২৩ কার্তিক, ১৩৭৮ বুধবার, ১০ নভেম্বর, ১৯৭১
বগুড়া শহর মুক্ত করতে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক তৎপরতা চালায়। এদিন গভীর রাতে শহরের উপকণ্ঠে বাবুর পুকুরে একজন মহিলাসহ ১৪ জন নিরীহ লোককে দাঁড় করিয়ে পাকহানাদার বাহিনী গুলী করে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডে পাকবাহিনীর দালাল আনিসুর রহমান সহযোগিতা করে। এদিন যারা শহীদ হলেন, তাঁরা হলেন, সহোদর মান্নান ও হান্নান, বাচ্চু, টুকু, জামাল, ভোলা, মন্টু, সাইফুল, আলতাফ, আবুল, ফজলু, বাদশাহ, নূরজাহান এবং অজ্ঞাত অপর এক ব্যক্তি।
দিনাজপুর সীমান্তের জাবর ক্যাম্প থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিন কসরানী গঞ্জে তার পিতা-মাতার খোঁজে আসে। ঠাকুরগাঁয়ের খান সেনা ও রাজাকারদের দল সালাহউদ্দিনের বাড়ি ঘেরাও করে তাঁকে ধরে ফেলে এবং নির্যাতন করে। পরে খান সেনাদের পোষা চিতা বাঘের খাচায় সালাহউদ্দিনকে ফেলে দেয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাহ উদ্দিন শহীদ হন। উল্লেখ্য, বীরগঞ্জ (দিনাজপুর) মুক্তিযুদ্ধে যারা মহান ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের মধ্যে উলক চন্দ্র সরকার, কবিরুল ইসলাম, কৃষ্ণকান্ত রায়, ধনঞ্জয় রায়, আব্দুল লতিফ, মুজিবুর রহমান ও শহীদ বুধারু বর্মণের (বীরগঞ্জ) নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী প্যারিস থেকে বনে (পশ্চিম জার্মানী) চারদিনে (১০-১৩ নভেম্বর) সরকারী সফরে গিয়ে পৌঁছান। তিনি পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলর ব্রান্টটের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন। উল্লেখ্য, শ্ৰীমতী গান্ধী ২৪ অক্টোবর বেলজিয়াম, ২৬ অক্টোবর ভিয়েনা, ২৯-৩১ অক্টোবর লন্ডন, নভেম্বর ১ অক্সফোর্ড, ৪-৫ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র, ৭-৯ নভেম্বর প্যারিস, এবং শেষ পানে জাৰ্মান সফর করেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকা ‘ডন’ এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পোৎপাদিত পণ্য জমে ওঠেছে। ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়া হচ্ছে না। দেশে চরম আর্থিক অনাচার ও সংকট বিরাজ করছে।
এদিন ১ নং সেক্টরের সলিয়া দিঘীতে পাকসেনাদের ওপর মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে। পাক সেনারা ট্যাঙ্ক সজ্জিত হয়ে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের পাল্টা হামলা চালায়। বহু মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। মিত্রবাহিনীর একজন নায়েক নিহত হয়। উল্লেখ্য, পাকসেনারা বেলোনিয়া থেকে রেজুমিয়া সেতু পর্যন্ত মাইন ফিল্ড প্রস্তুত করেছিল ফলে মুক্তিবাহিনীর চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।
মুক্তিযোদ্ধার বিশেষ গেরিলাদল এদিন নারায়ণগঞ্জ জে এম সি’র একটি পাটের গুদাম ভস্মীভূত করে। ঢাকা আজিমপুর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে এবং হলিক্রস কলেজে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। (সংগ্রহ)
এক নম্বর সেক্টরে বেলুনিয়ায় অবস্থানরত দুটি পাকিস্তানী ব্যাটেলিয়ানের বিরুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর অভিযানকে সফল করার জন্য এক বিগ্রেড ভারতীয় সৈন্য এই সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করে। (মূলধারা’ ৭১ পৃঃ ১৬৬)
মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদল পাকসেনাবাহিনীর ট্রেনের ওপর কুড়িগ্রামের কাছে আক্রমণ চালায়। একজন অফিসারসহ আটজন পাকসেনা নিহত হয়।
সিরাজগঞ্জের বারইতলা গ্রামে পাকবাহিনী নারী-পুরুষ ও শিশু মিলে ২ শত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। রাজাকার ও দালালদের অত্যাচারে এলাকাটিতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। অসহায় মানুষের আহাজারী এসব ধর্ম ব্যবসায়ীদের স্পর্শ করেনি।
চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর পাঞ্জাবী লাইন, ওয়ারলেস কলোনী, বাহাদুর শাহ কলোনীর নারী-পুরুষ শিশুকে জল্লাদ বাহিনী ধারাল অস্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে সকাল থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত গণহত্যা চালায়। শত শত নারী-শিশুর খন্ডিত মৃত দেহগুলি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। ওয়ারলেস কলোনীতে হাজার হাজার নারী-পুরুষের লাশ পড়ে থাকে। কোথাও পুঞ্জীভূত পেট্রোলপোড়া বিকৃত খন্ডিত শব। পাহাড়ের উপরে অনেক যুবতী ও নারীদেহ ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় পড়েছিল। পাহাড়তলীতে বাঙ্গালী মা বোনদের উপর বিহারী ও পাকবাহিনী যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় দুনিয়ার স্বাধীনতার ইতিহাসে তা বিরল। (বাঃ স্বঃ যুঃ ৮ খন্ড পৃঃ ৩৫৫)
পবিত্র রমযান মাসের আজ ২০ দিন। মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী ও পিডিপি’র। দালালদের কাছে পাহাড়তলীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা বলে সাহায্য চেয়েছেন রেলওয়ের হিসাবরক্ষক জনাব সামসুল হক। কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ীদের মনের ইতরবিশেষ পরিবর্তন হয়নি। মানবতার এতবড় অপমান স্ৰষ্টা সইবে কী। (৮ খঃ পূঃ ৩৫৫)
বিকেলে গেরিলারা ঢাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে কেন্দ্রে বিপুল ক্ষতিসাধন করে। গেরিলাদের হামলার ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ বিঘ্নিত হয়। ফলে, পুরনো শহরসহ টাকার অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে। সারারাত নগরীর দুই-তৃতীয়াংশ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। গ্রীন রোডে পাকিস্তানের প্রকৌশলী ভবনে গেরিলা হামলায় দু’জন প্রকৌশলী জিয়াউর রহমান, নাসিরউদ্দিন নিহত হয়।
গভীর রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা সাদা পোশাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে প্রবেশ করে ছাত্রী ও শিক্ষয়ত্রীদের রুমে পাইকারী লুণ্ঠন চালায়। এ সময় হলের সামনের রাস্তায় সামরিক ভ্যান ও জীপ টহলরত ছিল। ভাইস-চ্যান্সেলর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি।
রক্তক্ষয়ী আটগ্রাম যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১০ নভেম্বর। লেঃ জহির (বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত মেজর ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত) দুই কোম্পানি সৈন্যসহ সুরমা নদী অতিক্রম করে শত্রুর ঘাঁটির সামনে আটগ্রাম ও দর্পণ নগরে অবস্থান নেয়। লেঃ গিয়াসকে (মেজর হিসেবে ১৯৮১ সালের ৩০ চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যার অভ্যুত্থানে অংশ নেয়ার অভিযোগে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত) এক কোম্পানি সৈন্যসহ আটগাম, জাকিগঞ্জ সড়ক মুক্ত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন রব এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে পোটাগ্রামে অবস্থান নেন। চারগ্রামে পাকিস্তানী এক কোম্পানি সৈন্য ও একটি রাজাকার কোম্পানি ছিল। ৯ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী অগ্রাভিযান শুরু করে। ক্যাপ্টেন রব পোটাগ্রাম দখল করে রাস্তার দু’পাশে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। লেঃ জহির ও লেঃ গিয়াস পাকবাহিনীর পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করেন। এই যুদ্ধে ৪০ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১২ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। (বিচিত্রা ২৬/৩/৯০) উল্লেখ্য, ৪ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের পরিকল্পনা অনুসারে এসব অপারেশন হয়।
প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকসমূহ পর্যালোচনার জন্য জামাতে ইসলামীর নেতা ও তাবেদার মন্ত্রিপরিষদের শিক্ষামন্ত্রী আব্বাস আলী খান ২০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিলেন, মন্ত্রিপরিষদ এই রিপোর্ট অনুমোদন করে নভেম্বর ৮। ইত্তেফাক (নভেঃ ১০) লিখেছে, এই রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী আগামী শিক্ষাবর্ষ হইতে কিছুসংখ্যক পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করা হবে এবং বাদবাকি বইগুলি ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি এবং পাকিস্তানের আদর্শগত ভিত্তি তুলিয়া ধরার জন্য ঢালিয়া সাজানো হইবে।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী