You dont have javascript enabled! Please enable it! 1954 | উপ নির্বাচন ৫৪ - সংগ্রামের নোটবুক
উপ নির্বাচন ৫৪
যুব উৎসব
কাগমারী সম্মেলন
শেখ মুজিবের আক্রোশ
ভাসানীর আসসালামু আলাইকুম 
আদান-প্রদানের রাজনীতি 
ভাসানীর হাঁ-না
কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন 
ভাসানীর পদত্যাগ। 
১৯৪৭ সাল হইতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের শুনা ৩৫টি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান না করিয়া গণতন্ত্রের অঙ্কুরােদগমনকালেই কুঠারাঘাত হানিয়া সর্বনাশের সূচনা করিয়া যান। তাই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি ২১ দফা ওয়াদার অন্তর্ভূক্ত করে।
 
ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াই আওয়ামী লীগ উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। উপনির্বাচন প্রাক্কালে খাদ্য সংকট নিরসনে ব্যর্থ হইয়া যুক্তফ্রন্ট মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার পদত্যাগ করিলে তদস্থলে আতাউর রহমান খান দুর্ভিক্ষাবস্থায় ক্ষমতা গ্রহণ করেন ও প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর সহায়তায় অত্যন্ত দক্ষতার সহিত খাদ্য সংকট মােকাবেলা করেন। আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার কর্তৃক সফল খাদ্য সংকট সমাধানই ১০ই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থীর বিপুল ভােটাধিক্যে জয়ের অন্যতম কারণ। সংগঠন সভাপতি মাওলানা ভাসানী ৭টি উপনির্বাচন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনােনয়নের জন্য জনমত যাচাই করিবার নিমিত্ত শেখ মুন্সির রহমান, ইয়ার মোহাম্মদ খান ও আমাকে লইয়া তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করিয়া দিয়াছিলেন। উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পণতন্ত্রের ভিত্তি সদঢ় করিবার প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং এইভাবেই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদল হিসাবে তাহাদের দেয় ২১ দফা ওয়াদার ২১তম ওয়াদাকে রক্ষা করে।
যুব উৎসব
১৯৫৭ সালের ৪ঠা হইতে ৭ই জানুয়ারী রংপুর শহরে পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ যুব উৎসব উদযাপন করে। উক্ত যুব উৎসবে পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রীসভার সদস্যবয় সর্বজনাব খরাত হোসেন, মশিউর রহমান ও মাহমুদ আলী অংশগ্রহণ করিয়া যুব সমাজের অনন্য প্রচেষ্টাকে উত্সাহদান করেন। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আমিও যুব উৎসবে যােগ দেই। বিভিন্ন এলাকা হইতে আগত অসংখ্য যুব প্রতিনিধির সমাবেশ ও প্রাণচাঞ্চল্য আমাকে অভিভূত ও আত্মহারা করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ না করিয়া পারিতেছি না যে, ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ আমাকে কারান্তরালে থাকা অবস্থায়ই ইউথ স্টার’ সম্মানে ভূষিত করিয়াছিল। এই ধরনের উৎসব যুবকদের মন ও মানসিকতার উন্নতি ঘটায়, নির্মল করে ও তাহাদের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করে। এতদ্বারা তাহাৱা নীতি ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, স্বীয় কর্মক্ষমতার প্রতি প্রত্যয় ও পরস্পরের প্রতি মমত্ববােধের শিক্ষা লাভ করে।
 
পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ১৯৫১ সালের ২৭শে ও ২৮শে মার্চ ঢাকায় দুই দিনব্যাপী অধিবেশনের মাধ্যমে গঠিত হয়। জন্মলগ্ন হইতেই পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নির্ভীক, সচ্চরিত্র, আত্মত্যাগী, আদর্শ নিষ্ঠা ও সংগ্রামী যুব সংগঠনের রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল। দলমত নির্বিশেষে যুব সমাজ পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের গণতান্ত্রিক মঞ্চে ধীরে ধীরে সংঘবদ্ধ হইতে থাকে। এইভাবেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, মুসলিম লীগ, ছাত্র। 
 
ফেডারেশন, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল, আত্মগােপনকারী কমিউনিষ্ট পার্টিও নির্দলীয় যুব কর্মীরা পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়। উপরোল্লিখিত সংগঠনগুলির যুবকৰ্মী শ্ৰণী স্ব স্ব সংগঠনের নেতৃত্বের সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী ও কোন কোন স্কুলে কায়েমী স্বার্থ প্রভাবান্বিত কার্যক্রমকে স্ব স্ব ধ্যান-ধারণা পরিপন্থী জ্ঞান করিত এবং প্রায়শঃ স্বীয় বিবেক ও নীতিজ্ঞানকে দলীয় শৃঙ্খলার যুপকাষ্ঠে বলি দিয়া দেশ ও জাতির চরম ক্ষতির কারণ হইত। উপরােক্ত কারণে যুবকৰ্মী শ্রেণী মর্মপীড়া ও বিবেক দংশনে হতােদ্যম হইয়া পড়িতেছিল ও প্রখর গণতান্ত্রিক চেতনা হারাইয়া ফেলিতেছিল। এহেন সংকটময় মুহূর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ” এক নব আশার সঞ্চার করে। ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ, পাকিস্তান মন্দুন মজলিস ও আওয়ামী লীগ প্রভাবাম্বিত গণসংগঠনের নেতারা আপােষকামিতার ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন, তদাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ২১ শে ফেব্রুয়ারী ও পরবর্তী দিনগুলিতে নির্ভীক, সগ্রামী ও সচেতন নেতৃত্ব না দিলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করিত না বরং করাচী শাসকচক্রেরই জয় সূচিত হইত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কারণেই বাঙালী মন ও মানসিকতার স্বকীয় সত্ত্বাবােধ পুরাপুরি জাগ্রত হয়। বলাই বাহুল্য যে, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে জাগ্রত এই সত্ত্বাবােধই হইল বাংলাদেশের সৃষ্টির সূচনা এবং নব জাতীয়তার মৌলিক ভিত্তি।
 
পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগকে আপামর জনসাধারণের যুব সংগঠনে পরিণত করিবার ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কারারুদ্ধ হওয়ায় অতীব দুঃখের সহিত স্বীকার করিতে হয় যে, আমার সেই স্বপ্ন সফল হয় নাই। তাহাছাড়া তদানীন্তন আত্মগােপনকারী কমিউনিষ্ট পার্টি কর্তৃক যুবলীগের উপরে তাহাদের নেতৃত্ব, কর্মসূচী ও সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দিবার অযৌক্তিক প্রবণতা ও প্রচেষ্টা সাধারণ যুৱশ্রেণীর মধ্যে তি ও সন্দেহের উদ্রেক করিয়াছিল। ফলে, ক্রমশঃ আপমির যুব সাধারণের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনে পরিণত হইবার সুযােগ ও শক্তি যুবলীগ হারাইয়া ফেলে। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে যুবলীগ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের হাতিয়ারে পরিণত হয় ও আত্মগােপনকারী কমিউনিষ্ট পার্টির নির্দেশাবলী পালনের মুখপাত্র সংগঠনে পর্যবসিত হয়। তাই কারামুক্তির পর আমি কার্যতঃ যুবলীগের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করি। কেননা, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ইহার জন্মলগ্ন হইতেই আমি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক যুব সমাজকে সংগঠিত করিবার প্রচেষ্টায় ব্রতী হইয়াছিলাম বটে কিন্তু এতদপ্রয়াসে কোন আন্তর্জাতিক শক্তির লেজুড়বৃত্তি করিবার আমি ঘাের বিদ্রোর্থী ছিলাম।
 
কাগমারী সম্মেলন
 
সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কাগমারীতে ৭ ও ৮ই ফেব্রুয়ারী (১৯৫৭) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করেন। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন ছিল বিধায় উল্লেখিত অধিবেশনটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তদুপরি এই সময়ে বৈদেশিক নীতি বিশেষ করিয়া পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পাদন ও সামরিক চুক্তি সম্পাদনসমূহ যথা ‘দক্ষিণপূর্ব এশিয়া সামরিক চুক্তি সংস্থা ও বাগদাদ চুক্তি সংস্থার সদস্যভুক্তির প্রশ্নে মাওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর মতদ্বৈততা চরম আকার ধারণ করিয়াছিল বিধায় এই অধিবেশনের বিশেষ গুরুত্ব দেখা দিয়াছিল। ইতিপূর্বে ৯ই ডিসেম্বর (১৯৫৬) সলিমুল্লাহ মুসলিম হল মিলনায়তনে এক ছাত্র সভায় প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ালা সামরিক চুক্তির স্বপক্ষে জোরালাে বক্তব্য পেশ করেন। ইহা ছিল আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তির বিরােধী ভূমিকার পরিপন্থী। সােহরাওয়ার্দীর বাগদাদ চুক্তি সমর্থনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী তীব্র প্রতিবাদ জানাইলে সােহরাওয়ার্দী াহাকে (ওসমানী) পদত্যাগের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এক সভা আহবান করা হয় এবং জনাব সােহরাওয়ার্দীর নির্দেশের পাল্টা জওয়াবে বাগদাদ চুক্তি সংস্থা হইতে সদস্যপদ প্রত্যাহার করিবার জন্য উক্ত সস্তা পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানায়। ১৩ই নভেম্বর (১৯৫৬) অনুষ্ঠিত সভায় পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি বাগদাদ চুক্তিভুক্ত শক্তিবর্গের তেহরান সম্মেলনের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালােচনা করে এবং ১৯শে জানুয়ারী (১৯৫৭) করাচী আওয়ামী লীগ সম্পাদক বি,এম,কুটী পদত্যাগ করেন। এই সমস্ত ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে সংগঠন ‘আওয়ামী লীগ কতখানি সোচ্চার ছিল। অবশ্য অকুণ্ঠচিত্তে ইহাও স্বীকার করিতেই হইবে যে, জনাব সােহরাওয়ার্দীর অনবদ্য কূটনীতির ফলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের সমর্থনে ২৪শে জানুয়ারী (১৯৫৭) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গণভােটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের আহবান জানায় এই কুটনৈতিক সাফল্যের দরুনই জনাব সােহরাওয়ার্দী দেশের অভ্যন্ডর সাধারণ মুসলমানদের সমর্থন পাইতেছিলেন।
 
নানাবিধ কারণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মী, সদস্য ও ভানুধ্যায়ীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আস্থা হারাইয়া ফেলিতেছিল। প্রথমতঃ প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত মার্কিন ঘেষা পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক জোটের লেজুড়বৃত্তি ছিল সংগঠনের সাধারণ কর্মীবৃন্দের মর্মপীড়ার কারণ । দ্বিতীয়তঃ ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত সংবিধানে ২১ দফা বর্ণিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ধারা সংযােজিত না হওয়া। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবীদার আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা সচেতন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও ছাত্র-যুব সমাজ খুবই আগ্রহের সহিত লক্ষ্য করিতেছিল। তৃতীয়তঃ ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত গঠনতন্ত্রের ৬৬ ধারা মোতাবেক শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী পদ গ্রহণ করায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের পদ ত্যাগ করা তাহরি জন্য অবশ্য পালনীয় ছিল। উক্ত ধারায় সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল যে, অন্যথায় এক মাস পরে উক্ত কর্মকর্তার পদ শূন্য বলিয়া অবশ্য গণ্য হইবে। উপরে বর্ণিত তিনটি বিষয়ই প্রধানতঃ সংগঠনের নিষ্ঠাবান কর্মীদিগকে বিচলত করিয়া তুলিয়াছিল। তদুপরি ১৯৫৬ সলের সেপ্টেম্বরে গদিতে আসীন হইবার পর হইতেই ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভােগের দুর্দমনীয় লালসায় মন্ত্রীবর্গ স্বল্প সময়ের মধ্যে সংগঠনের গঠনতন্ত্র, সিদ্ধান্ত, নীতি ও আদর্শকে বিসর্জন দিয়া আওয়ামী লীগকে স্বেচ্ছাচারী মন্ত্রীচক্রের লেজুড়ে পরিণত করিবার যে কুটিল পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহাতে কর্মী সমাজ উদ্বিগ্ন না হইয়া পারে নাই। সুতরাং কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনের ইহাই বিবেচ্য বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছিল যে, কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রীসভার নির্দেশে আওয়ামী লীগ সংগঠন পরিচালিত হইবে কি না অর্থাৎ সংগঠন ক্রমশঃ মন্ত্রী আওয়ামী লীগে পরিণত হইবে, না আওয়ামী লীগের গঠনতম সিদ্ধান্ত, নীতি ও আদর্শের প্রতি অটল আনুগত্য প্রদর্শন করিয়া মন্ত্রীসভা আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসস্তায় পরিণত হইবে।
 
শেখ মুজিবের আক্রোশ।
 
এহেন পরিস্থিতিতে ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৫৭) মওলানা আবুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সম্ভোষ মহারাজার নাটমন্দিরে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসে। মওলানা ভাসানীর বিশেষ আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী ওয়ার্কিং কমিটির এই সভায় যােগদান করেন। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা ও বাগদাদ চুক্তি সংস্থার সদস্যপদ প্রত্যাহারের দাবীতে ৭ ও ৮ই ফেব্রুয়ারীর কাউন্সিল অধিবেশনে প্রস্তাব গ্রহণ করা হইবে কি হইবে না- এই প্রশ্ন ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৩৫ ১ ভােটে কোন প্রকার প্রত্মাব আনয়ন না করিবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কেবলমাত্র আমি সামরিক চুক্তি বাতিল, সামরিক চুক্তি সংস্থা সমূহের সদস্যপদ প্রত্যাহার ও প্রয়ােজনবোেধ সংগঠনের সিদ্ধান্তের স্বার্থে মন্ত্রীসভার পদত্যাগের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণে দৃঢ়মত প্রকাশ করি এবং ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমি একা ভােট দান করি। সংবাদটি মার্কিন ঘেষা দৈনিক ইত্তেফাকের ৮ই ফেব্রুয়ারীর (১৯৫৭) সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠার ফলাও করিয়া ছাপান হয়। কাউন্সিল অধিবেশনকে লক্ষ্য করিয়া পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ ও বৈদেশিক নীতি” নামে একটি ক্ষুদ্রাকার পুস্তিকা প্রকাশ করি। তন্মধ্যে ১৯৫৩ সালের ১৪ ও ১৫ই নভেম্বর ময়মনসিংহে, ১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩শে অক্টোবর ঢাকায় ও ১৯৫৬ সালের ১৯ ও ২০শে মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সামরিক চুক্তি বিরোধী প্রস্তাবাবলী সন্নিবেশিত করি। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়র্দিী কর্তক সংগঠনে গুইত সুস্পষ্ট সিদ্ধাক্তের বিরুদ্ধাচরণ সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত ও সজাগ হইবার আহবান জানাই। অতীব পরিতাপের বিষয়, সােহরাওয়ার্দী-ভাসানী বৈঠকে মওলানা ভাসানী পররাষ্ট্র বিষয়ে সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে কোন ক্ষৰ আনয়নে বিরত থাকিবার শর্তে সমঝােতা করেন। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে মওলানা ভাসানীর দ্ব্যর্থবােধক ভূমিকাই ইহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সাধারণ কর্মী ও সমর্থকবৃন্দের নিকট উচ্চস্থানীয় নেতৃবৃন্দের লীলাখেলা অনুধাবন কষ্টকর ফলশ্রুতিতে বহু ক্ষেত্রেই তাহাদের রাজনৈতিক জীবনের ঘটে অপমৃত্যু আর দেশবাসীর হয় হাড়ির হাল। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে। ইহ্য দিবালােকের মত প্রতিভাত ছিল যে, সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তিগুলি চীন-রাশিয়া প্রভৃতি। 
 
কমিউনিষ্ট দেশগুলির বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হেফাজতের স্বার্থে নয়। কিন্তু ক্ষমতার নেশায় আত্মহারা মন্ত্রী-মেম্বারগণ সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্বকে যে কোন মূল্যে রক্ষার জন্য যেন বদ্ধপরকর ছিলেন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত প্রশ্নে ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ সম্পাদক পদ ত্যাগে অনীহা সমগ্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে সক্রিয় করিয়া তােলে। জাতীয়তাবাদী, প্রগতিশীল ও আদর্শনিষ্ঠ কর্মীর বিপুলাংশ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সদস্য। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির খুঁটার ভূমিকায় অবতীর্ণ শেখ মুজিবুর রহমানের ক্রোধ স্বাভাবিকভাবেই তাহাদের উপরে নিপতিত হয়। তাই তিনি প্রস্তাব আনয়ন করিলেন যে, কোন সদস্য আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের যুগপৎ সদস্য থাকিতে পারিবে না। মওলানা ভাসানী এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করিয়া ওজস্বিনী ভাষায় কয়েক ঘন্টা বক্তৃতা করিলেন বটে, তবে প্রস্তাব গ্রহণ হইতে প্রতিক্রিয়াশীল মন্ত্রী-সমর্থকদের বিরত করিতে পারেন নাই ।
ভাসানীর আসসালামু আলাইকুম 
৬ই ফেব্রুয়ারী ওয়ার্কিং কমিটির সভায় মওলানা সাহেব জনাব সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্ব রক্ষার প্রয়ােজনে সংগঠনের প্রতিষ্ঠিত পররাষ্ট্রনীতি বলি দিয়া সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তিনীতি গ্রহণ করিয়াছিলেন বটে, তবে পরদিন ৭ই ফেব্রুয়ারী কাউন্সিলের উদ্বােধনী অধিবেশনে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং সিয়াটো চুক্তি সংস্থা (SEATO) ও বাগদাদ চুক্তিসংস্থার বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কয়েক ঘন্টা জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। কিন্তু ফল কিছুই হয় নাই । পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ প্রসঙ্গে মস্তব্য করেন যে, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে ও সামরিক-বেসামরিক চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সংখ্যাসম্য নীতি পালিত হইলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলিবে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে। স্মর্তব্য যে, ১৯৫৫ সালের ১৭ই জুন রােজ শুক্রবার অপরাহে ঢাকার পল্টন। ময়দানের জনসভায় সভাপতির ভাষণদানকালেও মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করিয়া ঘােষণা করেন যে, শােষণ-শাসনের মনােবৃত্তি ত্যাগ না করিলে পূর্ব পাকিস্তান আসসালামু আলাইকুম” বলিতে বাধ্য হইবে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান পৃথক হইয়া যাইবে। উক্ত মক্তব্য সে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচীতে এক বিরূপ আলােড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল।
আদান-প্রদানের রাজনীতি 
‘বিষয় নির্বাচনী কমিটি সভায় সভাপতির আসন হইতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ আনিতে চাহেন যে, কাউন্সিল অধিবেশনে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত আমার প্রস্তাবটি আমি উত্থাপন করিতে চাহি কি না? তদুত্তরে আমি বলি যে, “ওয়ার্কিং কমিটি ও বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে আমার প্রস্তাবাবলীর পক্ষে দ্বিীয় কোন সদস্যের সমর্থন অর্জন করিতে ব্যর্থ হইয়াছি, অতএব নিছক শক্তি পরীক্ষার জেদের বশবর্তী হইয়া কাউন্সিল অধিবেশনে আমি আমার প্রস্তাবাবলী উথাপন করিব না। আমার এই বক্তব্যের কারণ এই ছিল যে, আমি জানিতাম, মজলুম নেতা মওলানা ভাসানীর অব্যবস্থিত চিত্ত ব্যর্থবােধক ভূমিকা ও পলায়নী মনােবৃত্তির কারণে এবং মন্ত্রীবর্গের ঐক্যবদ্ধ জোটের বিরুদ্ধে কাউন্সিল সভায় উপস্থিত সদস্যবৃন্দকে প্রস্তাবের পক্ষে প্রভাবান্বিত করিবার ব্যাপারে আমার একক প্রচেষ্টা শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইতে বাধ্য। অকপট মনে সাধারণ্যে স্বীকার করিতেই হইবে যে, আত্মগােপন অবস্থায়ও কমিউনিস্ট নেতৃবর্গ কমরেড মনি সিংহ, কমরেড খােকা রায় ও কমরেড় সালাম জাতির সংকটময় মুহূর্তে নীতি-নির্ধারণে ও নীতি-নিষ্ঠা আওয়ামী লীগ সংগঠনে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে প্রভূত সহায়তা করিয়াছে।
 
যাহা হউক, শেষ পর্যন্ত নেপথ্যে দেন-দরবার ও আদান-প্রদান রাজনীতি জয়লাভ করে এবং ভাসানী-মুজিব সমঝােতা হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানীর সংগঠন প্রশ্নে অর্থাৎ সাধারণ সম্পাদক পদে মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে বহাল রাখিবার মত গঠনতন্ত্র বিরােধী পদক্ষেপ সংগঠনের প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী অংশকে দ্বিারুণভাবে হতাশ করে। আর এইভাবেই মার্কিন কূটনীতির নিকট আওয়ামী লীগের সম্রাজ্যবাদ বিরোধী পদক্ষেপ সংগঠনের প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী সামী অংশকে নিদারুণভাবে হতাশ করে এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী রাজনীতি পরাজয় বরণ করে। বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী রণপাঁয়তারার বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালে মহাচীনে অনুষ্ঠিত শাস্তি সম্মেলনের সক্রিয় অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও এবং ১৯৫৩-৫৬ইং সামরিক চুক্তি ও সামরিক জোট বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ সত্ত্বেও কোন ক্ষমতালােভী রাজনীতিবিদ যে কিভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নীড়নকে পরিণত হইতে পারেন তাহার জ্বলন্ত উদাহরণ মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। এই বিষয়ে মন্ত্রী শেখ মুজিবকে সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ চীনের চিয়াং কাইশেক, দক্ষিণ কোরিয়ার সিং ম্যানরী, থাইল্যাণ্ডের সরিৎ থানারত ও ইরাকের নূরী আসসাঈদের মন্ত্র শিষ্য বলিলেও ভুল বলা হইবে না। ক্ষমতার রাজনীতির সীমাবদ্ধতা এইখানেই। এইখানেই নীতি, অর্শ, দর্শন সবকিছুই অপাংক্তেয় বা অবান্তর।
 
ভাসানীর হাঁ-না
 
৮ই ফেব্রুয়ারী সমাপ্ত কাউন্সিল অধিবেশনাস্তু আমি টাঙ্গাইল বড় বােনের বাড়ীতে চলিয়া যাই । সন্ধ্যার একটু পূর্বে আমি সন্তোষ (কাগমারী) আসি। দেখামাত্র শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে লােকের ভিড় হইতে এক পাশে ফুলবাগানের মধ্যে নির্জনস্থানে লইয়া একাস্তে প্রশ্ন করেন, “অলি আহাদ, পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কোন প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে কি?” আমি তদুত্তরে গীরভাবে বলি, “না”। কথা প্রসঙ্গে অত্যন্ত বিচলিত ও উদ্বিগ্ন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের জবানীতে অবগত হই যে, সংগঠনের সভাপতি মওলানা ভাসানী সাংবাদিকদের নিকট এক বিবৃতিতে ঘােষণা করিয়াছেন যে, কাউন্সিল অধিবেশন ১৯৬-এর মে অধিবেশনে হাত বৈদেশিক নীতিকে পুনরায় প্রস্তাবকারে সমর্থন দিয়াছে এবং মন্ত্রীই হউক বা পার্লামেন্ট সদস্যই হউক বা প্রাদেশিক পরিষদ সদসই হউক কেই প্রস্তাবের খেলাফ কাজ করিলে তাহার বিরুদ্ধে শাক্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার ক্ষমতাও কাউন্সিল ভঁহাকে দিয়াছে। আমার সুস্পষ্ট মনে আছে, মওলানা ভাসানী উপরােক্ত মর্মে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিয়াছেন বটে, তবে তিনি বা অন্য কেহ আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রস্তাব কাউন্সিল অধিবেশনে উত্থাপন করেন নাই। আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিতভাবে তাহার এই অসত্যের আশ্রয় গ্রহণ আমাকে বিস্মিত, বিমুঢ় ও হতবাক করিয়াছিল। বােধহয় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে স্বীয় ভূমিকার গ্লানি মওলানা ভাসানীকে দংশন করিতেছিল এবং ইহা তাহার প্রায়শ্চিত্তেরই ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। অথচ মুহূর্তের জন্য তাঁহার চেতনায় উদিত হয় নাই যে, সংবাদপত্র পাঠক হয়ত তাহার বক্তব্যকে বিশ্বাস না করলেও সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করিবে না। কিন্তু কাউন্সিল অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী ৮৯৬ জন সদস্যের পক্ষে তাঁহার দেয় এই খবর বা বিবৃতিকে সত্য মনে করিবার বাস্তব কোন হেতু নাই। ফলে, তাঁহার বিশাল ব্যক্তিত্বের মর্যাদা কি সদস্যদের নিকট ক্ষুন্ন হইবে না? সজ্ঞানে তিনি ইহা করিয়া থাকিলে দায়িত্ব তাঁহার, তবে অন্যের প্ররােচনায় করিয়া থাকিলে পরামর্শদানকারীগণ সংগঠনের অথবা দেশের যে কল্যাণকামী নহেন, তাহা দিবালােকের মত স্পষ্ট।
 
শেখ মুজিবুর রহমানের রিপাের্ট শ্রবণে আমার ইন্দ্রিয়ানুভূতি যেন লােপ পাইতেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীমহলই মওলানা ভাসানীর প্রায়শ্চিত্তানুভূতির সুযােগ গ্রহণ করিয়া সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই বৃদ্ধ নেতাকে এইভাবে অসত্যের আশ্র গ্রহণ করিতে হয়তাে প্ররােচিত করিয়াছে। কে না জানেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে ও কেন্দ্রীয় সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও শক্তিতে ভীত সন্ত্রস্ত প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা তাহার একান্ত বশংবদ শিল্পপতি সদরী ইস্পাহানীচক্র মারফত সােহরাওয়ার্দীর গণভিক্তির মূল খাটি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে দ্বিধাবিভক্ত ও শহীদ-ভাসানীর নীতিগত মত-পার্থক্যের সুযােগে তাঁহাকে তাহার রাজনৈতিক দোসর মাওলানা ভাসানী হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার প্রচেষ্টায় রত রহিয়াছেন । যাহা হউক, মজলুম নেতার নাটকীয় আচরণের আলোচনা শেষ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাবচ্ছলে আমাকে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সহিত আপােষ আলােচনার উদ্দেশ্যে তাহার সহিত করাচী যাইতে অনুরােধ জানান। আমি তাহার প্রস্তাবের উত্তর ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর দিব বলিয়া এখনকার মত বিদায় নিলাম।
চাকুরীর টোপ 
পরবর্তীকালে মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আবদুল গণি রােডস্থ সরকারী বাসভবনে আমি ও খুলনার মমিনউদ্দিন আহমদ তাহার সহিত আলােচনাকালে শেখ সাহেব আমাকে সােভিয়েট রাশিয়া বা যুক্তরাজ্যের ব্রেড কমিশনারের পদ বা পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র শিল্প করপােরেশন (East Pakistan Small Industry Corporation or EPSIC) এর চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। আমি সবিনয়ে ভঁহার প্রস্তাব গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জানাই। ইহার কয়েকদিন পর কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী নুরুর রহমান করাচী হইতে ঢাকা আগমন করেন ও আমার সহিত দেখা করিয়া প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর পক্ষ হইতে কলিকাতাস্থ ডেপুটি হাই কমিশনারের কূটনৈতিক পদ গ্রহণ করিতে অনুরােধ জানান। প্রস্তাবগুলির অন্তর্নিহিত মর্মার্থ আমার নিকট সুস্পষ্ট ছিল-রাজনীতির অঙ্গন হইতে আমাকে অপসারণ। চাকুরী গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাইলে করাচীর মন্ত্রীমহল, ঢাকার মন্ত্রীমহল ও ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক মহল আমার উপর বেজায় খাপলা হয়। শুরু হয় আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা। প্রচার চলিতে থাকে যে, আমি ভারত সরকারের এজেন্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে জড়িত। সুতরাং আমার বিচার হওয়া উচিত। তদুরে সংশ্লিষ্ট কুচক্রীমহলকে পরিষ্কার ভাষায় জানাইয়া দিয়াছিলাম যে, মুসলিম লীগের নির্যাতনে আত্মসমর্পণ করি নাই। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর ধমকও শির নত করিবার কোন কারণ দেখা দেয় নাই।
কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন 
১৯৫৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী কাগমারীতে আফ্রো-এশীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ডঃ কুদরত-ই খুদা, ডঃ এস, হেদায়েত উল্লাহ, ডঃ ওসমান গণি, ডঃ শামসুদিন আহমদ, ডঃ নুরুল হুদা, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ডঃ কাজী মােতাহার হােসেন, প্রফেসর এ,বি,এ, হালিম (ভাইস চ্যান্সেলর, করাচী বিশ্ববিদ্যালয়), ডঃ মাহমুদ হোসেন, ডঃ হাসান হাবাসী, ডঃ মমতাজ উদ্দিন আহমদ ও জনাব ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, ছারছ হইতে আগন্তু ভারতীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রফেসর হুমায়ুন কবীর, মিঃ তারা শংকর বন্দোপাধ্যায়, মিঃ। প্রবােধ সান্যাল, মিসেস রাধারাণী দেবী, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মিসেস সুফিয়া ওয়াদিয়া অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলন উপলক্ষে কায়েদে আযম’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, হকিম আজমল খান, ও আরও খ্যাতনামা ব্যক্তিদের নামে টাঙ্গাইল হইতে কাগমারী পর্যন্ত তােরণ নির্মাণ করা হয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়াদী অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি সমর্থন না করায় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে নীতিগত মতভেদ দেখা দেওয়ায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীমহল এবং ইত্তেফাকের মালিক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন ওরফে মানিক মিয়া বেসামাল ও জঘন্য ভাষায় ইত্তেফাকের পৃষ্ঠায় বিশেষতঃ তদীয় লিখিত রাজনৈতিক মঞ্চে আমাদিগকে আক্রমণ করেন।
ভাসানীর পদত্যাগ। 
কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনের পর বিভেদের মেঘ আকাশে ক্রমশঃ ঘনীভূত হইতে থাকে। আওয়ামী লীগ দ্রুত দ্বিধাবিভক্তির পথে অগ্রসর হইতে শুরু করে, একাংশ পশ্চিমা শক্তির অন্যতম দোসর প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীকে সমর্থন জানায় ও অপরাংশ সামরিক চুক্তি বিরােধী ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির প্রবক্তা বৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানীকে সমর্থন দেয়। সংগঠনের নির্ধারিত বক্তব্যের প্রতি দেশবাসী ও কর্মীবাহিনীর সজাগ দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার উদ্দেশ্যে আমি তদানীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় জনসভা ও কর্মীসভায় যােগ দিতে শুরু করি। উক্ত কর্মসূচী মােতাবেক ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত বারহাট্টা, বৈখরহাটী, নেত্রকোনাে ও আটপাড়ায় যথাক্রমে ৬, ৮, ১০ ও ১৭ই মার্চ আওয়ামী লীগ কর্মীসত্য ও জনসভায় বক্তৃতা দেই। ১৮ই মার্চ আমি কাগমারীতে (সন্তোষ) সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ করি। মওলানা ভাসানী সংগঠনের সভাপতি পদ হইতে ইস্তফা দানের সিদ্ধান্ত আমাকে জানান। তিনি আমার কোন যুক্তিই শ্রবণ করিতে রাজী হন নাই। বরং তাঁহার পদত্যাগপত্রটি দৈনিক সংবাদ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরীর নিকট পৌছাইয়া দেওয়ার জন্য আমাকে আদেশ দেন। পদত্যাগ পত্রটি নিম্নরূপঃ
 
জনাব পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী সাহেব, ঢাকা।
 
আরজ এই যে, আমার শরীর ক্রমেই খারাপ হইতেছে এবং কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এইবার খুলিতে হইবে, তদুপরি আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভার লীডার সদস্যদের নিকট আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব ২১ দফা ওয়াদা অনুযায়ী জুয়া, ঘােড়দৌড়, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি হারামী কাজ বন্ধ করিতে, সামাজিক ও ধর্মীয় বিবাহ বন্ধনের উপর ট্যাক্স ধার্য করা জনমত অনুযায়ী বাতিল করিতে আবেদন জানাইয়া ব্যর্থ হইয়াছি। ভয়াবহ খাদ্য সংকটেরও কোন প্রতিকার দেখিতেছি না। ২১ দফা দাবীর অন্যান্য দফা আহাতে অর্থব্যয় খুব কমই হইবে তাহাও কার্যকরী করিবার নমুনা না দেখিয়া আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ হইতে পদত্যাগ করিলাম। আমার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করিয়া বাধিত করিবেন।
 
इंडि স্বা-মােঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী
 
কাগমারী ১৮/৩/৫৭
 
‘মারি অরি পারি যে কৌশলে | যদিও আদেশ অনুযায়ী পদত্যাগপত্রটি দৈনিক সংবাদ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরীর নিকট পৌছাইয়া দিয়াছিলাম। তবে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকেও বিষয়টি জানাই। শেখ সাহেব আমাকে ভুল বুঝিলেন ও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইলেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলায় কর্মী ও জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে সংগঠনে গৃহীত সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি বিরােধী পররাষ্ট্রনীতি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহবান জানাইতেছিলাম। তাই মার্কিন অনুচর মন্ত্রীমহল আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী খীগ সহ-সম্পাদক ফজলুর রহমান এবং সাফরউদ্দিন শেখ মুজিবুর রহমানের প্ররােচনায় আমার বিরুদ্ধে এক দরখাস্ত তাহার নিকট দাখিল করেন। দরখাস্তে বর্ণিত অভিযােগ শেখ সাহেব ৩০শে মার্চ (১৯৫৭) পূর্বপাক আওয়ামী লীগ সদর দফতরে (৫৬ সিম্পসন রােভ) আহুত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বিবেচনার জন্য পেশ করেন। অভিযােগের জবাবে আমি শেখ সাহেবকে আওয়ামী লীগ মন্ত্ৰীমন্ডলীর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযােগ জনসমক্ষে খইতে আহবান ক্লালাই ও আওয়ামী লীগ মন্ত্ৰীমন্ডলী কর্তৃক সংগঠনের গৃহীত পররাষ্ট্র বিষয়ক ও পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবীর বরখেলাফ নীতি অনুসরণ পরিহার করিতে বলি। সকাল দশ ঘটিকার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। কোন প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করিয়াই সভা মুলতবী রাখা হয়। সন্ধ্যা আট ঘটিকায় পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে মুখ্যমন্ত্রীর কক্ষে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জনাব আবুল মনসুর আহমদের সভাপতিত্বে ওয়ার্কিং কমিটির মুলতবী সভা আরম্ভ হয়।
মজার ব্যাপার এই যে, এই সময়ে অসুস্থতা বিধায় আবুল মনসুর আহমদ দফতরে সরকারী কজি করিতে যাইতে পারিতেন না এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়ােজনে অবস্থান করিতেছিলেন, তথাপি আমাকে সংগঠন হইতে বহিস্কার করিবার জন্য কার্যকরী সংসদের সভায় যােগ দিতে বা সভাপতিত্ব করিতে কোন অসুবিধা বােধ করেন নাই। গরজ বড় বালাই। চতুর মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ পূর্বাহ্নে সমস্ত রিপাের্ট অবগত হইয়া বুঝিয়াছিলেন যে, সকাল বেলার অধিবেশনে আনীত অভিযােগ বলে আমাকে বহিষ্কার করা সম্ভব নয়। সুতরাং তিনি পিথ অবলম্বন করিলেন। দেখা গেল, ক্ষমতাসীনদের নিকট ন্যায়-অন্যায়, প্রাসঙ্গিক-অপ্রসংগিক ও বৈধ-অবৈধ কোন কিছুই বিবেচ্য নয়। পথের কাটা দূর করিতেই হইবে সুতরাং মারি অপ্তি পারি যে কৌশলে’। বলাই বাহুল্য যে, এইভাবে একপ্রকার গায়ের জোরেই আমাকে সংগঠন হইতে বরখাস্ত করা হইল। সভায় সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ আমাকে প্রশ্ন করেন, মওলানা ভাসানীর পদত্যাগপত্র সংবাদ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরীর নিকট দিলেন কেন? কাগমারীতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থার সদস্যপদ প্রত্যাহারের দাবীতে প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল কি? প্রত্যুত্তরে আমি বলিয়াছিলাম যে, উভয় প্রশ্নের সঠিক উত্তর কাগমারীতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভার সভাপতি মওলানা ভাসানীই দিতে পারেন। তঅন্য সভা মুলতবী রাখিতে হয় এবং পরবর্তী সভায় মওলানা ভাসানীর উপস্থিতি নিশ্চিত করিতে হয়। প্রশ্নোত্তরে বেকায়দায় পতিত হইলেও নব্য মার্কিনী দোসর মন্ত্রীশ্রেণীর প্রতিনিধি আবুল মনসুর আহমদ হাল ছাড়িবার পাত্র নহেন। হাল ছাড়িলে মার্কিন অনুচর মহলে মর্যাদা ক্ষুন্ন হইবে যে। তাই জওয়াব শুনিবার পর কালবিলম্ব না করিয়া সভাপতির। আসন হইতে স্বয়ং আবুল মনসুর আহমদ প্রস্তাব করিলেন যে, So “Mr Oli Ahad be suspended from the post of the Organising Secreatry”
 
অর্থাৎ অতএব “মিঃ অলি আহাদকে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ হইতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হউক।” সর্বমোট ৩৭ জন সদস্যের মধ্যে আমিসহ ৩০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলাম। ৩০ জনের মধ্যে ১৪ জন সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন এবং নিম্নলিখিত ৯ জন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন ও প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন।
 
১। ইয়ার মােহাম্মদ খান, এম,পি,এ, কোষাধ্যক্ষ, ২। আবদুল হাই, প্রচার সম্পাদক, ৩। জনাব আবদুস সামাদ, এম,পি,এ, শ্রম সম্পাদক, ৪। সেলিনা বানু, এম,পি,এ, মহিলা। সম্পাদিকা, ৫। দবিরউদ্দিন আহমদ, এম,পি,এ, সভাপতি, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগ, ৬। হাবিবুর রহমান, এম,পি,এ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ, ৭। হাতেম আলী খান, এম,পি,এ, ৮। অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহমদ, এম,পি,এ, ৯। আকবর হােসেন আখন্দ, এম,পি, সভাপতি, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ।
 
রাত ১-৩০ মিনিটে সজ্জা ভঙ্গ হওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুজ্জোহা সভাস্থলে আসিয়া ফতুল্লা ঘাটে মওলানা ভাসানীর নৌকায় অবস্থানের খবর আমাদিগকে জানান। আমরা কালবিলম্ব না করিয়া মওলানা ভাসানীর সহিত দেখা করিতে ঘাটমুখে রওয়ানা হই। মওলানা ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ ও আলােচনার পর শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দেন। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্থানের পর মওলানা ভাসানী নারায়ণগঞ্জ নগর আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ৩১শে মার্চ রোজ রবিবার জনসভা আহবান করিবার আদেশ দান করেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে মওলানা ভাসানীর মুখপানে তাকাইয়া রহিলাম। আমি তাহাকে ওয়ার্কিং কমিটির সভা পুনঃ আহবান করিতে পরামর্শ দান করি এবং ওয়ার্কিং কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রীমহলের কারসাজিকে মােকাবেলা করিবার অনুরােধ জানাই। কিন্তু গঠনতান্ত্রিক পথে সমস্যার সমাধান না করিয়া তিনি নারায়ণগঞ্জ জনসভার মাধ্যমে সাংগঠনিক অন্যায় ক্রিয়াকলাপ প্রতিরােধ করিবার মত অদ্ভুত মানসিকতার পরিচয় দিলেন। ইহার সারমর্ম হইল, সংগঠনের ঐক্যের পথ পরিহার করিয়া বিচ্ছেদের দ্বার উন্মুক্ত করা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইহাই চাহিয়াছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাহারাই জয়ী হইল। মওলানা ভাসানী সংগঠনের সভাপতি। তিনি স্বয়ং ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহবান করিয়া সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিতে পারিতেন। কি চমৎকার! বিচারক নিজেই বিচারপ্রার্থী। মওলানা ভাসানী সুস্থ নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হইলেন। চরম সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী সবসময় পলায়নী মনােবৃত্তির পরিচয় দিয়াছেন। ফলে দেশ, জাতি ও জনতা বঞ্চিত হইয়াছে তাহার সঠিক নেতৃত্বের সুফল হইতে।
শােকজ-নােটিশ
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ক্রমশঃ মন্ত্ৰীমহলের কুক্ষিগত হয়। মওলানা ভাসানী উপায়ন্তর না দেখিয়া ১৮ ও ১৯শে মে বগুড়ায় কৃষক সম্মেলন আহবান করেন এবং খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১লা জুন হইতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিবার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। তদানুযায়ী ১লা জুন হইতে ৭ই জুন অবধি “আত্মশুদ্ধির” নামে অনশনব্রত পালন করেন। মওলানা ভাসানী অনশব্রত পালনকালেই ৩রা জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আমাকে সংগঠন হইতে তিন বৎসরের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ৩০শে মার্চ ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পদত্যাগী ৯ জন সদস্যের স্কুলে নূতন ৯ জন সদস্য কো-অপট করিবার ব্যবস্থা হয়।
 
৩০শে মার্চ দিবাগত রাত্রে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গৃহীত প্রস্তাব ছিল নিম্নরূপঃ
 
“Whereas the general Secretary Sheikh Mujibur Rahman has brought certain-charges of indiscipline and disruptive activitics against Mr. Oli Ahad, Organizing Secreatary and whereas after long deliberations has come to the conclusion that a primafacie case has been made out that he has neglected to perform his duties and responsibilities as the organizing Secreatary, this committee hereby resolves that a notice to show-cause within 15 days why he will not be expelled from the organization or otherwise dealt with. The notice will be sent to Mr. Oli Ahad by registered 
 
post. In the meantime Mr. Oli Ahad will remain under suspension as the Organizing Secretary of the party with immediate effect.
 
অর্থাৎ “যেহেতু সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান জনাব অলি আহাদের বিরুদ্ধে লাভস ও বিভেদাত্মক কার্যকলাপের কতিপয় অভিযােগ আনিয়াছেন, এবং যেহেতু দীর্থ আলাপ-আলােচনার পর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল যে, জনাব অলি আহাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোেগ (কেস) নির্ণীত হইয়াছে এবং যেহেতু ইহাও নির্ণীত হইয়াছে যে, সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে তিনি স্বীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে অবহেলা করিয়াছেন; সুতরাং এই কমিটি এতদ্বারা প্রস্তাব করিতেছে যে, তাহাকে কেন সংগঠন হইতে বহিস্কার করা হইবে না। বা অন্যভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না এই মর্মে পনের দিনের মধ্যে কারণ দর্শাইবার জন্য নােটিশ দেওয়া হউক। ননাটিশটি রেজিষ্টার্ড ডাকে জনাব অলি আহাদকে পাঠাইতে হইবে। ইতিমধ্যে সাংগঠনিক পদ হইতে তাৎক্ষণিক কার্যকারিতার সহিত জনাব অলি আহাদ সাময়িকভাবে কর্মচুত থাকিবেন।”
 
ইতিপূর্বে ২১শে মে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পদত্যাগী ৯ জন সদস্যের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয় এবং ৩রা জুন ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নিম্নলিখিত সদস্যবর্গকে কো-অপট করা হয়। যথাঃ | জসিমউদ্দিন আহমদ সভাপতি, সিলেট আওয়ামী লীগ; আমজাদ হােসেন, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ; মুজিবর রহমান, সভাপতি, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ; দেওয়ান মহিউদ্দিন আহমদ, বগুড়া; রওশন আলী, সম্পাদক, যশাের জেলা আওয়ামী লীগ ও ডিস্ট্রি বাের্ড চেয়ারম্যান, শামসুল হক, ঢাকা; আজিজ আহমদ, নােয়াখালী এবং মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। ইহা ছাড়াও বৈঠকে নিম্নলিখিত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। যথা
 
আবদুল হামিদ চৌধুরী। – সাংগঠনিক সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী।
 
শ্ৰম সম্পাদক অধ্যাপক হাফেজ হাবিবুর রহমান – প্রচার সম্পাদক মিসেস মেহেরুন্নেসা খাতুন – মহিলা সম্পাদিকা
 
৫ই এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে শত অনুরােধ সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর সহিত অর্থপূর্ণ আলােচনা না হওয়া পর্যন্ত পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানান। এবং আলােচনাকালে তিনি ১৯৫৫ সালের ২৬শে এপ্রিল আইন মন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক লিখিত ও দস্তখতকৃত অঙ্গীকারপত্রের কথা “আমি এতদ্বারা ঘােষণা করিতেছি যে, আমি যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবী ও যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা কনস্টিটিউশন কনভেনশন মারফত শাসনতন্ত্রে স্বীকৃতির জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করি। যদি ইহাতে সক্ষম না হই, তবে মন্ত্রীত্ব হইতে পদত্যাগ করিব” স্মরণ করাইয়া দেন। মিনিট বুকে এই বৈঠকের বিবরণী লিপিবদ্ধ করা হয় নিম্নভাবেঃ
 
“Maulana Bhashani has informmed the working committee that he will withdraw his resignation letter after a discussion with Mr. Suhrawardy on different subject. Therefore the working committee defers decision on this matter and the meeting is adjourned. The General secretary is authorised to fix the date of the next meeting.”
 
অর্থাৎ মওলানা ভাসানী ওয়ার্কিং কমিটিকে এই মর্মে অবহিত করেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দীর সহিত বিভিন্ন বিষয়ে আলােচনার পর তিনি তাঁহার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিয়া নিবেন। সুতরাং ওয়ার্কিং কমিটি এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখে এবং সভা মূলতবী করা হয়। পরবর্তী সভার তারিখ ধার্য করিবার জন্য সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।” | সংগঠন হইতে আমার বহিষ্কার, পদত্যাপী ৯ জন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ও কর্মকর্তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ, সংগঠনের সভাপতি পদ হইতে মওলানা ভাসানীর পদত্যাগ পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, ৩১শে মে মন্ত্রীপদ হইতে শেখ মুজিবুর রহমানের পদত্যাগ ১লা জুন মওলানা ভাসানীর অনশন, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট শাসন সেপ্টেম্বর অবধি বলবৎ রাখার সিদ্ধান্ত এবং ৩রা এপ্রিল পূর্ব পাকািন প্রাদেশিক পরিষদে মুন্না, পররাষ্ট্রবিষয়াদি, দেশরক্ষাকে কেন্দ্রীয় বিষয়ভুক্ত করিয়া পূর্ণ অঞ্চিলিক স্বায়ত্তশাসন দাবীতে প্রস্তাব গ্রহণের পটভূমিকায় ১৩ ও ১৪ই জুন ঢাকায় সাকিস্তান (পিকচার প্যালেস) ও গুলিস্তান সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানী স্বীয় বক্তব্য পেশ করিবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অধিবেশন হল ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি বিরােধী ঐতিহ্য বিস্মৃত হইয়া সংগঠনের পূর্ব সিদ্ধান্ত নাকচকরতঃ জনাব সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী থাকিবার প্রয়োজনে যুদ্ধজোটে জড়িত হওয়ার পররাষ্ট্রনীতি অনুমােদন করে। কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনের পর মার্কিন মহলে প্রধানমন্ত্রী বেকায়দায় পতিত হইয়াছিলেন। তাহা হইতে উদ্ধার লাভের জন্যই আওয়ামী লীগকে স্বীয় অতীত নীতি বিসর্জন দিতে হইল। আর এইভাবেই আওয়ামী লীগ পরিণত হইল নেতাসর্বস্ব দলে। দ্বিতীয়তঃ এইবারেও এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল যে, কেহ একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীপের সদস্য হইতে পারিবে না। সর্বপরি ১৪ই জুন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী ঘােষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানকে শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হইয়াছে। মওলানা ভাসানী ও বহুসংখ্যক ভ্যাপী কর্মীর অতিকষ্টে গড়া আওয়ামী লীগে এইভাবেই নীতিজ্ঞানহীন রাজনীতির জয়যাত্রা সূচিত হইল। | পররাষ্ট্রনীতি ও স্বায়ত্তশাসন বিষয়ে মতানৈক্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে দ্বিখন্ডিত করে। কাউন্সিল সভায় মওলানা ভাসানীর নীতির পরাজয়ই চম উপসংহার নয়, যেমন কাগমারী। কাউন্সিল অধিবেশনের পর সংগঠনের সভাপতির ঘােষণায় আওয়ামী লীগ রাজনীতির শেষ কথা ছিল না । ঘড়যন্ত্রের রাজনীতির গুরু ঠাকুর ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বশংবদ প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার দাবার চালে দুই নেতাকেই পরাস্থ স্বীকার করিতে
হয়। আওয়ামী লীগ হয় দ্বিধাবিভক্ত।