You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.16 | ২৯ কার্তিক, ১৩৭৮ মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২৯ কার্তিক, ১৩৭৮ মঙ্গলবার, ১৬ নভেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে প্রেরিত এক সংবাদে দি ডেইলি টেলিগ্রাফ এর বিশেষ সংবাদদাতা মিস ক্লোয়ার হোলিং ওয়ার্থ বলেন, আধুনিক অস্ত্রের স্বল্পতা এবং গোলাগুলির অভাব সত্ত্বেও মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনা তিনি লক্ষ্য করেছেন। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট এই এলাকাটি সাতটি মুক্তাঞ্চলের অন্যতম বলে এই সংবাদে উল্লেখ করা হয়। আগামী এক মাসের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকা আক্রমণের জন্য তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে ঢাকার চতুর্দিকের গ্রামাঞ্চলে প্রায় দু’হাজার গেরিলা যোদ্ধা নিয়োজিত রয়েছে। (‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’)

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ দিল্লীতে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এই বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধীর সাম্প্রতিক সফরের অভিজ্ঞতা, বিশেষতঃ বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানীর মনোভাব, অধিকৃত অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা, সীমান্ত অঞ্চলে ক্রমবর্ধিত সংঘর্ষ, কাশ্মীর সীমান্তে পাকিস্তানের সম্ভাব্য অভিযান, ভারতের পাল্টা অভিযানের প্রস্তুতি প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়। এই বৈঠকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে ভারত সরকার স্থগিত করে দেয়। উল্লেখ্য, ‘দি টাইমস’ পত্রিকার সংবাদদাতা মিঃ পিটার হেজেলহাষ্ট-এর দিল্লী থেকে প্রেরিত এক সংবাদে এদিন বলা হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মিঃ তাজউদ্দিন আহমদ ভারত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জরুরী আলোচনা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দিল্লী পৌঁছেছেন। সম্ভবতঃ এই সংবাদের জন্য ভারতের সঙ্গে গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে প্রচারণা প্রাধান্য পায়। স্মরিতব্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় মার্চ ১৯, ১৯৭২ তারিখে ঢাকায়।

১৬ নভেম্বর ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা“দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস”—এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাশ্চাত্যের নেতৃবৃন্দের সংগে সাম্প্রতিক আলোচনাকালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দু’সপ্তাহের মধ্যে পূর্ববঙ্গ সংকটের অবসান ঘটানোর দাবী জানান। সংবাদদাতা সি. এস. পন্ডিত বলেন, দু’সপ্তাহের মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে ভারত সরকার দেশে জরুরী পরিস্থিতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীকে প্রকাশ্যে সমর্থন দানকরবে।

এ দিন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর বিশেষ প্ৰতিনিধি আনোয়ারুল আলম শহীদ মুজিবনগর বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল (জেনারেল) এম. এ. জি. ওসমানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী সম্পর্কে সকল অভিযোগ জ্ঞাত হন জেনারেল ওসমানী। কাদেরিয়া বাহিনীর বহু সফল যুদ্ধের বর্ণনা শুনে এক পর্যায়ে খুশীতে আহ্লাদিত হয়ে জেনারেল ওসমানী বলে ওঠেন “বৃটিশ আমল থেকে সেনাবাহিনীতে রয়েছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িত ছিলাম। খুব মনোযোগের সংগে দেখেছি, গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছি, আমার যদি যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানও থেকে থাকে (গলার স্বর উচ্চগ্রামে ভুলে ম্যাপ দেখিয়ে) আমি বলছি, কাদের সিদ্দিকী উইল বি দ্যা ফাস্ট ম্যান টু রীচ ঢাকা। উল্লেখ্য, জেনারেল ওসমানীর ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। (স্বাধীনতা ৭১ পৃঃ ১৮৩)

পিপিপি নেতা জেড. এ. ভুট্টোর সমালোচনা করে জামাতের নেতা গোলাম আযম বলেছেনঃ ক্ষমতার লোভ জনাব ভুট্টোকে এক অদ্ভুত ধরনের পাগলামীতে পেয়ে বসেছে। মহা-সংকটের দিনগুলিতেও ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে এলেন না। অধ্যাপক আযম বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি না, এই মনোভাব নিয়ে কি করে তিনি জাতীয় নেতা হওয়ার দুঃসাহস দেখান। তবে অদূর ভবিষ্যতে তিনি জাতীয় নেতা হওয়ার গুণাবলী অর্জন করুন, আমি বরং এই মোনাজাত করি। (দৈঃ পাঃ) উল্লেখ্য, এই সময়ে জামাতে ইসলামী পাকিস্তানীর নেতৃত্ব গ্রহণে আশ্বান্বিত হয়ে ওঠেছিল। বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগসহ ন্যাপ, জাতীয় লীগ নিষিদ্ধ। তাদের কর্মীদল দুষ্কৃতকারী। অতএব মেঃ জেঃ রাও ফরমান আলীর মদদপুষ্ট প্রায় একলক্ষ রাজাকার ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য নিয়ে জামাতে ইসলামী ক্ষমতা পাওয়ার আশা করছে বৈ কী।

এদিন ‘The Evening star’পত্রিকায় Elections A Farce in East Pakistan’শিরোনামে এ সংবাদে উপনির্বাচন সম্বন্ধে হাস্যকর নির্বাচনী অবস্থার বিবরণ ছাপা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের এ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের নৈপথ্যে রাও ফরমান আলীর ভূমিকার উল্লেখ করা হয় প্রকাশিত সংবাদে আরো বলা হয় ‘Officials here have the helpless feeling of watching a puppet show whose stings are being pulled from Farman Ali’s office.” (BD-2, p. 63)

পাঁচ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর আজমিরীগঞ্জে এক ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। আজমিরীগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাশ পাকসেনাদের কাছে টেরর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ৯টি সফল অপারেশন করেছিলেন। এদিন পাকসেনাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে আড়াই ঘন্টা স্থায়ী যুদ্ধে শহীদ হলেন জগৎজ্যোতি বীরযোদ্ধা উপেন্দু প্রমুখ। আহত হলেন বেশ ক’জন। আজমিরীগঞ্জ পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। উল্লেখ্য, শহীদ জগৎজ্যোতি দাশ বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন।

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী