ চেরাই কল। ’৭১ জায়গাটি ছিল বাঁশ ঝাড় ও নিচু জলা ভূমি। এখানে খাঁন সেনারা মানুষকে হয়া করে মাটি চাপা দেয়। কখনো বা হত্যা করে জলাশয়ে লাশ ফেলে রাখা হতো। শিয়াল কুকুর ছিঁড়ে খেতো শহীদদের দেহের অংশ। পাক হান্দার বাহিনীরা কামারজানিতে ক্যাম্প করে মে মাসের দিকে। নদী পার  হয়ে এ মুক্তি সেনারা কুড়িগ্রাম হয়ে ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে যেত। তাই এ পথে পাক সেনাদের ছিল কঠোর পাহারা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধ ধরে কামারজানি থেকে দাড়িয়াপুর-রসুলপুর-কাইয়ারহাট-ফুলছড়ি এ পথে পাক সেনাদের অবাধ চলাচল ছিল।

পূর্ব বারো বলদিয়া গ্রামের রহুল আলম জানান, মে মাসের কোনো এক সময়ে পূর্ব গিদারী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জেল হোসেন বাড়ি আসেন। দালালদের কাছে এ খবর পেয়ে পাক সেনা তাকে বাড়ি থেকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তারপর তাকে অমানবিক নির্যাতন শেষে কামারজানি গ্রামের উমেদ আলী, ছালামত মিয়া, ময়েজ উদ্দিন, ছাবেদ আলী, জসিজলসহ ৯ জনের সঙ্গে একই দিনে হত্যা করে এখানে মাটি চাপা দেওয়া হয়।

জেলা বধ্যভূমি সংরক্ষন কমিটির আহবায়ক জি. এম. মিঠু জানান, ১৯৯৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর গথির গাইবান্ধা জেলা বধ্যভূমি সংরক্ষণ কমিটি তার নেতৃত্বে এক জরিপ চালিইয়ে এ বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করে।

 

গোবিন্দগঞ্জ কাটাখালি বধ্যভূমি

ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ করতোয়া নদীর কাটখালী সেতু ভাঙার মধ্য দিয়ে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রংপুর থেকে পাকবাহিনীর সুসজ্জিত বহর সড়ক পথে গোবিন্দগঞ্জের দিকে আসছিল। এমন সংবাদে ২৬ মার্চ স্থানীয় ছাত্র-জনতা তা প্রতিহত করতে এক গোপন বৈঠক করে। পরের দিন সকালে পাক বাহিনীকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে মহাসড়কের এই সেতু ভেঙে ফেলার জন্য তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য জামালুর রহমান প্রধান ও থানা ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুল মতিন তালুকদারের নেতৃত্বে উজ্জীবিত ছাত্র-জনতা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সেতু ভাঙতে গিয়ে তা সম্ভব না হওয়ায় সেতুর উত্তর পাশে রাস্তা কেটে ও গাছ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

এ সময় রংপুর সেনানিবাস থেকে আসা পাক সেনারা নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন উপজেলার তুলসী পাড়ার আবদুল মান্নান, মো. হারেজ, গোলাববাগের মনোরঞ্জন মহন্ত বাবলু, যিশুবাড়ী দরবস্ত গ্রামের আবদুল মজিদ, পুন তাইড় গ্রামের ফজলুল করিম, নীলকণ্ঠপুরের তোবারক আলী, পাটোয়া গ্রামের আবদুল কুদ্দুস, শাখাহার গ্রামের মোনোঢার হোসেন সরকার, সিরাজুল ইসলাম ও বুজরুক বোয়ালিয়ার বাবু দত্ত।

সেতু নির্মাণের সময় ঠিকাদাররা সেতুর উত্তর ও মহাসড়কের পশ্চিম পাশে তাঁদের বিশ্রামের ও শ্রমিকদের থাকার জন্য কয়েকটি ঘর তৈরি করে ছিলো। পরবর্তীতে ঐ জায়গাটি হাওয়াখানা নামে পরিচিত লাভ করে। এই হাওয়াখানায় ২৭ মার্চের প্রতিরোধ যুদ্ধের পর ঐ সেতু রক্ষার জন্য গাইবান্ধা শহরের আগেই এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সেখানে পাকসেনারা ক্যাম্প স্থাপন করে।

এরপর থেকে তারা ও তাঁদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সহায়তায় গোবিন্দগঞ্জ ও আশেপাশের এলাকায় চালায় ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতন। মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলা বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে এনে এখানে হত্যা করতো। ঐ সেতুর উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম ধারে লাশ মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। গোবিন্দগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শ্যামলেন্দু মোহন রায় জানান, কুখ্যাত রাজাকার মোফাজ্জল হোসেন ও আতাউর রহমান বেলালের সহযোগিতায় প্রথমে তারা উপজেলার ফতেউল্যাপুরের রায় বাড়ি লুট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। গোবিন্দগঞ্জ থানার দেড় সহস্রাধিক বাড়িঘর লুট করে ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পাঁচ শতাধিক মানুষ মানুষ হত্যা অসংখ্য নারীকে নির্যাতন করে তারা। এছাড়া ঐ সড়কে যে সব বাস চলাচল করতে পাক সেনারা সে বাস গুলো থামাতো। বাসের কোন নারী যাত্রিকে পছন্দ হলে তাঁদেরকে জোর পূর্বক নামিয়ে নিতো।

পাক বাহিনীর ওপর চালায় গেরিলা আক্রমণ শুরু হলে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনী তিন দিক থেকে ট্যাংক, কামানের ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ত্রিমুখী আক্রমণ চালায় পাকবাহিনীর কাটাখালী ক্যাম্পে। সারারাত ধরে চলে দু’পক্ষের গোলাবর্ষণ। এতে বহু পাকসেনা নিহত হয়, পালিয়ে আত্মরক্ষা করে অনেকে ও বহু সংখ্যক পাক সেনা আত্মসমর্পন করে। অবশেষে ১২ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় গোবিন্দগঞ্জ।

তাজুল ইসলাম রেজা

 

 

গোপালগঞ্জ জেলা

শত শত মানুষকে মিনি ক্যাটনমেন্টে আটক রেখে নির্যাতন ও অত্যাচার করত। ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন পুকুরপাড়ে মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে লাশ পদ্ম পুকুরে ফেলে দিত। ফলে এক সময়ের পদ্ম পুকুর পরিচিত হয়ে ওঠে জয় বাংলা পুকুর নামে।

 

জয় বাংলা পুকুর বধ্যভূমি

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ কার্যালয় সংলগ্ন বধ্যভূমিটি ‘জয় বাংলার পুকুর’ নামে পরিচিত। ৩০ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোপালগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। তারা সিও অফিসে ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ স্থাপন করে। এখান থেকেই হানাদার বাহিনী বিভিন্ন স্থানে গিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, অত্যাচার নির্যাতন চালাত এবং মুক্তিকামী মানুষকে ধরে আনত। শত শত মানুষকে মিনি ক্যান্টনমেন্টে আটক রেখে নির্যাতন ও অত্যাচার করত। ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন পুকুরপাড়ে মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে লাশ পদ্ম পুকুরে ফেলে দিত। ফলে এক সময়ের পদ্ম পুকুরে পরিচিত হয়ে ওঠে জয় বাংলা পুকুর নামে।

গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা শেখ লুতফার রহমান বাচ্চু জানান, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ ক্যান্টনমেন্টে মুক্তিযোদ্ধা গোলজার চৌধুরী, আবদুল লতিফ, অধ্যাপক সন্তোষ দাস, গিরিন, দীলিপসহ শত শত মানুষকে হত্যা করে লাশ পদ্ম পুকুরে ফেলে দেয়। স্বাধীনতার পর এই পুকুর ও তার পাড়ে মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

 

ভাটিয়াপাড়ার গণকবর

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ভাটিয়াপাড়া রেল স্টেশন সংলগ্ন গণকবরে অজ্ঞাত শত শত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিকামী মানুষকে কবর দেওয়া হয়েছে। ভৌগলিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেলস্টেশন ও নদী বন্দর ভাটিয়াপাড়ার ওয়্যারলেস স্টেশনে ১৯৭১ এর মে মাসে পাক হানাদার বাহিনী সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। গোপালগঞ্জ, নড়াইল, যশোর, ফরিদপুর জেলার সীমান্তবর্তী  এ সামরিক ঘাঁটি থেকে পাক বাহিনী ৪টি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে অভিযান চালিয়ে নারী ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করত।

মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে এ ক্যান্টনমেন্টে আটক রেখে নির্যাতন করত। তাঁদের হত্যা করে রেল স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় মাটি চাপা দিতো। ফলে এটি গণকবরে পরিণত হয়। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ক্যাপ্টেন হুদা ও কমল সিদ্দিকী জানান, মুক্তিযোদ্ধা মিন্টু, জয়নাল, ইয়াসিনসহ ৪ জেল্র শত শত মানুষকে হত্যা করে পাক বাহিনী লাশ ভাটিয়াপাড়া গণকবরে মাটি চাপা দেয়।

 

মুকসুদপুরের বনবাড়ি বধ্যভূমি

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বহুগ্রাম ইউনিয়নের বনবাড়ি গ্রামের বৈরাগীর ভিটা বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ১৭ মে মুকসুদপুর ক্যাম্প ও টেকেরহাট ক্যাম্প থেকে শতাধিক পাক সেনা মুকসুদপুরের প্রত্যন্ত বিল এলাকার গ্রাম গুলোতে অভিযান চালায়। এ দিন তারা বহুগ্রাম, মটবাড়ি, খাগড়াডাঙ্গা গ্রামে অভিযান চালিয়ে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে। ৪টি গ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ বনবাড়ি বৈরাগীর ভিটায় আশ্রয় নেয়।

পাকসেনারা সেখানে ২৩ জনকে হত্যা করে। পরে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষদের এখানে ধরে এনে হত্যা করা হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশগুলো সেখানেই পচে গলে যায়। স্বাধীনতার পর সেখানে মানুষের হাড়গোড়, মাথার খুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। গ্রামের প্রবীন শিক্ষক গোবিন্দ চদ্র বিশ্বাস বলেন, ১৭ মে পাকসেনারা বড় নৌকায় করে বহুগ্রাম ইউনিয়নের ৪টি গ্রামে তাণ্ডব চালায়। বনবাড়ি বিলের শেষ মাথায় বৈরাগীর ভিটায় জীবন বাঁচাতে মানুষ আশ্রয় নেয়। সেখানে হামলা চালিয়ে পাক বাহিনী প্রথম ২৩ জনকে হত্যা করে। পরে গোকুল মজুমদার, কৈলাশ বোস, খগেন মজুমদারসহ আরও অন্তত ২৫ জনকে এখানে ধরে এনে গুলি করে লাশ বৈরাগীর ভিটার ওপর ফেলে যায়।

 

কলাবাড়ি বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা যায়, গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় কলাবাড়ি এলাকায় ১৯৭১ সালের ১২ অক্টোবর পাকবাহিনী আধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গানবোট নিয়ে নির্মমভাবে হামলা চালায় এবং ঐ এলাকার প্রায় ২০০ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। পুরো কলাবাড়ি গ্রামটি এ সময় বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। (সূত্র: দৈনিক সংবাদ: ১২ অক্টোবর ১৯৯৩; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৪২৪-৪২৫; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৭৫; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-০৬-০৭)

মনোজ সাহা

 

 

 

চট্টগ্রাম জেলা

১৯৭১ এর ১৩ এপ্রিল রাউজানের ঊনসত্তর পাড়ার মহাজন বাড়ির পুকুর ঘাট সংলগ্ন পাড়ে ৭০-৭২ জন নারী পুরুষকে দাঁড় করিয়ে ব্রাহস ফায়ার করা হয়। এতে মারা যান হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬৯ জন। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাহ করার  পরিবর্তে তাঁদের ওই পুকুরের খাড়িতে কোনরকমে মাটিচাপা দেওয়া হয় বলে স্থানীয়রা জানান।

 

আমবাগান বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম শহরের আমবাগানে রয়েছে বধ্যভূমি। এখানে হানাদার খান সেনারা বাঙালি নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৮-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

ওয়্যারলেস কলোনি বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলী ওয়্যারলেস কলোনি এলাকায় রয়েছে বধ্যভূমি। একাত্তরের ১০ নভেম্বর পাহারতলীর পাঞ্জাবি লাইন, ওয়্যারলেস কলোনি এবং বাহাদুর শাহ কলোনির শিশু, যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধদেরকে বাসা থেকে ধরে আনে সিভিল পাইওনিয়ার ফোর্সের লোকরা। অনেককে ‘মিলিটারি অফিসার সাহেব ডাকছে’ বলে ফাঁকি দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায়। এভাবে সবাইকে একত্র করে ওয়্যারলেস কলোনির নিকটস্থ পাহাড়ের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে জল্লাদরা ধারালো অস্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। সকাল থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত থাকে। নরঘাতকেরা একেকবারে আনুমানিক ২শ’ লোককে হত্যা করে। হাজার হাজার নারী-পুরুষের লাশ সেখানে পড়েছিল। কোথাও কোথাও লাশগুলোকে একত্র করে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবার কোথাও বাড়িঘর ও লাশ ধ্বংসের জন্য গানপাউডার ব্যবহার করা হয়। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৫-৫৬, ২৩৫; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৭৮; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-৩৫৫; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

শেরশাহ কলোনি বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম শহরের শেরশাহ কলোনিতে রয়েছে বধ্যভূমি। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৮-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

ফয়েজ লেক বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়লীতে তৎকালীন পাঞ্জাবি লেনের পাশে ফয়েজ লেকের অবস্থান। রক্তপিপাসু পাঞ্জাবি ও বিহারিদের মাত্র একদিনের হত্যাকান্ডে পাহাড়তলীর ফয়েজ লেককে দেশের বৃহত্তম বধ্যভূমিতে পরিণত করে। রেল কলোনিবাসীদের বিহারিরা নির্বিচারে হত্যা করেছিল। শুধু তাই নয়, লোকাল রুটের দোহাজারীগামী ট্রেন থামিয়েও তারা গণহত্যা চালায়। বাঙালি কলোনি থেকে নারী-পুরুষকে ধরে এনে হাত-পা বেঁধে জল্লাদ দিয়ে মাথা দ্বিখণ্ডিত করে হত্যাযজ্ঞ চালানো হতো। তাঁদেরকে হত্যা করে বাঙালিদেরকে দিয়ে জোরপূর্বক গণকবর খুঁড়িয়ে অবশেষে সেই কবরেই মাটি চাপা দেওয়া হতো। সেনা নিবাসে বন্দী নারীদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে শেষে হত্যা করে এখানে এনে পুঁতে রাখা হতো। এই বধ্যভূমির মাটি খুড়লে এখনও পাওয়া যাবে অসংখ্য শহীদের কঙ্কাল। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৯, ২৩৫; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮০-৩৮১; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-৩৭৫; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

চাঁদগাঁও বধ্যভূমি

চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও-এ রয়েছে একটি বধ্যভূমি। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৮-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

লালখান বাজার বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজারে রয়েছে বধ্যভূমি। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৮-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

হালিশহর বধ্যভূমি

চট্টগ্রামের হালিশহরে নাথপাড়ায় একাত্তরের ৩১ মার্চ একটি পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়। পাক বাহিনীর সাঁড়াশী অভিযানের সমর্থনে শওকত নামে এক জল্লাদের নেতৃত্বে স্থানীয় বিহারিরা এই হত্যাকাণ্ড চালায়। অল্প সময়ের মধ্যে কুড়াল, কিরিচ এবং রামদা দিয়ে কুপিয়ে ৪০ জন ইপিআরসহ ৭৯ জনকে হত্যা করে। ২৯ মার্চ পশ্চিম দিকের বঙ্গোপসাগর উপকূল দিয়ে পাকবাহিনী দক্ষিন কাট্টলীর ইপিআর ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হয়। এক পর্যায়ে ৩০ মার্চ পাকবাহিনী উত্তরে গহনা খাল এবং দক্ষিণে ইপিআর ক্যাম্প ও তৎসংলগ্ন এলাকা ঘিরে ফেলে। এ অবস্থায় অধিকাংশ ইপিআর সদস্য এলাকা ত্যাগ করলেও ৪০ জন ইপিআর নাথপাড়ায় বিভিন্ন বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৭৯, ৩৮২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

কালুরঘাট বধ্যভূমি

চট্টগ্রামের কালুরঘাটে রয়েছে বধ্যভূমি। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৮-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮২, ৬৩২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

 

পোর্ট কলোনি বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম শহরের পোর্ট কলোনি এলাকায় রয়েছে বধ্যভূমি। এই এলাকায় প্রায় ১৫০ জন বাঙালি নর-নারীকে হত্যা করা হয়। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৮-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮১, ৩৮২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

চট্টগ্রাম সেনানিবাস বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অভ্যন্তরে বেশ কিছু গণকবর ও বধ্যভূমি রয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সৈণিকরা চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে প্রশিক্ষণার্থী প্রায় ২৫০০  নিরস্ত্র বাঙালি সৈনিকের ওপর হামলা চালায়। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও পাকিস্তানিদের ব্যাপক আক্রমণের মুখে সেদিন তারা টিকতে পারেনি। তাঁদের অধিকাংশকেই নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়া সেনানিবাসের আশপাশে বিভিন্ন জায়গা থেকেও অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে এখানে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এসব গণকবরে কত সংখ্যক শহীদ শায়িত আছেন তা জানা যায়নি। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৮-৫৯; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮১; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-১০৫; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বাংলা, ১৪ মে ১৯৭২)

 

সার্কটি হাউজ বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম শহরের সার্কটি হাউজ এলাকায় রয়েছে বধ্যভূমি। চট্টগ্রাম সার্কটি হাউজের ভিতর অসংখ্য বাঙালিকে বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর অনেক মানুষের খুলি সার্কটি হাউজের গর্তে পাওয়া যায়। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮২, ৪৬২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক জনকণ্ঠ, ১২ ডিসেম্বর ১৯৯৯)

 

মিরশ্বরাই বধ্যভূমি

একাত্তরের এপ্রিলে পাকবাহিনী মিরশ্বরাইয়ে রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠনের পর হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ ও বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন চালাতে থাকে। পাকবাহিনী মিরশ্বরাইয়ের অদূরে লোহারপুর, হিঙ্গুলী সেতু, তছি মিয়ার পুল, করের হাট ইউনিয়ন, সীমান্তবর্তী ফেনি নদীর পাড় (পূর্ব-পশ্চিমে), হিঙ্গুলী কোর্টের পাড়সহ অনেক জায়গায় নিরীহ মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেয়। এই হত্যাকাণ্ড ও গণকবর সৃষ্টিতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে এ দেশীয় দালালরা। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড – আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, পৃ.-১১৪-১১৯; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

 

 

সীতাকুণ্ড পাহাড় বধ্যভূমি

পাকবাহিনী সীতাকুণ্ড পাহাড়ে হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা করেছে। স্থানীয় জনসাধারনের ধারণা-শুধু মিরশ্বরাই ও সীতাকুণ্ডের বধ্যভূমিগুলোতে ১৫ থেকে ২৫ হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

ঝাউতলা বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম শহরেরঝাউতলায় রয়েছে বধ্যভূমি। ১৯৭২-এ ‘পূর্বদেশ’-এর প্রতিনিধি ঝাউতলা এলাকার বিভিন্ন সেফটি ট্যাঙ্ক ও পাহাড়ি ঝোপঝাড়ের মধ্যে অনেকগুলো কঙ্কাল দেখতে পেয়েছেন উল্লেখ করে লেখেন “চট্টগ্রাম শহরের ঝাউতলায় বহু নরকঙ্কাল অস্তিত্ব পাওয়া যাবে”। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৯, ২৩৫-২৩৬; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

নাসিরাবাদ বধ্যভূমি

চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ এলাকায় রয়েছে বধ্যভূমি। ১৯৭২-এ ‘পূর্বদেশ’ প্রতিনিধি তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘নাসিরাবাদের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে বহু নরকঙ্কালের অস্তিত্ব পাওয়া যেতে পারে’। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৯; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮২; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

শিবনাথ পাহাড় বধ্যভূমি

চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডের শিবনাথ পাহাড়ে কয়েক হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৯; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

জোরারগঞ্জ বধ্যভূমি

চট্টগ্রামের মিরশ্বরাইয়ের জোরারগঞ্জ এলাকায় মানুষ জবাই করার স্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। এখানে রাস্তা, বাস-ট্রাক এবং ট্রেন থেকে বহু লোককে ধরে এনে আটক রাখা হতো এবং প্রতিদিন ৫০ জন অথবা ১০০ জন করে হত্যা করা হতো। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৯; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

 

 

দামপাড়া বধ্যভূমি

চট্টগ্রামের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় দামপাড়া গরীবুল্লাহ শাহ্‌ মাজারের পাশের বধ্যভূমিতে। এই বধ্যভূমিতে প্রায় ৪০ হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়। একাত্তরের ৩০ মার্চ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টির দিন ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় কড়া সেনা পাহারায় ৫/৬টি ট্রাক বোঝাই নিরীহ লোক ধরে নিয়ে আসা হতো। লাশ পুঁতবার জন্য এখানে গভীর গর্ত খনন করা হয়। তারপর হতভাগ্যদের চোখ বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হতো। মাত্র কয়েকদিনের লাশে এই গভীর গর্ত ভর্তি হয়ে গেলে সদ্যমৃত লাশগুলোকে ট্রাকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা হতো। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৭; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮১; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-২৬১; দৈনিক বাংলা, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

পশ্চিম হিঙ্গুলী বধ্যভূমি

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩ মে চট্টগ্রাম জেলার মিরশ্বরাই থানার পশ্চিম হিঙ্গুলী গ্রামের একটি পুকুর থেকে ৮৩ টি নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। জঙ্গল ঘেরা অন্ধকার এলাকায় পুকুরটি ছিল। হত্যার পর পাকবাহিনী এই পুকুরে হতভাগ্যদের ফেলে যায়। এই গ্রামটির অবস্থান ফেনী নদীর রেলসেতুর কাছেই। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড – আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, পৃ.-১১৪; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৯; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮০; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-৩৪২; দৈনিক বাংলা, ৫ মে ১৯৭২)

 

পাঁচলাইশ বধ্যভূমি

চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে দাম্পিং ডিপোর কাছে একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়। এই স্থানের মাটি সরাবার পর শত শত নরকঙ্কাল পাওয়া যায়। মানুষের খুলি এবং হাড়গোড়ের পরিমাণ দেখে এখানকার বধ্যভূমিতে প্রায় পাঁচ শতাধিক বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। কোনো কোনো কঙ্কাল তখনও বুলেট বিদ্ধ অবস্থায় ছিল। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৬, ২৩৪-২৩৫; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮০; দৈনিক বাংলা, ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

 

বড়পুকুরপাড় গণকবর

১৯৭১ সালের ১৯ মে পাকবাহিনী চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানায় প্রবেশ করে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে দেয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। প্রথম দিনেই তারা বাঁশখালির বাণী গ্রামের বিভূতিরঞ্জন চৌধুরী, আশুতোষ, দুই সহোদর সুধাংশু দে ও সুশান্ত দেসহ মোট ১৮ জনকে বড়পুকুর ঘাটে এনে গুলি করে হত্যা করে। পরে পাকবাহিনী গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে গ্রামবাসীরা ঐ ১৮ জনকে বড়পুকুর পাড়ে গণকবরে সমাহিত করে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড – আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, পৃ.-১২১-১২২)

 

 

ছুটি খাঁ দীঘি গণকবর

চট্টগ্রামের মিরশ্বরাইয়ে ছুটি খাঁ দীঘির পাড়ে গণকবর রয়েছে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস, তৃতীয় খণ্ড – আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন, পৃ.-১২১-১২২)

 

কামানটিলা বধ্যভূমি

৫ ডিসেম্বর ১৯৯৯ সালে পতেঙ্গায় নতুন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়ে নির্মাণের জন্য মাটি খননকালে এর উত্তর-পূর্ব পাশে আবিষ্কৃত হয় একটি বধ্যভূমি। এই বধ্যভূমিটি ছিল এরোড্রামের বেশ কাছে। ’৯৯-এর ৬ ও ৭ ডিসেম্বর এটি খনন করে উদ্ধার করা হয় শহীদদের মাথার খুলি, হাড়গোড় ও কাপড়চোপড়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী পতেঙ্গা, হালিশহর, চৌধুরী পাড়া, শীলপাড়া, জেলেপাড়াসহ আশে পাশের এলাকার নিরাপরাধ বাঙালিদের নানা অজুহাতে ধরে পতেঙ্গার কামানটিলা নামক স্থানে জড়ো করে রাতের আঁধারে গুলি করে হত্যা করতো। স্বাধীনতার কিছু দিন পর তিন চার ফুট মাটি খুড়তেই এখান থেকে বেরিয়ে আসে হাড়, মাথার খুলি, কাপড়, চশমা, পরিচয়পত্রসহ নিহতদের বিভিন্ন নিদর্শন। পরে এই বধ্যভূমিতে নিহতদের পরিবারের আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, কামানটিলার নিকটবর্তী শীলপাড়ার লোকদেরকে এখানে এনে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল সিভিল এভিয়েশন অফিসে কর্মরত এক বিহারি পরিবারের তিন ছেলে ও পাকবাহিনী। যুদ্ধের সমুয় এঁরা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। গ্রামে গঞ্জে ঘুরে মেয়েদের ধরে আনাও এদের কাজ ছিল। এদের সহয়তায় পাকবাহিনী একাত্তরে শীল সম্প্রদায়ের ৩৮ জন নিরীহ মানুষকে ধরে এনে এখানে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হতো। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৭৯; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-২৭)

 

শাকপুরা বধ্যভূমি

চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানার শাকপুরা গ্রামেও রয়েছে বধ্যভূমি। একাত্তরের ২০ এপ্রিল পাকবাহিনী ও তাঁদের দোসররা খুব ভোরে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। গ্রামবাসীর অনেকেই তখন ঘুম থেকে ওঠেনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা দেখেন সামনে পাকসেনা, পালাবার উপায় নেই। এদের মধ্যে দুজন পালাতে পারলেও অন্যদের পান দিতে হয়।  তারা গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর অবিরাম গুলিবর্ষণ, চারিদিকে আগুন, শিশু-নারী-পুরুষের আর্তচিৎকার ও আহাজারিতে শাকপুরা গ্রাম যখন কাঁপছে তখন পশু লুট করে চলছে ধনসম্পদ। কেবল সম্পদ নয়, সেই সঙ্গে চলে নারী ধর্ষণও। অসংখ্য নারী তাঁদের সম্ভ্রম হারান, ১৫০ জন হারাম তাঁদের প্রান। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৭-৫৮; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮১; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, চতুর্থ খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-১০২)

 

রাউজানের ঊনসত্তর পাড়া বধ্যভূমি

১৯৭১ এর ১৩ এপ্রিল রাউজানের ঊনসত্তর পাড়ার মহাজন বাড়ির পুকুর ঘাট সংলগ্ন পাড়ে ৭০-৭২ জন নারী পুরুষকে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হয়। এতে মারা যান হিন্দু সম্প্রদায়ের ৬৯ জন। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তাঁদের দাহ করার পরিবর্তে তাঁদের ওই পুকুরের খাড়িতে কোনরকমে মাটিচাপা দেওয়া হয় বলে স্থানীয়রা জানান। স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতারা পাকিস্তানি বাহিনীকে ওই পাড়ায় নিয়ে গিয়ে এ হত্যাকাণ্ড চালায়। ওই স্থানে কোন স্মৃতিফলক না থাকলেও স্থানীয় ঊনসত্তর পাড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তাঁদের নাম সম্বলিত একটি ফলক আছে। একইদিন সকালে স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় পাকবাহিনী রাউজানের কুণ্ডেশ্বরীতে নিজ বাড়িতে নূতন চন্দ্র সিংহ এরপরে পার্শবর্তী জগতমলপাড়ায় একসাথে ৩৭ জনকে হত্যা করে।

মিন্টু চৌধুরী (সহযোগিতা করেন সুবর্ণা মজুমদার)

 

 

চাঁদপুর জেলা

“দেশ মাতৃকা রক্ষার জন্য গ্রামের চার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। আমরা তাঁদের লাশ না আনতে পারলেও নিহতদের খুলি ও হাড়গোড় এনে গণকবর দিয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পার হতে চললেও তাঁদের গণকবরের কেউ খোজ নিচ্ছে না। এই জন্যই কি তারা জীবন দিয়েছিল?”

 

কাটাখালি বাজার বধ্যভূমি

হাইমচর উপজেলার কাটাখালি বাজারের ওয়াপদা খাল হিল পাকিস্তানিদের হত্যাকেন্দ্র। হানাদাররা বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে নির্যাতনের পর নির্মমভাবে হত্যা করতো। প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন এক চা দোকান মালিক মনা বেপারী, কর্মচারী আ. সোবাহান বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৪ অগাস্ট সকালে পাকবাহিনী কাটাখালী বাজারে আক্রমণ চালায়। লোকজন ভয়ে দিগ্বিদিক পালাতে থাকে। তখন কাটাখালী বাজার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করায় তাঁদের উদ্দেশ্য করেই পাকবাহিনী কাটাখালি বাজারে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৪ অগাস্ট তৎকালীন ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা মুকবল পাটওয়ারী জীবন বাঁচাতে ওয়াপদা খালে ঝাঁপিয়ে পড়লে পাকবাহিনী তাকে খালেই গুলি করে হত্যা করে।

 

ডাকবাংলো বধ্যভূমি

ফরিদ্গঞ্জ উপজেলার ডাকবাংলো চত্বরে পাক হানাদার বাহিনীর একটি নির্যাতন ও হত্যাকেন্দ্র ছিল। যুদ্ধাকালীন এখানে বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরের পশ্চিম বাজারে নির্জন পরিবেশে ডাকাতিয়া নদীর কোল ঘেঁষে ডাকবাংলোটির অবস্থান। যুদ্ধকালীন এখানে শত শত নারী-পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাখানাদার বাহিনী নদীতে ফেলে দেয়। ডাকবাংলোয় উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী-পুরুষদের ধরে এনে হাত-পা বেঁধে নদীতে নিক্ষেপ করা হতো। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৭৭; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮৪)

 

 

 

নাসিরকোর্ট উচ্চ বিদ্যালয় বধ্যভূমি

হাজীগঞ্জ উপজেলার নাসিরকোর্ট উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৭১’র নভেম্বরের শেষদিকে পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ ৯ জনকে কবর দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর তা চিহ্নিত করা হয়। এঁরা হলেন- এম. এ. মতিন, জয়নাল আবেদীন, জাহাঙ্গীর আলম, এস. এম. জহিরুল হক, মো. জয়নাল আবেদীন, আবু তাঁদের, এমদাদুল হক, আ. রশিদ, ইলিয়াছ হুছাইন। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৪৩২-৪৩৩)

 

মেহের রেলস্টেশন বধ্যভূমি

শাহরাস্তি উপজেলায় চাদপুর-লাকসাম রেল সড়কের মেহের স্টেশনে হানাদার বাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করে। মেহের স্টেশন সংলগ্ন সূয়াপাড়া গ্রামের মৃত সেকেন্দর আলী পাটোয়ারীর ছেলে ছেলামত উল্যাহ পাটোয়ারী (৭০) বলেন, “আমাদের বাড়ির পাশে মেহের স্টেশন। আমি স্বচক্ষে দেখেছি কিভাবে পাক হানাদার বাহিনী এই এলাকার নিরীহ মানুষদের হত্যা করে। মেহের স্টেশনের পূর্ব পাশে একটি আম গাছ আজও বেঁচে আছে। আজও আমার মনে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী রাজাকারদের ইন্ধনে এলাকার নিরীহ মানুষদের এনে পা উপর দিক দিয়ে গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন চালাতো। স্টেশনের পশ্চিম পাশে রেল লাইনের দক্ষিণ অংশে একে একে ৪/৫টি লোককে গুলি করে একটি গর্তে ফেলে দিতো। পরে গর্তের ভিতরে কেউ নড়াচড়া করে আবারও গর্তের ভিতরে গুলি চালাতো”।

 

একই গ্রামের মৃত আকুব আলীর ছেলে আব্দুস সালাম (৮৫) বলেন, “আমি তখন জীবন বাজি রেখে বেবি ট্যাক্সি চালাতাম। ঘরে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে তাঁদের খাবার জোগানর জন্য। আমি দেখেছি, মেহের স্টেশনের পূর্ব পাশে একই গর্তে ২০/২৫ জনকে মাটি চাপা দিয়ে গণকবর দেওয়া হয়”।

 

চান্দ্রাকান্দি গ্রামের গণকবর

১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধে মতলব উত্তর উপজেলার সাদুল্যাহপুর ইউনিয়নের চান্দ্রাকান্দি গ্রামের চার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এঁরা হলেন – সিরাজুল হক, আবদুল আওয়াল, সাইজুদ্দিন ভূঁইয়া ও দুধ মিয়া ব্যাপারী। দেশকে পাক হানাদার মুক্ত করার জন্য ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পথে কোতোয়ালি থানার পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গুলিবদ্ধ হয়ে নিহত হন এই চার জন।

মতলব উত্তর উপজেলার চান্দ্রাকান্দি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী ইসমাইল হোসেন বলেন, “দেশ মাতৃকা রক্ষার জন্য গ্রামের চার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। আমরা তাঁদের লাশ না আনতে পারলেও নিহতদের খুলি ও হাড়গোড় এনে গণকবর দিয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পার হতে চললেও তাঁদের গণকবরের কেউ খোজ নিচ্ছে না। এই জন্যই কি তারা জীবন দিয়েছিল?”

নিহত মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হকের বড় ভাই মুজিবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ১৯৬৮ সালে সিরাজুল হক এসএসসি পাশ করার পর টঙ্গীতে অলিম্পিয়া কোম্পানিতে চাকুরী নেয়। এ সময় যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চাকুরী ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। এরপর তারা প্রশিক্ষনের জন্য ভারতে যায়। প্রশিক্ষণ শেষে ভারত থেকে ফেরার পথে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে আমার ভাই সিরাজসহ ৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এর মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন। যুদ্ধচলাকালীন তিনি ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবদুল মতিন দেশে এসে আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক নিহত হয়েছেন বলে সংবাদ দেন। অপরদিকে শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আওয়াল এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ফর্ম ফিলাপ করেন, এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। তিনি পরীক্ষা বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আরেক মুক্তিযোদ্ধা সাইজুদ্দিন ভূঁইয়া নবম শ্রেনীতে অধ্যায়নরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে। আর ওই যুদ্ধে তিনিও নিহত হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা দুধ মিয়া ব্যাপারী বিয়ের ১০ মাসের মাথায় যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন।

 

রেলওয়ে স্টেশন বধ্যভূমি

চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় রয়েছে বধ্যভূমি। এখানে একটি কসাইখানাও ছিল। রেল স্টেশনের অফিসগুলো ও রেস্ট হাউজেও পাকিস্তানি ও তাঁদের দোসরদের ক্যাম্প ছিল। পাকসেনারা স্টেশনের ওয়েটিং রুকমে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। অসংখ্য বাঙালির লাশ এ বধ্যভূমিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। রেলের ডোম ছনুয়া ও গয়াকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে এসব লাশ সরাতে বাধ্য করা হতো।

মুক্তিযুদ্ধে এই বধ্যভূমির অগণন শহীদ স্মরণে বড় স্টেশন এলাকায় মেঘনা নদী তীরে নির্মিত হচ্ছে ‘রক্তধারা’ স্মৃতিস্তম্ভ। ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ এই স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে। এ বধ্যভূমির কথা অন্যান্য গ্রন্থেও উল্লেখ আছে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৭৭; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮৬; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-১১৩-১১৪; দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)

আল-ইমরান শোভন

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা

“দেশ মাতৃকা রক্ষার জন্য গ্রামের চার মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। আমরা তাঁদের লাশ না আনতে পারলেও নিহতদের খুলি ও হাড়গোড় এনে গণকবর দিয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পার হতে চললেও তাঁদের গণকবরের কেউ খোজ নিচ্ছে না। এই জন্যই কি তারা জীবন দিয়েছিল?”

 

রেহাইচর বধ্যভূমি ও গণকবর

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের শ্মশান ঘাট গণকবর থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে রেহাইচর এলাকায় মহানন্দা নদীর তীরে অসংখ্যা সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে পাকিস্তান সেনা বাহিনী। এ স্থানে কোন স্মৃতি স্তম্ভ নেই। নদী ভাঙ্গনে অনেকটাই বিলীন হয়ে গেছে।

অন্যসুত্রে বলা হয়েছে, রেহাইচর গ্রামে বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। এখানে  মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। গুলি করে হত্যা করার পর লাশগুলো গর্ত করে পুঁতে ফেলা হতো। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে গণকবরটি আবিষ্কৃত হয়। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

শ্মশানঘাট বধ্যভূমি

চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের শ্মশান ঘাটের কাছে পাকিস্তানি সেনারা শত শত মানুষকে হত্যা করে। এর অনেক লাশ মাটিতে পুঁতে রাখে এবং অন্যগুলো নদীতে ভাসিয়ে দেয় তারা। এ স্থানে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নাই। বর্তমানে এখানে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করা হয়েছে এবং অনেকটা এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়াও অন্যান্য সূত্রে বলা হয়েছে, মহানন্দা নদী তীরবর্তী নবাবগঞ্জ শ্মশানঘাট ছিল পাক হানাদার বাহিনীর অন্যতম বধ্যভূমি। শহরের বহু তরুন ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক মানুষকে এখানে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বুলেটের খরচ বাঁচাতে বহু মানুষকে জবাই করেও হত্যা করা হয়। তারপর সেইসব লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

বারোঘরিয়া গণকবর

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বারোঘরিয়া জমিদার কাচারী বাড়ির সামনে বট গাছের কাছে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। বর্তমানে এ স্থানে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। অন্য সূত্রেও এর বর্ণনা রয়েছে – নবাবগঞ্জ সদর থানার বারোঘরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন প্রাচীন জমিদার কাচারী বাড়ির সামনের বটগাছের নিচে পাক হান্দার বাহিনী ও রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের সময় অগণিত মানুষকে হত্যা করে। নিহতদের বটগাছের পাশে গর্তে (আয়তনে প্রায় এক বিঘা) ফেলে মাটিচাপা দিত তারা। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

রহনপুর স্টেশনপাড়া বধ্যভূমি ও গণকবর

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর রেলস্টেশন পাড়ায় শত শত মানুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। এ স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। অন্যসূত্রে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গোমস্তাপুর থানার রহনপুরে পাক হানাদার বাহিনী সেনাছাউনি গড়ে তুলেছিল। এখানে তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরীহ মানুষদের ধরে এনে বন্দী করে রাখতো এবং তাঁদের রহনপুর স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় নিয়ে নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা করতো। অজ্ঞাত অসংখ্য শহীদ ঘুমিয়ে আছেন এখানকার গণকবরে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

রহনপুর এবি উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে গণকবর

রহনপুর এবি উচ্চ বিদ্যালয়ে তৎকালীন ইপিআর অস্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন সময়ে বাড়ি থেকে মানুষকে ধরে নিয়ে এসে এ স্থানে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। এর মধ্যে উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ঘাট নগর, গৌরিপুর, দরবারপুর, লক্ষীনারায়নপুর, গৌড়তলা, কাঞ্চনতলা ও নওদাপাড়ার একই দিনে ২৫০ জনকে ধরে এনে এই স্থানে হত্যা করা হয়। ২৫০ জনের মধ্যে ১৩৩ জনের নাম জানা গেছে। অন্যত্র বর্ণনা রয়েছে – চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার রহনপুর হাই স্কুলের পেছনে পুনর্ভবা নদীন তীর ছিল পাক হানাদার বাহিনীর অন্যতম বধ্যভূমি। এখানে অসংখ্য লোককে ধরে এনে তারা হত্যা করে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

গোমস্তাপুর গণকবর

গোমস্তাপুর উপজেলার থানা সংলগ্ন গণকবর ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় স্থানীয় ৩৫ জনকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে গোমস্তাপুর থানা সংলগ্ন এলাকায় হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। এখানে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নেই।

 

টিকরামপুর গ্রামের বধ্যভূমি

বিভিন্ন সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রামের মানুষকে ধরে নিয়ে এসে গোমস্তাপুরের পারবতীপুর ইউনিয়নের টিকরামপুর গ্রামের বধ্যভূমিতে হত্যা করে। স্মৃতিস্তম্ভ নেই।

 

গোমস্তাপুর উপজেলার জিনারপুর গ্রামের গণকবর

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গোমস্তাপুর উপজেলার জিনারপুর গ্রামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্টী ওঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। স্মৃতিস্তম্ভ নেই।

 

গোমস্তাপুর উপজেলার এনায়েতপুর গণকবর

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গোমস্তাপুর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামের মানুষদের এ স্থানে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। এখানে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নেই।

 

গোমস্তাপুর স্মৃতি মন্দির গণকবর

গোমস্তাপুর থানার কাছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা হিন্দুপাড়ায় ঢুকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৫/৩০ জন মানুষকে ধরে লাইনে দার করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। পরযর্তীতে ঐ পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তাঁদের স্মৃতিতে সেখানে একটি স্মৃতি মন্দির তৈরি করে।

অন্যসূত্রে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানা সংলগ্ন খালের পাড়ে গণকবর ছিল। এখানে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। এখানে সংঘটিত বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একটি দিন একাত্তরের ২৩ এপ্রিল। সেদিন দুপুর একটায় হানাদার বাহিনী থানা সংলগ্ন হিন্দু পাড়ায় অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে সমস্ত ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ৩৫ জনকে ধরে নিয়ে এখানে লাইন করে দার করিয়ে ব্রাশফায়ারে করে হত্যা করে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

 

 

 

ইপিআর ক্যাম্প বধ্যভূমি

তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্পে বর্তমানে বিজিবি ব্যাটালিয়ান সদরে মহানন্দ নদীর তীরে ইপিআর সদস্য ও অসংখ্য নিরীহ মানুষকে এ স্থানে হত্যা করা হয়। নদী ভাঙ্গনে স্থান্টি বিলীন হয়ে গেছে। তবে ব্যাটালিয়ন সদরের সামনে শহীদ ইপিআর সদস্যদের নামের তালিকা সম্বলিত একটি স্মারক স্তম্ভ রয়েছে। অন্যসূত্রে – চাঁপাইনবাবগঞ্জের তৎকালীন ইপিআর বাহিনীর ৬ নং উইং হেডকোয়ার্টারের পেছনের দিকে মহানন্দ নদীর তীরে বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। অনেক মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর লাশগুলো নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

বোয়ালিয়া গণকবর

১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পাক হানাদার বাহিনী ও তাঁদের সমর্থকরা গোমস্তাপুর থানার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের গৌরীপুর, দরবারপুর, ঘাটনগর, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, নওদাপাড়া, বৌরতলী, কাঞ্চনতলা, বঙ্গেশ্বরপুর, চকমজুমদার, নরশিয়া, পলাশবনি, সাহাপুর, আলমপুর ও বোয়ালিয়া গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে ১৫২ জন নরনারীকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের পর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে লাশগুলো পুঁতে ফেলা হয়। এতে পুরো বোয়ালিয়াটি একটি গণকবর হয়ে ওঠে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

পোড়াগ্রাম গণকবর

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের পোড়াগ্রাম ও দশরশিয়া গ্রামে দুটো গণকবর রয়েছে। ১৯৭১ সালের মধ্য নভেম্বরে পাকবাহিনী ঐ গ্রামে আক্রমণ চালায়। এ হামলায় গ্রামের দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়। পাক বাহিনীর এই আক্রমণ ছিল আকস্মিক। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

কাশিমপুর বধ্যভূমি

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাশিম্পুর ছিল পাক হানাদার বাহিনীর আরেকটি বধ্যভূমি। এখানে তারা বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য লোককে ধরে এনে হত্যা করে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

শিবগঞ্জের দোরশিয়া গ্রাম বধ্যভূমি

শিবগঞ্জ উপজেলার দোরশিয়া গ্রামের এ বধ্যভূমিতে যুদ্ধকালীন ১০ অক্টোবর ৩৮ জনকে হত্যা করা হয়। বর্তমানে নদী ভাঙ্গনের কারনে এ স্থান্টি বিলীন হয়ে গেছে। অন্য সূত্রে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ‘দোবশিয়া গ্রামে’ পাক হানাদার বাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য লোককে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

কালুপুর বধ্যভূমি

চাঁপাইনবাবগঞ্জের কালুপুর ছিল পাক হানাদার বাহিনীর আরেকটি বধ্যভূমি। এখানে তারা অসংখ্য লোককে ধরে এনে হত্যা করে। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৬৯, ২৭১-২৭৪; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৪০৮)

 

সোনা মসজিদ গণকবর

শিবগঞ্জ থানার গৌড়ের ঐতিহ্যবাহী ছোট সোনা মসজিদ ও দাখিল দরওয়াজা সীমান্তের মধ্যবর্তী স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়। তাঁদের সেখানেই গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এী গণকবরটি আবিষ্কৃত হয়। (মুক্তিযুদ্ধ সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-২৭৩)

 

বালিয়া দীঘি গণকবর

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সোনামসজিদ স্থল বন্দরের অদূরে বালিয়া দীঘি গণকবর রয়েছে। যুদ্ধকালীন বিভিন্ন সময়ে অসংখ্য মানুষকে এ স্থানে হত্যা করা হয়। এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। এছাড়া গণকবরটি সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও রয়েছে।

 

পোড়াগাঁ দশ রশিয়া, তেররশিয়া গ্রামের গণকবর

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের পোড়াগাঁ, দশ রশিয়া, তেররশিয়া গ্রামে গণকবর রয়েছে। এই গ্রাম গুলোতে প্রায় ২০০ জনকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। এ গ্রাম ৩টিতে কোন স্তম্ভ নেই।

 

শিবগঞ্জের পাকিস্তানি বাগান গণকবর

শিবগঞ্জের মহিলা কলেজের কাছে পাগলা নদীর তীরে ‘পাকিস্তানি বাগান’ নামক স্থানে ১৯৭১ সালের জুলাই-অগাস্টে অসংখ্য সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। বর্তমানে এই পাগলা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

 

ভোলাহাট উপজেলার শাহপুর গড়ের গণকবর

ভোলাহাট উপজেলার শাহপুর গড়ের গণকবরে যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে গণ মবর দেয়। এখানে কোন স্মৃতিস্তম্ভ নেই।

 

রবিউল হাসান ডলার

তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করেন: ‘মুক্তিযুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জবই এর লেখক চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ড. মাযহারুল ইসলাম তরু, জেলার প্রবীন সাংবাদিক ডি.এম. তালেবুন নবীসহ অন্যরা।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!