২৪ কার্তিক, ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর ১৯৭১
যশোর, রংপুর, সিলেট ও চট্টগ্রামে পাক-বাহিনীর অবস্থানগুলোর ওপর মুক্তিবাহিনীর চাপ জোরদার করা হয়।
ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্ৰী ভিভি গিরি উড়িষ্যার বহরমপুরের এক সমাবেশে পাকিস্তানের যুদ্ধের পয়তারা সম্পর্কে বলেন, আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে তা একতা এবং দৃঢ় সংকল্পের শক্তিতে ভারতের জনগণ তা জয় করতে সক্ষম হবে। (জয় বাংলা ২য় সংখ্যা)
পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সফর উপলক্ষে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তিনি শরণার্থীদের সাহায্যে DM ৫ কোটি (ডলার ১শ ৪০ কোটি) দানের ঘোষণা দেন। (DM 50,000.000 = 14,000.000 official rate) (KCA pp. 24993) ছয় নম্বর অঞ্চলসমূহে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে থাকলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩১ কোরের অধিনায়ক লেঃ জেনারেল থাপ্পা। মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার এম কে বাশার এবং সাব সেক্টর কমান্ডার এবং এফ এফ কমান্ডারবৃন্দ। ভুরুঙ্গামারীর পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আক্রমণ শুরু হল। ভারতীয় বিমান বাহিনী এ যুদ্ধে অংশ নেয়। ফলে, পাটেশ্বরীতে পাকবাহিনীর বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হলো।
কুমিল্লার বেতিয়ারা গ্রামে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে নিজাম উদ্দিন আজাদ, সিরাজুল মুনির, আওলাদ, বশীর, শহীদুল্লাহ, দুদুমিয়া, শফিউল্লাহ, কাইয়ুম ও কাদের এই ন’জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কুমিল্লায় একসাথে এতজন মুক্তিযোদ্ধা আর কোথাও শহীদ হননি। উল্লেখ্য, এ সব মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন বামপন্থী (কম্যুনিস্ট পার্টি) সক্রিয় সদস্য।
ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সম্পর্কে শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অনমনীয় মনোভাব থেকে বুঝা যায়, উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার স্পষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। (“দি গার্ডিয়ান”)
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ অথবা সাহায্য করার অভিযোগ আটক ব্যক্তিদের বিচারের জন্য বিশেষ আদালত গঠনের নির্দেশ। ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেশের সকল বেসামরিক এলাকায় টেঞ্চ খননের নির্দেশ। দিনাজপুর, ফেণী, রংপুর সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর আক্ৰমণ।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও পশ্চিম জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের মধ্যে বনে আলোচনা বৈঠক ২য়। বৈঠক শেষে মিসেস গান্ধী সাংবাদিকদের বলেন, ভারত পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের নিজের পছন্দমত একটি রাজনৈতিক সমাধান আশা করে।
এদিন দুপুরে বায়তুল মোকাররম বিপণী কেন্দ্রে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে ৬ জন রাজাকার নিহত ৫৫ জন আহত। ঘটনাস্থল থেকে একজন গেরিলা গ্রেফতার। লক্ষ্মীবাজার সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে বোমা বিস্ফোরণ। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে হামলাকালে গুলী বিনিময়, চারজন গেরিলা আটক।
১নং সেক্টর কমান্ডারের নিয়ন্ত্রণাধীন বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৪ নভেম্বর থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করে আজ বেলুনিয়ায় শত্ৰুব্যূহ ভেদ করে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। বেশ কিছু পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয়। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক লিখেছেনঃ যুদ্ধবন্দীদের কাছ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দু’ভাগের কথা আমরা জানতে পারি। সর্বত্রই শত্ৰু সৈন্যদের একটা সাধারণ অভিযোগ ছিল যে, অফিসাররা তাদের সাথে ফ্রন্ট লাইনে থাকতো না। শুধু গোলাগুলি ছাড়া অন্য সব কিছুরই অভাব ছিল। তাদের তিক্ত অভিযোগঃ ‘এমনকি খাদ্যের জন্যও আমাদেরই ব্যবস্থা করতে বলা হতো। প্রতিটি সেক্টরে যুদ্ধবন্দীদের কাছে এবং মৃত সৈনিকদের পকেটে অনেক চিঠি পাওয়া গেছে। এগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের মা-বাবা এবং আত্মীয়স্বজনের কাছে লেখা। কিন্তু পাঠাতে পারেনি। এসব চিঠিতে তাদের করুণ অবস্থা এবং প্রতিটি স্তরে শৃংখলার কাঠামো সম্পূৰ্ণ ভেঙ্গে পড়ার এক করুণ চিত্র পাওয়া যায়। এই ছিল তাদের সাফল্য মাসের পর মাস দস্যুবৃত্তি, পাশবিক অত্যাচার এবং যাবতীয় জঘন্য অপরাধের উপযুক্ত পুরস্কার। (১০ খৃঃ পূঃ ৩২)
১০ নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা বিগত দুসপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের ৭টি এলাকা দখল করে ‘মুজিবনগর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ঢাকার নিকটবর্তী মধুপুর জংগল এবং সুন্দরবন এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে রয়েছে। (“দি ডেইলি টেলিগ্রাফ” ১১ই নভেম্বর ১৯৭১)
বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও ত্ৰাণমন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান পুনরুল্লেখ করেন, স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মুক্তিসংগ্রাম চলবে।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী