৫ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ সোমবার, ২২ নভেম্বর ১৯৭১
মুক্তিবাহিনীর অকুতোভয় যোদ্ধারা সিলেটের জাকিগঞ্জ, যশোরের চৌগাছা, দিনাজপুরের রায়গঞ্জ, রংপুরের হাতিবান্ধা, বড়খাতা, অমরখানা, সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ এবং খুলনা কলারোয়া পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে। মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়ার ২২টি সীমান্ত ফাঁড়ির মধ্যে ২১টি দখল করে নেয়। যশোর বিমান ঘাঁটিতেও মুক্তিবাহিনী সেল নিক্ষেপ করেছিল। রংপুর ও দিনাজপুরে ব্যাপকভাবে সংঘর্ষ চলেছিল। চালনা বন্দরে মুক্তিবাহিনীর নৌ গেরিলাদল একটি গ্রীক জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে বন্দর পরিচালনায় বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন সেক্টর থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার পাকবাহিনীর ব্যাপক ও বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের সংবাদ মুজিবনগরে পৌঁছতে থাকে। (লেখক)
সিলেটে ৪ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় ৯৯ মাউন্টেন রেজিমেন্ট সমন্বয়ে গেরিলা বাহিনী জাকিগঞ্জ দখলের আক্রমণ চালায়। এ বীরত্বপূর্ণ অভিযানের পর মুক্তি বাহিনী জাকিগঞ্জ ও আটগ্রাম করায়ত্ত্ব করে।
পাক-সরকার অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সকল অভ্যন্তরীণ পিআইএ সার্ভিস বাতিল করে দিয়েছে। ঢাকা শহরে ইপিআরটিসির বাস সার্ভিসও সীমিত করা হয়েছে। ‘লাল’ ও ‘সাদা’ পতাকাবাহী বাসগুলো চলতো। লাল, বাসগুলো যেতো বধ্যভূমিতে। ‘সাদা’ গুলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বিহারী মুসলিম ড্রাইভাররা এসব বাস চালাতো।
পাক বিমানবাহিনী ত্রিপুরার তিতাসা গ্রামের কাছে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর বোমা বর্ষণ করে।
পিডিপি নেতা নুরুল আমিন আশংকা প্রকাশ করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পাকিস্তানে অস্তিত্ব চরম সংকটে উপনীত হবে। (স্টেটস্ম্যান)
লণ্ডনের দৈনিক ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস’ প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবনরাম বলেন, গত মার্চ থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বাঙালী গেরিলা বাহিনীর হাতে পাকবাহিনীর ১০,০০০ হাজার সেনা নিহত হয়েছে। এই দৈনিকের প্রতিনিধিকে জগজীবন আশ্বাস দেন, ভারত মুক্তি যোদ্ধাদের সাহায্য দেবে এমনকি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে কিন্তু পূর্বাঞ্চলে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না।
পাকবাহিনী দ্বিতীয় দিন বয়রা সীমান্তে দুপুর (২ টা ৪৯ মিনিটে) ৪টি স্যবর জেট বিমান ভারতের অভ্যন্তরে আক্রমণ করে। ভারতীয় জোট বিমানের হামলায় তিনটি পাক বিমান বাহিনীর স্যবর জেট বিধ্বস্ত হয় দু’জন বৈমানিক ধৃত হয়। একটি বিমান পাক ঘাঁটিতে ফিরে যায়। উল্লেখ্য, ১৭ নভেম্বর সীমান্ত অতিক্রমের পাক প্রচেষ্টার পর এটি ছিল ভারতের দ্বিতীয় হামলা। ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার তাঁর ‘White house years’গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটন ত্যাগের (নভেম্বর ৫, ১৯৭১) ঠিক ১৭ দিন পর পাকিস্তানী বেতারে বলা হয় যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে। (India had launched an allout offensive against East Pakistan. (Time. October 15, 1979 o. 47)
পিণ্ডিতে পিপিপি নেতা জেড. এ. ভুট্টো ও গভর্ণর ডাঃ এম মালিকের সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের একান্ত বৈঠক হয়।
জাতিসংঘে পাকিস্তান অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছে যে, ১২ রেগুলার ইণ্ডিয়ান ডিভিশন পূর্বাঞ্চলে ৪টি সেক্টরে হামলা চালিয়েছে। “The Pakistan Ambassador to the U.N. Mr. Agha Shahi, alleged during a debate in the Social Committee on the refugee problem on Nov. 22 that 12 Indian divisions, numbering are than 100,000 men, had attacked in four sectors of East Pakistan. The Indian representative, Mr. Samar Sen, described the accusation as “not related to reality” and said that the problem of East Bengal concerned Pakistan only. (KCA, p. 24995)
উত্তরাঞ্চলে পাকসেনারা জলপাইগুড়ির করিমগঞ্জে মর্টার হামলা চালায় আটঘন্টাব্যাপী গোলা বিনিময়ে আটজন ভারতীয় ও ২৯ জন পাকসেনা নিহত হয়।
ভয়েজ অব আমেরিকার এক সংবাদে বলা হয়, জনগণের সমর্থনের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা এই ব্যাপক সাফল্য লাভ করতে সমর্থ হয়। উল্লেখ্য, অবরুদ্ধ বাংলাদেশে সাধারণ নাগরিকরা মুক্তিযোদ্ধাদের আহার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয়।
ব্রিটিশ শ্রমিকদের সাংসদ জন ষ্টোনহাউজ এদিন বাংলাদেশ আন্দোলনের উদ্দেশ্য মার্কিন টেলিভিশনে প্রোগ্রামী ব্যাখ্যা করার জন্য লণ্ডন থেকে আমেরিকা যাত্রা করেন। উল্লেখ্য, তিনি কয়েকবার মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিপ্লবী ডাক টিকেট প্রকাশনা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী