২৫ কার্তিক, ১৩৭৮ শুক্রবার, ১২ নভেম্বর ১৯৭১
মুক্তিবাহিনীর নৌ সেনারা এদিন দু’টি নৌযান ডুবিয়ে দেয়। জাতিসংঘের মার্কিং নিয়ে ছিল একটি জাহাজ। অপরটি পাকিস্তানের। ভয়েজ অব আমেরিকা জানায়, মুক্তিবাহিনী ব্রিটিশ ফ্ৰীটার সিটি অব সেন্ট আলবান জাহাজটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরে কলকাতা পোতাশ্রয়ে নিয়ে যায়। উল্লেখ্য, মুক্তিবাহিনী ৪০০০ টনের পাকিস্তানী বাণিজ্য জাহাজ ‘শের আফগান’কে গত ২৭ অক্টোবর ফুলছড়ি ঘাটে ডুবিয়ে দেয়।
পাকবাহিনী ছাগলনাইয়া, নাোয়াখালী জেলার বল্লভপুরের হাইস্কুলে ২৬ মার্চ থেকে অত্যাচার অব্যাহত রাখে। নারী নির্যাতন ছিল দৈনন্দিন ব্যাপার। হাইস্কুলের চারপাশে ২৫ পরিখায় ১৫০ জন গ্রামবাসীকে পাকসেনারা মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করে। এদিন মুক্তিবাহিনী বান্দরকাটা শত্ৰু মুক্ত করে।
পশ্চিম বাংলার সল্টলেকে শরণার্থী শিবিরে আয়োজিত বিরাট জনসভায় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার সম্পাদিকা মিসেস বদরুন্নেসা আহমেদ, আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রবীণ সদস্য শ্ৰী ফণী ভূষণ মজুমদার, আওয়ামী লীগ সমাজসেবা সম্পাদক জনাব কে এম ওবায়দুর রহমান, জনাব আমিরুল ইসলাম বার-এটল দৃঢ়তার সাথে ঘঘাষণা করেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় অবধারিত এবং শরণার্থীরা ভবিষ্যতে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন। নেতৃবৃন্দ বলেন যে, যতদিন বাঙালী জাতি থাকবে-সভ্যতা থাকবে, ইতিহাস থাকবে, ততদিন বাংলাদেশ-ভারত মৈত্ৰী অটুট থাকবে। কেননা, ভারতবাসী বাংলাদেশের জন্য যা করছেন, তারা কোনদিন ভুলতে পারবে না। বাঙালী অকৃতজ্ঞের জাত নয়। সভায় জনাব মোহাম্মদ শাহ বাঙালী স্বরচিত গান পরিবেশন করেন। (জয় বাংলা ২৮ শ সংখ্যা পৃঃ৭)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে তাদের ৬টি জাহাজ মুক্তিবাহিনী কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত ও ডুবিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে (বাঃ বাঃ)। উল্লেখ্য, ১৬ আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত সময়ে মুক্তিবাহিনী প্রায় ২১টি পাকিস্তানী ও বিদেশী জাহাজ বিনষ্ট করে ও ডুবিয়ে দেয়।
পাকসেনারা সিলেটের কুলাউড়া, গোপালগঞ্জ এলাকায় বেশ কয়টি রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলে। এসব কেন্দ্র খুদিরামনগর ও বড়লেখায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অতিরিক্ত। উল্লেখ্য, এ সময়ে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। গত সপ্তাহে একজন আমেরিকান মিশনারী ও দুজন পশ্চিম জার্মানের কনস্যুলার অফিসার ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় নিহত হয়।
ফরাসী প্রেসিডেন্ট জর্জেস পম্পিদু ও পশ্চিম জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে জরুরী পত্র পাঠান।
মুক্তিবাহিনী একযােগে পাবর্ত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর ও কুমিল্লা সেক্টরে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা চালায়।
বনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে যদি বাঙালীদের কোন উপকারে আসে তাহলে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি বিবেচনা করবে। তিনি স্বীকার করেন যে, পশ্চিম বাংলার জনমতের চাপে মুক্তিবাহিনীকে সামান্য সাহায্য দেয়া হচ্ছে। (কেসিএ, পৃঃ ২৪৯৯৩) তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে আরো বলেন, পূর্ববঙ্গে উদ্ভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং লক্ষ লক্ষ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্ৰীষ্টান শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যেতে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি বিপদজনক বলে বিবেচিত হতে থাকবে। (সংবাদপত্র)
ঢাকা থেকে “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ” এর বিশেষ সংবাদদাতা মিস ব্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, রাজধানীর প্রধান পোস্ট অফিসের নিকট একটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণের ফলে ৩ জন নিহত, ২১ জন আহত এবং ৫ খানি মোটরগাড়ি বিধ্বস্ত হয়। বোমা বিস্ফোরণের পর নগরীর দোকানপাট ও অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে যায়। সংবাদে আরও বলা হয়, গত মার্চ মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত পুলিশ বাহিনীর ছ’হাজার সদস্যদের মধ্যে অবসাদের লক্ষণ স্পষ্ট। সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি পালন না করার জন্য হিংস্র মনোভাব প্রকাশ করে তারা অবিলম্বে ফিরে যাওয়ার তারিখ ঘোষণার দাবী জানিয়েছে। (দি ডেইলি টেলিগ্রাফ ১২ নভেম্বর)
লন্ডনে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমান্ডোর জুনেজোর নেতৃত্বে পাকিস্তানের সামরিক সরকার উৎখাত করার জন্য যৌথ কমিটি গঠন করা হয়। উল্লেখ্য, রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর সংবাদদাতা প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, জনৈক অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শালসহ লাহোরের ৪ জন নাগরিক এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী করেছেন। (“দি ইকোনমিস্ট” নভেঃ ১৩)
করাচিতে পিপিপি নেতা জেড. এ. ভুট্টোর জীবননাশের চেষ্টা ব্যর্থ হয় বলে এক সংবাদ প্রকাশিত হয়। করাচীতে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবী জানিয়ে বক্তব্য রাখা হয় বলে জানা যায়।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী