You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.01.05 | পট পরিবর্তনের দিকে পাকিস্তান | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পট পরিবর্তনের দিকে পাকিস্তান

নির্বাচনের পর ঢাকা নগরীতে আওয়ামী লীগের প্রথম গণ-সমাবেশে শ্রী মুজিবর রহমান যে ভাষণ দিয়েছেন তার প্রভাব বস্তুত সারা ভারত-উপমহাদেশে পড়বে। পাকিস্তানের সংবিধান রচনায় শ্রী মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। তাছাড়া পূর্ববাংলার বিধানসভাতেও আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিদ্যমান। সংবিধান রচনা এবং তার সক্রিয় পরিচালনা অবধি যে-দলের এমন শক্তি, তাঁদের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে পাকিস্তানের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের ঔৎসুক্য সবচেয়ে বেশি। ভারত-পাক সম্পর্কের উপর দু’দেশের নিজ নিজ রাজনীতি, সমাজনীতি এবং বৈষয়িক নীতি সবই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। তাসখন্দ ঘােষণা অকার্যকরী হয়ে থাকায় দু’দেশেরই যার পর নাই ক্ষতি হচ্ছে। শ্রী মুজিবুর রহমান সােজা সেই প্রশ্নকেই তুলে ধরেছেন এবং স্পষ্টাক্ষরেই বলেছেন যে সকল দেশের সঙ্গে, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে পাকিস্তান বন্ধুত্ব চাইবে এবং “কাশ্মীর ও ফারাক্কার বিরােধকে ন্যায় ও শান্তির ভিত্তিতে মীমাংসা করতে হবে।”
পাকিস্তানের আভ্যন্তরিন বিষয়ে শ্রী মুজিবর রহমান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সেতু-বন্ধনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, বাইশ বছর ধরে পূর্বকে পশ্চিম যেভাবে উপনিবেশ করতে চেয়েছে, নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ৬-দফা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি সংবিধানে রূপ নেবে; কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক সংবিধান পশ্চিম পাকিস্তানের গরীবদের ভাগ্যের উন্নতি বিধানের জন্য”-ও রচিত হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সহযােগিতাও সেই সংবিধান রচনায় কামনা করা হবে।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ঐক্যবােধ ভারতের পক্ষেও বাঞ্ছনীয়। নতুবা পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক ও কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলাে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা দ্বারাই নিজেদের দু’অঞ্চলের বিরােধকে কোনরকমে জোড়াতালি দেবার চেষ্টা চালায়। ভারতের প্রতিক্রিয়ার শক্তিও সেই ‘ঘােলা জলে মৎস্য শিকারের নামে। যেমন ভারতের প্রতিক্রিয়ার স্তম্ভ জনসংঘ নেতা শ্রী বাজপেয়ী পাকিস্তান নির্বাচনের ফলাফলের পর বগল বাজিয়ে বলতে শুরু করেছেন যে, এবার নাকি পাকিস্তানকে আর এক রাষ্ট্ররূপে বিবেচনা না করে দু-রাষ্ট্ররূপে দেখাই হল কর্তব্য।
বৈষয়িক ক্ষেত্রে শ্রী মুজিবুর রহমান পাটের ব্যবসা, ব্যাঙ্ক, বীমা প্রভৃতি রাষ্ট্রীয়করণের কথা বলেছেন। ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দাবির সঙ্গে এ কার্যসূচীর অভিন্নতা লক্ষ্যণীয়। সদ্য স্বাধীন প্রত্যেকটি দেশের জাতীয়করণের কার্যক্রম অন্য দেশের স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক অর্থনীতির জন্য আন্দোলনকে সহায়তা করে। পাকিস্তানে পাটের ব্যবসার জাতীয়করণ ভারতের কৃষক, শ্রমিক এবং গণতান্ত্রিক মানুষকে এ দেশেও পাটের ব্যবস্থা ও চটকলগুলিকে জাতীয়করণের দাবি আদায়ে যে খুবই সাহায্য করবে সে কথা বলাই বাহুল্য।
সর্বোপরি শ্রী মুজিবর রহমান রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি এবং রাজনৈতিক মামলাগুলি প্রত্যাহারের যেদাবি জানিয়েছেন, বিশ্বের সকল দেশের গণতন্ত্রীরাই তাতে সােচ্চার সমর্থন দেবেন। সামরিক শাসনকালের রাজনৈতিক বন্দীদের বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়া ছাড়া কোন গণতন্ত্র ভিত গড়তে পারে না। এই সব রাজনৈতিক বন্দীদের মধ্যে কমিউনিষ্টরাও আছেন এবং কায়েমী স্বার্থের ষড়যন্ত্র ভেদ করে পাকিস্তানের যে-গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা ও স্থাপন করতে হবে তাতে শ্রী মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগের ও সেই বামপন্থীদের এবং কমিউনিস্টদের সাহায্য খুবই প্রয়ােজন। পার্লামেন্টের ভিতরের সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে পার্লামেন্টের বাইরেও প্রতিক্রিয়া ও কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড সগ্রাম ছাড়া ওদের যে জাঁতাকলে ধরা যায় না সে কথা বিস্তর অভিজ্ঞতায় এখন সকল মানুষেরই জ্ঞাত।
পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক পট-পরিবর্তনের দিকে ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলাে অনেক আশা এবং বিশেষ ভরসা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। পাকিস্তানে যে গণশক্তি অগ্রগতির মশাল জ্বালিয়েছে, সেই শক্তি ভারতউপমাহাদেশেও একটি ভরসার প্রদীপ।

সূত্র: কালান্তর, ৫.১.১৯৭১