You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.03 | ১৬ কার্তিক, ১৩৭৮ বুধবার, ৩ নভেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

১৬ কার্তিক, ১৩৭৮ বুধবার, ৩ নভেম্বর ১৯৭১

মুক্তিবাহিনী কিশোরগঞ্জের সাতটি থানা পাকসেনার অবস্থান থেকে এদিন মুক্ত করে বলে জানা যায়। মুক্তিবাহিনী কিশোরগঞ্জ সদর মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় পাকসেনাদের অবরোধ করে রেখেছিল। বিশ্বস্তসূত্রের খবরে জানা যায়, এদিন মুক্তিবাহিনী প্রায় ২০০ বর্গমাইল এলাকা শত্রুমুক্ত করে। বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মুজিবনগর থেকে তৎপরতা নেয়া হয়। গণপরিষদের সদস্যকে দিয়ে মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন চালু করার জন্য পূর্বাঞ্চল আঞ্চলিক কাউন্সিলের দায়িত্বে নিয়োজিত জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীকে জানানো হয়।

শ্ৰীমতী ইন্ধিরা গান্ধী এদিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সসনের সঙ্গে আলোচনার জন্য লণ্ডন থেকে ওয়াশিংটন পৌঁছান। হোয়াইট হাউজে মধ্যাহ্ন ভোজে তিনি ভারতে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। শ্রীমতী গান্ধী প্রশ্ন রাখেনঃ…“Our people cannot understand’ how those who are victims and who are bearing a burden and have restrained themselves with such fortitude should be equated with those whose action has caused the tragedy”…(KCA. p. 24993)

মুক্তিবাহিনী গেরিলাদল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউজের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৪ টি জেনারেটরের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। শান্তি কমিটির সদস্য এডভোকেট মোদাব্বির রফিকের বাসায় গেরিলা হামলা চালায়। মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইউসিবি ঢাকার পলওয়েল ও মৌচাক শাখায় মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা হামলা চালায়। চট্টগ্রাম বন্দরের গুপ্তখালি জেটিতে বাৰ্মা ইষ্টাৰ্ণের তেলবাহী জাহাজ মাহতাব জাবেদ ২নং-কে গেরিলারা ডুবিয়ে দেয়। (দৈঃ পাঃ)

পাকবাহিনী ফেণী জেলার (নোয়াখালী) প্রতিটি গ্রামে প্রবেশ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। অনেককে বন্দী করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। রাজাকারদের অত্যাচার ছিল সবচেয়ে জঘন্য। নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপর এদিন রাজাকার বাহিনী হঠাৎ আক্রমণ করে গুলী, বেয়নেট চার্জ করে। মুক্তিবাহিনীর সহায়তাকারীদের পাকবাহিনীর হাতে সোপর্দ করে। এমনিভাবে পাকবাহিনী ৪৯ জন লোককে হত্যা করে। ধর্মপুর, জোয়ার কাছাড়, মঠবাড়ীয়া, পদুয়া, মসলিমপুর গ্রামের হিন্দু জনসাধারণের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বাস্তুত্যাগী লোকদের বাড়ির আসবাবপত্র, টালি, দরজা-জানালা রাজাকাররা লুণ্ঠন করে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মুক্তিবাহিনীর অপারেশন তীব্র হলে-রাজাকাররা শহরমুখী হয়।

ওয়াশিংটন প্রেস ক্লাবে এক বিবৃতিতে অষ্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমোহন বলেন, সমগ্র পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। (বিড়ি-২ পৃঃ ১৭০)

মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক সহায়তা না করার জন্য গণচীন এদিন আবার ভারতের প্রতি হুঁশিয়ারি জানায়। (সংবাদপত্র)

পিপিপি নেতা জেড এ, ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনির্ধারিত বৈঠকের জন্য করাচী থেকে পিণ্ডিতে পৌঁছেন। (সংবাদপত্র)

টোকিওস্থ পাক দূতাবাসের দু’জন বাঙালী কর্মকর্তা সর্বজনাব এস. এম. মাসুদ ও আব্দুর রহমান পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। সুইজারল্যাণ্ডে পাক চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স ওয়ালিলুর রহমান বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ও ঐকমত্য প্রকাশ করেন।

পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন থেকে এ দিন ঘোষণা দেয়া হয় যে, ৫৩ জন সদস্য জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ বিষয়ে Keesing’s Contemporary Archives (পৃঃ ২৪৯৫৩) উল্লেখ করা হয়েছে যে, “It was announced on Nov. 3 that candidates for 53 of the vacant seats had been returned unopposed. Most of the seats went to right-wing pro-government parties. Such as the various factions of the Moslem league and the religious parties, which had reached an agreement to share the seats among themselves. The largest number (J4) was secured by the ultra-orthodox Jamaat-l-Islami; in the general elections it had virtually no popular support in East Pakistan, all its 69 candidates there being defeated.” এদিন ‘Pakistan Bars 53 Election Contests’শিরোনামে দি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ম্যালকম ব্রাউনের এক সংবাদ ছাপা হয়। (বিডি-২ পৃঃ ৬০) এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক প্রশাসনের নৈপথ্যে রাও ফরমান আলীর ভূমিকা এবং তথাকথিত উপ-নির্বাচন সম্বন্ধে পত্র-পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় যে, He (Rao Farman) is widely regarded as the man who runs East Pakistan behind a facade of civil officials. By giving thethem (six-party alliance) free seats in the East they might be able to manoeuver into forming govt that the army likes.

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিসংখ্যান সম্বন্ধে“The Guardian reported (on Nov.3) Impartial analysts credit the guerrilla organization with having expanded within seven months from zero to force of 80000to 1,00,000 a figure roughly equal to the number of regular Pakistani soldiers deployed against them.”(KCA, P.24989)

টাঙ্গাইল কাদেরিয়া মুক্তিবাহিনীর বিশেষ প্রতিনিধি আনোয়ারুল আলম শহীদ (ছাত্রলীগ নেতা) মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের অগ্রগতি ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কামরুজ্জামান টাঙ্গাইলের জন্য সাহায্য সহযোগিতার সম্পূর্ণ আশ্বাস দেন। উল্লেখ্য, বিডি এম এস এস থেকে কয়েকট্রাক কম্বল ও আনুষঙ্গিক সামগ্ৰী তুরা সীমান্তে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নেন ছাত্রলীগ নেতা সুধীর হাজরা। শাহ মোয়াজ্জেম এম পি–এর নির্দেশেই সুধীর হাজরা এ দায়িত্ব গ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনী গড়ে ওঠার উপর সাংবাদিক মানকেকার (Mankekar) লিখেছেনঃ “Brigadier”Qadir Siddiqui, the 23 year old, charismatic leader of a group of guerillas he himself raised and led in the Tangail district, is a typical example, he gatheredround him sorne 16,000 young men….and played havoc with the enemy’s communications.Ambushed their columns and Convoys and blew lip their ammunition dumps. This a was the handiwork of the Qadir Bahini. named after its leader Qadir Siddiqui.” (PCS. P-138) সোভিয়েত পত্রিকা ‘প্রাভদায়”এ দিন সরকারের অভিমত প্রকাশিত হয়ঃ “পূর্ব পাকিস্তানী সমস্যার রাজনৈতিক মীমাংসার ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান জটিলতা দূর করা যেতে পারে। সামরিক প্রশাসনের উচিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের গৃহে প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজনীয় অবস্থা সৃষ্টির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই রকম একটা সমাধানই সর্বোপরি খোদ পাকিস্তানের স্বার্থসম্মত এবং উপমহাদেশে শান্তি রক্ষার আদর্শসম্মত হবে।”

ঢাকা থেকে “দি ডেইলি টেলিগ্রাম”—এর বিশেষ সংবাদদাতা কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, ৪০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের জন্য গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। শহর অঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা দৈনিক কমপক্ষে ২০ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে হতাহত করছে। জনসমর্থনপুষ্ট গেরিলা যোদ্ধারা তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে ক্রমেই অধিকতর সচেতন হচ্ছে। উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম শহরে দুপুরবেলা উভয় পক্ষের মধ্যে গুলী বিনিয়ের ফলে দুজন পাকিস্তানী সৈন্য, একজন পুলিশম্যান ও একজন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। প্রত্যেক রাত্রে পুরনো ঢাকায় দীর্ঘক্ষণ যাবৎ গুলী বিনিময় এবং ৩/৪ টি বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা যায়। জনৈক পাকিস্তানী সামরিক অফিসার সংবাদদাতাকে বলেন, গত দুমাস যাবৎ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন ক্ৰমাগত বৃদ্ধি পেয়ে জোয়ারের পানির মত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। (“দি ডেইলি টেলিগ্রাফ” ৩ নভেম্বর)

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী