৪ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ রবিবার, ২১ নভেম্বর, ১৯৭১
এ দিনে বাঙালী বীর সেনাবাহিনী (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী), মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনগণের সম্মিলিত অভিযান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক গৌরবময় অধ্যায় রচিত হয়। চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পরও দিবসটি “সশস্ত্র বাহিনী দিবস”হিসেবে উদযাপন করা হয়। যশোরের চৌগাছায় মুক্তিবাহিনীর সংগে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১৬টি ট্যাংকের মধ্যে ১১টি ধ্বংস ও ১০০ জন পাকসেনা নিহত এবং প্রতিরক্ষা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পাকসেনা চৌগাছা ছেড়ে যশোর সেনানিবাসে অবস্থান নেয়। এ যুদ্ধের পর থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী যশোর অভিমুখে অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে। উল্লেখ্য, যশোরের ১৫ কিঃ মিঃ পশ্চিমে এবং ভারতের সীমান্ত গ্রাম বয়ড়ার পাশেই চৌগাছা অবস্থিত। পাকসেনাদের এক স্কোয়াড্রন ট্যাংকবহর নিয়ে ভারতের সীমান্ত বয়রার (যশোর) অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করার জন্য তীব্র আক্রমণ চালায়। দু’দিন ধরে এ যুদ্ধ চলে। পাকবাহিনীর ৩টি স্যাবরজেট ও তেরটি শ্যাকি টাংক ধ্বংস হয় এবং তিনটি ট্যাংক অক্ষতাবস্থায় দখল করে। পাকবাহিনীর হাত থেকে মুক্তিবাহিনীর চৌগাছা মুক্ত করে। যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করার জন্য মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই জারী রাখে।
এই সময়ের পাক-ভারত সম্পর্কের বিষয়ে“ Keeping’s contemporary Archives (পৃঃ ২৪৯৮৯) লিখেছে”“Relations between Pakistan and India became increasingly strained between August and November, as the civil war in East Pakistan intensified and the member of refugees fleeing into India rose to over 9,000,000. The Bangladesh guerrillas launched a general offensive on Nov. 21 in which the Pakistan Government alleged that India troops were taking part, and serious clashes between Indian and Pakistani forces occurred on the border”,
মেজর রফিক (১নং সেক্টরের অধিনায়ক) এ সময় যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেনঃ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি মাসে ২০ হাজার গেরিলাকে ট্রেনিং প্রদান করে তাদেরকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ যথাযথভাবে কাজ করলেও পাক বাহিনীর সমর পরিকল্পনায় একা ভাঙন ধরানো সম্ভব। এই পরিস্থিতিতে গেরিলাদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে। আর চূড়ান্ত আঘাত হানার সেটাই সুবর্ণ সুযোগ। একদিকে যেমন চলছিল এসব পরিকল্পনা অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে ভারত ও পাকিস্তান ক্ৰমান্বয়ে এগিয়ে চলছিল একটা অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের দিকে। … এ সময়ে বাংলাদেশে নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণের জন্য, বিশেষ করে গেরিলা ঘাঁটিগুলোর জন্য কিছুসংখ্যক এম সি এ (গণ পরিষদ সদস্য) কে ট্রেনিং দেওয়া হয়। (খঃ ১০ঃ পৃঃ ১৯)
এদিন ঢাকা থেকে AP সংবাদ দাতার তারবার্তায় জানিয়েছেন, ‘The Pak Army and The guerillas are locked in a grim struggle sapping the army’s ability to fight India if the two col.ntries start an all-out war.’ “For the first time young west Pakistani officers, some stationed in Dacca, talk of the need to remove Yahya Khan if the civil war continues without signs of abatement.”উল্লেখ্য, এ সময়ে মুক্তিবাহিনী ৭টি থান মুক্ত করেছে। বন্দর, শিল্প কারখানায় কাজ কর্ম বন্ধ। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিধ্বস্তপ্রায়। মুক্তিযুদ্ধের দ্রুতশক্তি বৃদ্ধিতে ইয়াহিয়া-নিয়াজি বেসামাল। পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, এ আশংকায় তারা ভীত এবং সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। (লেখক)
এদিন পাকিস্তান সমূহ বিপদ টের পেয়ে জাতিসংঘে পাক প্রতিনিধি হিসেবে আগাশাহী এক নালিশ দায়ের করে বলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১২টি ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানের চারটি সেক্টরে আক্রমণ শুরু করেছে। (সংবাদপত্ৰ)
২০-২১ নভেম্বর রাতে জাকিগঞ্জ ও আটগ্রাম মুক্ত হয়। এই যুদ্ধে ভারতীয় ৯১ মাউন্টেন ব্যাটেলিয়ান ও ১ম ইস্ট বেঙ্গলের বীর সৈনিকরা অংশগ্রহণ করে। ২১ নভেম্বর ক্যাপ্টেন রব সালমটিয়া দখল করেন এবং ২২ নভেম্বর লেঃ জহির রাজটিলা শত্রুমুক্ত করেন। জেড ফোর্স অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল জিয়া (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) ক্যাপ্টেন রবকে কানাইঘাট আক্রমণের নির্দেশ দেন। সুরমা নদীর পাড়ে কানাইরঘাটে পাক অবস্থানের জন্য সামনে অগ্রসর হওয়া যাচ্ছিলো না। ১ম ইস্ট বেঙ্গল জামালপুর-চরখাই-সিলেট অক্ষে অগ্রসর হয়।
এদিন বাংলাদেশ সরকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন সেকটরে ৬ জন রণ সাংবাদিক (War Correspondents) নিম্নোক্তভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত রণ সাংবাদিক হলেন সর্বজনাব আবুল মঞ্জুর (সেকটর-১), মঈনউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (সেকটর ২/৩), হারুন-উর-রশিদ (সেকটর-৪), জালালউদ্দিন আহমেদ (সেকটর-৫), আব্দুল্লা আল ফারুক (সেকটর-৬), এস এ নবী (সেকটর-৭), সেকটর ৮ ও সেকটর-৯ কোন সরাসরি নিয়োগ দেয়া হয়নি। উল্লেখ্য স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদদাতা ও স্থানীয় সংবাদপত্রের সংবাদদাতাদের মাধ্যমে রণ সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করে। এদের মধ্যে আলমগীর কবীর, আলী যাকের, মোহাম্মদ মুসা প্রমুখের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী