২০ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ মঙ্গলবার ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
[মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্যগণ উৎকর্ণ হয়ে কাল কাটাচ্ছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম.কামরুজ্জামান বিভিন্ন স্থানের সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি জানার জন্য কয়েকজন উর্ধর্তন কর্মকতাকে (লেখকসহ) তৎপর রেখেছিলেন। প্রিন্সেপ স্ট্রীট, থিয়েটার রোড, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বাংলাদেশ মিশনসহ শরণার্থী শিবির ও যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্রের সকল বাঙ্গালীর মনই স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় উদ্বিগ্ন ও উৎকর্ণ ছিল।
আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র বাংলা সংবাদ বুলেটিন প্রচার করা ছাড়া অতিরিক্ত কয়েকদফা সংবাদ প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সকাল ৯-০০ টা, ৯-৫মিঃ, দুপুর ১২-৫ মিঃ, ২-২৫ মিঃ, বিকাল ৪-২০ মিঃ এবং বিকাল ৪-২৫ মিঃ যুদ্ধ সমীক্ষাসহ অতিরিক্ত সংবাদ বুলেটিন প্রচার করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও সকাল ও সন্ধ্যায় অতিরিক্ত সময়ে যুদ্ধ সমীক্ষা, দেশাত্মবোধক গান ও চরমপত্র প্রচার করা হয়।
১৯৭০ সনের ৭ ডিসেম্বর ছিল বাঙ্গালীর গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দিন। এ দিনই বাঙ্গালী আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জাতীয় নেতা নির্বাচন করেছিল। আজ ৩৬৫ দিনের সুর্যপ্রদক্ষিণের পরে অনিবার্য হয়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলার শুভ অভুদয়। এ অভ্যুদয় রুধিরাক্ত এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। এ অভ্যুদয় অজস্র মা-বোনের অশ্রু, মুক্তিযোদ্ধার স্বেদ ও রক্ত, লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগে গরীয়ান।
গতকাল সোমবার অপরাহ্নে ভারত সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করায় পাকিস্তান সরকার ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।]– লেখক
যশোর মুক্ত হলো সকালে। সিলেট মুক্ত হলো দুপুরে। বহু পাক সেনা আত্মসমর্পণ করলো।
পাঁচ নম্বর সেক্টরভুক্ত বালাট সাব-সেক্টর অধিনায়ক মেজর অবঃ এম এ মোতালিব মিত্রবাহিনীর ক্যাপটেন যাদব ও ক্যাপটেন রঘুনাথ ভাটনগরের যৌথ নেতৃত্বে তিন হাজার মুক্তি-মিত্র বাহিনী গভীর রাতে সুনামগঞ্জ মুক্ত করার জন্য আক্রমণ করে। এদিন প্রত্যুষে পাকসেনারা সুনামগঞ্জ থেকে পালিয়ে যায়। বিনা যুদ্ধে সুনামগঞ্জ মুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা জয় বাংলা ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তোলে। স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।
মৌলবীবাজার মুক্ত হয় এদিন। মুক্তি ও মিত্রবাহিহীর সঙ্গে কালেঙ্গায় (বড়টিলা) পাকবাহিণীর প্রচণ্ড লড়াই হয়। মিত্র বাহিনীর ১২৭ জন সেনা নিহত হয়। পাকসেনারা অবস্থান থেকে পালিয়ে যায়।
গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) এদিন মুক্ত হয়। উল্লেখ্য ৩০ নভেম্বর মুজিব বাহিনীর সঙ্গে পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই হয়। মুক্তিযোদ্ধা জসিম শহীদ হন এবং মুক্তযোদ্ধা সিরাজ, মজনু ও মতিয়ুর আহত হয়ে পাকসেনাদর হাতে ধরা পড়েন, পরে পাকসেনারা তাদেরকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক মুখপাত্র বলেন যে, মার্কিন সরকার সরকারীভাবে অবহিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের ঘোষণা সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে অপারগ। (দৈঃ ইঃ)
যশোর মিত্র বাহিনীর হাতে মুক্ত হলো। যুদ্ধই হয়নি বলা চলে, মুক্তিবাহিনীও এত সহজে বিজয়ী হবে ভাবেনি। পাকবাহিনী গোপনে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে মাগুরার দিকে পালিয়ে যায়।
সুনামগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, চরখা, ছাতক, মৌলভীবাজার ও অন্যতম ক্যান্টনমেন্ট সিলেটের পতন হলো দুপুরে মিত্রবাহিনীর হাতে। পাকবাহিনী ঢাকার দিকে ছুটছে-মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনী ওদেরকে অবরুদ্ধ করেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে এগুতে দেয়নি। মেহেরপুর সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, ঝিনাইদহ এলাকা মুক্ত হয়ে গেল পর পর। খানসেনাদের সব দুর্গই খান খান হয়ে যাচ্ছে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রবল আক্রমণে। উল্লেখ্য সাতক্ষীরা মুক্ত করতে এ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ তিনটি যুদ্ধ বিশেষ আলোড়ণ সৃষ্টি করে, সেগুলো হ’ল ডোমরার যুদ্ধ (২৯ মে) নেতৃত্ব দেন আবু ওসমান, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন। দেবহাটার শ্রীপুরের যুদ্ধ (৬ জুন) এবং কলারোয়ার যুদ্ধ (ডিসেম্বর ২)। এসব যুদ্ধে সমন্বয়কারী হিসেবে নেতৃত্ব দেন গণপরিষদ সদস্য, ক্যাপ্টেন স. ম.আলাউদ্দিন। তিনি জেলা মুজিব বাহিনীর সংগঠক ছিলেন। শ্রীপুরের যুদ্ধে শহীদ হন শামসুদ্দোহ খান (কাজল), এ.বি.এম নাজমুল আবেদীন, শ্ৰী নারায়ণ চন্দ্র ধর, আবুল কালাম আজাদ ও সিরাজুল ইসলাম। উল্লেখ্য সাতক্ষীরার গণ অভ্যখান আন্দোলনে প্রথম শহীদ রিকশাচালক আব্দুর রাজ্জাক, পরবর্তিতে তার নামে সাতক্ষীরার শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্ক ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রতিনিধি যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব দু’বার তুললেন-দু’বারই সোভিয়েট প্রতিনিধি ভেটো প্রয়োগ করলেন। প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেল, আবার বিতর্ক শুরু হলো সাধারণ পরিষদে। তুমুল বাকযুদ্ধ চললো ভারতীয় স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন ও পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহীর মধ্যে। সেদিনই অনিবার্য হয়ে ওঠে স্বাধীন স্বার্বভৌম গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শুভ অভ্যুদয়।
বাংলাদেশের অনুকূলে অগ্রসর হয়ে চলেছে তার ফলে এবং বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীকে দ্রুত সংগঠিত করার পরিকল্পনা কার্যকর করার পর আগামী দ’থেকে তিন মাসের মধ্যে অবশিষ্ঠ ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। দেশের আইন ও শৃংখলার দায়িত্ব বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর কাছে দ্রুত হস্তান্তরিত করার লক্ষ্যে এইসব বাহিনীর সম্প্রসারণের জন্য অফিসার প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল সর্বাগ্রে। এই উদ্দেশ্যে ২৬ শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ মন্ত্রীসভা জাতীয় দেশ রক্ষা একাডেমী প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। একই দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয় এবং এ থেকেই অনুমান করা চলে নতুন সরকারের দৃষ্টিতে দেশরক্ষা বাহিনীর সংগঠন কি পরিমাণ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত হয়েছিল। (Bangladesh Observer. Dec. 27.71)
INDIA RECOGNIZES BANGLADESH
Mrs Indira Gandhi announced in Lokshbha on Dec. 6 that India had recognized the provisional government of Bangladesh. “It was natural that our sympathy should be with the people of Bangladesh in their just struggle. “She said. “But we did not act precipitately in the matter of recognition. Our decisions were not guided by emotions, but by the assessment of prevailing and future realities. With the unanimous revolt of the entire people of Bangladesh and the success of their struggle, it has become increasingly apparent that so- called mother-state of Pakistan is totally incapable of bringing the people of Bangladesh back under its control. As for the legitimacy of the government of Bangladesh, the whole world is now aware that it reflects the will of the overwhelming majority of the people, which not many government can claim to represent. Applying this criterion, the military regime in Pakistan, which some states are so anxious to buttress, is hardly representative of its people, even in West Pakistan.
“Now that Pakistan is waging war against India, normal hesitation on our part not to do anything which would come in the way of a peaceful solution or which might be constructed as intervention has lost significance. The people of Bangladesh battling for their very existence and the people of India fighting to defeat aggression now find themselves partisans in the same cause. I am glad to inform the house that, in the light of the existing situation and in response to the repeated requests of the government of Bangladesh, the government of India have decided to grant recognition to the People’s Republic of Bangladesh.
“The Government of Bangladesh has proclaimed their basic principles of state policy to be democracy, socialism, secularism & the establishment of an egalitarian society in which there would be no discrimination on the basis of race, religion, sex or creed. In regard to foreign relation the Bangladesh government has expressed their determination to follow a policy of non-alignment, peaceful co-existence and opposition to colonialism, racialism and imperialism in all its manifestations. These are ideals to which India also is dedicated.
“The Bangladesh government have reiterated their anxiety to organise the expedition’s return of their citizens who have found temporary refuse in our country, and to restore their lands and belongings to them. We shall naturally hep in every in this arrangements.
-ভারতীয় পার্লামেন্ট তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তানের বর্তমান সংকটে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ক্ষতিকর হওয়ার আশংকা থাকা সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনাবলীর স্বাভাবিক পরিণতির সম্ভাবনা থাকলে এই পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে তিনি ইতস্তত করতেন। (দি টাইমস)
-শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি পত্রের কপি পার্লামেন্ট সদস্যদের অবগতির জন্য পেশ করেন, ২৪ এপ্রিল তারিখে বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকার সর্ব প্রথম বাংলাদেশের স্বীকৃতিদানের জন্য অনুরোধ জানায়। ৪ ডিসেম্বর তারিখে লিখিত সর্বশেষ পত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাক্ষর করে। (দি টাইমস)
DIPLOMATIC RELATIONS WITH INDIA
BROKEN OFF BY PAKISTAN
The Pakistan government immediately broke off diplomatic relations with India, and described India’s action as evidence of its ‘deep hatred’ of Pakistan and of its determinations to break up the country. (KCA pp 25054)
-ভারতে লোকসভায় প্রধামন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সর্বপর্থম স্বীকৃতি ঘোষিত হবার ২৪ ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদ ঘটায়। উল্লেখ্য,
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন কর্তৃক ভেটো প্রয়োগের ফলে সিকিউওরিটি কাউন্সিল ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অসমর্থ হওয়ার ১৩১- সদস্যবিশিষ্ট সাধারণ পরিষদ ৭ই ডিসেম্বর জরুরী ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন
-উদ্বেগ পরিবেশ আলোচনা অনুষ্ঠানকালে আর্জেন্টিনা কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে পাকিস্তানী ও ভারতীয় সৈন্যবাহিনী নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবী জানান হয়।
-আরও আটটি দেশ কর্তৃক সমর্থিত এই প্রস্তাবে ভারত থেকে শরণার্থীদের অবিলম্বে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার আহবান জানান হয়। গত রবিবার (৫ই ডিসেম্বর) রাত্রে সোভিয়েত কর্তৃক প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করা হয়, তার সঙ্গে আর্জেন্টিনা কর্তৃক উত্থাপিত প্রস্তাবের খুব বেশী অমিল নেই।
-মার্কিন প্রতিনিধি নেতা জর্জ বুশ প্রস্তাবটি সমর্থনের আবেদন জানান। তিনি সংকটের পরিসর বৃদ্ধির জন্য ভারতকে দায়ী করে বলেন, রাজনৈতিক সমাধান ত্বরান্বিত করার জন্য জাতি সংঘের প্রভাব খাটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা অবশ্য কর্তব্য (দি ডেইলি টেলিগ্রাফ ও দি টাইমস ৮ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১)
-জাতিসংঘ কর্তৃক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আলোচনা এক বিবৃতির মাধ্যমে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘের ভূমিকা সম্পর্কে মুজিবনগর সরকারের বক্তব্য ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জঙগণকে যখন নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন জাতিসংঘ নিষ্ক্রিয় ছিল। আক্রমণকারী পাকিস্তানী সৈন্যদের হটিয়ে দিলে বাংলাদেশ যখন সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন জাতিসংঘ কর্তৃক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই প্রস্তাব গৃহীত হলে পাকিস্তান লাভবান হবে এবং বাংলাদেশের জনগণ অবর্ণনীয় দুর্দশার সম্মুখীন হবে। এর ফলে মূল সমস্যার সমাধান হবে না। বাঙালীদের জয় অনিবার্য। চূড়ান্ত জয়লাভ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বলে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে তিনি ঘোষণা করেন। (সূত্র বিচারপতি চৌধুরী কর্তৃক লন্ডনে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে, ৩১ শে অক্টোবর ১৯৮৬) স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রবাসী বাঙালী পৃ-২০১
-ভূটান আজ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশক স্বীকৃতি দিয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭০ সনের ২০ ডিসেম্বর ভূটান জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য আবেদন করেছিল।
-৯নং সেক্টরের বীর মুক্তিবাহিনী বরিশাল মুক্ত করে এবং পাক-সেনারা ক্যাপ্টেন এবগ ও নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এম, এন এ-এর কাছে আর্ত্মসমর্পণ করে। ( ১০ ম খণ্ড পৃঃ) ৭৫৯
-পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানান। এই সরকারের প্রধান মন্ত্রী পি ডি পি নেতা নূরুল আমিন ও ভাইস প্রধামন্ত্রী পিপিপি নেতা জেড এ ভুট্টো। (আকাশ বাণী)
Following is the statement
Of the President Yahya khan
“I have called upon Mr. Nurul Amin and Z.A Bhutto to form a coalition Government at the centre with Mr. Nurul Amin as the prime minster and Mr. Bhutto as the vice-prime minister and foreign-minister says a PID handout.”
“I view of the war and consequent difficulties in communications between the two wings of the country I have decided to set up the Government at the centre now, which was to be formed after the 27th of December. The members of the central Government will be drawn from the selected representatives of the two wings as decided upon by the leaders of the coalition Government.”
-পাকহানাদার বাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্টকে রক্ষার জন্য যশোর রোডে সীমান্তের কাছে নাভারন ও সারসার মধ্যে প্রায় দেড় মাইল লম্বা চব্বিশ ফুট চওড়া ও পাঁচ ফুট গভীর একটি খাল কেটেছিল। এ ছাড়া পঁচিশটির বেশী কংক্রিটের ব্যাংকার তৈরী করেছিল। ভারতীয় বাহিনীর বেনাপোল ও যশোর রোড ধরে যশোর শহর ও ক্যান্টনমেন্টের দিকে ট্যাংক, দুর-পাল্লার কামান, সাজোয়া বাহিনী ও বিমান বাহিনীর সাহায্যে পাকবাহিনীর সমস্ত প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙ্গে দেয়। যশোর অভিযানে মুক্তিবাহিনী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। অনেক ক্ষেত্রে একক ভূমিকা ছিল মুক্তিবাহিনী।
-পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন বিচারপতি আবদুস সাত্তার যুদ্ধের পরিপেক্ষিতে আজ পূর্ব পাকিস্তানের সকল উপ-নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেন। এই নির্বাচন ৭ ও ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ হওয়ার কথা ছিল। (দৈঃ ইত্তফাক)
-ভারতীয় নৌবাহিনী ৫ টি এক হাজার টনের পাকিস্তানী জাহাজ অবরোধ করে নিকটস্থ ভারতীয় বন্দরে আটক রাখে।
রাত দশটায় আকাশবাণী থেকে হিন্দি, উর্দ্দু ও পশতু ভাষায় ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেক শ’ বাংলাদেশে দখলদার পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। এই আহ্বানে জেনারেল মানেক শ’ বলেনঃ
‘তোমাদের বাঁচার কোন পথ নেই। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য তোমাদের ঘিরে রেখেছে। তোমরা যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে তারা তাঁর প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। অনেক দেরী হবার আগেই তোমরা আত্মসমর্পণ কর। তোমাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা ও যুদ্ধাস্ত্রের শক্তি অকেজো হয়ে গেছে, এমনকি বাইরতে থাকে বিমানের সাহায্য আসার সম্ভাবনাও নেই। অতএব তোমরা অস্ত্র ত্যাগ কর। তোমাদের বাঁচার কোন পথ নেই। একমাত্র পথ হচ্ছে সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা।‘
-ঢাকায় ৭৬ ঘন্টাব্যাপী সান্ধ্য আইন জারী। ঢাকার পত্রিকার আজ শেষ প্রকাশনা। আকাশে মিত্র বাহিনীর বিমান গর্জন। নীচে পাক বাহিনীর আর্তনাদ। রাজাকার আলবদরদের পেচক পদচারণ। শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতি ঢাকা নগরীর। আলকাতরামাখা রাতের অন্ধকারে ডুবে আছে শংকিত বাঙালীরা।
-ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো এক বিবৃতিতে বলেন, যদি ভারত ও পাকিস্তান দুই যুদ্ধরত দেশ অনুরোধ করে, তা’হলে ইন্দোনেশিয়া এই সংঘর্ষে মধ্যস্থতা করতে রাজী আছে। ( দি জাকার্তা টাইমস)
-জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আলজেরিয়া আর্জেনটিনা, ব্রাজিল, বরুডি, ক্যামেরুন, শাদ, কলম্বিয়া, কোষ্টারিকা, ইকুয়েডার, ঘানা, গুয়াতেমালা, হাইতি, হণ্ডুরাস, ইন্দোনেশিয়া, ইটালী, আইভরী কোষ্ট, জাপান, জর্দান, লাইবেরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো, নেদারল্যাণ্ড, নিকারাগুয়া, পানামা, উরুগুয়ে, ইয়েমেন, জায়ারে এবং জাম্বিয়া খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে। উক্ত প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি ও লড়াই বন্ধসহ পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং সেখানকার জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুনরায় পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
-সোভিয়েত ইউনিয়ন সাধারণ পরিষদে নিরাপত্তা পরিষদের ৬ ডিসেম্বর উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবের অনুরূপ আরেকটি প্রস্তাব পেশ করে।
-জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। উক্ত প্রস্তাবে “ভারত ও পাকিস্তানকে অতি সত্বর যুদ্ধ বিরতি কার্যকর ও সৈন্য প্রত্যাহার এবং শরণার্থীদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাবার স্বাভাবিক ও অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে প্রচেষ্টা জোরদার করার আহ্বান জানানো হয় ”।
-প্যারিসের দৈনিক লু’মানিতে বলা হয়, চীন ও আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের বিরুদ্ধে দ্বৈত সঙ্গীত চালিয়ে যাচ্ছে। … সম্পাদকীয় নিবন্ধে আরো বলা হয়, ‘এক কোটি শরণার্থীর ভাগ্য সম্পর্কে এবং হিংস্রতার শিকার পূর্ব বাংলার জনসমষ্টির ভাগ্য সম্পর্কে পিকিংয়ের পরিপূর্ণ ঔদাসীন্যেরই প্রমাণ। সোভিয়েত বিরোধিতার জোরে এবং ভারতের প্রতি বৈরিতাপূর্ণ মনোভাবের দরুণ পিকিং সরকার ওয়াশিংটন প্রশাসনের সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করছে বলে সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়।
-‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’ পত্রিকার পর্যপেক্ষক যোসেফ ক্রাকট লিখেছেন যে, ‘ভারত পাক সংকট সম্পর্কে নিক্সন প্রশাসনের মনোভাবের বৈশিষ্ট্য হলো নৈতিক অন্ধতা ও রাজনৈতিক বাস্তববুদ্ধির অনুপস্থিতির এক অদ্ভুদ মিলন’।
-সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বলেছেন, ‘গত আট মাস ধরে যেখানে মার্কিন সরকার পূর্ববাংলার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিয়মিত নিষ্ঠুর নির্যাতনের নিন্দা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে, সেখানে তাঁরা এখন ভারতের নিন্দা করছে। রিপাবলিকান প্রশাসনের নীতির তীব্র নিন্দা প্রসঙ্গে তিনি একথা বলেন। ওয়াশিংটনে সিনেটর কেনেডী বলেন, সংকটের মূল কারণ গত মার্চ থেকে পূর্ব বাংলায় পাক জঙ্গী শাসকবর্গের অত্যাচার। চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার প্রয়াসকে তিনি সমর্থন জানান। (আঃ বাঃ পঃ)
— পোলিশ ইউনাইটেড ওয়ার্কস পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস কমরেড এল, আই, ব্রেঝনেভ বলেনঃ ভারতীয় উপমহাদেশে সামরিক সংঘর্ষ পূর্ব পাকিস্তান জনসমষ্টির মৌল অধিকার ও সুস্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত দমনেরই ফল…। বাইরের কোনও প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়া জনগণের বৈধ অধিকার বিবেচনায় রেখে উদ্ভুত সমস্যাবলীর রাজনৈতিক সমাধনের এবং ঐ এলাকায় স্থায়ী ও ন্যায়সম্মত শান্তির সহায়ক হয় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন দৃঢ়ভাবে রয়েছে।…
-সোমবার সকালে পূর্বঞ্চলীয় ভারতীয় বাহিনীর অন্যতম প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকব বলেন, দুটো কারণে পূর্ব বাংলায় ভারতীয় বাহিনীর অগ্রগতি খুব দ্রুত হতে পারছে না। (এক) পূর্ববঙ্গে নদী নালা রয়েছে প্রচুর। সেখানে খুব দ্রুত অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত কঠিন। এবং (দুই যথাসম্ভব ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়ার প্রতি ভারতের আগ্রহ। (আঃবাঃপঃ)
-সিলেট সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ফেনীর পতন হয়েছে সোমবার সকালেই। ফলে চট্টগ্রাম জেলা বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এই সেক্টরে জুরী, কালাউড়া, লাটু এবং মুন্সী বাজার মুক্ত। মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড লড়াই করে উজানিসার ব্রিজও দখল করে নেয়।
-হিলি এখনও পাকসেনাদের দখলে। কিন্তু হিলির ১৬ মাইল উত্তরে হাতিবান্দা মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। চরখাইর দিক থেকে মিত্রবাহিনী করোতোয়া নদী অতিক্রম করে এগুচ্ছিল।
-রংপুর সেক্টরে লালমনিরহাট অবরুদ্ধ। কুড়িগ্রাম মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। পাকসেনাদের রংপুর ক্যান্টমেন্টে আশ্রয় গ্রহণ।
-কুমিল্লা ও সিলেট এই দুই সেক্টর থেকেই মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী অকুতোভয় বীরযোদ্ধারা ঢাকার দিকে এগিয়ে যায়।
-ভারতীয় নৌবাহিনীও একই দিন বারবার আক্রমণ চালায়। খুলনা, চালনা এবং মংলা বন্দরে ভারতীয় নৌবাহিনীও বিমান দু’টি গানবোট ডুবিয়ে দেয়। মেঘনায় দু’টি পাক তৈলবাহী জাহাজকে ভারতীয় জাহাজ দখল করে নেয়।
-যশোর ক্যান্টমেন্টে অবরুদ্ধ পাক-সেনারা বুধবারের মধ্যে আত্মসমর্পণ করবে কিনা তা এখনও জানা যায় নি। বিভিন্ন সেক্টরে গত ৭২ ঘন্টায় পাঁচ পাকসেনা ও অফিসার মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর হাতে ধরা দিয়েছে। অবরুদ্ধ পাকসেনারা যদি আত্মসমর্পণ না করে শেষ পর্যন্ত চড়াই চালিয়ে যাওয়ার নীতি অবলম্বন করে, তাহলে যশোরে তুমুল লড়াই হবে বলে আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়।
-স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক বেতার ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলে, তাঁর সরকার শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং পুনর্বাসনের জন্য দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। তিনি বলেন, ঢাকা স্বাধীন হবার আর বেশী বাকী নেই। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ছাড়া এ স্বাধীনতার আনন্দ আমাদের কাছে নিষ্প্রভ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণপণ সহায়তা করবার জন্য তিনি ভারতের জনগণ, সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
-নূরুল আমিন ও ভুট্টোকএ নিয়ে পাকিস্তানের সরকার গঠন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহম্মদ হাসতে হাসতে বলেন, উন্ময়াদরা অনেক কিছু করতে পারে। তিনি বলেন, সে সব লোক এখন ভয়ে ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে তাঁরা এখনা বার বেসামরিক সরকার গঠন করতে চাইছে—এটা মজার ব্যাপার। (আঃ বাঃ পঃ)
-গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখন এক স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান। তাঁকে কারাগারে রাখবার অধিকার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেই।
-নিউয়ইর্ক টাইমস পত্রিকায় (ডিসেম্বর ৭) ‘কে দোষী কে নির্দোষ’ – এই বিষয়টি সাব্যস্ত করার যাবতীয় প্রয়াস ত্যাগ করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। পত্রিকায় বলা হয়। আমেরিকার নির্লজ্জ পাক- সমর্থনের ফলে সারা পৃথিবীতে মার্কিন ইজ্জত বহুলাংশে নষ্ট হয়েছে।
-মঙ্গলবার শেষ রাতে (বাংলাদেশ সময়) সাধারণ পরিষদ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ প্রসঙ্গটি নিয়ে জরুরী আলোচনা বসে। সাধারণ পরিষদে বিতর্ককালে ভারতীয় প্রতিনিধি শ্রী সমর সেন জোরালো বক্তৃতায় মার্কিন প্রতিনিধিকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞাসা করেন, নিরাপত্তা পরিষদ যে আজও বেঁচে আছে, পৃথিবীর লোককে জানাবার জন্যই কি এই অবান্তর প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে? মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ (বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট) বলেন, গতকাল আমি একটি চমৎকার প্রস্তাব এনেছিলাম যে প্রস্তাবটি আমেরিকান জনগণের সমর্থন ছিল, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন সেটাকে ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে খারিজ করে দিল। সীমান্ত থেকে উভয় পক্ষের সৈন্য সরিয়ে নিতে রাজী করাবার চেষ্টা প্রেসিডেন্ট নিক্সন করেছেন। সেটাও ভারতের পছন্দ হলো না। রাষ্ট্রপুঞ্জ সেক্রেটারী জেনারেল সহায়তায় স্বেচ্ছায় শরণার্থীদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে। কোন ফল হয় নি। মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে আমেরিকান সংবাদপত্রে যা কিছু লেখা হচ্ছে, তাই বেছে নিয়ে ভারতীয় প্রতিনিধি এখানে শোনাচ্ছেন। শ্রী সমর সেন পাল্টা জবাবে বলেনঃ সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, পররাষ্ট্র ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি, গালভরা এমন কত কথাই না বলা হচ্ছে। কিন্তু মানবিক অধিকার, গণহত্যা, মানব সভ্যতার দেহে এ সকল দুষ্ট ক্ষতের কথা চেপে যাওয়া হচ্ছে কেন?… এ কথা জেনে প্রীত হলাম যে, মার্কিন জনগণ মার্কিন সরকারকে সমর্থন করে থাকেন।
সোভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক চীনের প্রতিনিধিকে লক্ষ্য করে বলেনঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের ব্যাপারে নাক গলাতে যাবে না।– কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ বাস্তব অবস্থাকে উপেক্ষা করে চলবেন না সেটাও আমরা চাই না। যুদ্ধ বিরতির প্রশ্নটি সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব আনে সোমালিয়া। ১১-০ ভোটে সেটি গৃহীত হয়। চারটি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। (পি টি আই/ জাতিসংঘ/ আঃ বাঃ পঃ)
-দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা “বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেল” শিরোনামে সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করেঃ “…বাংলাদেশ খুঁড়ছে অত্যাচারী স্বৈরতন্ত্র কবর। তাতে ইসলামাবাদের শব নামবে ভারত। আর এই কবরে মাট দেবে ভারত এবং বাংলাদেশের সাড়ে বাষট্টি কোটি নরনারী। এ দু’টি রাষ্ট্রের বন্ধুত্বের বুনিয়াদ পরস্পর বুকে পাঁজরে গড়া এবং শহীদের তাজা রক্তে সিঞ্চিত। এ বন্ধন অক্ষয় এবং ভবিষ্যতের অপরূপ আলোকে ভাস্কর। স্বাগত সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাগত তার রাহুমুক্ত জনতা এবং স্বাগত তার সরকার। জয় বাংলা ।” (১৪ খণ্ডঃ ৯৫৪ পৃঃ)
-চট্টগ্রামের অবরোধ ভেঙ্গে গানবোট নিয়ে পাক-সেনারা পালাবার চেষ্টা করে। আমাদের নৌ-বাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ এদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং দখল করে নেয়। উপকুলবর্তী এলাকায় পাকিস্তানী সৈন্য সমাবেশ, পরিবহনের নিমিত্ত ব্যব্বহৃত গাড়ী এবং কামানের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালানো হয়।
-পাকিস্তানী জাহাজগুলো নিরপেক্ষ দেশের জাহাজের ছদ্মবেশ ধরে পালাবার প্রচেষ্টা করে। প্রতিটি জাহাজকে থামিয়ে এবং অনুসন্ধান চালিয়ে তাদের সব প্রচেষ্টা ভারতীয় নৌবাহিনী বানচাল করে দেয়। ( দ্যা ষ্টোরী অব ডিফেন্স/৭৩)
হেলিকপ্টারে প্রেরিত মিত্রবাহিনী সিলেটে পাকসৈন্য ছাউনী অবরুদ্ধ করে। যুগপৎ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ডিভিশন আখাউড়া, ব্রাক্ষণবাড়ীয়া, আশুগঞ্জ, নরসিংদী ও ঢাকা সীমানায় আক্রমণ চালায়। অন্য আর একটি ডিভিশন মিত্রসৈন্য সোনামুরা, ময়নামতি, চান্দিনা, দাউদকান্দি, ঢাকা এবং চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, মুজাফফরগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর সীমানায় দ্বিমুখী আক্রমণ পরিচালনা করে।
-মিত্রবাহিনীর অভূতপূর্ব কৃতিত্ব। রাতের অন্ধকারে মেঘনা নদীর ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারে করে সৈন্য পারাপার। ভারতীয় বিমান বাহিনীর এ এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। এক দিনে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের সময়টুকুর ভেতর ভারতীয় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো মেঘনার ওপর দিয়ে ১২৭০ জন সৈন্য আর ৪০ টন সাজ সরঞ্জাম পারাপার করে। সব মিলে এর পরিমাণ ৩০০০ জন সৈন্য এবং ১০০ টন সাজ সরঞ্জাম।
-যশোর মুক্ত হবার পর বিদেশী সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে কিসিং আরকাইভ লিখেছেঃ
“Western Journalist who visited Jessore described the tumultuous welcome which the Indian forces received the Bengali population, and gave detail of the ordeal to which the civilian population in the town had been subjected since April. AN Italian missionary told reporters that during the week April 4-10 the streets and houses had been full of bodies of residents executed in had around Jessore. Which normally has a population of about 60,000? Over half of the population included almost women, had fled to the country side or to India during the occupation by the Pakistan Army; the Hindu community and disappeared, and many of the houses in the empty Hindi Quarters had been demolished.”
(K.C.A.PP.25054)
আট নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোট চাঁদপুর থেকে গত দু’দিন অগ্রসর হয়ে ঝিনাইদাহ দখল করে। ঝিনাইদাহ যুদ্ধে মেজর মুস্তাফিজ আহত হন।
এদিকে যশোর দখলের পর লেঃ আখতার কালীগঞ্জের দিকে এবং লেঃ অলীক কুমার গুপ্ত ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হয়। মিত্রবাহিনী খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। রূপদিয়া ও নোয়াপাড়া দখলের পর শিরমনিতে যুদ্ধ শুরু হয়।
-৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাক সামরিক বেসামরিক গভর্নর মালিকের সঙ্গে জেনারেল নিয়াজীয় বৈঠকটি ছিল একটি অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা। গভর্ণর ডাঃ মালিক বলেন, একজন জেনারেলের জীবনে ওঠানামা আছে। যশ এক সময় তাঁকে আচ্ছাদিত করে, আরেক সময় পরাজয় তার মর্যাদাকে ধুলিসাৎ করে। যে মুহূর্তে ডাঃ মালিক তাঁর বক্তব্যের শেষাংশ উচ্চারণ করেন সেই মুহূর্তে জেনারেল নিয়াজী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তিনি দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন এবং শিশুর মোট ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
(উইটনেস টু সারেন্ডার/ সিদ্দিক সালিক পৃঃ ১৯২)
-বিকেলে ঢাকায় সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর যৌথ বাহিনীর বিমান হামলা। ঢাকায় পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত বিকাল ৫টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি। নিস্প্রদীপ অব্যাহত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অর্থনৈতিক সাহায্য বাতিলে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।
-পাক-প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করার জন্য নুরুল আমিন ও জেড এ ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নুরুল আমিনকে প্রধামন্ত্রী ও জেড এ ভুট্টোকে ভাইস প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদে শপথ নেয়ার আমন্ত্রণ জানান।
-যৌথ বাহিনীর চান্দিনা ও জাফরগঞ্জ অধিকার। কুমিল্লা ও কালসামে প্রচণ্ড যুদ্ধ। বিয়াক্লে বগুড়া-রংপুর সড়কের করতোয়া সেতু দখল নিয়ে পাকিস্তান ও যৌথ বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। ভুরুঙ্গামারী মুক্ত।
-নয়াদিল্লী থেকে ইউ এন আই সংবাদ সংস্থা পরিবেশিত এক সংবাদে জানান হয়, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মৌলানা আসানী আজ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জঙ্গীশাহীর কার্যকলাপকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে নিন্দা করেন। তিনি বলেন, ‘ আমাদের দেশের নিরপরাধ জনসাধারণের প্রতি এই নির্যাতন। সরকারী চীনা-নীতি ইয়াহিয়া প্রশাসনকে সমর্থন করার তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, চীন অত্যাচারকে ঘৃণা করে। অথচ সেই চীনই এ ব্যাপারে চুপ করে আছে। এ বড়ই দুঃখের বিষয়।” (আঃ বাঃ পঃ ৮/১২/৭১)
নবম সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর লেঃ হুদার নেতৃত্ব এবং অষ্টম সেক্টরে সৈন্যরা (মুক্তিবাহিনী) ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্ব সাতক্ষীরা দখল করে। (১০ খঃ ৭৬১ পৃঃ)
-ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহি, ফ্লাইং অফিসার কালাম ও লেঃ নুরুন্নবী কুষ্টিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মেজর আযম চৌধুরী দুই কোম্পানী সৈন্য নিয়ে ৬ ডিসেম্বর মেহেরপুর দখল করে ও ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা শত্রুমুক্ত করেন। (১০ খঃ ৭৬১ পৃঃ)
-৭ ডিসেম্বর খান এ, সবুরের নেতৃত্বে শান্তি কমিটির নেতৃত্ববৃন্দ একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ১০ ডিসেম্বর এই পরিষদ সাফল্যের সাথে ভারতীয় হামলা প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করে। এরপর কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যকলাপের আর কোন উল্লেখযোগ্য বিবরণ কোথাও পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, হানাদার বাহিনীকে সহয়তা করার জন্যে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল এপ্রিল মাসে।
-মার্কিন সরকারের ভূমিকা সম্বন্ধে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির তীব্র সমালোচনা এবং হেনরী কিসিঞ্জারের সাংবাদিক সম্মেলনে সিনেটর কেনেডীর সমালোচনার প্রত্যুত্তর বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। (কিসিং কন্টেম্পরারী আর্কাইভস)। এদিন সন্ধ্যায় মুক্তিবাহিনী মিত্র বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে ১১ গুর্থা রেজিমেন্ট আর কে মজুমদার নেতৃত্বে এবং মুক্তিবাহিনীর মেজর আইন উদ্দিনের ডনতৃত্বে সীমান্ত অতিক্রম করে তিনদিক থেকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এক দলের নেতৃত্ব দেন লেঃ দিদারুল আলম বিবিরবাজার পথে, অন্য দুটি দল গোমতি নদী অতিক্রম করে ভাটপাড়া এবং চৌদ্দগ্রামের বাঘের চির দিয়ে। রাতেই মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর হাতে কুমিল্লার বিমান বন্দরে পাক-সেনাবাহিনীর ঘাঁটি পতন হয়। প্রত্যুষ মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা শহরের চক বাজারে প্রবেশ করে। কুমিল্লা সেনানিবাস দখল নিয়ে তখন প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী