You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.26 | ৯ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

৯ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর ১৯৭১

হিলি, বালুরঘাট অঞ্চলে পুরোদমে লড়াই শুরু হয়ে যায়। ২৫, ২৬ ও ২৭ নভেম্বর গোটা অঞ্চল জুড়ে বড় দরের ট্যাংকের লড়াই হ’ল এবং শেষ দিনের লড়াইয়ে পাক সেনারা ধামরাই হাটের দিক থেকে পালাতে বাধ্য হ’ল। এই যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী মোট পাঁচটা ট্যাংক হারালো কিন্তু ট্যাংক হারিয়ে বা লড়াইয়ে বড় মার খেয়েও পাকবাহিনী হিলি স্টেশনের ঘাঁটি ছাড়তে চাইল না। ভারতীয় সেনাবাহিনী হিলি দখল থেকে বিরত থাকে। (১০ খঃ পূঃ ৭৭৭)

শৈলকুপা যশোর সদরকে হানাদার পাকসেনা মুক্ত করতে ৪২ জন মুজিববাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্না পৌঁছায়। এসব মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা ছিলেন আলমগীর। স্থানীয় রাজাকার রাজ্জাক মোল্লা ও আমজাদের শঠতায় ঝিনাইদহ থেকে পাকসেনারা কামাল্লায় গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে (সাধন ভৌমিকের টিনের চালা ও ছামেনা বেগমের খড়ের ঘর) আক্রমণ চালায়। ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। পরে ধলহরচন্দ্র ও আবাইপুরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তুললে পাকসেনারা পিছু হটে যায়। কামান্না স্কুলের এক পাশে ৫টি কর

শহীদদের ২৭টি লাশ সমাহিত করা হয়। এ-সমাহিত শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন, মোমিন, কাদের, শহীদুল, সলেমান, রাজ্জাক, ওয়াহেদ, রিয়াদ, আলমগীর, মতলেব, আলী হোসেন, শরিফুল, আলীমুজ্জামান, আনিসুর, তাজুল, মনিরুজ্জামান, মাছিম, রাজ্জাক, কাওছার, মালেক, আজজ, আকবর, সেলিম, হোসেন, রাশেদ, গোলজার, অধীরচন্দ্র এবং গৌরচন্দ্র। উল্লেখ্য, হানাদার বাহিনী এদিন মুক্তিবাহিনীর সহযোগী রঙ্গবিবি ও ফনী ভূষণ কুন্ডুকেও হত্যা করে (সংবাদ)।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সকল উপদল ও গ্রুপকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান বিরোধী আবদুল গাফফার খানের পাক শত্ৰুতা কখনো ক্ষান্ত হয়নি। ইয়াহিয়া বলেন, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ও তার দল এখন দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যারা প্রথমেই পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা দাবী করেছিলেন মওলানা ভাসানী তাদের অন্যতম। এখন তিনি আমাদের শত্রুদের মধ্যে বসবাস করছেন। (দৈঃ পাঃ)

কুমিল্লা-নোয়াখালী সেক্টরে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সংঘর্ষে ৩০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত (খবর দৈঃ পাকিস্তান)। প্রকৃত অর্থে দিনাজপুরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনী তীব্র প্রতিরোধে বহু হতাহত হয়। ময়মনসিংহ জেলার বরমারী, আকিপাড়া, কমলপুর দক্ষিণ সিলেট (কেরামত নগর) কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কায়েমপুর যশোরের হিরণ, জীবন নগর ও শার্শায় গোলাবর্ষণে পাকবাহিনী পিছু হটে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকবাহিনী তখন ক্যান্টনমেন্টমুখী হয়ে সীমান্ত চৌকিগুলো পাকসেনারা ছেড়ে যেতে থাকে।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ডাঃ মালিক রাওয়ালপিণ্ডিতে বলেন, কতিপয় বিদ্রোহী ও ভারতীয় চর ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এখন বুঝতে পেরেছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনই একটা ভাওতা। তিনি বলেন, তাঁর কাছে এ ধরনের সঠিক খবরও আছে যে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা ফিরে আসার জন্য খুবই আগ্রহী। কিন্তু তাদের কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে। (দৈঃ পাঃ ৭ খঃ পৃঃ ৫৯২)

এদিন সকাল এগারোটায় মুক্তিবাহিনী সম্মিলিতভাবে সারিয়াকান্দি থানাতে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীকে আক্রমণ করে। বিকাল তিনটায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবস্থানরত পাকসেনাদের পতন ঘটে। সারাদিন এবং সারারাত যুদ্ধের পর শনিবার (২৭ নভেঃ) সকালে হানাদার বাহিনীসহ সারিয়াকান্দি থানার পতন ঘটে। শতাধিক রাজাকার ও পুলিশ মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আটক হয়। আটককৃত পুলিশদের মুক্তাঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। রাজাকারদের যমুনার তীরে বিচার করা হয়। অন্যদিকে পাক বিমানবাহিনী সারিয়া কান্দিতে বোমাবর্ষণ করতে থাকে-আটক পাকসেনারা সে সুযোগে পালিয়ে যায়। (উত্তরাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ)

জাতিসংঘে প্রেরিত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলনেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধির বক্তব্য না শুনে নিরাপত্তা পরিষদ ‘বাংলাদেশ’নিয়ে আলোচনা করা সঠিক নয়। তাছাড়া, পাকসেনারা যখন গণহত্যা চালাচ্ছিল তখনও নিরাপত্তা পরিষদ সামান্যতম ভূমিকা পালন করেনি।

পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম এক বিবৃতিতে রাজাকারদের হাতে সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দেয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, আধুনিক অস্ত্র পেলে তারা দুস্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) খতম করতে সমর্থ হবে।

পাক সরকার মিঃ এ কে ব্রোহীকে ভারতে পাক হাইকমিশনার পদে নিয়োগ দান করে। পি পি পি দলীয় মুখপাত্র। ‘মুসাওয়াত’ পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে এ নিয়োগের তীব্র সমালোচনা করা হয়। বলা হয় যে, মিঃ ব্রোহীর সঙ্গে শ্ৰীমতী গান্ধীর পরিবারের সম্পর্ক রয়েছে।

বিবিসি’র সংবাদঃ যশোর মুক্তিবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ। রংপুর অঞ্চলে ২৫০ বর্গমাইল মুক্তিবাহিনী কর্তৃক অধিকৃত। জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছেন, পুরাতন পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। নতুন পাকিস্তান গড়ে তোলা যায় কিনা তা ১৯৭১ সালের মধ্যেই বোঝা যাবে। গোলাম আযম বলেছেন, “আমার বন্ধু শেখ মুজিব কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিলেন না। ভুট্টো এবং অন্যান্য সমাজতন্ত্রী দলগুলো তাকে বেকায়দায় ফেলে”। বিবিসির মন্তব্যঃ ইয়াহিয়া খান সাহেবের জন্যে সম্মানজনক মীমাংসার কোন পথ খোলা নেই। বিবিসি’র অন্য খবরঃ ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেছেন, তথাকথিত নির্বাচনে নির্বাচিতদের দ্বারা গঠিত তাঁবেদার পাক সরকার ভারত গ্রহণ করবে না। শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৯৭০ ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গ্রহণযোগ্য মীমাংসাই শুধু তারা গ্রহণ করবেন। বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। (আত্মস্মৃতি-পুঃ ৩৩৫)

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী