You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৬ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ শুক্রবার ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১

[মাত্র দু’ঘন্টার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্ৰী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা এসেছিলেন একমাত্র কর্মসূচী বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জন সভায় ভাষণ দান। আসলে ৪ ডিসেম্বর তাঁর কলকাতা আসার কথা ছিল। জনসভার উদ্যোক্তারাও সেইমত পোষ্টার দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১ ডিসেম্বর দিল্লী থেকে প্রচারিত হল যে, ইন্দিরাজী তাঁর কলকাতার কর্মসূচী একদিন এগিয়ে দিয়েছেন। কৌতুহল আরও বাড়ল। বাংলাদেশ সরকার, শরণার্থী, বিদেশী সাংবাদিকরা প্রশ্ন তুললেন, তাহলে কি কলকাতায় শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবেন? বিদেশী সাংবাদিকদের অনেকেরই তখন অভিমত ভারত প্রথম যুদ্ধটা শুরু করবে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, নভেম্বর ২০ থেকে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী একসাথে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যশোহর, রংপুর সেক্টরে লড়াই করছিল।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এলেন, ভাষণও দিলেন, নতুন কোনও চমকপ্রদ কথা বলেননি, দেননি কোনও রণহুঙ্কার- নেই যুদ্ধ শুরু করা বা বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথাও। স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম জনসভা হল ব্রিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডের জনসভা। ভাষণদান কালে একটি চিরকুট শ্রীমতী গান্ধী হাতে পেয়েছিলেন, ক্ষণিক থামলেন তারপর কয়েক মিনিটে বক্তব্য শেষ করেন। রাজভবনেই প্রথম খবরটা পেলেন তিনি। পাকিস্তান লড়াই শুরু করে দিয়েছে। দিল্লী ফিরেই প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী গান্ধী একে একে সব ব্যবস্থা নিলেন। কথা বললেন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে। ডাকলেন মন্ত্রীসভার বিশেষ বৈঠক। আকাশবাণী দিল্লী কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দেয়া হল। প্রধানমন্ত্ৰী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ভারতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন। সারা বিশ্ব যখন গভীর ঘুমে তখন একটি স্বাধীন জাতির অভ্যুদয়-মুহুর্তে স্বাগত জানালেন তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) অনাগত রুদ্রকে] – লেখক।

শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে ডিসেম্বর ৩।৪ মধ্যরাত্রিতে আকাশবাণীতে প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে বলেনঃ

“I SPEAK To you at a moment of grave peril to our country and to our people. Some hours ago, soon after 5.30 p.m. on December 3, 1971, Pakistan launched a full-scale war against us. The Pakistani Air Force suddenly struck at our airfields in Amritsar, Pathankot, Srinagar, Avantipur, Uttarlai, Jodhpur, Ambala and Agra. Their ground forces are shelling our defense positions in Sulaimanki, Khemkaran, Poonch and other sectors.

Since last March, we have bronc the heaviest burden and with stood the greatest pressure, in a tremendous effort to urge the world to help in bringing about a peaceful solution and preventing the annihilation of an entire people, whose only crime was to vote for democracy, but the world ignored the basic cause and concerned itself only with certain repercussions. The situation was bound to deteriorate and the courageous land of freedom fighters have been staking thcir all in dcfcnce of the values, for which we also have struggled, and which are basic to our way of life.

Today the war in Bangladesh has become a war on India. This has imposed upon me, my Government and the people of India great responsibility. We have no other option but to put our country on a war footing. Our brave officers and jawans are at their post mobilized for the defense of the country. An emergency has been declared for the whole of India. Every necessary step is being taken, and we are prepared for all eventualities.

Aggression must be met, and the people of India will mcct it with fortitude and determination and with discipline and utmost unity.”

শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রদত্ত ভাষণের বাংলা রূপান্তর :

“দেশ ও জনগণের একটা বিরাট বিপদের মুহূর্তে আমি আপনাদের সামনে কথা বলছি। কয়েক ঘন্টা আগে ৩রা ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে পাঁচটার পরই পাকিস্তান আমদের বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধ শুরু করেছে। পাকিস্তানী বিমানবাহিনী আকস্মিকভাবে অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্ৰীনগর, অবন্তীপুর, উত্তরলই, যোধপুর, আম্বালা ও আগ্রায় আমাদের বিমানঘাঁটির উপর আঘাত হেনেছে। তাদের স্থল বাহিনী সালাইমানকী, খেমকারন, পুঞ্চ ও অন্যান্য সেক্টরে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর শেল নিক্ষেপ করেছে।

গত মার্চ থেকেই আমরা বিরাট বোঝা বহন করেছি। একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার জন্যে এবং শুধুমাত্র গণতন্ত্রের পক্ষে ভোট দেয়ার অপরাধে একটি জাতির সমগ্র জনতাকে ধ্বংস করা থেকে নিবৃতি করার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যে আমরা বারবার বিশ্বের কাছে আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু মৌলিক কারণকে অবজ্ঞা করে বিশ্বের দেশগুলো শুধু কতিপয় নির্দিষ্ট বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এতে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে বাধ্য। সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মূল্যবোধকে রক্ষার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে যাচ্ছিলেন। এটা সেই মূল্যবোধ যার জন্যে আমরাও সংগ্রাম করেছিলাম, যে মূল্যবোধ আমাদের জীবনপথের মূল আদর্শ।

আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এই যুদ্ধে আমার সরকার ও ভারতের জনগণের উপর বিরাট দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। দেশকে যুদ্ধের মোকাবেলা করার জন্যে তৈরী করা ছাড়া আমাদের জন্য আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই। আমাদের জোয়ান ও অফিসারদেরকে দেশের প্রতিরক্ষার জন্যে সীমান্তে পাঠানো হয়েছে। সমগ্র ভারতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা সবরকম আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত।

আক্রমণের মোকাবেলা করতে হবে, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও অনড় ঐক্যের সাথে ভারতের জনগণ এই আক্রমণের মোকাবেলা করবে।”

ভারতে জরুরী আইন জারী হ’ল। সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্তধারা। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কম্যাণ্ড দুর্বার বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইয়ে। গভীর রাতে পূর্ণাঙ্গ লড়াই শুরু হয়। চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশে দখলদার পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করল ভারতীয় সৈন্য, বিমান এবং নৌবাহিনী। আর মুক্ত এলাকা থেকে যোগ দিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রথম সার্থক হামলা করলো রাত ১১-৩০ মিঃ গোদনাইল (নারায়ণগঞ্জ) ও চট্টগ্রামের দুটি ফুয়েল পাম্প শোচনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এরপর থেকেই সম্মিলিত ভারত-বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণে তেঁজগাও বিমানবন্দর, কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়। আক্ৰমণ চলল চট্টগ্রাম, চাদপুর, কুমিল্লা ও কক্সবাজার প্রভৃতি এলাকায়। চট্টগ্রাম বিমান বন্দরের কর্মক্ষমতা অর্ধেকটাই ধ্বংস হয়ে গেল। বন্দরের তেলের ডিপোগুলোও জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীই আক্রমণের সুচনা করে। পরবর্তী ১৮ ঘন্টায় বাংলাদেশ-ভারত মিত্র বিমানবাহিনী লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত হেনে হানাদার পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে পঙ্গু করে দেয়।

ভারতীয় বিবান ঝাঁকে ঝাঁকে মোট ১৭০ বার কুর্মিটোলায়, তেজগাঁ, যশোহর, লালমনির হাট, কুমিল্লা সহ বাংলাদেশের সকল বিমান ক্ষেত্রের উপর আক্রমণ চালায়। এই বিমান আক্রমণে পাক বাহিনী ১০টি এফ ৮৬ স্যাবর জেট (তন্মধ্যে ঢাকায় ৪টি যশোহরে ৩টি লালমনিরহাটে ৩ টি আকাশ যুদ্ধে ভূপাতিত হয়।) ৩টি পর্যবেক্ষণ বিমান ও একটি টারবোপ্রুফ বিমান সহ মোট ১৪টি পাক বিমান ভূপাতিত হয়। বোমাবর্ষণে রানওয়েতে গোটা কতক ছোটখাট পুকুর তৈরী হয়ে গেল। কুর্মীটোলায় ৫০ টন বোমা বৰ্ষণ করা হয়।

এ দিন (৩ ডিসেম্বর বিকেল ৫-৩০মি: কলকাতার প্যারেড গ্রাউণ্ডে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তৃতা দানকালে খবর পৌঁছে কোন প্রকার আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই পাকিস্তান বিমানবাহিনী আচমকা ভারতের আগরতলা, অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্ৰীনগর, অবন্তিপুর, উত্তরলাই, যোধপুর, আম্বালা এবং আগ্রা বিমান ঘাটিসমূহের ওপর আক্রমণ চালায়। উল্লেখ্য, শ্ৰীমতী গান্ধী জনসভায় শরণার্থী সমস্যা, আন্তর্জাতিক সাহায্য নিয়ে বক্তব্য রাখেন। তাঁর কটি কথা ইঙ্গিতবহ ছিলঃ “We are doing only what is proper and in our interest …An Army must fight to be victorious …It is a testing time for our country but I am confident that we shall succeed..”

ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সমস্ত পাক অধিকৃত বন্দরে অবরোধ করে জলপথে সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। আক্রমণের প্রথমেই পাকবাহিনীর সাবমেরিন গাজীকে বঙ্গোপসাগরে সলিল সমাধি ঘটায়।

পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে পিআই এ ফ্লাইট বাতিল হয়। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সন্ধ্যা আইন জারি ও নিম্প্রদীপ পালনের নির্দেশ জারী করা হয়।

ঢাকার গভর্নর ডাঃ এ এম মালেকের বেতার ভাষণ।(সংবাদপত্র)।

পিপলস পার্টি চেয়ারম্যান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে প্রেরিত এক জরুরী বার্তায় বলেন, তাঁর দল একজন পূর্ব পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী সহ সহকারী প্রধানমন্ত্রীর পদ নিতে রাজী আছেন। যদি এ প্রস্তাব গৃহীত হয় তবে আগামীকালই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করা যেতে পারে। (সংবাদপত্র)

পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম রাওয়ালপিণ্ডিতে বলেন কোয়ালিশন দলের প্রধান নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হলে তার কোন আপত্তি নেই। কেননা বাংলাদেশ ‘তামাশা’ বন্ধ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা উচিত।(সংবাদপত্র)।

পাকিস্তান সফররত মার্কিন সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি রাওয়ালপিণ্ডিতে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে বলেন, তিনি বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সাক্ষাত করতে পারেননি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা হয়। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাত করার জন্য পুনরায় পাকিস্তান আসতে রাজি রয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনার সময় তাকে জানানো হয়, দেশের অখন্ডতা রক্ষার জন্যই পাকিস্তানকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং নয়াদিল্লীতে পার্লামেন্ট ভবনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতে মার্কিন অশ্ব চালানের লাইসেন্স ও ইতিপূর্বে পেশকৃত অস্ত্রের অর্ডার বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি বলেন বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর নির্যাতন বন্ধ করার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য ভারত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু সে প্রচেষ্টার কোনো সুফল হয়নি। বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমনে ও ভারত সীমান্তে পাকিস্তানী গোলাবর্ষণে ভারতের নিরাপত্তা বিপদসংকুল হয়ে পড়েছে।

৩ ডিসেম্বর ভারতীয় পুর্বাঞ্চল কমাণ্ডের লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ ভারত যুক্ত কমাণ্ড| ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী হল মিত্র বাহিনী। দখলদার পাকবাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধে রত বাংলাদেশ সশস্ত্র (নিয়মিত বাহিনী) ও মুক্তি বাহিনী মিত্র বাহিনীর সহায়তায় নিম্নোক্ত রুট সমূহে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

মিত্র বাহিনীর নবম ডিভিশন গরীবপুর-জগন্নাথপুর হয়ে যশোহর ঢাকা মহাসড়কের পথে। চতুর্থ ডিভিশন মেহেরপুরের পাশ দিয়ে কালীগঞ্জ ঝিনাইদহের দিকে। বিংশতিতম ডিভিশন দিনাজপুরের হিলিকে উত্তরে রেখে পূর্বদিকে। ষষ্ঠ ডিভিশন তেঁতুলিয়া থেকে ঠাকুরগাঁ, পাটগ্রাম থেকে কালিগঞ্জ এবং কোচবিহার থেকে নাগেশ্বরী কুড়িগ্রাম অভিমুখে। উত্তরে মেঘালয় থেকে দুটো ব্রিগেড ডালু থেকে জামালপুর এবং হলুয়াঘাটের দিকে। পূর্বদিকে অষ্টম,সাতা, এবং তেইশ নং ব্রিগেড সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট, হবিগঞ্জ থেকে মৌলভীবাজার এবং আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হয়। তেইশ নং ডিভিশন কুমিল্লা ও ময়নামতির পাশ কাটিয়ে দাউদকান্দির দিকে এবং চৌদ্দগ্রাম থেকে লাকসাম ও চাঁদপুরের দিকে এবং আর একটি বাহিনী পূর্ব দিকে বেলোনিয়া থেকে ফেনীর দিকে এগিয়ে যায়। উল্লেখ্য, গভীর রাতেই মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্ত এলাকায় অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয়। তারপর অমানিশার অবসানের যাত্রাপথে উদয়ের বাণী নিয়ে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যোদয় জাতির মানচিত্রে স্থান পেতে থাকে। ২৫শে মার্চের পর থেকে ২৬৭ দিনের অশ্রু রক্তস্বেদ দিয়ে লেখা ইতিহাসের চুড়ান্ত পর্ব শুরু হল।

মুক্তি বাহিনীর সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, যশোহর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, জেলার আরও কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনী গতকাল দখল করে নিয়েছে। গেরিলা আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পাকফৌজ যশোহর শহর থেকে সরিয়ে নাইন ডিভিশনের হেড কোয়ার্টার মাগুরা শহরে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। গেরিলারা লালমনিরহাট বিমানবন্দর বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। রংপুরের নাগেশ্বরী থানা দখল করে তাঁরা এগিয়ে এসে চারদিক থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখল করে।

রঙ্গিন হিন্দি ছবি ‘জয় বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের সংগ্রামের পটভূমিতে নির্মিত পরিচালনা ও প্রকাশনা করেছেন আই এস জোহর। বাংলাদেশের নায়িকা কবরী চৌধুরী এ ছবিতে অভিনয় করেন। এ সপ্তাহের কলকাতায় একমাত্র নতুন ছবি ছিল এটাই।

পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনীর ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল, তা হলোঃ

এক) পাকিস্তান বিমান বাহিনীকে যথা শীগগির নিষ্ক্রিয় করে দেয়া।

দুই) ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যদ্দুর সম্ভব কাছ থেকে সহায়তা করা এবং

তিন) সেনাবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করবার জন্যে পরিবহণ কর্যে সহায়তা প্রদান।

[যুদ্ধ ঘোষণার পর মিত্র বাহিনীর বিমান বাহিনী ও বাংলাদেশ বিমান বাহিনী এ দায়িত্ব পরিপূর্ণ দক্ষতার সাথে সম্পাদন করেছেন। (দ্য ষ্টোরী অব ডিফেন্স, ১৯৭৩)]

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন সরকার যে তৎপরতা চালিয়েছিলেন তা বিলম্বে প্রকাশিত হয়। হোয়াইট হাউজে ওয়াশিংটন স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপ (ডাব্লিউ এ এস জি) নামে একটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গ্রুপ গঠন করা হয়। পররাষ্ট্র প্রতিরক্ষা ও সি আই এর পদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে এই গ্রুপ গঠিত হয়। প্রতিদিন তারা বৈঠকে বসতেন। ৩ ডিসেম্বর এই গ্রুপ জরুরী বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। [হেনরী কিসিঞ্জার, এইসব দিনগুলি নিয়ে গ্রন্থ লিখেছেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক এণ্ডারসন তার ‘এণ্ডারসন পেপারস’-এ অনেক তথ্যের সন্ধান দেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যবহৃত তথ্যাদি সংযুক্ত করা হয়েছে- লেখক।]

ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থীদের সংখ্যা ছিল নিম্নরূপঃ

আসামে ৩ লক্ষ ১৩ হাজার

বিহারে ৯ হাজার

মেঘালয়ে ৬ লক্ষ ৮৮ হাজার

ত্রিপুরায় ১৪ লক্ষ ১৩ হাজার

পশ্চিমবঙ্গে ৭৪ লক্ষ ৯৩ হাজার

মোট ৯৮ লক্ষ ৯৩ হাজার

*(জাতিসংঘ তথ্য ও ভারত সরকারের পরিসংখ্যান থেকে গৃহিত)

পাক বিমানবাহিনী কর্তৃক ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি আক্রমণের সম্ভাব্য কারণ বিশ্লেষণ করে কিসিং কন্টেমপরারি আরকাইভ লিখেছেঃ

“The Pakistani attack, it was believed, had three main aims; to reduce the pressure on the forces in East Pakistan by creating a diversion in the west to occupy territory in Kashmir and Rajsthan which could be used as a bargaining counter to negotiate a Settlement in East Pakistan, and to secure he intervention of the great powers or the Security Council. The following reasons for ihc timing of the attack was suggested;

(1)boring operations on the right of Dec.3 were facilitated by a full moon;

(2) the Indians would not expect the Pakistanis to attack on a Friday, the

Mosley Sabbath;

(3) if the offensive in Kashmir were delayed operations would

be hindered by snow. (KCA PP. 25053)

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাক বাহিনীর ১৪ ডিভিশনে কেবল ৪টি পদাতিক ডিভিশন ছিল। ২৮ মার্চের মধ্যে নবম এবং ষোড়শ ডিভিশন দুটি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়। তারপর আরো দুটি ডিভিশন গড়ে তোলা হয় ৩৬ এবং ৩৯ অস্থায়ী ডিভিসনের নামে। এবং অস্থায়ী ডিভিশনগুলোর সাথে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে ছিলো গোলন্দাজ ও ভারী মর্টার বহর এবং ট্যাংক বহর। আমেরিকান শ্যেফি ট্যাংক ছিল ৬০ টি। বিমানবাহিনীতে ২০ খানি এফ-৮৬ স্যাবর জেট এবং নৌবাহিনীতে ছিল অজ্ঞাত সংখ্যক গানবোট এবং অন্যান্য উপকূলীয় নৌযান।(১০ম খণ্ড পৃ. ৩৯)

ভারত তার ৭টি পদাতিক ডিভিশনকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার জন্য নিয়োজিত করে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৭টি জঙ্গী-বোমারু বিমানের স্কোয়াড্রনকেও নিয়োজিত করা হয়। এ ছাড়া ছিল সৈন্য পরিবহণের জন্য কিছু সংখ্যক হেলিকপ্টার। বিমানবাহী জাহাজ আই এন এস বীক্রান্ত সহ ইষ্টার্ন ফ্লীটের অন্যান্য জাহাজ।

যে কোন আক্রমণ পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করতে প্রতিটি অত্মরক্ষাকারী সৈনিকের বিরুদ্ধে তিনজন আক্রমণকারী নিয়োগ করতে হয়। পূর্বাঞ্চলে ভারত কিন্তু সেই অনুপাতে পাকিস্তানের চাইতে শক্তিশালী ছিল না। অনুপাত যেখানে ৩:১ হওয়া দরকার, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনামুলক অনুপাত ছিল ২:১। ইষ্টাৰ্ণ কমাণ্ডের লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ৭টি ডিভিশন পেয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর সমগ্র বাহিনী তাঁর সহযোগিতায় প্রস্তুত ছিল। এর মধ্যে নিয়মিত ব্রিগেডগুলো ছিল কে ফোর্স, এস ফোর্স এবং জেড ফোর্স। ৯টি সেক্টরের ২০ হাজার নিয়মিত বাঙ্গালী সেক্টর ট্রুপস অস্ত্রহাতে প্রস্তুত। তা ছাড়া ছিল বাংলার একলাখ দামাল মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা। তারা সর্বত্র শত্রুকে তখন তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল। সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের জন্য তারা তৈরী হয়েছিলেন।

“যে ভাবেই হোক ইয়াহিয়া চক্রের মাঝে এ বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ততঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোধকল্পে তার সামরিক শক্তির সম্ভার নিয়ে যুদ্ধ বিরতি এবং পূর্বতন স্থিতাবস্থা কায়েম করার জন্য তৎপর হয়ে উঠবে। কার্যক্ষেত্রেও ঘটেছিল তাই। ফলে মার্কিন প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার জন্য পাল্টা আন্তর্জাতিক শক্তির সমাবেশ অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে।”(মূলধারা ৭১ পৃঃ ১৯৮)

৫৪৬

উল্লেখ্য এ সময়ের ঘটনা বিশ্লেষণে ‘দি হোয়াট হাউস ইয়রস’ ‘দি মেমোরিস অব প্রেসিডেন্ট নিক্সন’এবং এণ্ডারসনস পেপারস বর্ণিত তথ্যাদিতে গবেষকগণ উপজীব্য বিষয়ের তথ্য পাবেন।

পশ্চিম খণ্ডে আক্রমণ করার দুই ঘন্টা আগেই পূর্ব খণ্ডে আগরতলায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী হামলা করে। এ প্রসঙ্গে কিসিং কন্টেম্পরারী আরকাইভস লিখেছেঃ

“Two hours before the Pakistani air raids in the West, Pakistani aircraft attacked the air fieid at Agartala on Dec. 3. for the second consecutive day. Indian troops which had criscrossed the Border on Dec. 2 forced the Pakistanis to withdraw artillery which had been shelling the town for the past three days.” (KCA. PP. 25053)

এদিন লণ্ডনে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় ভারতকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ভারতের পাঞ্জাব এলাকায় একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে চরমপন্থী শিখদের সমর্থন করবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে। গতকাল (২ ডিসেম্বর) লণ্ডনে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে চরমপন্থী শিখ নেতা ডাঃ জগজিৎ সিং চৌহান উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ করে বলেন, ইয়াহিয়া খান কর্তৃক পাকিস্তানের অন্তর্গত নানকানা সাহেব থেকে একটি বেতার কেন্দ্র এবং লাহোর এবং রাওয়ালপিণ্ডি থেকে নতুন একটি যাত্রীবাহী বিমান প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি দেয়া হবে। এর ফলে পাক-ভারত সীমান্ত বিরোধে শ্ৰীমতী গান্ধী কর্তৃক অনুসৃত নীতি ব্যাহত হবে বলে ডাঃ চৌহান মনে করেন। (দি টেলিগ্রাফঃ ৩ ডিসেম্বর)

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!