You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.14 | ২৭ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ মঙ্গলবার ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস - রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

২৭ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ মঙ্গলবার ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

[গভর্ণর ডাঃ মালিকের মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক চলছিল। এগারটায় মিত্র বাহিনীর বিমান পাঁচবার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে রকেট হামলা করে। ঢাকা থেকে জেনেভার বার্তা পাঠান হলো পূর্ব পাকিস্তান সরকার ও সর্ব্বোচ্চ অফিসাররা পদত্যাগ করেছেন। ভারত ও বাংলাদেশ সরকারকে যে অবিলম্বে সমস্ত ঘটনা জানানো হয়। ঢাকায় প্রচণ্ড কামান আক্রমণ চলছে। আক্রমণ চলছে বিমানে। জেনারেল নাগরার বাহিনী টঙ্গীর উপকণ্ঠে। মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে আগমনের পথে। অন্যদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তুমুল বাকযুদ্ধ চলছিল।]- লেখক

-মিত্র বাহিনীর গোলা এসে পড়ছে ঢাকা সেনানিবাসে। সে ধ্বনি ঢাকার জনমনে চৈতন্য এনে দিল। জনতা সব ছাদে। ডগ ফাইট থেকে আজ অবধি ছাদে। বিহারীদের “চীন আ গিয়্যা” আর আলবদর বাহিনীর ‘পাকবাহিনী এখন দিল্লীর উপকণ্ঠে’ জিগিরে কোন উত্তেজনা সৃষ্টি করে নি। বরং ঢাকাবাসী আতংকে ছিল; কার্ফু ও অন্ধকারাচ্ছন্ন ঢাকার বাঙালী মাত্রই বিহারী, রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের তৌহিদী তৎপরতা কখন মৃত্যু সমুপস্থিত হয়।

-নিরপেক্ষ এলাকা হোটেল ইন্টারকন আশ্রয় নিচ্ছে। বিরাট রেডক্রশের পতাকা উড়ছে হোটেলে। একটি বোমা পতন হ’ল গভর্ণর হাউজের ভবন ঘেষে-চিচিং ফাঁক হয়ে গেল। তবু দালাল মন্ত্রীরা বেঁচে গেল। এ সময় সম্পর্কে এন্ডারশন পেপারস এর মন্তব্য দেখুন।

-গভর্ণর মালিক ইস্তফা দিয়ে দৌড়ে উঠলো হোটেল ইন্টারকনে দালাল মন্ত্রী পরিষদ সহ। যাত্রাদলের অধিকারীর ভাষায় বলতে হয়-অদ্যই পূর্ব পাকিস্তানের শেষ রজনী।

-মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে এসেছে। দারুণ উত্তেজনা দালাল ও বিহারীদের মনে। তবু যুদ্ধে চলছে ঢাকার উপকণ্ঠে। মুক্তিবাহিনী ঢাকার দোর গোয়ায় পৌঁছে যায়।

-অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর রাজশাহীর নবাবগঞ্জের মরিচায় শত্রুবাহিনীর সঙ্গে প্রত্যন্ত সংঘর্ষে শহীদ হন। তাঁর দেশপ্রেম ও সমর নৈপুণ্যে পরবর্তী সময়ে (১৯৭৩) তাঁকে বীরশ্রেষ্ট উপাধি দেওয়া হয়। সাত নম্বর সেক্টরের আর একটি দল লেঃ রফিকের নেতৃত্ব মহানন্দা নদী অতিক্রম করে রোহনপুর-নাচোল আমনুরা বরাবর অগ্রসর হয়েছিল। লেঃ রশিদের নেতৃত্বে গোমস্তাপুর হয়ে নবাবগঞ্জ আক্রমণ করেছিল। ( ১০ খঃ পৃঃ ৭৬০)

-রাতের কালো অন্ধকারে রাজাকার, আলবদর, আল শামস, বাংলাদেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে। এদের মধ্যে রয়েছে সাহিত্যিক সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহম্মদ, কবি আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্‍্য, ডাঃ মোহাম্মদ মুর্তোজা, ডঃ আবুল খায়ের, নিজামউদ্দিন (সাংবাদিক), অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডঃ ফয়জুল মহী, রশীদুল হাসান, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সেলিনা পারভিন, ডাঃ আলীম চৌধুরী, ডাঃ ফজলে রাব্বী, প্রমুখ।

The Anderson Papers এর Bangladesh: Birth by fire অধ্যায়ের ২৭৭ পাতায় লিখেছেঃ “Not all of Yahya’s officials had the courage such a stand demands. As Indian air forces MIG’s “pounded Government House, Dr A.M Malik, The small, sad-eyed civilian Governor of East Pakistan, cowered in a bunker as he and his entire cabinet handed their resignation to a UN representative and asked for asylum. With the collapse of the civilian government the last semblance of civilized behari our disappeared in Dhaka. Squads of al Badar, armed Bihari irregulars, toured the city in buses and rounded up Bengali intellectuals. At gun point, doctors, lawyers, University professors, and writhers were taken from there.

Homes and driven to a swamp on the edge of the city. There they were tortured and killed….. It seemed that the Pakistani military was determined to destroy the future of Bengal.”

উল্লেখ্য, আলবদর বাহিনী জুন মাসে সৃষ্টি করা হয় রাজাকার বাহিনীর সঙ্গেই। বিহারী ও মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। শুধু মাত্র সামরিক বাহিনী এদের ট্রেনিং দিয়েছে কিন্তু এদেশের শিক্ষিত লোকেরা মদদ দিইয়েছে। মৌলবী ফরিদ আহমদের মতো অনেকে ছিল এদের পিছনে। নানান জায়গায় ছিল তাঁরা, রাজনীতিতে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সংবাদপত্রে, প্রচার মাধ্যমে ছিল অতিশয় সুপ্রতিষ্ঠিত ভাবে। এরা বিকার গ্রস্ত, বিকৃতমনা পঙ্গু কাঠমোল্লা। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এই কাঠমোল্লা বিসদৃশ উল্লফন ও কর্কশ চিৎকার থেকে থেকে বারবার শোনা গেছে। এই কাঠমোল্লারাই কখনও জানিয়েছে যে বাংলাভাষা পৌত্তলিক, কখনো বলেছে কবি নজরুল ইসলাম ঘোরত্র কাফেরম বলেছেন পয়লা বৈশাখ পালন করা মানে মুসলমানত্বের সর্বনাশ করা, বলেছে শহীদ মিনারের সামনে আলপনা আঁকলে হিন্দুদের কৃতদাস হয়ে যাবে। (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, দৈনিক বাংলা ১৬.১২.৭২)

-পরাজয় অনিবার্য জেনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাঁদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস, বুদ্ধিজীবি নিধনে মেতে ওঠে। এ রাতে ঘাতক বাহিনী শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই শিক্ষক সাংবাদিক আইনজীবি চিকিৎসক প্রকৌশলী শিল্পীসহ দুশতাধিক বুদ্ধিজীবি ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিদের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে খুন করে।

-যৌথ বাহিনী আজ নদী পথের প্রধান প্রতিবন্ধকসমূহ ডিঙিয়ে ঢাকার চারপাশে বেষ্টনি গড়ে তোলে।

-বেতার মারফত ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানকশ কর্তৃক পাকিস্তানী কমাণ্ডারদের প্রতি আত্মসমর্পনের নির্দেশ। রাত ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল ও জেনারেল নিয়াজীর বৈঠক। জেনারেল ইয়াহিয়া খান গভীর রাতে যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন।

-দুপুরে বগুড়া ব্রিগেডের আত্মসমর্পণ। মানিকগঞ্জ মুক্ত। তুরাগ ব্রিজের ওপর যৌথ বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ। সাভার মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান। ডেমরায় যুদ্ধ। রূপগঞ্জের পতন। বৈদ্যেরবাজারের নিয়ন্ত্রণ দখল। কুমিল্লা পতনের পর মুক্তিবাহিনীর চট্টগ্রাম শহর অভিমুখে যাত্রা। কক্সবাজার মুক্ত।

-পোল্যাণ্ড নিরাপত্তা পরিষদে, পূর্বাঞ্চলে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচিত গণ প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত’ মর্মে প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবে আরো বলা হয়ঃ ক্ষমতা হস্তান্তরের অব্যবহিত পরেই সমস্ত এলাকায় সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে এবং ৭২ ঘন্টার জন্য যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হবে। যুদ্ধ বিরতির প্রাথমিক পর্যায় শুরু হবার পর পরই পাকিস্তানকে তার সৈন্য প্রত্যহার করে নিয়ে যেতে হবে। ৭২ ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হবার পর পরই যুদ্ধ বিরতি স্থায়ীভাবে কার্যকর করতে হবে। পাকিস্তানী সৈন্য অপসারণ শুরু হবার পর পরই ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করতে হবে।

অবশ্য এই সৈন্য অপসারণ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব নির্বাচিত গণ প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করেই করতে হবে।

-টাঙ্গাইল ও জামালপুরের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনীর সার্বিক পতন ঘটলো। ভীত সস্ত্রস্ত শৃগালের ন্যায় ওরা ইতস্ততঃ পালাতে শুরু করলো। রাস্তায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর হাতে ওরা দলে দলে আত্মসমর্পণ করছে। যারা নির্বোধের মত প্রতিরোধের চেষ্টা করছে, তারা মৃত্যু বরণ করছে। ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এই অবস্থা চলে। পর পর মিত্র বাহিনী মুক্তি বাহিনীর শ্লোগান হলঃ “ঢাকা চল, ঢাকা চল’।

-১৪ ডিসেম্বর সকালে খবর এলো যে, পাক বাহিনীর টাঙ্গাইল সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদের খান মুক্তি বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছে। এলেঙ্গা থেকে কোন রকমে পালিয়ে কাদের খাঁ ঢাকার দিকে রওনা হয়। তার সঙ্গে ছিল দু’জন কর্নেল, তিনজন মেজর ও একজন লেফটেন্যান্ট। হয়ত তারা পালিয়ে যেতে সম্ভব হত কিন্ত রাস্তায় চারবার তার গাড়ী মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত মির্জাপুর তাকে মুক্তি সেনাদের হাতে আত্মসমর্পন করতে হয়। বন্দী হওয়ার পর কাদের খাঁ বলে যে, তার ব্রিগেডের সব সৈন্যরা এলেঙ্গা কালিহাতির মুখে ধ্বংস হয়েছে। তারি মাত্র ক’জন ঢাকায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। বাঘা-সিদ্দিকী বন্দী কাদের খাঁ ও তার সঙ্গীদের মিত্র বাহিনীর হাতে তুলে দিলেন।

-ময়মনসিংহ শহর শত্রুমুক্ত করে ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং (বাবাজী) ১৪ তারিখে মৌচাকে উপস্থিত হলেন। এখান থেকে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত শেষ জয়যাত্রা শুরু হল। তাঁদের বাহিনী তিন ভাগে বিভক্ত করে তিনটি পথে এগুতে লাগল। মিত্র বাহিনীর একটি কলাম জয়দেবপুর-টঙ্গীর রাস্তা ধরে এগুতে লাগল ব্রিগেডিয়ার ক্লিয়ার নেতৃত্ব। অপর কটি কলাম ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিংহের নেতৃত্ব চলল নয়ারহাট- সাভার সড়ক হয়ে ঢাকার দিকে। আর কাদেরিয়া বাহিনীর এক ব্যাটিলিয়ন সৈন্য বাঘা-সিদ্দিকীর নেতৃত্ব জয়দেবপুর- সাভারের মাঝখান দিয়ে মাঠ ও গ্রামের মধ্য দিয়ে মপিং আপ করতে করতে মীরপুর পুলের দিকে ছুটে চলল। পূর্ণ বিজয়ের আশায় উদ্দীপ্ত প্রতিটি প্রাণ।

দুশমনের নৈতিক বল নষ্ট হলেও মিত্র বাহিনীর অগ্রগতিতে তারা বাধা সৃষ্টি করতে কসুর করল না। কড্ডার নিকট ব্রিগেডিয়ার ক্লিয়ারের বাহিনীর উপর পাক বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ শুরু করল। ফিল্ড কামান দিয়ে তারা হামলা চালিয়ে ক্লিয়ারের বাহিনীর গতি রোধ করে, কিন্তু পরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর মিলিত আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তারা কড্ডা সেতু ধ্বংস করে অপর পারে গিয়ে ডিফেন্স নেয়।

বিগেডিয়ার সন্ত সিংও সাভার এলাকায় প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হন। এই এলাকায় সারাদিন ধরে যুদ্ধ চলে। ওদের কামানের গোলায় মাঝে মাঝে ঢাকা শহর কেঁপে কেঁপে ওঠে। কাদেরিয়া বাহিনীর ছেলেরা গ্রাম ও মাঠ পার হয়ে সন্ত সিংহের কালামের মাঝ দিয়ে মিরপুর টঙ্গীর কিছু উত্তরে অবস্থান নিয়ে বসে থাকলো। (পূর্বদেশ ১৬,১২,৭২)

-জাতিসংঘের লবি মহলে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন বিমানবাহী জাহাজ এনটার-প্রাইজকে পাঠানো নিয়ে জোর আলোচনা হয়। ওয়াল ষ্ট্রিট জারনাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই কার্যকলাপটিকে ‘পুরানো পদ্ধতি’ এবং ‘অগভীর চিন্তাপ্রসুত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। (বিবিধ এজেনসিজ)

-সাত নম্বর সেক্টরের তপন ও হামজা সাব সেক্টরের সৈন্যরা হিলিকে বগুড়া হয়ে দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। মেজর গিয়াসের নেতৃত্ব লালগোল্লা সাবসেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা পদ্মা নদী পার হয়ে রাজশাহী আক্রমণ করে। (১০ খঃ পৃ ৭৬০)

-সাত নম্বর সেক্টরের শেখপাড়া সাব সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা মেজর রশিদের নেতৃত্ব পাবনা অভিমুখে যাত্রা করে। পাক সেনারা রাজশাহী ছেড়ে নাটোর আশ্রয় নেয়। (১০ খঃ পৃ ৭৬০)

-পরিকল্পনা মত ঢাকা দখলের দায়িত্ব না থাকায় অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় উত্তর দিক থেকে এগিয়ে যাওয়া মিত্রবাহিনী যেমন সৈন্য সংখ্যা বেশী ছিল না, তেমনি ভারী অস্ত্রশস্ত্রও ছিল না। যশোহর, খুলনা, বগুড়া, রংপুর এই সমস্ত সেক্টরের প্রতিটি ভারতীয় পদাতিক বাহিনীকে গোলন্দাজ ও ট্যাংক স্কোয়াড দিয়ে সাজানো হয়েছিল। চট্টগ্রাম নোয়াখালী সেক্টরের মিত্রবাহিনীর সাথে গোলন্দাজ ও ট্যাংক স্কোয়াড ছিল আখাউড়ার দিক থেকে এগিয়ে আশা যৌথ বাহিনী ঢাকা দখল নেবেন, এটাই ছিল মূল পরিকল্পনা। আখাউড়া হয়ে ঢাকা দখলে  এগিয়ে যাবার সম্ভাবনা যে বাহিনীর আছে, সে বাহিনীকে সবচেয়ে শক্তিশালী করে গঠন করা হয়েছে। এই বাহিনী কাছে গোলন্দাজ ও ট্যাংক স্কোয়াড সহ বিশাল আকারের অনেকগুলো যুদ্ধ হেলিকপ্টার রয়েছে। আখাউড়া হয়ে যৌথবাহিণী ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া ঝটিকা বাহিনী, আখাউড়ার দিক থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীর ঢাকা পৌঁছার নির্ধারিত সময়ের ত্রিশ-চল্লিশ ঘন্টা আগে ঢাকার প্রান্ত সীমায় পৌঁছে যায়।

অস্ত্রশস্ত্র, নিয়মিত সৈন্যবল কম এবং দূরত্ব বেশী হওয়া সত্ত্বেও উত্তর দিক থেকে এগিয়ে যাওয়া যৌথ বাহিনী সবার আগে ঢাকার পাদদেশে পৌঁছে যায়। এর প্রধান কারণ কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বধীন বিশাল মুক্তিবাহিনী ঢাকার ত্রিশ মাইল উত্তর থেকে ময়মনসিংহ জামালপুর রাস্তায় উনিশটি নাগরপুরের তিনটি কুদ্দুসফারের চারটি, টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ রাস্তার পাঁচটি ও গোপালপুরের রাস্তায় একটি বড় পাকা সেতু ধ্বংস করে পাকহানাদার বাহিনীর চলার পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। এছাড়া কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে ময়মনসিংহ-জামালপুর থেকে পালিয়ে আসা সাত হাজার, টাঙ্গাইলের তিন হাজার নিয়মিত পাক হানাদার সেনাদের মধ্যে দু’হাজারের বেশী ঢাকা পর্যন্ত পিছিয়ে যেতে পারেননি। উল্লেখ্য মুক্তিবাহিনীকে ময়মনসিংহ হালুয়াঘাট, শেরপুর, কামালপুর, জামালপুর, কড্ডা ও সাভারে ছাড়া আর কোথাও পাকবাহিনীর সাথে বড় রকমের লড়াই করতে হয়নি। বীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী দুর্জয় সাহস, দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল। পাকহানাদার বাহিনীর নৈতিকতার বালাই ছিল না, মনোবলহীন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল।

-‘চীন ও আমেরিকার কেন এ পক্ষপাত’ শিরোনামের আনন্দবাজার পত্রিকার এক উপসম্পাদকীয় মন্তব্যে রনজিৎ রায় কতিপয় প্রশ্নোত্থাপিত করেছিলেন। সে সময়ের আলোতে উত্থাপিত বিষয়গুলোর গবেষক বা পাঠককে নতুন দৃষ্টিকোণের ইঙ্গিত দিয়ে থাকবে। প্রাসঙ্গিক কারণেই উত্থাপিত হলঃ

বাংলাদেশ এবং পাক-ভারতের যুদ্ধের ব্যাপারে ওয়াশিংটন এবং পিকিং একই মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হয়। তারা দুজনেই জানেঃ ভারত আক্রমণকারী নয়ঃ কিন্তু সব জেনেশুনেও তারা ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করেছে বলে অভিযোগ করেছে। পাকিস্তানের পছন্দ-মাফিক যুদ্ধ-বিরতি ঘটানোর জন্য তারা দুই বন্ধু একইভাবে চেষ্টা করেছে।

তবু ওয়াশিংটন এবং পিকিং পারস্পরিক যোগ- সাহসের মাধ্যমে অগ্রসর হচ্ছে ভাবলে বেশী ভাবা হয়। তাদের রাজনীতিক এবং সামাজিক পদ্ধতিতে পার্থক্য আমূল।… চীনের সঙ্গে ভারতের একটানা বৈরিতার সম্পর্ক আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন- উভয়েরই পছন্দ। কিন্তু এর ফলেও ভারত পেন্টাগনের খপ্পরে পা দেয়নি। অন্যদিকে আমেরিকার উপর পাকিস্তানের নির্ভরতা বাড়তেই থাকে। জটিল কূটনীতির দুনিয়ায় ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়, পাকিস্তান একদিকে ওয়াশিংটন অন্য দিকে পিকিং- এই দুই বিপরীত মেরু থেকে সামরিক এবং কুটনীতিক সহায়তা জোটাতে থাকে।

জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশে জল্লাদ-বৃত্তি শুরু করার পর পাকিস্তান আর আগের পাকিস্তান থাকার কথা কেউই ভাবতে পারছে না। ওয়াশিংটন এবং পিকিং ইসলামাবাদের প্রতি সমর্থন বজায় না রাখলে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের বন্ধুত্ব হারাবে; অথচ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার ক্ষতি পূরুণ হবে না। সে রকমটি হলে ইসলামাবাদ তখন হয়ত ওয়াশিংটন এবং পিকিং প্রতিশ্রুতি রাখছে না দেখে তাঁদের ছেড়ে মস্কোর দিকেই ঝুঁকবে।

ওয়াশিংটন এবং পিকিং এর লক্ষ্য মুখ্যত রাজনীতিক। ঐ লক্ষ্য পূরণের জন্য তারা নয়াদিল্লীর উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। সপ্তম নৌবহরের অভিযান সেই ইঙ্গিতই দেয়।

ভারত বিশ্ব জনমত লংঘন করেছে বলে আমেরিকা চেঁচামিচি করছে। কিন্তু জনমতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এবং দীর্ঘ মাস ধরে বাংলাদেশে পাশবিক নিষ্ঠুরতা চালিয়ে ইয়াহিয়া যে বিশ্ববাসীর ঘৃণা কুড়াচ্ছে-ওয়াশিংটনের সে কথাটাও এতদিনে উপলব্ধি করা উচিত ছিল। সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীকুজনেৎসভের দিল্লী অবস্থানকালে কূটনীতিক মহল থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা যাচ্ছে যে, তলে তলে আমেরিকা এবং চীনও একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে  মেনে নিতে শুরু করেছে। একটি সমগ্র জাতি বিদ্রোহী হয়ে উঠলে দীর্ঘকাল যে কোন জঙ্গী প্রশাসন টিকে থাকতে পারে না-সে কথাটাও তাঁরা বুঝতে শুরু করেছেন বলে ঐসব সূত্রে জানা যাচ্ছে।

যতদিন বাংলাদেশ যুদ্ধ শেষ না হচ্ছে এবং সেখানে পাকিস্তানী বাহিনী সম্পূর্ণ পরাজিত না হচ্ছে ততদিন ভারত অসুবিধাজনক অবস্থায় চলতে থাকবে। কিন্তু ঢাকায় একবার মুক্তি বাহিনীর পতাকা উড়লে শুধু অন্যান্য দেশ কেন, ওয়াশিংটন এবং পিকিংও বাংলাদেশকে মেনে নেবে।

অবশ্য তাঁরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে কালক্ষেপ করতে পারে।

স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছে কি না ওয়াশিংটন এবং পিকিং বর্তমানে সে প্রশ্নে খুব চিন্তিত নয়, ভারত পশ্চিম পাকিস্তান প্রবেশ করে শক্তির দ্বারা কাস্মীরে যুদ্ধবিরতই সীমারেখা নতুন করে নির্ধারণ করতে চলেছে কিনা সে সম্পর্কে তাঁরা বেশী চিন্তিত। মস্কোও এরকম প্রলোভনের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লীকে হুশিয়ার করে দিয়েছে।

-পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগি চরম দক্ষিণাপন্থী উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিষ্ট গেষ্টাপো আল-বদর বাহিনীর ঘাতকের ঢাকা শহরে যুদ্ধ ও কারফিউ মধ্যে ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে খুঁজে খুঁজে সেরা বাঙালী অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের রায়ের বাজার ও মিরপুর অবাঙ্গালি অধ্যুষিত এলাকায় নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। উল্লেখ্য পাক সামরিক অফিসারদের আদেশ ও জঘন্য হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হলেও এ হত্যার পরিকল্পনা ও তালিকা প্রণয়ন, আত্মগোপনকারী বুদ্ধিজীবিদের খুঁজে বের করা, তাঁদের ধরে নিয়ে নৃশংস অত্যাচারের মধ্য দিয়ে হত্যা করার কাজটি আল-বদর ও রাজাকার বাহিনীর বাঙালী সদস্য ও তাঁদের নেতাদের দ্বারা সম্পন্ন হয়।

-আলবদর বাহিনীর সদস্যদের জীপে ই, পি, আর, টি, স্যার বাসে হলুদ কাপড়ে লাল কালিতে লেখা। পাকিস্তানী বাহিনী দিল্লীর উপকণ্ঠে চলে গেছে এবং মাইকে তৌহিদী আহবান জানান। হিন্দস্থানের নাম পৃথিবী থেকে মুছে ফেলা হবে প্রভৃতি শ্লোগান দেয়। ওদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল বলে এক সাক্ষাৎকারে মিটফোর্ডের জনাব মনসুর হোসেন (বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক) লেখককে জানিয়েছেন। ঢাকার শূন্য ঘরবাড়িতে পশ্চিম পাকিস্তানের পুলিশ মিলিশিয়া বাহিনী আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আঁধারে ঢাকা ঢাকায় বিহারী হামলায় আশংকায় প্রতিটি বাঙালী পরিবার সত্রস্ত্র হয়ে ছিল। প্রতিটি রাতেই ভয়াবহ আতংকের রাত ছিল ঢাকায়। এ কথা লেখককে বললেন জনাব আব্দুর রহিম (বাদশা), পাঁচভাই ঘাট নিবাসি।

-সায়গন থেকে নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতা জানিয়েছেন যে, সপ্তম নৌবহরের পারমানবিক শক্তি পরিচালিত মার্কিন বিমানবাহী জাহাজ “ এণ্টারপ্রাইজ” অন্য কয়েকট জাহাজ ও ডেস্ট্রয়ার সহ শুক্রবার সায়গনের দরিয়া থেকে ভারত মহাসাগরের উদ্দেশ্য যাত্রা করেছে।

-ওয়াশিংটনের এক খবর উদ্ধৃত করা নিউইয়র্ক টাইমস বলেন, সোভিয়েত রাশিয়া ভারত মহাসাগরে তার নৌশক্তিকে আরো শক্তিশালী করছে বলে জানা গিয়েছে। এন্টারপ্রাইজ জাহাজটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব চেয়ে বড় বিমানবাহী জাহাজ।

-ভারত সরকারের জনৈক মুখপাত্র বলেন, বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। সপ্তম নৌবহর যাত্রা করে থাকলে মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্যেই তা করা হচ্ছে। মার্কিন নাগরিকদের ঢাকা থেকে উদ্ধারের জন্য পারমানবিক শক্তি পরিচালিত জাহাজের প্রয়োজন পড়ে না। তারা হয়ত ইতিমধ্যেই ঢাকা পরিত্যাগ করেছে।

-ইউ এন আই পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশঃ ঢাকার গভর্ণর হাউজ ও অন্যান্য কয়েকটি লক্ষ্যস্থলে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা আগুল জ্বলছে। গভর্ণর হাউজ ডাঃ এম এ মালিক, তাঁর মন্ত্রী পরিষদ ও উর্দ্ধতন আসামরিক কর্মকর্তারা ইতিমধ্যে তাদের নিজ নিজ পদে ইস্তফা দিয়ে নিরেপেক্ষ এলাকা ইন্টারকন্টিনেণ্টাল হোটেলে পালিয়ে গিয়েছিল। ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রাজধানি ঢাকার উপকণ্ঠে প্রবেশ করেছিল এবং সেখান তখন যুদ্ধ চলেছিল।

-আজ দুপুরে একটি পাক- পরিবহণ থেকে পুস্তিকা ফেলা হয় তাতে বলা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যে সব অবাঙ্গালীদের হাতে অস্ত্র দিয়েছে তারা যেন নিজ নিজ এলাকা থেকে দ্রুত সরে যায়।

-খুলনাকে সব দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। পাক সেনাবাহিনী সেখানে শেষ যুদ্ধ লড়ে চলেছে। রংপুর সেক্টরের খেতলাল, জয়পুরহাট ও খানসামা মুক্ত হয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী এদিনও খুলনা দৌলতপুর, গোকুল, খানসামা মুক্ত হয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী এদিনও খুলনা দৌলতপুর, গোকুল, খানসামা, জয়দেবপুর ও ময়নামতি ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছে। খুলনা, গোয়ালন্দঘাট, আরিচাঘাট ও সিরাজগঞ্জে শত্রুসেনারা লঞ্চে, নৌকাযোগে আক্রমণ করতে উদ্যোগী হয়েছিল। তবে তারা ব্যর্থ হয়েছে।

-কালিয়াকৈরে নয়জন পাকসেনা বন্দী হয়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশী। ইতিমধ্যে ৪১০২ জন পাকসেনা বন্দী হয় এবং ৮০৬৬ জন প্যারা মিলিটারী ধরা পড়ে। (আঃ বাঃ পঃ)

-১৪ ডিসেম্বর ছিল পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শেষ দিন। গভর্ণর মালিক, তাঁর মন্ত্রী সভা এবং পশ্চিম পাকিসানী বেসামরিক কর্মচারীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল গিয়ে ওঠেন। আন্তর্জাতিক রেডক্রস হোটেলটিকে ‘নিরপেক্ষ জোন’- এ পরিণত করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানী ভি আই পি দের মধ্যে যারা ছিলেন, তারা হলে চীফ সেক্রেটারী, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, প্রাদেশিক সেক্রেটারী এবং অন্যান্য কয়েকজন। ‘নিরপেক্ষ জোন’ এ স্থান পাবার জন্যে তারা লিখিতভাবে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক চ্যুতি ঘটালেন। কেন না, যুদ্ধমান দেশ সমূহের কোন ব্যক্তিই রেডক্রসের আশ্রয় লাভের অধিকারী হতে পারেন না। (নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, পৃঃ ২০৪)

 এ সময়ে বাংলাদেশ সরকারের বিষয় নিয়ে মইনুল হাসান লিখেছেনঃ ১২-১৩ ডিসেম্বর নিউইয়র্কের মধ্যরাত্রির আগে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে চীনের সম্মতি আদায়ের জন্য সপ্তম নৌবহরকে নিশ্চল করার পর একই উদ্দেশ্যে যখন নিরপত্তা পরিষদের বৈঠকও মূলতবী করার ব্যবস্থা চলছিল, ঠিক সে সময় কলকাতার ১৩ ডিসেম্বর সকালে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে প্রায় মাসাধিকাল যাবত অব্যাহতিপ্রাপ্ত মাহবুব আলম চাষী যুদ্ধ বিরতির বিবৃতি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এই প্রস্তাবিত বিবৃতির মূল বক্তব্য ছিলঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌছার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়, তবে তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ সরকার এককভাবেই যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করবেন। বাংলাদেশ তখন ভারতের সঙ্গে যুগ্ম কমাণ্ড ব্যবস্থায় ঘোষণা করতেন, তবে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে এককভাবে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া নীতিগতভাবে অসিদ্ধ হত। পক্ষান্তরে ভারত যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা প্রশ্নে গড়িমসি করার পর আন্তর্জাতিক ও যুক্তরাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ জনমতের কাছে বাংলাদেশের এককভাবে সামরিক হস্তক্ষেপ করা নিক্সন প্রশাসনের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ হত। (মূলধারা  ৭১ পৃঃ ২২৭-২৮)।

১৪ই ডিসেম্বর দি ওয়াশিংটন পোষ্ট- এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়। ইয়াহিয়া খান এক পর্যায়ে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আপস-আলোচনা চালাতে রাজী হয়েছিল। তবে সর্বজন স্বীকৃত ও নির্বাচিত বাঙালী নেতা শেখ মুজিব কিংবা তাঁর মনোনীত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আপষ-আলোচনা চালাতে সে রাজী হয়নি। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পূর্ববংগের বিভিন্ন দাবী সম্পর্কে একটা ঘোষণা প্রকাশের সম্ভাবনা ছিল এসব খবর ভারত সরকারের জানা ছিল না। তা সত্ত্বেও ভারত ২২শে নভেম্বর অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ শুরু করে। শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আক্রমণ শুরু করা বলে মার্কিন কর্তৃপক্ষ মনে করেন।

৭ই ডিসেম্বর পাক-ভারত পরিস্থিতি সম্পর্কে সিনেটর ব্যারী গোল্ডওয়াটারের সঙ্গে আলোচনাকালে হেনরী কিসিংজার উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ করেন। ৯ই ডিসেম্বর সিনেটর গোল্ডওয়াটার এই আলোচনার বিবরণ মার্কিন কংগ্রেসের সরকারী রিপোর্টের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করেন।

-ইয়াহিয়া খান কর্তৃক শেখ মুজিবের সঙ্গে অস্বীকার করার ফলে ভারত নিরুৎসাহিত বোধ করে। এ ব্যাপারে ভারতের মনোভাব মার্কিন কর্তৃপক্ষের জানা ছিল বলে সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়। (দি ওয়াশিংটন পোষ্ট ১৪ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১)

১৪ই ডিসেম্বর বিকেলবেলা পূর্ব বঙ্গের গভর্ণর ডাঃ এ, এন মালিক ও অর মন্ত্রী পরিষদ একযোগে পদত্যাগ করেন। একটি বল- পয়েন্ট কলম দিয়ে এক টুকরো ছেঁড়া কাগজে নিজ হাতে পদত্যাগপত্র লিখে ডাঃ মালিক তা জাতিসংঘের অফিসার জন কেলী ও দি অবজারভার-এর সংবাদদাতা গেভিন ইয়াংকে দেখান। ইয়াহিয়া খানের নিকট লিখিত পদত্যাগ পত্রখানি ঢাকায় নিয়োজিত আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির প্রতিনিধি নিকট হস্তান্তর করা হয়। পদত্যাগ পত্রটি ছিল নিম্নরূপঃ

To the President of Pakistan,

With a view to saving further bloodshed in the country, we do hereby tender our resignation from the offices of the Governor and of Council of Minister with immediate effect and we severe our connections with the Government.

                                           

Sd/-

                                                      A.M. Malek

                                                      14-12-71

                                                      Abul Quasem

                                                      14-12-71

                                                   A.S.M Sulaiman

                                                     14-12-71

                                                   Nawajesh Ahmed

                                                   14-12-71

                                                      A.Ahmed

                                                    14-12-71

  1. Yusuf

                                               14-12-71

                                                  Md. Ishaque

                                               14-12-71

                                                  Mujibur Rahman

                                             14-12-71

                                                Jaseemuddin Ahmad

 14-12-71

                                               Md. Obaidullah Majumder

                                                    14-12-71

                                              A.K.Mosharraf Husain

                                         14-12-71

                                                      Abbus Ali Khan

                                                        14-12-71

                                         (সুত্রঃ এ্যডভোকেট আমিনুল হক)

-যুদ্ধ শুরু হওয়ার ১১ দিন পর ভারতীয় সৈন্যবাহিনী উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিন দিক থেকে সর্বত্মক আক্রমণ চালিয়ে ঢাকা দখলের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, বগুড়ায় পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর বিভাগীয় কর্মকেন্দ্রের পতন হয়েছে।

-চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করবে না। মর্মে ভারত সরকারের জনৈক মুখপাত্র বলেন, We still believe China has nothing to gain by enlarging the conflict, while we are aware of certain areas, we still believe this must be part of their effort designed to express political solidarity with Pakistan. (Daily Telegraph, Dec 14)

১৪ই ডিসেম্ব ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক মুখপাত্র বলেন, পূর্ববঙ্গে উচ্চপদস্থ সরকারী অফিসারগণ পদত্যাগ করে রেডক্রস নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেন বলে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটি ভারত সরকারকে জানিয়েছে। (দি টাইমস ১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১)

ভারত সরকার ১৪ই ডিসেম্বর হতাহত ভারতীয় সৈন্যদের সংখ্যা সর্বপ্রথম প্রকাশ করে। ১৩ই ডিসেম্বর বিকেল ৩টা পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী পূর্ব ও পশ্চিমঞ্চলে মোট ১,৯৭৮জন নিহত ও ৫,০২৫ জন আহত এবং ১,৬৬৬ জন নিখোঁজ হয়।

হতাহত পাকিস্তানী সৈন্যদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে ‘অনেক বেশী’ বলে ভারতীয় সামরিক সূত্রে বলা হয়। তাঁরা আরও বলেন, পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর ৫,০২৫ জন এবং অনিয়মিত বাহিনীর ৪,০৬৬ জন সদস্যকে বন্দী করা হয়েছে। (দি টাইমস, ১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১)

দি ডেইকলী টেলিগ্রাফ-এ প্রকাশিত এক পত্রে বাংলাদেশ আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব নেই, এই সত্য ইয়াহিয়া খানকে মেনে নিতে হবে। গণতান্ত্রীক পদ্ধতিতে নির্বাচিত বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া তার পক্ষে অবশ্য-কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন। (দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১)

Reference:

একাত্তরের দশ মাসরবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী