২ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ শুক্রবার, ১৯ নভেম্বর ১৯৭১
আজ ঈদ-উল-ফিতরের পূর্বদিন। এবং জুমাতুল বিদা। এদিন সকালেই মুক্তিবাহিনীর হাতে কালিগঞ্জ (সাতক্ষীরা) মুক্ত হয়। গোটা শহরের সর্বত্র শক্ত ব্যাংকার তৈরি করেছিল পাকবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড চাপে পাকসেনা, রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা ট্রাক বাসে কালীগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
সাত নম্বর সেক্টরাধীন আলমপুর আম্রকাননে পাকবাহিনীর উপর প্রচন্ড আঘাত হানে (৯ অক্টোবর) কমিশনপ্রাপ্ত মুক্তি বাহিনীর সদস্য রফিকুল ইসলামের বাহিনী। বহু পাকবাহিনী হতাহত হয়। রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন শাহপুর গড় পাকবাহিনীর এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য কর্তৃক অতর্কিতে আক্রান্ত হয়। ফলে ১১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শাহপুর দখলের যুদ্ধ স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এক বীরত্বপূর্ণ অধ্যায়। বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন শহীদ হন লেঃ কর্ণেল নূরুজ্জামান এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দেন।
বাংলাদেশের প্রথম কমিশন প্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদের নেতৃত্বাধীন বীর মুক্তিবাহিনীর সংগে পাকসেনাদের কুড়িগ্রামের জয়মন্দির হাটে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা আশফাকুস সামাদ শহীদ হন।
৬ নং সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ ফুলকুমার নদী অতিক্রম করে পরিকল্পনা অনুযায়ী মধ্যরাতে হতেই রায়গঞ্জে শক্র বাহিনীর অবস্থান ঘিরে প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে পাকবাহিনী ও দোসর বহু দালাল নিহত হয়। রায়গঞ্জের যুদ্ধে প্রথম ভারতীয় সামরিক অফিসার মুক্তিবাহিনীর সাথে অংশগ্রহণ করে বীরের মর্যাদা লাভ করে।
ঢাকার গেরিলা দল মতিঝিলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৬টি গাড়ি ধ্বংস করে। ডেমরায় এসোসিয়েটেড প্রিন্টার্স লিঃ-এ বিস্ফোরণ ঘটায়। পাকিস্তান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের শান্তিবাগের অফিসে বিস্ফোরণ ঘটায়। উল্লেখ্য, এই বিভাগের জনৈক কর্মকর্তা কতিপয় ডকুমেন্টারী ফিল্ম নিয়ে মুজিবনগর পৌঁছেছিলেন।
ঢাকায় সরকারের এক প্রেস নোটে সকল ভবন প্রাঙ্গণে অবিলম্বে পরিখা খননের কাজ সমাপ্ত করার সামরিক নির্দেশ পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় (দৈঃ পাঃ)
জাতিসংঘের তৃতীয় কমিটিতে এক ভাষণে চীনের প্রতিনিধি মিঃ ফু হাও বলেন যে, ‘চীনদেশের সরকার ও জনগণ সব সময় বিশ্বাস করে যে, কোন দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সে দেশের জনগণই সমাধান করবে। কোন কোন দেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করাতে উপমহাদেশে বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ্য, ফু হাও-এর বক্তব্যের মাধ্যমে বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামের প্রতি চীন সরকারের বিরূপ মনোভাবের প্রকাশ হল। উল্লেখ জাতিসংঘের চীন পূর্ব বাংলার প্রশ্নের তীব্র সমালোচনা চালাচ্ছিল। নেপথ্যে চলছিল কূটনীতির কুটচাল। টাইম ম্যাগাজিন লিখছেঃ‘Though they made a stinging attack against India in the UN. … Peking and New Delhi were quietly negotiating behind the scene to re-established high-level diplomatic exchanges. (Time, Dec. 6)
পিআইএ (বিমান সংস্থা) পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের অভ্যন্তরে সকল অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে।
বাংলাদেশ সরকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দেশবাসীর প্রতি ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের সবাই এক সাথে ঈদ-উল-আযহা উদযাপন করবো।
রমযান মাসের শেষ দিন করাচীতে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভারতের প্রতি “বন্ধুত্বের হস্ত” প্রসারিত করার আহবান জানায়।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী