You dont have javascript enabled! Please enable it!

১০ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ শনিবার, ২৭ নভেম্বর ১৯৭১

‘ফাইনান্সিয়াল টাইমস’ এর সংবাদদাতা কলকাতা থেকে প্রেরিত সংবাদে বলেন, বাংলাদেশ নামক একটি নতুন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র শীঘ্রই সৃষ্টি হবে বলে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন। উৎসাহী ব্যক্তিরা সময়সীমা হিসেবে কয়েক মাসের পরিবর্তে কয়েক সপ্তাহের কথা উল্লেখ করেন।’সংবাদদাতা কেভিন রেফার্টি প্রতিবেদনে আরো বলেন, ‘যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোন সন্তোষজনক সমাধানের কথা কেউ ভাবতে পারছেন না। পাকিস্তানের দু’অংশকে পুনরায় এক দেশে পরিণত করা সম্ভব নয় বলে ক্রমেই অধিক সংখ্যক লোক মেনে নিচ্ছেন। যুদ্ধ শুরু হতে দেরি হবে না বলে তারা মনে করেন। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মুক্তিবাহিনীর দখলে রয়েছে।

পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুস সাত্তার পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণের তারিখ ঘোষণা করেছেন। জাতীয় পরিষদের ২০টি ও প্রাদেশিক পরিষদের ৭১টি আসনে এই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। (দৈঃ পাঃ ৭ খৃঃ পূঃ ২৩৫)

পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের তারিখ ২৭ ডিসেম্বর নির্ধারিত হয়েছে। পরিষদ ও অধিবেশনের স্থান তখনো ঠিক হয়নি। তবে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ইসলামাবাদে বসতে পারে। (দৈঃ পঃ ৭ খঃ পৃঃ ২৩৭) (উপনির্বাচনে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী তালিকা পরিশিষ্টে দেয়া হলো।)

পাকিস্তান সরকার ষড়যন্ত্র, গুপ্তচরবৃত্তি ও শত্রুদের সাহায্য করার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য দু’সদস্যের (বিচারপতিদের দিয়ে) একটি বিশেষ আদালত গঠনের কথা ঘোষণা করে। (দৈঃ পাঃ ৭ খঃ পৃঃ ২৩৬)

দৈনিক পাকিস্তানের প্রধান সংবাদ শিরোনামঃ যশোর সীমান্তে সাঁজোয়া বাহিনী জঙ্গী বিমান ও ট্যাঙ্ক ব্যবহার ১৮টি ট্যাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্তঃ ৬৩০ জন ভারতীয় সৈন্য হতাহত। সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তে ভারতীয় হামলা। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সর্বাত্মক আক্রমণ। উল্লেখ্য, ২৪ নভেম্বরে যশোর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে পাকবাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশঃ ভারতীয় সেনাবাহিনী যশোর সেক্টরে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সেখানে ৯ ভারতীয় পদাতিক ডিভিশন, ও ভারতীয় মাউন্টেন ডিভিশন ও দু’টি ভারতীয় ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট আক্রমণ চালায়। (৭ খৃঃ পৃঃ ৬২৯)

লেঃ জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজী এদিন যশোরে নব নির্বাচিত এম. এন এ.এবং শান্তি কমিটির সদস্যদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। (দৈঃ পাঃ ৭ খঃ পূঃ ৬৩৩)

পাকিস্তান গোলন্দাজ বাহিনী পশ্চিম দিনাজপুরের (ভারতীয়) শহর বালুর ঘাটের উপর এদিন প্রচণ্ড হামলা চালায়। কামানের গোলায় ছত্ৰচ্ছায়ায় এক ব্রিগেড পাকসেনা হিলিতে ভারতীয় অবস্থানের ওপর আক্রমণ করে। পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে ট্যাংক বহরও ছিল। প্রথম দফায় পাকিস্তানীদের ৮০ জন সৈন্য। চারটি ট্যাংক ধ্বংস হয় এবং তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয় পরের দিন দ্বিতীয় দফা হামলার সময় তিনটি পাকিস্তানী ট্যাংক আটক করা হয় এবং তাদের বহুসংখ্যক সৈন্য প্রাণ হারায়। ভারতীয় পক্ষের ক্ষয়-ক্ষতিও ছিল ব্যাপক। এবার ভারতীয়রা প্রতিশোধ নিতে বিপুল শক্তিতে আন্তর্জাতিক সীমারেখা পার হয়ে বাংলাদেশের ভেতরে কয়েক মাইল ঢুকে পড়ে। ভারত সরকারের নির্দেশ ছিল সীমান্তের ওপার থেকে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হুমকি দেখা দিলে সৈন্যরা তা নির্মূল করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে। (১০ খৃঃ পূঃ ৩৪)

রাওয়ালপিণ্ডিতে একজন সরকারী মুখপাত্র বলেন, গত এক সপ্তাহে দেশের পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি সেক্টরে ভারতীয়দের সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধ এখনো অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধে প্রতিপক্ষের এক হাজার জন নিহত হয়। পাকিস্তানের ১০০ জন সৈন্য হতাহত হয়।

এদিন ৭ নং সেক্টরের লালগোলা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টন গিয়াস চৌধুরীর নির্দেশে মুক্তিবাহিনীর ৫টি কোম্পানির পাকসেনাদের ঘাটি পোড়াগ্রাম আক্রমণ করে। পাকসেনারা চাপাইনবাবগঞ্জে আশ্রয় নেয়। সংঘর্ষে ৩০ জন পাকসেনা ও ৫০ জন রাজাকার নিহত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মুরতাজ আলী অপূর্ব বীরত্বের পরিচয় দেয়।

জামাত নেতা অধ্যাপক গোলাম আজম রাওয়ালপিণ্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আক্রমণই হলো প্রতিরক্ষার বড় অস্ত্র। যুদ্ধের সময় প্রত্যাঘাত না হলে কোন জাতি টিকে আছে এমন নজির ইতিহাসে নেই। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ চলছে। খোদা না করুন পূর্ব পাকিস্তান যদি পাকিস্তানের অংশ না থাকে তাহলে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। (সংবাদপত্ৰ)

কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক খান আব্দুস সবুর এক বিবৃতিতে প্রত্যেক মুসলিমকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান।

ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্ৰী ভিভি গিরি দিল্লীতে বিভিন্ন রাজ্যের গভর্ণরদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাদান কালে বলেন, পাকিস্তানের যদি একজনও আন্তরিক বন্ধু থাকে তবে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষকে বলা উচিত, শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংগে বুঝাপড়া করা। তা ছাড়া সমস্যা সমাধানের অন্য কোন উপায় নেই। (সংবাদপত্ৰ)

পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে পি পি পি নেতা জেড. এ. ভুট্টোর দীর্ঘ আলোচনা হয়। সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণ সম্বন্ধে আলোচনা হয়ে থাকবে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশ পায়। উল্লেখ্য, এদিন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশেষ উদ্বেগের সৃষ্টি হ’ল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এক নির্দেশ জারী করেছেন যে, বঙ্গোপসাগরকে মার্কিন ৭ম নৌ বহরের এক্তির ভূক্ত। ৭ম নৌ বহরের প্রতিরাধ ক্ষমতা ভারতের নেই কেননা ঐ নৌ বহর আনবিক অস্ত্রে সজ্জিত।

পশ্চিম বঙ্গে এক জনসভায় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম মার্কিন ৭ম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরের এলাকা এক্তিয়ারভুক্ত হওয়ার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার ফলে বাংলাদেশ শীঘ্রই স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করবে বলে তিনি দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেন। (মনিংষ্টার/সংবাদপত্র) এদিন কলকাতা থেকে প্রেরিত ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ এর সংবাদদাতা সিডনী এইচ শানবার্গ এক সংবাদ বিশ্লেষণে বলেন, “পূর্ববঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ, লোকায়ত ও স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ভারতের মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা মেনে নিয়েছে। এ ব্যাপারে তারা অবিচলিত এবং কোনরকম আপস করতে রাজী নয়।”

পেশওয়ারের আওয়ামী লীগ ভাইস প্রেসিডেন্ট খান গুলকে পাক-সরকার গ্রেফতার করে।

পিডিপি নেতা নূরুল আমিন সপরিবারে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায় বলে জানা যায়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের আতঙ্কে আটটি দক্ষিণপন্থীদলের নেতারা। পাকিস্তানে পাড়ি জমাতে থাকেন। উল্লেখ্য, ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে জাতীয় সংসদের অধিবেসন শুরু হওয়ার পর একটি জাতীয় সরকার গঠন সম্পর্কে আলোচনার জন্য জনাব নূরুল আমিন এম এন এ কে-ইয়াহিয়া খান আমন্ত্রণ জানান। মিঃ ভুট্টো এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দু’বার আলোচনা করেছেন। জনাব নূরুল আমিন পাকিস্তানের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। যে কারণে ৩০ নভেম্বর এক বক্তব্যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের বর্তমান নীতির মৌলিক পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নেই বলে দাবী করেন।’ (দি টাইমস)

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!