২১ কার্তিক, ১৩৭৮ সোমবার, ৮ নভেম্বর ১৯৭১
মুক্তিবাহিনীর নৌ গেরিলাদল চাঁদপুরের অদূরে ‘American Freighter Loren’নৌযান ডুবিয়ে দেয়। এই নৌযানে বহু অস্ত্রশস্ত্র চাঁদপুরে খালাস করার জন্য যাচ্ছিল।
শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী প্যারিসে এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি ভারতপাকিস্তান সমস্যা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনা করতে প্রস্তুত। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার সমস্যা নয়। এটা হলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে বাঙ্গালীদের সমস্যা।“ It is perhaps inevitable today that Bangladesh should become independent, she added, “but I do not think that East Bangal would wish to be associated with West Bangal as the latter is industrialized and would be the dominant Partner.” (KCA, P 24993)
মুক্তিবাহিনী গেরিলাদল নবীগঞ্জ (ঢাকা) বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে।
জামাতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্র সংঘের’ সভাপতি এদিন বায়তুল মোকাররমের বদর দিবসের গণজামায়েতে ৪ দফা ঘোষণা করে। ৪ দফা হলো (১) দুনিয়ার বুকে হিন্দুস্থানের কোন মানচিত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ার বুক থেকে হিন্দুস্থানের নাম মুছে না দেওয়া যাবে ততদিন পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম নেব না। (২) আগামীকাল থেকে হিন্দু লেখকদের কোন বই অথবা হিন্দুদের দালালী করে লেখা পুস্তকাদি লাইব্রেরীতে স্থান দিতে পারবে না বা বিক্রি বা প্রচার করতে পারবে না। যদি কেউ করে তবে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিশ্বাসে স্বেচ্ছাসেবকরা তা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে। (৩) পাকিস্তান বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পর্কে বিরূপ প্রচারকারীদের হুঁশিয়ার করে দেন। (৪) এই ঘোষণা বাস্তবায়িত করার জন্যে শির উঁচু করে বুকে কোরআন নিয়ে মর্দে মুজাহিদের মতো এগিয়ে চলুন। প্রয়োজন হলে নয়াদিল্লী পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আমরা বৃহত্তর পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করবো। ইসলামী ছাত্র সংঘের মীর কাশেম আলী, মোহাম্মদ শামসুল হক একই ভাবালোকে বক্তব্য রাখে। বদর দিবসের সভা শেষে মিছিলের শ্লোগান ছিলঃ ‘বীর মুজাহিদ অস্ত্র ধর, ভারতকে খতম কর’, ‘মুজাহিদ এগিয়ে চল, কলিকাতা দখল কর’, ‘আমাদের রক্তে পাকিস্তান টিকবে’ ইত্যাদি (দৈঃ পাকঃ)। উল্লেখ্য, এ ধরনের উসানিমূলক বক্তব্যের কারণে ঢাকার (পাটুয়াটুলি) ঐতিহ্যবাহী শত বছরের পুরাতন রামমোহন লাইব্রেরীর অমূল্য গ্রন্থাদি লুট হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ব্রাহ্ম সমাজের উদ্বোধন করেছিলেন।
এক নম্বর সেক্টরের সৈন্য, ২নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সৈন্য এবং মিত্র বাহিনীর ২য় রাজপুত ও ৩য় ডোগরা ২টি কোম্পানি সম্মিলিতভাবে পরশুরামে আক্রমণ চালিয়ে পরশুরাম পাকহানাদার মুক্ত করে।
সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের সদস্য জনাব এ. এফ. এম. আব্দুল হকের শিক্ষা সংস্কার কমিটির রিপোর্টে প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যক্রমে ইসলামী মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তনের সুপারিশ গ্রহণ করে। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, সকল শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক ন্যাশনাল একাডেমী অব পাকিস্তান এ্যাফেয়ার্স কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।
নিউজ উইক ম্যাগাজিনের সাংবাদিকের সঙ্গে ইয়াহিয়া খান এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাকে অনেকেই বিশ্বাস নাও করতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয়, যদি তিনি (শেখ মুজিব) পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যান, তবে তার নিজের জনগণই তাকে হত্যা করবে। তারা তাঁকেই (শেখ মুজিব) তাদের দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী করেছে।’ ইয়াহিয়া খান আরো বলেন, ভারত যদি বাংলাদেশের ধোঁয়া তুলে পূর্ব পাকিস্তান দখলের চেষ্টা করে তা হলে যুদ্ধ বাঁধবেই। সে যুদ্ধ শুধু পূর্বাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।”
পাক সামরিক সরকার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ক’জন বাঙ্গালী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আনুগত্য ঘোষণার কারণে চাকুরি থেকে বহিষ্কার করেন। এরা হলেন, সৰ্বজনাব এম এ রশীদ (যুগ্ম সচিব), আব্দুস সাত্তার (পরিকল্পনা বিভাগ), নয়াদিল্লী সহ প্রেস এ্যাটাশে আমজাদুল হক, কলকাতা মিশনের সহ প্রেস এ্যাটাশে মাকসুদ আলী প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে Time Magazine (Dec. 6) লিখেছেঃ Awami League Leaders who escaped to India promptly set up the Bangladesh government in Exile with headquarters in Calcutta, and some 130 Bengali diplomats subsequently defected from Pakistani Missions around the world. The rebels immediately began raising and training a guerrilla force that, by some estimates, now numbers 1,00,000 men.” (pp2)
৮ নভেম্বর রাজশাহী আল বদর প্রধান আব্দুল হাই ফারুকীর সভাপতিত্বে স্থানীয় ভূবন মোহন পার্কে আল বদর বাহিনীর বেসামরিক বিভাগের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় ভাষণ প্রসঙ্গে মুসলিম লীগ নেতা আয়েনুদ্দিন বদর যুদ্ধের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান বিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানায়। সভাপতির ভাষণে আল বদর কম্যান্ডার আব্দুল হাই ফারুকী জনগণকে পাকিস্তান ও ইসলামের দুশমনদের নির্মূল করার কাজে আল বদর বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য আহ্বান জানায়। রাজশাহীর এই আল বদররা কি করেছে, তার সামান্য বিবরণ ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত ‘রাজশাহীর সেই ভয়ঙ্কর বধ্যভূমিটি কোথায়’শিরোনামের প্রতিবেদনটি দেখা যেতে পারে।
মিঃ ভুট্টোর চীন সফর সম্পর্কে ‘দি টাইমস’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, “পিকিং ছাড়া আর কোন রাজধানীতে কূটনৈতিক আলোচনার জন্য পাকিস্তান সরকার প্রতিনিধি পাঠায়নি বলে তাদের বক্তব্য দুর্বল বলে সহজেই বুঝা যায়। ভুট্টো তার “ব্ৰীফকেস”-এ সরকারী বিবৃতির কপি না নিয়ে পিকিং ত্যাগ করার ফলে মনে হয় চীন এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানকে সরাসরি সাহায্য দান সম্পর্কে মনস্থির করেনি। মিসেস গান্ধী তার বর্তমান সফরকালে সহানুভূতি লাভ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার ব্যাপারে কোন আশ্বাস পাননি। ভুট্টোর চীন সফর সম্পর্কিত সংবাদ তাঁকে স্বস্তিদান করবে বলে সম্পাদকীয় মন্তব্যে উল্লেখ করা হয়। (দি টাইমস ৮ নভেম্বর)
ফেণী ঘাঁটি থেকে পাকসেনারা ভারতীয় এলাকার উপর এদিন প্রচন্ড গোলাগুলি চালানো শুরু করে। পাঁচ-ছয়দিন এভাবে গোলা বিনিময় হয়। ৮ নভেম্বর ভারতীয় বাহিনী এগিয়ে গিয়ে ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী পাক ঘাঁটি গুলিতে জোর আঘাত হানল। পাকিস্তানীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলি ছেড়ে তাদের পালাতে হল। এই অ্যাকশনের দুটো প্রত্যক্ষ ফল হল। প্রথমত, ত্রিপুরার বিভিন্ন এলাকার উপর কামানের গোলাবর্ষণের ততটা ক্ষমতা আর পাকিস্তানীদের থাকল না। দ্বিতীয়ত, মুক্তিবাহিনী আরও জোরে পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ করার সুযোগ পেল। কারণ, পাকবাহিনী তখন শক্ত ঘাঁটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে (১০ খঃ পূঃ ৭৭৫)
পাকবাহিনী অক্টোবরের শেষ থেকে পশ্চিম প্রান্তে সবচেয়ে বেশি গোলাগুলী বিনিময় হয়-বালুর ঘাট (পঃ দিনাজপুর), গেঁদে (কৃষ্ণনগর) এবং বয়রা (বনগাঁ)। প্রতিদিনই পাকবাহিনী এই অঞ্চলে হানা দিচ্ছিল। পাকিস্তানী সেনারা বাংকারের সাহায্যে দূরপাল্লার কামান ব্যবহার করেছিল। বয়রা অঞ্চলে সীমান্ত হল কপোতাক্ষ নদ। বয়রা থেকে একেবারে সোজা মাইল বারো তেরোর মধ্যেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট। এদিন ভারতীয় সেনাবাহিনী কপোতাক্ষের পশ্চিমপাড়ে জড় হতেই যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকসেনাবাহিনীও তৎপর হয়ে ওঠে। (১০ খৃঃ পূঃ ৭৭৫)
ফরাসী প্রেসিডেন্ট কর্তৃক তাঁর সম্মানার্থে আয়োজিত এক মধ্যাহ্নভোজ সভায় মিসেস গান্ধী বলেন, পূর্ব বংগে যা ঘটেছে তাকে গৃহযুদ্ধ না বলে গণহত্যা বলা উচিত। শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটদানের অপরাধে লক্ষ লক্ষ লোককে গণহত্যার মাধমে শাস্তিদান করা হচ্ছে। ৮ নভেম্বর সকাল বেলা এক বেতার সাক্ষাৎকারে মিসেস গান্ধী বলেন, পূর্ব বংগের জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য না হলে কোন সমাধানই গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিবেচিত হবে। তিনি আরও বলেন, পূর্ব বংগ সমস্যা সম্পর্কে আলোচনায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যোগদান অবশ্য প্রয়োজন। (“দি গাডিয়ান” “দি টাইমস” ও “দি ডেইলি টেলিগ্রাফ”৯ নভেম্বর এবং “ইন্ডিয়া নিউজ”১৩ নভেম্বর স্বঃ সং প্রঃ বাঃ)
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী